#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_23
শিকদার বাড়ি ভরে উঠেছে আত্মীয়স্বজন দিয়ে। চারদিকে রমারমা পরিবেশ। ছোট ছোট বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছে বাড়ির উঠোন জুড়ে। তাদের কারোর হাতে ফুল আবার কারোর হাতে বেলুন। বাড়ি সাজানো হয়েছে নানান রকম ফুল দিয়ে। দু’দিন পূর্বেই হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এসেছে আরজান। সেখানে প্রায় সপ্তাহ খানেক কাটাতে হয়েছে তাদের। সোফিয়া শিকদার চেয়েছিল কিছুদিন পরে আরজানের বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন দাওয়াত করে খাইয়ে দিতে। সাথে বউকেও সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। তাই এই আয়োজন। কিন্তু আরজানের জোরাজুরিতে সেটা আজই করতে হচ্ছে। ছেলে তার নাছোড়বান্দা। একবার যা বলবে তো বলবেই। বাড়িতে এসেছে চেয়ারম্যান, রোজিনা বেগম, পলাশ, হাশেম। শহর থেকে এসেছে আরজানের বাকি আত্মীয়রা। এসেছে লামিয়ার মা-বাবাও। তারা সব শুনে মেনে নিয়েছে তবে হয়তো মন থেকে কিছুটা তেতেই আছে। তাদের সাথে কথা হয়েছে আজকের দিনটা থেকে কালই তারা লামিয়াকে নিয়ে পাড়ি দেবে শহরে।
লামিয়া তো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেছে কোথাও। আটকায়নি সোফিয়া শিকদার। মেয়েটার মন ভালো না, চারদিক ঘুরে মন কিছুটা ভালো হলে ঠিকই চল আসবে। সে এতোটা বোকা নয় যে একা একা কোথাও চলে যাবে। নিশ্চয়ই আশেপাশেই আছে।
আরজান একটা পাতলা টি-শার্ট পরে টো টো করে সারা বাড়ি ঘুরছে। এদিক-ওদিক চেয়ে কিছু একটা খুঁজে চলেছে সে। পুকুরপাড়ে পর্যন্ত খুঁজে এসেছে সে। উঁহু, কোথাও তার বউ মিলছে না। এতো মানুষ দেখে বউ পালিয়ে গেল নাকি?
সব ঘরে ঘরে গিয়ে খাটের উপর-নিচ ভালো করে দেখে আসছে। হতেও পারে বউ খাটের তলায় লুকিয়ে পড়েছে। কিন্তু কোথাও তার বউ নেই। শুধু মায়ের ঘর দেখা হয়নি। সেখানে নিশ্চয় তার বউ যাবে না। আবার কী ভেবে মায়ের ঘরের দিকে যায় সে। দরজা থেকে উঁকি দিতেই চক্ষু চড়কগাছ। রূপকথা মায়ের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে আর মা আলমারি থেকে কিছু একটা বের করে তার সামনে রেখে আবার আলমারির কাছে ফিরে যাচ্ছে। হটাৎ তার দিকে সোফিয়া শিকদারের নজর পড়তেই ভ্রু কুচকে তাকায় সে। গলা উচিয়ে শুধায়, “তুই এখানে কী করছিস? বাঁদরের মতো ঝুলে আছিস কেন দরজা ধরে?”
হুট করে এমন কথাতে নিঃশব্দে হেসে ফেলে রূপকথা। দু’হাতে মুখ চেপে আরজানের দিকে তাকাতেই সে রাগান্বিত বলে ওঠে, “জামাইকে দেখে কেউ হাসে? বেয়াদব ছেমড়ি।”
রূপকথা চোখ বড়বড় করে তাকাতেই পুনরায় ধমকে ওঠে সে, “কখন থেকে খুঁজছি, তুমি এখানে কী করছো?”
রূপকথা কিছু বলার আগেই তার দিকে এগিয়ে যায় সোফিয়া শিকদার। রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে, “ও যেখানেই থাকুক, তোর সমস্যা কী? তোকে কি কেউ মজুরি দিয়ে রেখেছে ওকে খোঁজার জন্য?”
এসব ধমকা ধমকি মোটেই পাত্তা দেয় না আরজান। চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে রূপকথার পাশে। রূপকথার সামনে বিছিয়ে রাখা শাড়িগুলো দেখে বলে, “এগুলো কি তুমি রূপের জন্য বের করেছো?”
“হ্যাঁ, এর মধ্য থেকে একটা শাড়ি ওকে আজ পরতে হবে। তাই তো ওকে ডেকে আনলাম। শাড়ি পরতে পারে না নিশ্চয়? আমি পরিয়ে দেব।” বলে সোফিয়া শিকদার।
আরজান কিছুক্ষণ সবগুলো শাড়ি নেড়েচেড়ে দেখে। হটাৎ একটা ধূসর বর্ণের শাড়ি হাতে নিয়ে বলে, “এটাই পরবে রূপ।”
তেতে ওঠেন সোফিয়া শিকদার, “তোকে বলেছে এটা পরবে? আর এই দিনে কেউ এসব রং পরে নাকি?”
