#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_25
গুমট বেঁধেছে আবহাওয়া। প্রকৃতি যেন নিজের উচ্ছ্বাসিত রূপ ছেড়ে বিষন্নতা বয়ে এনেছে । পরিবেশ বারংবার আভাস দিচ্ছে কোনো অনাগত ঝড়ের। যা খুব নিকটেই অবস্থান করছে। থমথমে শিকদার বাড়িতে গুনগুনিয়ে কারোর কান্নার শব্দ ছাড়াও ভেসে আসছে কাকের কর্কশ কন্ঠের ডাক। গম্ভীর মুখে চেয়ারে বসে আছে লামিয়া। সোফিয়া শিকদার বারান্দায় বসে কেঁদেই চলেছে, তার সঙ্গ দিচ্ছে লামিয়ার মা। রোজিনা বেগম তো ইতিমধ্যে কান্নাকাটি করে জ্ঞান হারিয়েছেন। লামিয়া কিছুক্ষণ পর পর নিজের খালামণির দিকে তাকাচ্ছে আর বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে নিচ্ছে। অসহ্য লাগছে তার। ঐ মেয়ের জন্য মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে সবাই। সে কিছুক্ষণ পরপর ছোট আয়নায় দেখে ঠিক করে নিচ্ছে নিজের চুলগুলো।
চুলগুলোতে চিরুনি চালাতে চালাতে সে ভাবতে থাকে কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা। সে ঘুমিয়ে ছিল হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ছুটে বাইরে আসে। এসে দেখতে পায় দু’জন পুরুষ রূপকথাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রূপকথার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, সে অসাড়। তাদের একজনের হাতের বিশাল লাঠিটা দেখে মনে হলো এটা দিয়েই আঘাত করা হয়ছে। রোজিনা বেগম ও সোফিয়া শিকদার তাদের আটকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে না। বাড়ির কোনো ছেলে সে সময় বাড়িতে ছিল না। যার দরুন খুব সহজেই তারা মেয়েটাকে নিয়ে যেতে পেরেছে। এমনকি যাওয়ার পূর্বে সদর দড়জাটাও বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই বাজার থেকে ফিরে আসে আকরাম মিঞা ও পলাশ। সদর দরজা খুলে ভেতরে আসতেই রোজিনা বেগম খুলে বলে সবকিছু। তারা সবটা শুনে ছুটে কোথায় যে গেল তা সে জানে না। দু’জনের মুখের রং-ই যেন উড়ে গিয়েছিল সব শুনে। পলাশ তো রাগে গজগজ করতে করতে গেছে। আর তখন থেকে তার খালামণি কান্না জুড়েছে। বৌমার জন্য ভালোবাসা একদম উতলে পড়ছে। এতে অবশ্য সে খুশিই হয়েছে। আপদটা বিদায় হয়েছে শেষ পর্যন্ত।
তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে আরজান। বারান্দায় বসে মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ছুটে যায় তার কাছে। মায়ের কাছে বসে উত্তেজিত স্বরে শুধায়, “কাঁদছো কেন মা? কী হয়েছে আমাকে বলো?”
উত্তর দেয় না সোফিয়া শিকদার। ছেলেকে পেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে তার কান্নার বেগ। আরজানকে আঁকড়ে ধরে আরো জোরে কেঁদে ওঠে সে। বড্ড বেশিই ভরকে যায় আরজান। ব্যস্ত হয়ে আশেপাশে নজর বুলিয়ে বলে ওঠে, “রূপ, রূপ কোথায় মা? ওকে কোথাও দেখছি না কেন?”
“বৌমাকে নিয়ে গেছে ওরা।” ধরা গলায় বলে ওঠে সোফিয়া শিকদার।
ছিটকে সরে যায় আরজান। পুনরায় শুধায়, “নিয়ে গেছে মানে? কারা নিয়ে গেছে? পলাশ? পলাশ ওকে বাড়ি নিয়ে গেছে?”
দু’দিকে মাথা নাড়ায় সোফিয়া শিকদার। বলে ওঠে, “অচেনা দুটো লোক ধরে নিয়ে গেছে। পলাশ আর চেয়ারম্যান ওকে খুঁজতে গেছে।”
“কিন্তু কারা নিয়ে গেছে মা? রূপকে কেউ কেন নিয়ে যাবে? ওদের শত্রুতা থাকলে সেটা আমার সাথে। তবে রূপ কেন?” কথা আটকে আসছে আরজানের। বুকের মাঝে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। দম বুঝি আটকে আসবে তার।
“ওরা বলাবলি করছিল রূপ নাকি জলপরি। ওকে দিয়ে অনেক টাকা আয় করবে তারা। আমি কতো করে বললাম, তোমাদের ভুল হচ্ছে জলপরি বলতে আদতে কিছু হয় না। আমার বৌমা সাধারণ মানুষ কিন্তু কিছুতেই শুনলো না ওরা।”
জলপরি! তারা জলপরি বলেছে! এবার যেন বিনা মেঘেই বজ্রপাত হয় আরজানের মাথায়। কাউকে হারিয়ে ফেলার আতঙ্কে অসাড় হয়ে আসে তার দেহ। বিন্দুমাত্র শক্তি পাচ্ছে না সে উঠে দাঁড়ানোর। ওরা কীভাবে জানলো এই নির্মম সত্য? ওদের তো জানার কথা নয়! রূপকে দিয়ে টাকা আয় করবে! ভাবতেই যেন মাথায় আগুন ধরে যায় তার। জানো’য়ারগুলোর ম’রার সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ম’রনের ডাল-পালা গজিয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
সে কাঠের খুঁটিটা ধরে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। শক্ত দৃষ্টিতে তাকায় লামিয়ার দিকে। চোখগুলো তার লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। হটাৎ এমন দৃষ্টি দেখে হকচকিয়ে ওঠে লামিয়া। সে ভেবেছিলো আরজান হয়তো তাকে বকাঝকা করবে, রেগে কথা শোনাবে কিন্তু নাহ, তাকে কিছুই বলে না আরজান। উল্টো মায়ের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে, “তুমি চিন্তা করো না মা। আমি রূপকে ফিরিয়ে আনব। রূপের কিচ্ছু হবে না।”
“কিন্তু তুই কীভাবে,,,,,,,,,” কথা আর সম্পূর্ণ করা হয় না সোফিয়া শিকদারের। তার পূর্বেই হনহন করে বেরিয়ে গেছে আরজান। পেছন পেছন দৌড়ে সদর দরজা পর্যন্ত গিয়েও আর তাকে আটকাতে পারে না সোফিয়া শিকদার। রাস্তায় কোথাও আরজান নজরে আসছে না। ছেলে যেন তার ধূলিকণার ন্যায় মুহুর্তেই উবে গেছে।
টিনের তৈরি ছোট্ট ঘরটার ভেতর লন্ঠন জ্বলছে টিমটিমিয়ে। ক’টা বাজে তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। তবে টিনের নিচের অল্প ফাঁকা দিয়ে মৃদু আলো আসছে ঘরের ভেতর। হয়তো সন্ধ্যা নেমেছে আবার হয়তোবা নামেনি। স্যাঁতসেঁতে মাঠির মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রূপকথা। অসাড় তার দেহখানা। তবে উঠে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়াস নেই তার মাঝে। সজাগ হয়েছে সে কিছুক্ষণ পূর্বেই তবে উঠে দাঁড়ানোর বিন্দুমাত্র শক্তি তার মাঝে অবশিষ্ট নেই। চোখদুটো বন্ধ করে মরার মতো পড়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই তার। শক্ত লাঠির অবিরত আঘাতের ফলে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি সে খুইয়েছে পূর্বেই। বেশ কিছুদিন যাবত পানি থেকে দূরে থাকার কারনে সে এমনিতেই প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পড়েছিল। তার ওপর এমন শক্ত আঘাত সে সহ্য করতে পারেনি।
কিছুক্ষণ যাবত কারোর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সে। না, কোথাও কেউ নেই। সকলে একসাথে গেল কোথায়?
ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করে। তবে বারংবারই ব্যর্থ হতে হয় তাকে। দুর্বল শরীরটা যে তার সাথ দিচ্ছে না। বড় বেইমানি করছে এই বিপদের সময়। এখন তার পানি প্রয়োজন, শুধুই পানি। পানি ছাড়া এভাবে আহত অবস্থায় বেশিক্ষণ টিঁকে থাকা তার জন্য বড়ই দুষ্কর!
অথৈ পানির অভাবেই এবার বোধহয় প্রাণ যাবে তার। পানিহীনতাই মৎসকন্যার মৃত্যু! বড় আশ্চর্যজনক ঘটনা হবে নিশ্চয়ই!
চোখদুটো পুনরায় বন্ধ করে নেয় সে। আনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে, “মরনের আগে তোমায় একবার দেখার বড় সাধ জাগছে ম্যাজিশিয়ান।”
তখনই হটাৎ টিন ও কাঠের স্বমন্বয়ে তৈরি দরজাটা মরমর শব্দে খুলে যায়। শ্রবণগোচর হয় কারোর চুপিসারে কথা বলার আওয়াজ। কেউ যেন খুব সাবধানী হয়ে ফিসফিসিয়ে বলছে, “স্যার আহোনের আগেই কাম সারতে হইব।”
“কিন্তু এইডা তো এহনো মুখ থোবড়াইয়া পইড়া আছে।” অপরজন বিরক্ত কন্ঠে বললো।
“কাম শুরু কর, আপনে আপ উইঠা পড়ব।” বিদঘুটে হেসে বললো প্রথম ব্যক্তিটি।
“হ, তুই যাইয়া জামাডা খোল। আর সামলাইতে পারতাছি না আমি।”
অতঃপর সব থমথমে। শুধু দু’জোড়া পায়ের শব্দই আসছে যা ক্রমশ তার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। লোভাতুর দৃষ্টিগুলো হয়তো তাকেই পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। চোখদুটো খিচে বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে এ সবকিছুই শুনে যায় রূপকথা। জামা খুলে কী করবে এরা? তার সাথে কী ঘটতে চলেছে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞত সে।তবুও কেমন আতঙ্কে বুকটা ঢিপঢিপ করছে। ভয়ে কুঁকড়ে আসছে তার মুখখানা।
তার ভয়কে আরো বাড়িয়ে দিয়ে কেউ তার হাত টেনে সোজা করে শুইয়ে দেয়। জামাতে হাত দিয়ে লোভাতুর স্বরে বলে ওঠে, “গতরডা দেখছোস? জিহ্বায় পানি চইলা আইছে এক্কারে।”
অন্যজন তাড়া দিয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি কর, স্যার আইয়া পড়ব।”
“স্যার বাজারে গেছে। আইতে দেরি হইব।”
“বিশ্বাস নাই, ঝরের বেগে চইলা আইব।”
চোখ বন্ধ রেখেই রক্তাক্ত হাতে নিজের পোশাক আঁকড়ে ধরে রূপকথা। কী করবে এরা?
লোকটা তার জামা ধরে হাত টান দেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে কেউ সুস্পষ্ট ভাষায় চিল্লিয়ে বলে ওঠে, “ওখানেই থেমে যা। আর এক বিন্দু বাড়লে এখানেই তোদের মেরে দেব।”
আচমকা এমন ভারি আওয়াজে ভরকে যায় তারা, খানিক চমকে ওঠে রূপকথাও। লোকদুটো ছিটকে সরে যায় তার থেকে। দূরে দাঁড়িয়ে কাউকে উদ্দেশ্য করে কাঁপা কাঁপা স্বরে একজন বলে ওঠে, “স্যার, আপনে?”
“কেন? আমার আসা উচিত হয়নি বুঝি? ভুল সময়ে এসে পড়েছি?” অগ্রসর হতে হতে বলে লোকটা।
“আপনে তো বাজারে,,,,,,,,,,,,,,,,।”
কথা সম্পূর্ণ হয় না তার। পূর্বেই শব্দ করে ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে ছিটকে পড়ে কেউ। পরপর দু’বার একই রকম শব্দ হয় সেই সাথে কারো ব্যথা মিশ্রিত চিৎকার। পুনরায় সেই স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা লোকটা রাগান্বিত বলে ওঠে, “তোদের সাবধান করেছিলাম আমি। ওর কাছে যেতে নিষেধ করেছিলাম, মরার বড্ড শখ জেগেছে? সাহস বোধহয় খুব বেশি বেড়ে গেছে?”
“মাফ কইরা দেন স্যার। আর এমুন করমু না। এইবারের মতো ছাইড়া দেন।”
অন্যজন ভীত স্বরে বলে ওঠে, “ভুল হইয়া গেছে স্যার, আর হইব না।”
তাদের কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না পুরুষটা। উল্টো রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “সুযোগ আমি একবারই দেই। তোদেরও দিয়েছিলাম কিন্তু তোরা হেলায় নষ্ট করেছিস সেই সুযোগ। এখন আর সময় নেই।”
“ছাইড়া দেন স্যার। আমাগো মাইরেন না। আপনের লিগা কতো কাম করছি আমরা। আইজ একটা ভুলের লিগা আমাগো মাইরা ফালাইবেন? ভেসে আসে কারোর আকুতি ভরা কন্ঠস্বর।
“মায়া-মোহব্বত কম আমার। জানিস তো তোরা? তাহলে আমার কথার বিরুদ্ধে যাস কীভাবে? তোদের সাহস বেড়ে গেছে। এখনি লাগাম টানা প্রয়োজন। এমনিতেও আমার জন্য বহু খুন খারাবি করেছিস তোরা এখন বিশ্রাম প্রয়োজন তোদের।”
“না স্যার, না।”
অতঃপর পরপর দু’বার গগণবিদারি চিৎকার। ঠিক তার পর মুহুর্তেই গভীর নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় চারপাশ। কারোর কোনো শব্দ না পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে রূপকথা। তার ঠিক সম্মুখে একজন অতি সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। দূরে পড়ে আছে দুটো মানুষ। ঠিক মানুষ নয় তাদের লাশ বললেই চলে। কারন লোকদুটোর গলা চিরে রক্ত পড়ছে অনবরত। তাদের নিঃশ্বাস ও চলছে না বোধহয়। তবে কি এদেরকে মেরে ফেলেছে লোকটা? ভীত দৃষ্টিতে পুনরায় পুরুষটার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সে গাঢ় দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। তার হাতে থাকা ছুড়িটা রক্তে রঞ্জিত। কুঁকড়ে যায় রূপকথা। এখন কি তাকেও মেরে ফেলবে লোকটা?
তাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা এগিয়ে আসে তার দিকে। তার সম্মুখে এক হাঁটু গেড়ে বসে বলে ওঠে, “সুদর্শন একটা পুরুষের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছো মেয়ে? সকলে তো ভালোবাসার চোখে তাকায়।”
হঠাৎ এমন কথাতে অবাক হয় রূপকথা। সে ভাবতেও পারেনি লোকটা এভাবে কথা বলবে। লোকটা পকেটে হাত পুরে কিছু ওষুধ বের করে এগিয়ে দেয় তার দিকে। পানির পাত্রে পানি ঢালতে ঢালতে বলে, “এগুলো খেয়ে নাও। এভাবে থাকলে মরে যাবে।”
উত্তর দেয় না রূপকথা। সে এখনো আগের মতোই হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। লোকটা মৃদু ধমকে উঠে বলে, “মরে যাবে মেয়ে, খেয়ে নাও দ্রুত।”
“এসবে আমার কিছু হবে না। আমার এখন পানি প্রয়োজন।”
“জলপরি? তুমি সত্যিই জলপরি।” মৃদু হেসে বলে লোকটা।
পিছিয়ে যেতে চায় রূপকথা। লোকটা এভাবে কথা বলছে কেন? এমন সুন্দর লোকটা কী অবলীলায় দুটো খুন করে দিলো। আবার তার সাথে কী স্বাভাবিক ব্যবহার করছে যেন আপন কোনো মানুষ। তার কোনো আচরণই বোধগম্য হচ্ছে না রূপকথার। তাকে মারতে চাইলে তো এতোক্ষন মেরে ফেলতে পারতো। বাঁচিয়ে রেখেছে কেন? কী তাদের উদ্দেশ্য? তার গোপন সত্য সম্পর্কে এরা জানলো কীভাবে? তাকে ধরে এনে এভাবে ফেলেই বা রেখেছে কেন?
তাকে পেছাতে দেখে বোধহয় রেগে গেল লোকটা। হুট করে তার হাত চেপে ধরে বলে ওঠে, “পেছাচ্ছো কেন মেয়ে? সুদর্শন পুরুষ দেখে জলপরিরা পালিয়ে যায় বুঝি? নাকি আমাকে দেখতে ভালো লাগছে না তোমার? আমার সঙ্গ পছন্দ হচ্ছে না?”
হাত টেনে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে রূপকথা। তবে শক্তিবলে বড্ড পিছিয়ে সে। তার দুর্বল শরীর মানছে না তার কথা। সে খানিক রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “আপনার চেয়ে অধিক সুদর্শন পুরুষ আছে আমার। যে শুধুই আমার, আমার একান্ত। তাই অন্যদের সৌন্দর্য চোখে বাঁধে না খুব একটা। আমার হাত ছাড়ুন।”
মাঠের ধার দিয়ে উন্মাদের ন্যায় ছুটে চলেছে আরজান। তার পুরো বিশ্বাস রূপকথাকে তারা ঐ ঘরেই আটকে রেখেছে যেখানে তাকে রেখেছিল। ওটাই তো তাদের আড্ডাখানা। তার রূপ কি ঠিক আছে? ভালো আছে তো? ওরা কি আঘাত করেছে তাকে?
সে আনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে, “তোমার কিছু হবে না রূপ। এতো দ্রুত তোমায় বিলীন হতে দেব না আমি।”
তখনই তার নজর কাড়ে মাঠের মাঝখানের সেই ঘরটা। ঘরটাতে আলো জ্বলছে তারমানে ওখানেই আছে ওরা।
ঘরটার কাছাকাছি আসতেই দরজা খোলা পেয়ে ছুটে ভেতরে যায় সে। দরজার পাশে পড়ে থাকা ছুড়িটা ব্যতীত আর কিছুই নেই ঘরটাতে। কোথায় তার রূপ? ঘর যে একেবারে শূন্য। এক কোনায় শুধু পড়ে আছে দুটো লাশ। যাদের নিশ্বাস বোধহয় থেমেছে আরো পূর্বেই।
কিয়ৎ দূরে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়ে আছে কারোর রক্ত। রক্তের মাঝে পড়ে জ্বলজ্বল করছে একটা রিং। দ্রুত সে হাতে তুলে নেয় সেটা। রিং-টা তার খুব পরিচিত। এইটা রূপের রিং যেটা সে বিয়ের পর এনে দিয়েছিল। তাহলে রূপ এখানেই ছিল কিন্তু এখন নেই কেন? দৌড়ে বেরিয়ে আসে সে। ঘরটার আশেপাশে সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজেও কারোর চিহ্ন পর্যন্ত পায় না। চারদিকে হন্যে হয়ে দৌড়াদৌড়ি করে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। না, তার রূপ কোথাও নেই। মাঠের এদিক থেকে ওদিক ছুটে বেড়ায় সে। একটাই আশা, হয়তো কোথাও মিলবে রূপের দেখা। তার সমস্ত প্রয়াস যেন মাঠে মারা যায়। রূপ তো দূর কোনো মানুষের অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই মাঠে। পাগল পাগল লাগছে তার। অজান্তেই চোখদুটো ভিজে এসেছে তার। তবে কি সে হারিয়ে ফেলবে তার জলরূপসীকে?
চলবে,,,,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_26
আকাশের বুকে ঠাঁই পেয়েছে এক টুকরো শুভ্রতা। জ্যোৎস্নার শুভ্র আলোয় আলোকিত হয়েছে অলোকপুর গ্রাম। বেহিসেবি চন্দ্র-শোভা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের চতুর্দিকে। মাঠের ফসলগুলো মাথা উঠিয়ে পান করছে সেই চন্দ্র-শোভা। কিছুক্ষণ পরপর মৃদু ঠান্ডা বাতাস এসে দুলিয়ে দিচ্ছে সমস্ত ফসলাদি। সাদাবিলের পাড় বেয়ে লাগানো খেজুরের গাছগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে কারোর কান্নাভেজা স্বীকারোক্তি। খেজুরের পাতাগুলো হালকা দুলে দুলে হয়তো তাকেই শান্তনা দিয়ে চলেছে। সাদাবিলের পানির মাঝে ফুটে উঠেছে চন্দ্রের প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতির এমন অপার সৌন্দর্যও যেন পুরণ করতে অক্ষম কারোর প্রিয় মানুষের শূন্যতা। বিলের পাড়ে পানিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আরজান। বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে তার সুন্দর মুখখানা। বিষাদের সুতো বুনছে তার হৃদয়মহল। না, এখানেও নেই তার রূপ। তাকে ফিরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা ধীরে ধীরে তীব্রতর হচ্ছে আরজানের। কেন নিয়তি এই নিঠুর খেলায় মেতেছে?
সে বড্ড আশা করেছিল তার রূপকে সাদাবিলে পাবে হয়তো কিন্তু নাহ, এখানে এসেও নিরাশ হতে হয় তাকে। নেই তার রূপ। বিলের পানিটুকু খুবই স্বাভাবিক। সেও হয়তো হাহাকার করছে তারই মতো এই জলরূপসীর অভাবে। যে খলবলিয়ে সাঁতরে বেড়াত এই বিলের এপার থেকে ওপার অব্দি। এই বিল কি উপলব্ধি করতে পারছে তার শূন্যতা?
আচমকা কিছু মনে পড়তেই সে ছুটে যায় সেই ঘরের দিকে। কিছুক্ষণ পূর্বেই যেটা সে ফেলে রেখে এসেছে। যেখানে অবস্থান করছে দুটো প্রাণহীন মানুষ। দৌড়ে এসে থেমে দুয়ারের সম্মুখে। আগের বার বিরহে ভুলে বসেছিল নিজের বোধবুদ্ধি। তবে এখানেই যে রয়ে গেছে রূপকে ফিরে পাওয়ার শেষ সুত্র। কয়েকবার জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় আরজান। কোনো রকম সূত্র ছাড়লে চলবে। সে নিজের মোবাইল বের করে আলো জ্বালিয়ে নেয় তাতে। অতঃপর দরজার সামনে থেকে সেই আলোর সাহায্য তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে প্রতিটা ধূলিকণা। হঠাৎ তার নজরে আসে কারোর রক্তমাখা জুতোর ছাপ। রক্তের পরিমাণ সেখানে খুবই সামান্য হলেও খুবই সাবধানে তাকালে সেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জুতোর ছাপটা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে এই ঘরের পেছনে অবস্থিত সেচকলটার দিকে। জুতোর ছাপের সঙ্গে রক্তের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসলেও তার ঠাক পাশেই ফোটে ফোটে পড়া রক্তের পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রক্তটুকু শুকিয়ে যায়নি তবে জমাট বেঁধেছে ইতিমধ্যে। খানিক ঝুঁকে পড়ে সেই রক্তে আঙ্গুল ছোঁয়ায় আরজান। তার আঙ্গুলে লেগে থাকা লাল পদার্থ জানান দিচ্ছে এ রক্ত এখনো তাজা। শুকিয়ে যাওয়া শুরু করেনি এখনো। রক্তের ফোঁটাগুলো সদ্য গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। হুট করে চোখ-মুখ শুকিয়ে আসে তার। এ রক্ত রূপের নয়তো?