“আরে তুমি জানো না। রূপ মনে মনে এটাই চাইছে। তাই না রূপ?” প্রশ্ন ছুড়ে দেয় রূপকথার উদ্দেশ্যে।
হকচকিয়ে যায় রূপকথা। সে কখন এটা পড়তে চাইল!
অবাক কন্ঠে সে কিছু বলার পূর্বেই আরজান তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয়। শাড়িটা তার কাঁধের উপর বিছিয়ে দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে, “দেখো তো, কতো সুন্দর লাগছে।”
“তাহলে তুই শাড়ি পরিয়ে দে। আমাকে আর কী দরকার?” হনহন করে বেরিয়ে যায় সোফিয়া শিকদার। এসব রং এমন একটা দিনে পরলে কেমন দেখাবে? ছেলে তার সবকিছুতে জেদ করে।
মা-ছেলের দ্বন্দ্বে হাঁ করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো করণীয় নেই রূপকথার। তাকে আরো একবার অবাক করে দিয়ে আরজান তাকে টানতে টানতে নিজেদের ঘরে নিয়ে যায়। যেখানে ইতিমধ্যে কাজ চলছে। পলাশ তার সাথে কয়েকটা ছেলেকে নিয়ে ঘরটা সাজিয়ে তুলছে। বিছানা ভরে গিয়েছে ফুলে ফুলে। চারদিকে শুধু ফুল আর ফুল। এসব দেখে না চাইতেও ভ্রু কুচকে যায় আরজানের। সে কিছু বলবে এমন সময় পলাশ বলে ওঠে, “কী দুলাভাই? পছন্দ হয়েছে?”
“দুলাভাই!” চোখ বড়বড় করে তাকায় আরজান। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে পুনরায় বলে, “আমাকে বললে?”
“বোন আমার একটাই তাইলে দুলাভাই আবার কইডা হইব?” শুধায় পলাশ।
আশ্চর্যের সীমা থাকে না আরজানের। তার মানে তাকেই দুলাভাই ডেকেছে! সে পুরো ঘরে একবার নজর বুলিয়ে বলে ওঠে, “তা, এই মেহেরবানির কারন?”
“আইজ আপনাগো বাসর রাইত। দেইখা বুঝতাছেন না?”
এবার বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবে আরজান। একেতো তাকে দুলাভাই ডাকছে! তার উপর আপনি করে কথা বলছে! আবার নাকি বাসর রাত! তার শা’লাবাবুর মতো একটা গোল্ডেন প্রপার্টি কি-না তার জন্য ঘর সাজাচ্ছে!
সে হতবাক স্বরে শুধায়, “তোমার কি জ্বর টর আসছে শা’লাবাবু?”
“জ্বর আইব ক্যাঁ?” শুধায় পলাশ।
“তাহলে নিশ্চয়ই সেই ভূতে আছর করেছে তোমার উপর। বাসর পরে করবোনে আগে চলো তান্ত্রিককের কাছে। দুইটা ফু মারলেই সব ঠিক।” কথা বলতে বলতেই পলাশের দিকে এগিয়ে যায় সে। পলাশের হাত ধরার আগেই সে ছুটে বাইরে চলে যায়। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয় আরজান। বিড়বিড়িয়ে বলে, “আরে পালিয়ে গেল কেন?”
রূপকথার দিকে চেয়ে বলে, “দেখেছো? তোমার ভাইয়ের আচরন। দুলাভাই ডাকছে আর সে পালাচ্ছে।”
চোখ-মুখ কুচকে তাকায় রূপকথা। রাগান্বিত স্বরে বলে, “এমন দুলাভাই থাকলে তার তো বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে পড়ে। আমার ভাই বলে তাও শুধু পালাচ্ছে।”
চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায় আরজান। তাকে কি অপমান করলো রূপ? যাকগে, করুক, বউই তো করেছে। সব ধ্যান ধারণা বাদ দিয়ে সে শাড়িটা হাতে তুলে নেয়। নতুন মোবাইলটা নিয় ইউটিউব থেকে খুঁজে খুঁজে শাড়ি পড়ার একটা সহজ টিউটোরিয়াল পায়। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে কয়েকবার ভিডিওটা দেখে নেয়। অতঃপর মোবাইলটা রেখে রূপকথাকে বলে, “শাড়ি পরতে আর কী কী লাগে জানো তুমি?”
“হ্যাঁ, মা সবকিছুই দিয়েছে।”
“তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন? পরে ফেলো সেগুলো।”
“তোমার সামনে?” অবাক হয়ে শুধায় রূপকথা।
“হ্যাঁ তাইতো, তুমি পরে নাও আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।” কথা সম্পূর্ণ করেই বেরিয়ে যায় আরজান।
বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রূপকথার ডাকের। কিছুক্ষণ কেটে গেলেও রূপকথার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে শুধায়, “কী করছো রূপ? এতোক্ষন লাগে নাকি?”