ধীরে ধীরে সেই ছাপ সেচকল বরাবর এসে থেমে যায়। না, আর কোনো ছাপ নেই আর না তো আশেপাশে কারোর অস্তিত্ব আছে। তবে সেচকলের ঠিক সামনে মাটি খুঁড়ে বানানো খুবই ছোট আকৃতির একটা জলাশয়টাতে পানি দিয়ে ভরপুর। সেচকল দিয়েই হয়তো পানি দেওয়া হয়েছে এখানে। পানির পরিমাণ এতোটাই স্বল্প যে পানির উপর কারোর আঁশটেযুক্ত লেজ খানিক ভেসে উঠেছে। মরুর বুকে পানির সঞ্চার হওয়ার মতোই খুশি হয় আরজান। উত্তেজিত হয়ে ডেকে ওঠে, “রূপ।”
তৎক্ষণাৎ পানির ভেতর থেকে মাথা উঠিয়ে আনে রূপকথা। আরজানের দিকে তাকাতেই যেন ব্যথার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তার। এতোটুকু সময়ে এ কী হাল হয়েছে লোকটার? উষ্ক-শুষ্ক চুল, শরীরে কাদামাটির ছড়াছড়ি, ভেজা দুটো চোখ, পড়নের শার্টটাও ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেগে আছে। এ অবস্থা কেন তার ম্যাজিশিয়ানের?
এই স্বল্প পানি তার দুর্বলতা খানিক কাটাতে পারলেও, পারেনি তাকে পূর্বের ন্যায় সতেজ করে তুলতে। তার প্রয়োজন অথৈ পানি। আরজানকে দেখে দ্রুত উপরে উঠতে চাইলেও ব্যর্থ হয় সে। সেই পুরুষটা তাকে এখানে এনেছে। এই শুকনো জায়গাটুকু ভরিয়ে তুলেছে পানি দ্বারা। হঠাৎ মোবাইলে কথা বলতে বলতে কোথায় গেছে তার জানা নেই। তার অনুপস্থিতিতে বারংবার উঠতে চেয়েও শক্তি জোগাতে পারেনি সে। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে এই পানির মাঝে একটু শান্তির আশায়।
সে কিছু বলার পূর্বেই প্যান্ট গুটিয়ে তার কাছে নেমে আসে আরজান। আলগোছে তাকে কোলে তুলে নিয়ে উঠে আসে উপরে। মুহুর্তেই সে জলরূপসীর রূপ বদলে এক সাধারণ নারীতে রূপান্তরিত হয়। দূর্বল হাতে আরজানের গলা জড়িয়ে ধরে শুধায়, “এ কী অবস্থা হয়েছে তোমার? সুদর্শন মুখটাকে এমন হাঙ্গরের মতো বানিয়ে রেখেছো কেন?”
আরজান দ্রুত স্বরে শুধায়, “কী বললে তুমি?”
“তোমাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে। হাসো তো একটু।” ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে আরজানের ঠোঁট টেনে ধরে সে।
টেনেটুনে মুখ সরিয়ে নেয় আরজান। বিরক্ত স্বরে বলে ওঠে, “আহ রূপ! কী করছো এসব?”
আমলে নেয় না রূপকথা। উল্টো বলে ওঠে, “তুমি জানো, ঐ লোকটা খুব খারাপ। ওনার দু’জন সহচরীকে মেরে ফেলেছে আমার সামনেই।”
ভ্রু কুচকে তাকায় আরজান, “তুমি তাকে দেখেছো?”
“হুম, সেই তো আমাকে এখানে এনেছে।”
অবাক হয় আরজান। তারমানে এরা রূপকে মারতে চায়নি, বাঁচিয়ে রেখে নিজেদের সার্থ সিদ্ধি করার উদ্দেশ্য ছিল। রূপকথার দিকে চেয়ে শুধায়, “তুমি তাকে দেখেছো? চিনতে পেরেছো? পরিচিত কেউ?”
“উঁহু, অপরিচিত কিন্তু সুদর্শন ছিল পুরুষটা আর কথাবার্তা এই গ্রামের মানুষদের মতো নয়।”
“কী বললে? সুদর্শন? তুমি এসবই দেখেছো বসে বসে?” ধমকে ওঠে আরজান।
হঠাৎ এভাবে ধমকে ওঠাতে খানিক চমকে যায় রূপকথা। কী হলো? এমন রেগে যাওয়ার মতো কী বললো সে? সে কথা ঘোরাতে বলে ওঠে, “আমার সবুজ পোশাকের রহস্য শুনবে তুমি? ওটা পড়লে বয়স কমে যায়। আমি এখানে একা থাকবো দেখে ওটা দাদিমা দিয়েছিল।”
অবাক হয় আরজান। শুধায়, “তোমার দাদিমা আছে?”
“উঁহু, উনি সবচেয়ে বৃদ্ধ জলপরি আর অনেক কিছু জানেন। আমরা সকলে উনাকে দাদিমা বলেই ডাকতাম। আমার জাতিগোষ্ঠী সকলে বিশাল সমুদ্রেই থাকে কিন্তু আমার শরীরের বর্ণের কারনে সেখানে ঠাঁই হয়নি আমার। একা একা পড়ে থাকতে হয়েছে এই গ্রামে। জানো, আগে খুব কষ্ট পেতাম। একা একা থাকতে একটুও ভালো লাগতো না আমার কিন্তু এখন আমার অনেক ভালো লাগে। একদমই মনে পড়ে না সমুদ্রের কথা।”
“তার কারন?” ভ্রু কুচকায় আরজান।
কথা থেমে যায় রূপকথার। কারন জানলে নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবে ম্যাজিশিয়ান। আরজানের দিকে চেয়ে নিজ মনে বলে ওঠে, “আমার সমস্ত ভালোলাগা যে তোমাকে ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে ম্যাজিশিয়ান।”
আকস্মাৎ পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে, “স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা তো জমে উঠেছে। একেই বলে এক ঢিলে দুই পাখি। ধরে আনলাম জলপরি আর সাথে ফ্রি পেলাম ম্যাজিশিয়ানকে। মানে হচ্ছে একটার সাথে একটা ফ্রি। তা তোমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি তো? চলো চলো, ভেতরে গিয়ে বসি সবাই।”
কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই পেছন থেকে চার/পাঁচ জন লোক এসে ধরে ফেলে তাদেরকে। জোর জবরদস্তির মাধ্যমে তাদের নিয়ে যেতে চায় সেই ঘরটার মধ্যে। আরজান দ্রুত রূপকথাকে নামিয়ে দিয়ে ছিটকে ফেলে দেয় তাদের। রাগান্বিত হয়ে সেই পুরুষটার গলা চেপে ধরতেই ওদের মধ্যে দু’জন গিয়ে ছুড়ি ধরে বসে রূপকথার গলায়। চিল্লিয়ে বলে ওঠে, “স্যারের কিছু হইলে কিন্তু মাইরা ফালামু এইডারে। ছাইড়া দে কইতাছি।”
দূর্বল রূপকথা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আরজানের দিকে। অমনি পুরুষটাকে ছেড়ে দেয় আরজান। সরে আসে তার থেকে। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে বাঁকা হাসে পুরুষটা। সে বুঝে গেছে আরজানের দূর্বলতা। তাদের ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দু’জনকে আলাদাভাবে বেঁধে ফেলা হয় দুটো চেয়ারে। ঘরের এককোনে আরজান অন্য কোনে রূপকথা। দরজার কাছেই পড়ে আছে সেই লাশদুটো। লোকগুলো সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পরে হাতে অস্ত্র নিয়ে। পুরুষটা একবার ঘুরে-ফিরে দেখে নেয় সবকিছু। অতঃপর আরজানের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে বলে, “পরিচিত হওয়া যাক। আমি আকাশ আর তোমার নাম তো জানা আছেই। বহুত জ্বালিয়েছো তুমি। আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছো, পুলিশকে পিটিয়েছো, থানায় অভিযোগ দায়ের করেছো আর কিছু কি বাকি আছে?”
“তোকে প্রাণে মারা এখনো বাকি।” রাগে হিসহিসিয়ে
হয়ে বলে আরজান। তবে চেয়ার ছেড়ে উঠার বা বাঁধন খোলার প্রচেষ্টা নেই তার মাঝে। সে তো চেয়ে আছে ঘরের কোনায় বেঁধে রাখা জলরূপসীর দিকে। যে কি-না ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ছে দুর্বলতার কারনে। ব্যথায়, যন্ত্রণায় চোখ-মুখের অবস্থায় বদলে গেছে তার। সুন্দর মুখখানা ভরে উঠেছে বিষাদে।
আকাশ আরো কিছু বলার পূর্বেই আরজান বলে, “তোদের শত্রুতা আমার সাথে তাহলে আমাকে মার কিন্তু রূপকে ছেড়ে দে। ও এসব ঝামেলার কিছুই জানে না, বোঝেও না। এভাবে থাকলে ও মরে যাবে।”
“কিন্তু ওকে যে আমাদের প্রয়োজন। জলপরির দাম কতো জানো? ওকে বেচলে টাকার পুরো একটা পাহাড় পাবো তারপর এসব খুনখারাবি, ডাকাতি সব ছেড়ে দেবো কথা দিলাম।”
এই কথাটাই যেন যথেষ্ট ছিল আরজানকে পুনরায় চেতিয়ে তুলতে। সে রাগে গর্জে উঠে বলে, “সেই সুযোগ তোর এই জীবনে আসবে না।”
বিচলিত হয় না আকাশ উল্টো মুচকি হেসে বলে, “খুন করার মজা একবার হাতে লেগে গেলে আর ছাড়া কষ্ট হয়ে যায়। তবে তোমার শশুরের মতো ভীতু লোক পেলে অবশ্য খুনখারাবির প্রয়োজন পড়ে না। চেয়ারম্যান শা’লা এতো সহজ মানুষ, ওকে ঠিক মানায় না চেয়ারম্যান হিসেবে। একদিন হুট করে দেখে ফেললো আমাদের কর্মকাণ্ড। রুখে দাঁড়াতে চাইলো পুরো দমে। আমি তো শা’লার ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। আব্বা এসে যখনি বউ-ছেলেকে মারার হুমকি দিলো অমনি সুরসুর করে রাজি হয়ে গেলো চুপ থাকতে। ওহহো! আমার আরেকটা পরিচয় তো তোমাকে দেওয়াই হয়নি। তুমি জানো আমার বাবার নাম কী?”
“মেম্বার রজত হাওলাদার তোর বাবার নাম। সঠিক নাম বলেছি তো? নাকি আরো বাপ আছে তোর?” মুহূর্তেই রাগ ছেড়ে ভ্রু কুচকে শুধায় আরজান।
এবার খানিক বিচলিত হতে দেখা যায় আকাশকে। সে হতবাক স্বরে শুধায়, “তুই আমার পরিচয় কীভাবে জানিস? আর জানলে এতোদিন কিছু বলিস নাই কেন? কী উদ্দেশ্য তোর?”
“আরে তুমি দেখি চেইত্তা গেছো? কুল! এতোদিন আমি শুধু ধারনা করেছিলাম আজ কনফার্ম হয়ে গেলাম। প্রথম সন্দেহ তো আমার সেদিন হয়েছে যেদিন মেলার মাঠে রজত হাওলাদার মোবাইলে তোর সাথে কথা বলছিল সেটাও খুবই আড়ালে। শুনলাম তার ছেলে নাকি শহরে থাকে। আর ঐদিনই আমি জানলাম রজত হাওলাদারের একমাত্র ছেলের নাম আকাশ। দ্বিতীয়ত আমার শ্বশুরমশাই সব ফেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল মেম্বারের ছেলেকে আনতে। কেন?কীসের এতো দায় তার? সেদিনই আমাকে এখানে ধরে আনা হলো। আমার চোখ বন্ধ থাকলেও কান বন্ধ ছিল না। আর আজ তোর নাম শুনে একেবারে কনফার্ম হয়ে গেলাম যে ঐ ক্ষেতেরই ফসল তুই।”
“তাহলে তো তুই সবই জেনে গিয়েছিস। বেঁচে থাকার আর কী প্রয়োজন?” রাগান্বিত হয়ে ছুড়ি হাতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আকাশ।
তৎক্ষণাৎ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করে রজত হাওলাদার। ছেলেকে এভাবে তেড়ে যেতে দেখে বলে ওঠে, “আরে কী করতাছিস আকাশ? এতো দ্রুত ওরে মাইরা ফালাইলে ও দেখব কেমনে ওর বাপের খুনের পেছনের মূল অপরাধীরে?”
বাবার কথাতে বেশ বিরক্ত হয় আকাশ। রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “একে বাঁচিয়ে রেখে নিজেদের বিপদ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না? বাপের মতো ম্যাজিশিয়ান হয়েছে এখন যদি বাপের মতো নিজের এই বাঁধন ছিড়ে ফেলে?”
একটা চেয়ার টেনে আয়েস করে বসে রজত হাওলাদার। অতঃপর অট্টহাসি হেসে বলে, “তাইলে বাপের মতোই অকালে মরব।”
অতঃপর আরজানের দিকে চেয়ে বাকা হেসে বলে, “বাজান, চিনছো আমারে? তোমার বাপরে মারার কইল ইচ্ছে ছিল না আমার। বাঁধন যে ছিইড়া ফালাইব তা কেডা জানতো? তয় তুমি চিন্তা কইরো না তোমারে ম্যালা শান্তি দিয়া মারমু। বেশি কষ্ট দিমুনা।”
রাগান্বিত দৃষ্টিতে একবার তাকে পর্যবেক্ষণ করে আরজান। এই জানো’য়ারটার সাথে কথা বলে মুখ নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা নেই তার। গ্রামের লোকজন একে কতো বিশ্বাস করছিল, নিজেদের মেম্বার বানিয়েছিল আর এই হারা’মখোর তাদেরকেই আড়ালে থেকে হত্যা করেছে। তৈরি করেছে বিরাট এই চক্র। একে তো পুরো গ্রামের সামনে ফেলে মারা উচিত কিন্তু আফসোস তা সে করতে পারবেনা।
রজত হাওলাদার পুনরায় বলে ওঠে, “আমার পোলার লগে পরিচয় হইছো তো ভালা কইরা? ওরে আমি শহরে রাখছিলাম। ডাকাতির সব মাল ঐখানেই যাইতো। পোলা আমার ম্যালা কামের।”
এবারও পূর্বের ন্যায় নিশ্চুপ আরজান। হতাশ হওয়ার ভঙ্গি করে রজত হাওলাদার। রূপকথার দিকে চেয়ে বলে, “বৌমা, বাঁইচা আছ তো? তোমারে পাইলে ম্যালা আগেই ডাকাতি ছাইড়া দিতাম। তোমার মতো একটা টাকার পাহাড় হেলায় পইড়া আছিল এতদিন। এইবার সঠিক ব্যবহার হইব। কী কস আকাশ?”