তবুও কোনো সাড়া নেই, নিশ্চুপ রূপকথা। আরজান ব্যস্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় রূপকথা কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে ওরনাটা পেঁচিয়ে রেখেছে ভালো মতো। কিছুক্ষণের জন্য আরজান থমকালেও মুহুর্তেই নিজেকে সংবরণ করে নেয় সে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, “এভাবে কাঁচুমাচু করার মতো কী হয়েছে? তোমার জলপরির পোশাকের থেকে ভালোই আছে।”
“কিন্তু এগুলো পড়ে আমি বাইরে যাব না।”
“একদম চুপ।” ধমকে ওঠে আরজান। শাড়ি হাতে নিয়ে বলে, “এসো পড়িয়ে দেই।”
সরে যায় রূপকথা। ক্ষীণ স্বরে বলে, “না থাক, আমি বরং মায়ের থেকে পরে আসি।”
“এক পা বাড়ালে পা ভেঙে দেবো একদম। আমার কাছে আসলেই তোমার যত ধানাইপানাই শুরু হয়ে যায়।”
অগত্যা তার কাছেই শাড়ি পরতে হয় রূপকথাকে। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে সে শাড়ি পরিয়েই যাচ্ছে, পরিয়েই যাচ্ছে। একবার পরাচ্ছে তো আবার খুলছে। এই নিয়ে বোধহয় পাঁচবার শাড়ি পরিয়েছে আর খুলেছে। এদিকে অস্বস্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে রূপকথা। দরজার বাইরে মা চিল্লাচিল্লি করছে। সবাই বউ দেখতে চাইছে, এখনো গহনা পরানো বাকি। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ। কে শোনে কার কথা। সপ্তমবারের মতো শাড়ি পরিয়ে আবার খুলতে নিতেই বাঁধা দেয় রূপকথা। আরজান ভ্রু কুচকে তাকাতেই সে বলে ওঠে, “এভাবেই থাক।”
“কিন্তু ঠিকঠাক তো পরানোই হয়নি।” হতাশ কন্ঠে বলে আরজান।
“অনেক সুন্দর হয়েছে। তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমি যাই, মা ডাকছে।” বলতে বলতে দরজা খুলে দেয় রূপকথা। হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে সোফিয়া শিকদার। রূপকথাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পরখ করে নিয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি চলো।”
বারান্দায় চেয়ার দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে রূপকথাকে। পাশে সটান হয়ে বড় একটা মোটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। আকরাম মিঞা অবাক চোখে চেয়ে বলে, “লাঠি নিছস ক্যাঁ ব্যাটা? কারে ধোলাই করবার যাইবি?”
“কাম আছে আব্বা, আপনে বুঝতেন না।” গম্ভীর স্বরে বলে পলাশ।
আর ঘাঁটে না আকরাম মিঞা। বেশি কথা বললে আবার রেগেও যেতে পারে তার ছেলে। তখনই হুট করে আরজান এসে বসে পড়ে রূপকথার পাশে। তার পরনে একটা সাধারণ শার্ট। মা বলেছে বউ দেখতে আসবে সবাই। তাকে তো আর দেখতে আসবে না তাহলে সে কেন নতুন জামাকাপড় পরে সময় নষ্ট করবে। পলাশ চোখ-মুখ কুচকে তার দিকে এগিয়ে আসে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, “এইডা কী পরছেন দুলাভাই? আইজ আপনের বাসর আর আপনে এই জামা পইরা বইসা আছেন।”
তার মাথাটা টেনে ধরে আরো একটু এগিয়ে আনে আরজান। দ্বিগুণ ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “বাসর করতে পোশাক লাগে নাকি শা’লা? খামাকা নতুন জামাকাপড় কিছুক্ষণের জন্য পরে ভাজ নষ্ট করার কোনো মানেই নেই।”
দ্রুত সরে যায় পলাশ। ব্যস্ত পায়ে গিয়ে রূপকথার পাশে দাঁড়িয়ে যায়। কী শুনলো সে এইগুলা! ছি ছি! নাউজুবিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ।
আত্মীয়স্বজন সকলে এসে এসে দেখে যাচ্ছে রূপকথাকে। কেউ দোয়া করছে, উপহার দিচ্ছে আবার কেউ তার চাপা বর্ণের কারনে মুখ কুচকাচ্ছে। কিন্তু কেউ মুখে তার বর্ণ নিয়ে টু শব্দটাও করছে না। এক বৃদ্ধা মহিলা এসে তাকে দেখেই চোখমুখ কুচকে নেয়। মাত্রই বলে উঠেছিল, “বউয়ের তো,,,,,,,।”
তার কথাখানা অসমাপ্তই থেকে যায়। সম্পূর্ণ করার পূর্বেই আরজান বলে ওঠে, “চাচি আপনার বৌমা নাকি আপনার ছেলেকে রেখে কার সাথে চলে গেল। এখন কি ফিরে এসেছে?”
মুহুর্তেই মুখটা কালো হয়ে ওঠে মহিলার। সে রাগান্বিত হয়ে কিছু বলার পূর্বেই এগিয়ে আসে পলাশ। লাঠিটা রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে শুধায়, “কিছু কইবেন নি চাচি?”
চুপসে যায় মহিলার মুখশ্রী। ভীত স্বরে বলে, “বউ ম্যালা ভালা হইছে।”
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায় সে। ঠোঁট চেপে হাসে রোজিনা বেগম ও আকরাম মিঞা। সোফিয়া শিকদার হাঁ করে চেয়ে আছে পলাশের দিকে। লামিয়ার মা সবেমাত্র রূপকথাকে কিছু কটূ কথা শোনানোর জন্য এগিয়ে এসেছিল। এসব কান্ড দেখে দ্রুত পিছিয়ে যায়। শেষে কি-না ভরা সভায় অপমান হতে হবে! তার চেয়ে চুপ থাকায় ভালো। তবুও সে খালাশাশুড়ি, তার একটা দায়িত্ব আছে। নিজের স্বামীর হাতে নিয়ে আসা উপহারটা দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ে সে। ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে মেয়ের জন্য।
একে একে সকলের বউ দেখা সম্পূর্ণ হয়। বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায় ধীরে ধীরে। এখন শুধু আত্মীয়স্বজন বলতে লামিয়ার বাবা-মা আর চেয়ারম্যান পরিবারই আছে এখানে। কখন যে দিন পেরিয়ে রাত নেমেছে তা বলতে পারে না রূপকথা। সে তো হতবাক নয়নে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল। বুঝতেই পারছিল না কী থেকে কী হচ্ছে। রোজিনা বেগম মেয়ের কাছে এসে আলতো করে চুমু এঁকে দেয় তার কপালে। তাকে ধরে নিয়ে যায় ঘরের ভেতরে।
এতোক্ষনে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে পলাশ। লাঠিটা রেখে ঘেমে ওঠা মুখটা মুছতে মুছতে আরজানের উদ্দেশ্যে বলে, “আপনেরে তো ধইরা নেওন লাগতো না। আপনে একাই সুরসুর কইরা ঘরে চইলা যাইবেন হেইডা আমি জানি। তাও আমার একটা দায়িত্ব আছে, চলেন দিয়া আহি ঘর অব্দি।”
আড়মোড়া ছাড়তে ছাড়তে উঠে দাঁড়ায় আরজান। হুট করে পলাশের গালদুটো টেনে দিয়ে বলে, “ওরে আমার বুঝদার শা’লা। তাড়াতাড়ি চলো, তোমার বোন ঘুমিয়ে পড়লে সব শেষ আমার।”
চোখ-মুখ খিচে সরে দাঁড়ায় পলাশ। সে শুধু এইডা ভাইবাই কুল পায় না যে বোনডারে কি-না বিয়া দিছে এর মতো একটা নির্লজ্জ মানুষির কাছে! যার কি-না না আছে কতার ধরন আর না আছে লজ্জা। বোনের জীবন তো ত্যানাত্যানা করবই সাথে তার চৌদ্দ গুষ্টির ঘুম এক্কারে হারাম কইরা ছাড়ব। হনহন করে চলে যায় পলাশ। আরজান অবাক চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। ভাই-বোন দুইটাই তার সামনে আসলে শুধু পালাই পালাই করে! সমস্যা কী এদের?
যাক এসব পরেও ভাবা যাবে। ঘরে প্রবেশ করে দরজায় খিল এঁটে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পায় রূপকথা বিছানায় বসে খুব মনোযোগ দিয়ে বিছানার ফুলগুলো খুঁটে খুঁটে দেখছে। তাকে দেখে শুধায়, “এতো ফুলের মাঝে ঘুমাবো কীভাবে?”
“বাসর রাতে বিছানায় ফুল থাকবে না তো কি পানি থাকবে?”
“বাসর?”
“হ্যাঁ, বাসর।” বলতে বলতে বিছানায় গিয়ে বসে আরজান।
রূপকথা পুনরায় কিছু বলার পূর্বেই তাকে একহাতে টেনে নিজের একদম কাছে এনে বসিয়ে দেয় আরজান।
রূপকথা চোখ বড়বড় করে তাকাতেই ধমকে ওঠে সে, “চুলে বিনুনি করা শিখব বলে তোমাকে কাছে এনেছি। এমনভাবে তাকাচ্ছো যেন বাসর অর্ধেক সেরে ফেলেছি।”
তার আরো কাছে গিয়ে এঁটে বসে রূপকথা। মুচকি হেসে বলে, “বিনুনি করো আর যাই করো মুখটা বন্ধ রাখিও তুমি, তাহলেই হবে।”
চোখ ছোট ছোট করে তাকায় আরজান। আবার অপমান!
চলবে,,,,,,
#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_24
রাতের আঁধার ছিন্ন করে আকাশের বুক চিরে আবির্ভাব ঘটেছে সূর্যের। সকলে নিজ নিজ কর্মে নেমে পড়েছে। সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি এসে হানা দিচ্ছে দুয়ারে দুয়ারে। জানালার ফাঁকা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে মৃদু আলো। বারবার কিছু একটা চোখেমুখে পড়াতে বিরক্ত হয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে ধরে আরজান। লেপটা ভালোমতো টেনে নিয়ে পাশ ফিরতেই কিছু দেখে চোখদুটো খিচে বন্ধ করে নেয়। ভুল দেখেছে সে, অবশ্যই ভূল দেখেছে। কিন্তু নিজের খুব কাছ থেকে কারোর নিশ্বাসের উষ্ণতা আর তীব্র ঘ্রান যেন তাকে মানতে বাধ্য করে সে ঠিক দেখেছে। তার খুব কাছে অবস্থান করছে তার হৃদয়ের রানি, তার জলরূপসী। তার সোনালি অবাধ্য চুলগুলোই এতোক্ষন তার চোখে-মুখে পড়ে বিরক্ত করছিল। নড়াচড়া করার ফলে লেপ পুরো তার শরীরে চলে এসেছে। যার কারনে ঘুমের মাঝেই শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছে রূপকথা। হাতরিয়ে হাতরিয়ে লেপ ধরে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। দ্রুত তার আরো কাছে এগিয়ে যায় আরজান। লেপ টেনে দেয় শরীর জুড়ে। উষ্ণতা পেতেই নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায় রূপকথার। পুনরায় ঘুমের গহীনে তলিয়ে গেছে সে। কী নিখুঁত মায়া তার ঘুমন্ত মুখখানাতে!