আকাশ রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “এইভাবে পড়ে থাকলে ও এমনিই মরে যাবে। তারপর জলপরির লাশ বেঁচে টাকার পাহাড় বানিয়ো তুমি।”
ছেলের এমন রাগে খানিক বিচলিত হয়ে পড়ে রজত হাওলাদার। হাঁক ছেড়ে বলে, “কেডা আছস? এই মাইয়ারে বিলে লইয়া চল। আর এই ঘরটারে আগুন লাগাইয়া দে। এই ঘরের সমস্ত কাম আইজ খতম। এই ম্যাজিশিয়ানের লগে পুইড়া শ্যাষ হোক সবকিছু।”
ঘর থেকে বেরোনোর পূর্বে শেষবারের মতো আরজানের দিকে এগিয়ে আসে আকাশ। বাঁকা হেসে বলে, “ওপারে গিয়েও বউয়ের জন্য ভালোবাসা উতলে পড়বে নাকি তোর? আয়হায় বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। একজোড়া প্রেমিক যুগলকে আলাদা করে দিচ্ছি চিরতরে। জীবনে খুনখারাবি করেছি অনেক কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছি এই প্রথম। বদ দোয়া করিস না মরার আগে।”
উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না আরজান। বরং মায়ার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে এলিয়ে পড়া রূপকথার দিকে। তার জলরূপসী পানির শূন্যতায় বড় অসহায় হয়ে পড়েছে। বেশিক্ষণ এরকম থাকলে তার অবস্থার আরোও অবনতি হবে।
আকরাম মিঞা ও পলাশ জমির আইল ধরে ছুটে চলেছে মাঠের মধ্যখানে। তারা মেম্বারের বাড়িতে গিয়েছিল কিন্তু সেখানে কাউকেই পায়নি সে। বাড়িতে তালা ঝুলছে দেখে আর বুঝতে বাকি থাকে না তারা তাদের অপরাধের লীলা শুরু করে দিয়েছে। তাই দু’জন ছুটেছে এই নির্দিষ্ট স্থানের দিকে। তারা আগে থেকেই অবগত মেম্বারের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিন্তু প্রাণের ভয়ে চুপ থাকতে হয়েছে এতোদিন। পলাশ ঝামেলা করতে চাইলেও আকরাম মিঞা থামিয়ে দিয়েছে। সে সরল মানুষ। এতো সাহস কোথায় যে এই খুনিদের পেছনে লাগবে? এমন সময় পলাশ রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, “আইজ মা’ইরা ফালামু দুইডারেই। এতোদিন চুপ থাইকা যে ভুল করছি তার দাম আমার বোনডা দিতাছে। আপনের কতা আর শুনমু না আমি। আমার বোনের কিছু হইলে কু’ত্তা দিয়া খাওয়ামু দুইডারে।”
আকরাম মিঞা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আইজ আর চুপ থাকুম না।”
কিছুক্ষণ বাদে মাঠের মাঝ বরাবর আসতেই নজর যায় সেই ঘরটার দিকে। থমকে দাঁড়ায় তারা দু’জন। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে সেখানে। ঘরের মাথায় উঠে গেছে সেই আগুন। ইতিমধ্যে ঘরের অবস্থা পুড়ে বেহাল। ভেতরে কেউ থাকলেও সে হয়তো এতোক্ষনে পুড়ে ছাই হয়েছে।
চলবে,,,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_27
আকরাম মিঞা পাথরের ন্যায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ভিজে একাকার তার সমস্ত শরীর। কিছুটা দূরে জ্বলে যাওয়া ঘরটা থেকে এখনো ধোঁয়া উঠছে। কিছুক্ষণ পূর্বে ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি নেমে বন্ধ করে দিয়েছে তার ধ্বংসলীলা। পুড়ে রাখ হয়ে যাওয়া ঘরটার ধ্বংসস্তূপ ভিজে চুপচুপে। ভেতরে থাকা আসবাবপত্র বা কোনো মানব শরীরের কোনো চিহ্ন অবদি রাখেনি সেই আগুন।
বৃষ্টি থেমে গিয়ে পূর্বের ন্যায় মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে মাঠ জুরে। ভেজা কাপড় শুকাতে বসেছে পলাশের শরীরে অথচ তার সেদিকে কোনো ধ্যানই নেই। সে তো কাতর চোখে দেখে যাচ্ছে জ্বলে যাওয়া ঘরটার ধ্বংসস্তূপ। ভিজে চুপচুপে হওয়ার পরেও যেন আগুন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে পূর্বের ন্যায়। সদ্য শেষ হওয়া বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ছে তার চুল বেয়ে। মনে তার একটাই আফসোস, সে কি আরেকটু আগে আসতে পারতো না? আরেকটু আগে আসলে হয়তো এই আগুনে জ্বলতে হতো না তার বোনটাকে। ভাই হিসেবে সে বড্ড খারাপ। নিজর দায়িত্ব নেভাতে অক্ষম সে।
“শা’লাবাবু।”
বোনের শোকে স্তব্ধ পলাশকে এই ডাক যেন আরোও খানিক কাতর করে তোলে। অসহায় দৃষ্টিতে পেছনে ফিরে তাকাতেই তার চক্ষুদ্বয় চড়কগাছ। আকরাম মিঞা পেছনে ফিরেই তৎক্ষণাৎ অবাক কন্ঠে বলে ওঠে, “বাজান।”
ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পলাশ। রূপকথাকে কোলে করে সটান দাঁড়িয়ে আছে আরজান। চুলগুলো তার ভিজে চুপচুপে। ভেজা শার্টটা খুলে চাপিয়ে রেখেছে রূপকথার শরীরে। চোখদুটো বন্ধ করে তার শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে রূপকথা। নিশ্বাস ছাড়া তার আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সোনালি চুলগুলো বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে মাটিতে। পলাশ হতবাক স্বরে শুধায়, “আপনে? বোনরে কোনহানে পাইছেন?”
“জাদু করে এনেছি তোমার বোনকে।” ফটাফট উত্তর আরজানের।
বিরক্ত হয় পলাশ। এমন একটা সময়েও এই লোক ঠাট্টা করবার পারতাছে! সে কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বলে, “ভালা করছেন, অহন বাড়ি চলেন। ভিইজা তো কাক হইয়া গেছেন দুইজন। অসময়ের বৃষ্টি, জ্বর আইতে সময় লাগব না। আর বোনের কী হইছে? সে কথা কয় না ক্যাঁন?”
ঘাড় কাত করে আরজান। আশ্চর্য হয়ে বলে, “আরেহ! কোথায় দুলাভাই বেঁচে ফিরেছে তারে গলায় লাগাবা তা না বোন নিয়ে পড়ে আছো। তোমার বোনের এই পানিতে কিচ্ছু হবে না উল্টো সুস্থ হয়ে যাবে।”
পলাশ ভ্রু কুচকে তাকাতেই সে পুনরায় বলে ওঠে, “তোমরা যাও, বাড়িতে গিয়ে খবর দাও। আমরা সকালে যাব।”
“অহন কোই যাইবেন?”