মুচকি হাসে আরজান। রাতে ভুলভাল পদ্ধতিতে বিনুনি করার ফলে পুরো চুল খুলে ছড়িয়ে পড়েছে বালিশ জুড়ে। সকাল করে এমন দৃশ্য যেন দিনটাকেই সুন্দর করে তোলে। সে আলতো করে একহাতে চুলগুলো গুছিয়ে দেয়। গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার মুখের পানে। হটাৎ আনমনে বলে ওঠে, “রূপ, আমায় ছেড়ে চলে যাবে তুমি?”
চলে যাওয়ার কথা মনে হতেই যেন মনটা তার বিষন্নতায় ভরে ওঠে। সে পুনরায় বলে, “আমার কথা কি মনে পড়বে তোমার? নাকি ভুলে যাবে অথৈ পানি পেয়ে? ভুলে যাবে এই ম্যাজিশিয়ানকে।”
হুট করে প্রফুল্ল মনটা কেমন বিষিয়ে উঠেছে। গলা ধরে আসছে কথা বলতে গিয়ে। খুবই আলতো করে তার মুখখানা ধরে বলে ওঠে, “তোমার রেখে যাওয়া এতো এতো স্মৃতি ভুলে থাকবো কী করে আমি? তোমার এই অগনিত মায়া কাটিয়ে ওঠা যে আমার পক্ষে সম্ভব নয় কখনোই। নিয়তি কি এতোটা নিষ্ঠুর হবে আমার উপর?”
গলা শুকিয়ে আসছে তার। তাকে ছেড়ে তার জলরূপসী চলে যাবে বহুদূরে ভাবতেই নিঃশ্বাসটা আটকে আসতে চাইছে যেন। হৃদয়টা যেন ধিক্কার দিয়ে জানান দিচ্ছে, “তুই ভুল করেছিস মায়ায় জড়িয়ে, ভুল করেছিস হৃদয়ের তালা ভেঙে।”
কিছুক্ষণ থেমে আবার ধরা গলায় বলে ওঠে, “জানো তো রূপ, আবেগের বয়স পেরিয়ে গেলে মানুষ হয়তো ভালোবাসা ভুলে যায় কিন্তু মায়া কাটিয়ে উঠতে পারে না রক্ত-মাংসের দেহটা কঙ্কালে রূপান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত।”
রূপকথা কি আদৌ কোনোদিন জানতে পারবে শক্ত আর গম্ভীর মানুষটাকে কেমন মোমের ন্যায় গলিয়ে দিয়েছে সে? তার ম্যাজিশিয়ানের এই অজস্র আবেঘন স্বীকারোক্তি কখনোই শোনা হবে না তার। জানা হবে না তার হৃদয়ের হাজারটা অব্যক্ত কথন। মানুষের অনুভূতি বদলানো কি এতোটাই সহজ? অথচ সে কী নিখুঁতভাবে বদলে দিয়েছে একটা মানুষকে। হাসতে শিখিয়েছে গম্ভীর মানুষটাকে। এতো এতো অব্যক্ত ভালোবাসার হদিস পাওয়া হবে না তার কোনোদিনই। সব ছেড়ে সে পাড়ি দেবে দূর সমুদ্রে। হারিয়ে যাবে তার ম্যাজিশিয়ানের জীবন থেকে।
ভালো লাগছে না আরজানের। উঁহু, মোটেই ভালো লাগছে না। তার রূপকে সে কোথাও যেতে দেবে না। আঁকড়ে রাখবে নাজের কাছে। প্রয়োজনে ঘর বাঁধবে কোনো নদীর তীরে। তবুও তাকে ছাড়বে না সে। যার ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাকে ছেড়ে বাঁচবে কী করে সে? কোথাও যাবে না রূপ, কোথাও না। যেতে দেবে না সে। অজান্তেই সে দু’হাতে আঁকড়ে ধরেছে রূপকথার মুখখানা। পুরো মুখ ভরিয়ে দেয় অজস্র চুমুতে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে ওঠে, “যাবে না তুমি, কোথাও যাবে না।”
রূপকথা নড়ে উঠতেই ছিটকে সরে যায় সে। হটাৎ কী ভেবে দ্রুত উঠে পড়ে। কোনোমতে ঘরে থাকা পানি দিয়েই ব্রাশ করে মুখ পরিষ্কার করে নেয়। অতঃপর শার্ট পড়ে বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে ব্যস্ত পায়ে ঘর ত্যাগ করে। বাইরে থেকে ভালো করে ভিড়িয়ে দেয় দরজাটা। অনেক কাজ বাকি তার, অনেক কাজ। বারান্দায় বসে বোনের সাথে গল্প করছিলেন সোফিয়া শিকদার। সাত সকালে ছেলেকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কোথাও যেতে দেখে অবাক হয় সে। আরজানকে ডেকে শুধায়, “কি রে? এতো সকালে কোথায় যাচ্ছিস? বৌমা উঠেছে?”
মায়ের কাছে এগিয়ে যায় আরজান। শার্টের হাতাগুলো গুটিয়ে রাখতে রাখতে উত্তর দেয়, “একটু কাজ আছে মা, আসতে দেরি হবে হয়তো। দুপুর নাগাদ চলে আসবো। রূপ এখনো ওঠেনি। ডেকে আর বিরক্ত করলাম না শুধু শুধু। এমনিও হাসপাতালে এ ক’দিন ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি।”
তার ছোট খালা মুখ বাঁকিয়ে বলে ওঠে, “বউদের এতো ঘুম কীসের রে? বেলা কতদূর গড়ালো তার হিসেব আছে? হাসপাতালে ক’দিনই বা ছিল।”
মুচকি হাসে আরজান। খালামণির উদ্দেশ্যে শুধায়, “এই নিয়ম কি তবে শুধু বউদের জন্যই প্রযোজ্য? কোথায়, লামিয়াকে তো দেখছি না? সে বুঝি এখনো ঘুমিয়ে আছে? বাড়ির মেয়েদের জন্য কী কী নিয়ম আছে তার একটা লিস্ট করে রেখো তো খালামণি, এসে দেখব।”
অকপটে বন্ধ হয়ে যায় তার মুখখানা। হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় আরজান। দজ্জাল শাশুড়িদের মতো কথা বলতে আসে শুধু শুধু।
বাইরে এসে ভ্যান ডেকে উঠে পড়ে। গন্তব্য পুলিশ স্টেশন। অফিসারটার সাথে তার অনেক আলাপ পড়ে আছে। তার মুখখানা তো দর্শন করতেই হবে। সে যে বেঁচে আছে সেই খবরটাও তো দিতে হবে। বেচারা নিশ্চয়ই এতোদিনে চিন্তায় চিন্তায় পাঁচ কিলো শুকিয়ে গেছে। কতো কষ্ট করে সে ডাকাতদলের কাছে খবরটা দিলো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। থানায় এসে ভ্যান থামতেই দৌড়ে সে ভেতরে ঢুকে পড়ে। আচমকা তাকে দেখে যেন ভূত দেখার ন্যায় চমকে ওঠে হাবিলদার। গলা ফাটিয়ে চিল্লিয়ে বলতে থাকে, “স্যার, আবার আইছে, আবার আইছে।”
হঠাৎ এমন চিল্লাচিল্লিতে বিরক্ত হয়ে এগিয়ে আসে পুলিশ অফিসার। আরজানকে দেখে সেও খানিক অবাক হয়। তার দিকে এগিয়ে গিয়ে শুধায়, “কী ব্যাপার? তুমি আবার এখানে?”
“আপনাকেই দেখতে এলাম। তা দিনকাল ভালো যাচ্ছে তো?”
হকচকিয়ে ওঠে অফিসার। থতমত খেয়ে বলে, “দিনকাল ভালোই যাচ্ছে। আমাকে আবার দেখতে আসার কী হয়েছে?”
“আমার বেঁচে যাওয়ার খবরটা নিশ্চয়ই পেয়েছেন? বেশি দুঃখ পেয়েছেন নাকি?” ভ্রু কুচকে শুধায় আরজান।
“মানে টা কী? কী বলতে চাইছো তুমি ছেলে? আমি তোমাকে মারতে চেয়েছিলাম? তোমার কথা আমি বলেছিলাম ডাকাতদলের কাছে?” তেতে উঠে বলে অফিসার।
“সে কথা আমি কখন বললাম? আপনি তো নিজেই নামতা পড়তে শুরু করে দিলেন দেখি। ছি! নিজের কথা কেউ নিজেই এভাবে বোকার মতো স্বীকার করে?” ব্যঙ্গ করে বলে আরজান।
এবার যেন হাতি কাদায় পড়ে যেমন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ঠিক সেভাবেই বোধশূন্য হয়ে ওঠে অফিসার। তেড়ে গিয়ে টেনে ধরে আরজানের শার্ট। চিৎকার করে বলে, “পুলিশের সাথে রংবাজি করিস?জেলে পুরে তোর সমস্ত রংবাজি ছুটিয়ে দিতে দুই মিনিটও সময় লাগবে না আমার।”
ধীরে সুস্থে শার্টটা ছাড়িয়ে নেয় আরজান। অতঃপর মনোযোগ দিয়ে শার্টটা পরখ করে দেখে নিয়ে বলে ওঠে, “যাক, একটা বোতামও ছেড়েনি। নাহলে শুধু শুধু জরিমানা ভরতে হতো আপনাকে।”
আবারো ছুটে আসে অফিসার। রাগান্বিত স্বরে বলে, “মস্করা করতে এসেছিস থানায়? কোন ধান্দায় এসেছিস সেটা সোজাসুজি বল?”