“চুরি করতে।”
“অসুখ হইব, সময় এমনিই ভালা না। পলাশের কতা ঠিক আছে। বাড়ি চলো বাজান। মাইয়ার শরীল তো দূর্বল লাগতাছে।” আকরাম মিঞা এগিয়ে এসে বলে।
তার দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় সেই পোড়া ঘরের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকায় আরজান। বদলে যায় তার চঞ্চল দৃষ্টি। গম্ভীর হয়ে ওঠে তার মুখভঙ্গি। শেষ, এই ঘরের সমস্ত খেলা আজ শেষ। আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ডাকাতদল পুড়ে ছাই হয়েছে, অসহায় হয়ে পড়ে রয়েছে এই ধ্বংসস্তূপের নিচে। নিশ্চিন্ন হয়েছে তাদের অপরাধের খেল। সেই সাথে পুড়েছে তাদের সর্দার। বোকার স্বর্গে বাস করছিল তারা। সাধারণ এক বাঁধন দিয়ে একজন ম্যাজিশিয়ানকে আটকাতে চেয়েছিল। সেদিনও এই ভুলটাই করেছিল তারা। যার ফলস্বরূপ বাঁধন খুলেছিল সে জাদু দারা অথচ ফিরোজকে দেখাতে দাঁত লাগিয়েছিল বাঁধনে। বোকা ফিরোজ, তার কথাতেই বিশ্বাস করে নিল হাত সামনে বাঁধা ছিল তাই দাঁত দিয়ে খুলতে পেরেছে। সে জানেই না সেদিনও হাতদুটো পেছনেই বাঁধা ছিল। বাবার শেখানো বিদ্যা তাকে সর্বক্ষেত্রে রক্ষা করেছে। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। চোখের পলকে বাঁধন খুলেছে সে। যাদের আগুন তাদেরকেই পুড়িয়েছে এই অনলে। আজ থেকে এই গ্রামে থাকবে না আর কোনো ডাকাত আতঙ্ক। ডাকাতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকতে হবে না কাউকে। সম্পদ রক্ষার্থে প্রাণ দিতে হবে না কোনো গ্রামবাসীকে।
বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েছে সে।
কৌতূহলী হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে পলাশ। হূট করে এভাবে গম্ভীর হয়ে যাওয়ায় মোটেও অবাক হয়নি সে। লোকটার গাম্ভীর্যতার সঙ্গে পরিচিত সে আবার চঞ্চলতার সঙ্গেও পরিচিত। তবে এভাবে হুট করে গম্ভীর হয়ে যাওয়ার কোনো কারন পায় না সে। আচমকা কিছু মনে পড়তেই সে আরজানের দৃষ্টি লক্ষ্য করে সেই ঘরটার দিকে তাকায়। অতঃপর চোখদুটো পূর্বের তুলনায় বড়বড় করে শুধায়, “দুলাভাই! আপনে পুড়াইছেন এইডা?”
আচমকা পলাশের প্রশ্নে ধ্যানভঙ্গ হয় আরজান। ঘরটা থেকে নজর সরিয়ে মুচকি হেসে বলে, “আমি কেন পোড়াতে যাব? মাঠের মাঝখানে এই ঠান্ডা আবহাওয়ার ভেতরে একাই আগুন ধরে গেছে। আগুনের বোধহয় হাত-পা গজিয়েছিল, তাই না শা’লাবাবু?”
হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে তাদের সমস্ত কথা শুনে যায় আকরাম মিঞা। তার বুঝতে আর এক বিন্দু বাকি থাকে না এই আগুনের সূত্রপাত কীভাবে ঘটেছে, কে ঘটিয়েছে। পলাশ কিছু বলার পূর্বেই সে ব্যস্ত কন্ঠে শুধায়, “কেডা কেডা আছিল ঐ ঘরে? ওর পোলা,,,,, পোলা আছিল তো?”
“সবাই ছিল, সবকটা মরেছে শুধু ফিরোজ ছিল না। সে হয়তো আগেই এদের শিকারে পরিণত হয়েছে আমাকে মারতে অক্ষম হওয়ার অপরাধে। সেদিন ওর মোবাইল ঘেটে স্যার নামের যে বান্দার নম্বর পেয়েছিলাম সেই তাহলে এই আকাশ, রজত হাওলাদারের ছেলে। রজত হাওলাদার শা’লা একটা জিনিসই বটে! সামান্য মেম্বার হয়ে এলাকার চেয়ারম্যানের চৌদ্দ গুষ্টি কাঁপিয়ে ফেলল! আপনি এতো ভীতু একটা মানুষ হয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন কীভাবে বলেন তো? আমার তো মনে হয় সব চোরাই ভোট ছিল। শা’লার কপাল আমার, শ্বশুর পাইলাম চেয়ারম্যান সেও আবার মুরগির বাচ্চার মতো ভয়ে কাঁপতে থাকে সামান্য চোর-ছ্যাচড় দেখে। ছি! থুহ!” একদমে বলে যায় আরজান।
বিস্ময়ে চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে আকরাম মিঞার। কোন জামাই তার শ্বশুরের সাথে এমনে কতা কয়! সে এইসব খুনখারাবি একটু বেশিই ভয় পায় ঠিক আছে তাই বইলা চোরাই ভোট! এইসবও শুনবার হইতাছে তারে এই বয়াসে আইসা! একেবারে মিছা কতাও কয় নাই পোলাডা। চেয়ারম্যান হওয়ার মতোন যোগ্যতা বোধহয় তার নাই। যে চেয়ারম্যান গ্রামবাসীরে সুরক্ষা দিবার পারে না অমন চেয়ারম্যান দিয়া হইবডা কী? মনে মনে সে ঠিক করে নেয় আর ভোটে দাঁড়াইব না সে।
পলাশ যথাযথভাবে নিজের কানটানে বন্ধ করে রাখতে চায়। সে জানে এইবার তার পালা। শ্বশুর ছাইড়া শা’লারে ঝাড়ব এখন। আর মুখের লাগাম তো আগে থেইকাই আছিল না। তার ভাবনাকে সত্যি করে আরজান বলে ওঠে, “আর এই যে, আমার সাহসী শা’লাবাবু। আপনার তো অনেক সাহস। সাহস দিয়ে একদম কোনা কোনা পরিপূর্ণ। আপনি কী করছেন এতদিন? নাকি শুধু আমার সামনে আসলেই লম্ফঝম্প করেন শুধু। শা’লা একটা মেম্বারকে সামলাতে পারলে না তোমরা দুই বাপ-ব্যাটা!”
ঠাসঠাস করে করা অপমানেও সামান্য বিচলিত বা রাগান্বিত হয় না পলাশ। উল্টো নিজের বাপের দিকে তাকায় কটমট করে। অতঃপর আরজানের দিকে চেয়ে বলে, “আমরা ম্যালা বেশিদিন আগে জানবার পারি নাই। আপনে আসার পর জানছি আমি। আব্বাও আপনে আসার কয়দিন আগেই জানবার পারছে। তার আগে তো আমরাই কতো কী করছি ডাকাত ধরবার লিগা। মেম্বার হওয়ার সুবিধা নিছে ঐ রজত হাওলাদার। হারা’মখোর একটা ঐ কু’ত্তার বাচ্চা। পুলিশরে পর্যন্ত হাত কইরা ফালাইছে। আপনে না মারলে আমিই কবে মা’ইরা দিতাম। আব্বা ভয় পাইয়া কয়দিন চুপ আছিল একটা সুযোগের লিগা। একবার শক্তপোক্ত কোনো প্রমাণ পাইলেই ওগো কাহিনী শ্যাষ। তয় ভালা করছেন আপনে। এইবার পুলিশ শা’লা আইলে ওর ঠ্যাং ভাইঙ্গা হাতে ধরাইয়া দিমু খালি ওরে আসতে দেন।”
এবার খানিক সন্তুষ্ট হয় আরজান। তারমানে সে যতটা ভেবেছিলো ততটাও আবুল নয় তার শ্বশুরমশাই। বুদ্ধি আছে লোকটার তবে প্রকাশ করে না। সে প্রমাণ খুঁজছিল ঠান্ডা মাথায় কিন্তু তার এতো ধৈর্য নেই। সে ধরলে একবারেই খেল খতম। এবার সে নজর সরিয়ে রূপকথার দিকে তাকায় যে আপাতত তার শরীরের সাথেই মিশে আছে। বৃষ্টিটা একদম সঠিক সময়েই এসেছে। তার জলরূপসীর পানির শূন্যতা দূর করতেই হয়তো এই আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। তবুও তার আরোও পানি প্রয়োজন। সে পূর্বের তুলনায় অনেকটাই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে এই পানিতে। তারপরেও পুরোপুরি সুস্থ নয় সে। তাই তাদের দিকে চেয়ে বলে, “তোমরা বাড়িতে গিয়ে খবর দাও। আমরা সকালে আসব। আমাদের একান্ত কিছুটা সময় প্রয়োজন। আর হ্যাঁ, আমার বাড়ি থেকে যেন একটা লোকও বেরোতে না পারে সকালের আগে। এইটা তুমি খেয়াল রাখবা শা’লাবাবু। আর গ্রামের লোকজন সামলানোর দায়িত্ব শ্বশুরমশাইয়ের।”
অতঃপর রূপকথার দিকে চেয়ে বলে, “আর এইটারে তো আমি পরে দেখে নেব। বলে কি-না ঐ আকাশ সুদর্শন! শাক-সবজি না খেলে চোখের সমস্যা তো হবেই। তোমরা বাড়িতে গিয়ে বলবে আজ কচুর শাক রান্না করতে।”
মুহুর্তেই চোখদুটো বড়বড় করে তাকায় আকরাম মিঞা। পলাশ ভ্রু কুচকে শুধায়, “ঠিকই তো কইছে। ক্যান? আপনার জ্বলতাছে?”
তেতে ওঠে আরজান, “জ্বলবে না তো কী হবে শা’লা? আমার বউ ক্যান চোর ছ্যাঁচড়কে সুদর্শন বলবে?”
দমে যায় পলাশ। নাহ, এর সাথে লেগে লাভ নেই তা সে ভালোই ঠাহর করতে পারছে। তাই প্রসঙ্গ বদলাতে বলে ওঠে, “বোন কতা কয় না ক্যান?”
বেশ বিরক্ত হয় আরজান। রাগান্বিত স্বরে বলে, “এ শা’লা এমন ক্যান? তখন থেকে শুধু বোন, বোন করে যাচ্ছে। জলজ্যান্ত দুলাভাই যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাকে তো একবারও জিজ্ঞেস করছো না কেমন কাটলো ঐ জালিমদের বন্দিশালায়? তোমার বোন একা ছিল নাকি ওখানে?”
হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পলাশ। একটা মানুষের কতগুলো রূপ হতে পারে তার ধারনা ছিল না। তবে একে দেখে কিঞ্চিত ধারণা জন্মেছে। তারা তো জানতোই না যে ইনিও ঐ ঘরে আছেন। সে তো ভেবেছিলো শুধু বোনই আছে ওখানে। তবে সে কথা এখন বলা যাবে না। বললে বিপদ বাড়বে বটে, কমবে না। তাই তার কথাতেই সম্মতি জানিয়ে বলে, “তাইলে চইলা যাই আমরা। সাবধানে থাইকেন আপনারা।”
আকরাম মিঞার দিকে চেয়ে বলে, “চলেন আব্বা। মা মনে হয় অসুখ বাঁধাইয়া ফালাইছে এতোক্ষনে।”
“হ চল, বেডি তো মনে হয় মাইয়ার শোকে কাইন্দা কাইটা গেরাম ভাসাইয়া ফালাইছে। আমার তো সন্দেহ হইতাছে যে এই বৃষ্টি তর মার চোক্ষের পানি না তো।” বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করে আকরাম মিঞা।
ভ্রু কুচকে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে পলাশ। তার আব্বার উপরে দুলাভাইয়ের আছর ভালা মতোই পড়ছে। আজগুবি কতা কইবার লাগছে জামাইয়ের মতোন। ভাবতে ভাবতেই তার পেছনে হাঁটতে শুরু করে সে। পেছন থেকে অবাক চোখে চেয়ে থাকে আরজান। শ্বশুরের পুরো গুষ্টিই এমন তার ছেঁড়া নাকি! এমনভাবে দু’জনে হাঁটতে শুরু করেছে যেন পৃথিবীর রং আজ নীল হয়ে গেলেও তাদের কিচ্ছু যায় আসে না! তাদের একমাত্র লক্ষ্য এখন বাড়ি পৌঁছানোর। কী সাংঘাতিক অপমান! তাকে বিদায় পর্যন্ত দিলো না!
তার উদম শরীরে রূপকথার গরম নিশ্বাস এসে আছড়ে পড়তেই ভাবনাচ্যুত হয় সে। রূপকথার দিকে চেয়ে দেখে সে দিব্যি তার বুকের সাথে মিশে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। ভ্রু কুচকায় আরজান। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি!
কিছুক্ষণ বাদেই সে উপলব্ধি করতে পারে রূপ ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা তো তারও লাগছে তবে এখন তা নিবারণের সময় নেই। আগে রূপকে সুস্থ করতে হবে। তাই দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে সাদাবিলের দিকে। এখান থেকে বিলের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। দ্রুতই পৌঁছে যায় তারা। বিলের পাঁড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় রূপকথার দিকে তাকায় আরজান। বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “রূপ, ওঠো। দেখো পৌঁছে গিয়েছি আমরা। চোখ খোলো।”
পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় রূপকথা কিন্তু ছাড়ে না আরজানকে। পূর্বের ন্যায় মিশে থাকে তার বুকের সাথে। হতাশ হয় আরজান। ধীরে সুস্থে তাকে নামিয়ে দেয় মাটিতে। ভরাট স্বরে বলে, “পানিতে নেমে যাও। ভয় পেও না, আমি আছি এখানে।”
মুচকি হেসে পানিতে নেমে যায় রূপকথা। কোমর পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে পুনরায় ফিরে তাকায় আরজানের দিকে। আবদারের সুরে বলে, “গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি?”
“একদম না, দ্রুত পানির নিচে যাও।” ধমকে ওঠে আরজান।
মনোক্ষুন্ন হয় রূপকথা। চোখ-মুখ কুচকে চেয়ে থাকে আরজানের দিকে। আরজান চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ধীরে ধীরে সে বিলীন হয়ে যায় পানির মাঝে। বিলের পানি পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক হতেই পরিবর্তন হয় আরজানের মুখভঙ্গি। অধিকতর গম্ভীর হয়ে ওঠে সে। তার ভুল ধারনা ভেঙে গেছে আজকের ঘটনায়। এই সংসার জীবন জলরূপসীর জন্য নয়। এই জীবনে তার পদে পদে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা। তার স্থান এই স্থলে নয় বরং অথৈ জলেই নিরাপদে থাকবে তার জলরূপসী। তার জীবনে থাকতে হলে তাকে ক্ষণে ক্ষণে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ পাবার আতঙ্কে কাটাতে হবে। সুযোগ পেলেই এই মানবগোষ্ঠী কাল হয়ে দাঁড়াবে তার বিরুদ্ধে। ভয়ে, আতঙ্কে, পানির শূন্যতায় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবে তার রূপ। হারিয়ে বসবে নিজের উচ্ছ্বাসিত জীবন। তাকে ফিরে যেতে হবে ঐ বিশাল সমুদ্রে। যেখানে সে খলবলিয়ে সাঁতরে বেড়াবে। নিজেকে নিরাপদ বোধ করবে।
ভিজে চুপচুপে খেজুরের পাতাগুলো মৃদু বাতাসে দুলছে। বড় অসহায় লাগছে আরজানের। সে আকাশের দিকে চেয়ে বিষন্ন মনে বলে ওঠে, “তোমার সান্নিধ্য বোধহয় এই জীবনে পাওয়া হলো না রূপ।”
চলবে,,,,,,