“আরেহ আরেহ! স্যার তো দেখি চেইত্তা গেছে। কে কোথায় আছিস? জলদি পানি আন।” বলতে বলতে চেয়ার পেতে বসে আরজান।
অফিসার রাগান্বিত হয়ে তার দিকে তেড়ে আসতে নিলেই মোবাইল বেজে ওঠে আরজানের। মোবাইলে মায়ের নাম দেখে সে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয় অফিসারকে। থেমে গিয়ে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে অফিসার। একটা সাধারণ ছেলে কি-না তার উপর খবরদারি করে! তাকে নিয়ে মস্করা করে!
আরজান মোবাইল রিসিভ করে কানে তুলে ধরতেই ভেসে আসে সোফিয়া শিকদারের আতঙ্কিত কন্ঠস্বর। সে খুব জোরে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “বৌমা,,,,,,,,।”
মুহুর্তেই হাহাকার করে ওঠে তার হৃদয়। আর কিছু বলার পূর্বেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।। ব্যস্ত হয়ে শুধায়, “কী হয়েছে রূপের? কিছু বলছো না কেন মা? বলো কী হয়েছে?”
আচমকা শব্দ করে কেঁদে ওঠে সোফিয়া শিকদার। ভরকে যায় আরজান। ব্যস্ত কন্ঠে বারবার শুধায়, “কাঁদছো কেন মা? আমাকে বলো, কী হয়েছে রূপের? তোমরা ঠিক আছো তো? রূপ কোথায় মা?”
কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শ্রবণগোচর হয় না আরজানের। সোফিয়া শিকদার কান্নাভরা কন্ঠেই বলে ওঠে, “তুই বাড়িতে আস তাড়াতাড়ি।”
“কিন্তু কী হয়েছে বলবে তো? রূপ ঠিক আছে?” উত্তেজিত কন্ঠে শুধায় আরজান। তবে না, আর কোনো উত্তর আসে না। ইতিমধ্যে কল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তার চিন্তার পাহাড় আরো বাড়াতেই যেন তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায় মোবাইলটা। চার্জ দেওয়া হয়নি সকালে যার ফলস্বরূপ এই অবস্থা। বারকয়েক মোবাইল জোর করে খুললেও এক মুহূর্ত সময় না দিয়ে তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পুনরায়। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা!
সে উত্তেজিতভাবে হন্তদন্ত হয়ে থানা থেকে বেরোতে নিলেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফিসার। তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে, “কি রে, বউ অন্য ছেলের সাথে ভেগে গেছে নাকি? তোর কি মুরোদ নেই বউ খুশি রাখার? নাকি তোর বউই এমন চরিত্রহীনা?”
চিন্তার মাঝে আচমকা এমন একটা বিশ্রি কথাতে হুট করে যেন মাথায় আগুন ধরে যায় আরজানের। অতিরিক্ত রাগের সাথে হটাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই অফিসারের বুক বরাবর লাথি বসিয়ে দেয় সে। ছুটে গিয়ে নিচে পড়ে অফিসার। হাবিলদার দ্রুত এগিয়ে আসতে নিলেই পকেটে হাত পুরে দেয় আরজান। বের করে আনে তার জাদুর সরঞ্জামের মধ্যে থাকা ছোট্ট লাঠিখানা। দু’বার তাতে ফুঁ দিয়ে ছুড়ে দেয় হাবিলদারের উদ্দেশ্যে। লাঠিটা হাবিলদারের ঠিক মাথা বরাবর গিয়ে থেমে যায়। কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তা শূন্যে ভেসে ভেসে আঘাত করতে থাকে হাবিলদারকে। ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে হাবিলদার। শূন্যে ভেসে থাকা লাঠির আঘাতের চেয়ে যেন ভয়টাই বেশি গ্রাস করেছে তাকে। সে থানার বাইরে ছুটোছুটি করতে করতে কাঁপা কাঁপা স্বরে বারংবার বিড়বিড় করছে, “ভূত! ভূত! কেডা আছ? বাঁচাও আমারে। ভূতে মাইরা ফালাইলো।”
এতো জোরে জোরে চিৎকার করার পরেও তা গ্রাহ্য করে না আরজান। উল্টো নিচে পড়ে থাকা অফিসারের কাছে এগিয়ে গিয়ে শার্ট টেনে কিছুটা এগিয়ে আনে তাকে। রাগান্বিত স্বরে হিসহিসিয়ে বলে, “আমাকে ডাকাতদলের কাছে মরতে পাঠানোর সমস্ত দায় একমাত্র তোর। তবুও তোকে কিছু বলিনি, ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার রূপের ব্যপারে আর একটা শব্দও যদি তুই উচ্চারণ করিস, তোকে জা’নে মে’রে ফেলব। আমাকে চেতিয়ে তুলিস না। আমি আরজান কোনো পুলিশ-টুলিশ মানি না। আর তোদের মতো জানো’য়ারদের তো বাঁচিয়ে রাখারও কোনো মানে নেই। মেরে রাস্তার কুত্তা দিয়ে খাওয়ালেও গ্রামের লোকজন টু শব্দটা পর্যন্ত করবে না। তোদের ব্যবহারে তাদের হৃদয় এমনিই বিষিয়ে আছে।”
অফিসারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। চলে যেতে নিয়ে পুনরায় ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “আমার রূপের চরিত্র নিয়ে কথা বলতেও নূন্যতম যোগ্যতা প্রয়োজন, যেটা তোদের নেই। সরকারের খেয়ে অপরাধীদের সাথ দিস আবার জনগণের উপরেই অন্যায়ভাবে চড়াও হয়ে যাস। এই গ্রামে ডাকাতদলের অবাধ চলাফেরার সাহস যুগিয়েছিস তোরাই। মূল্য চোকাতে হবে তোদের, অবশ্যই মূল্য চোকাতে হবে।”
কথা শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে যায় সে। ভ্যান ডেকে ছুটে চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখন একটাই চাওয়া, প্রিয় মানুষগুলো যেন ঠিক থাকে। কলিজা এতোটাই দ্রুতবেগে ধকধক করছে যেন বুকের শেকল ছেড়ে এখনি বেরিয়ে পড়বে। মায়ের কান্নার সেই শব্দটা বারংবার বেজে উঠছে কানের কাছে। তার মাকে সে এভাবে কাঁদতে দেখেছে বাবার মৃত্যুর পর। বাবাকে ভেবে রোজ তার মা কেঁদে ভাসাতো। প্রতি রাতে বালিশ ভেজাতো। মা হয়তো ভেবেছে তার ছেলে কিছুই জানে না। অথচ সে মায়ের কষ্টগুলো উপলব্ধি করেছে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। মাকে কাঁদতে দেখেও এগিয়ে যায়নি। স্বামীর মৃত্যুর শোক কি দুটো শান্তনার বাণীতে চোকানো যায়? উঁহু, কখনোই না বরং বেড়ে যায় কয়েকগুন। তারচেয়ে কেঁদে নিজের কষ্টটা হালকা করার পদ্ধতিটাই যেন সঠিক লেগেছে আরজানের কাছে।
অলোকপুর গ্রামের বিশাল মাঠ জুরে নজরে আসে শুধুই ফসলের ক্ষেত। তার কোনা দিয়ে বেয়ে গেছে একটি সুন্দর সরোবর যেটা স্থানীয়দের নিকট সাদাবিল নামেই পরিচিত। মাঠের মাঝ বরাবর অবস্থান করছে একটি সেচকল। যেটার সাহায্যে এই পুরো মাঠের সমস্ত জমিগুলোতে কৃত্রিম পদ্ধতিতে পানি দেওয়া হয়। তার ঠিক পাশেই টিনের একটা মাঝারি আকারের ঘর। ঘরটা মূলত তৈরি করা হয়েছে রাতে ফসল পাহাড়া দেওয়ার জন্য। তবে দুর্ভাগ্যবশত এটাই হয়ে উঠেছে কারোর অন্যায় কর্মকাণ্ড পরিচালনার আখড়া। যেখানে রাত নামলেই জমে ওঠে অপরাধের খেলা। খোলা মাঠের মাঝখানে বসে কিছু মানুষ খুব অবলীলায় অপরাধ সংঘটিত করে। তাদের দেখার মতোও কেউ নেই। কে থাকবে? এই ঘরের মালিকানা যে এলাকার গুণিজনের নিকট।
সেই ঘরে পেতে রাখা চকিটাতে গোল করে বসে রয়েছে কিছু পরিচিত মুখ। গ্রামের মানুষের কাছে তাদের মুখগুলো অতি পরিচিত। তবে তাদের এই অন্ধকার জগৎ ভীষণ অপরিচিতই বটে। তাদের কর্মের সময়সূচি রাতে হলেও আজ তারা দিনেই আড্ডা জমিয়েছে। তাদের সকলের হাতে একটি করে নেশার পানীয় ভরা বোতল রয়েছে। গ্রামের দিকে এই জাতীয় জিনিসের প্রচলন খুব একটা না থাকলেও শহরে এগুলোর ব্যবসা জমজমাট। তারা সকলে একত্রিত হয়ে মনের সুখে গিলে যাচ্ছে সেই পানীয়। একটা সময় পর নেশায় বুঁদ হয়ে একজন বলে ওঠে, “হাছাই জলপরি হয়? গেদাবেলা থেইকা খালি কেচ্ছাই শুইনা আইছি।”
অন্যজন কিটকিটিয়ে হেসে বলে, “আইজ দেখবার পারবি। মনের স্বাদ মিটাইয়া দেইখা লইবি।”
“শুধু কি দেখমু? খামু না? শরীলডা কী সুন্দর দ্যাখছোস? দেখলেই জিহ্বাই জল চইলা আহে।” লোভনীয় ভঙ্গিতে বলে সে।
প্রথমজন এবার জীভ ভিজিয়ে নেয় ভালো করে। অতঃপর বোতলটা ভালো মতো ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলে ওঠে, “শরীলের নেশা তো এই মালের চাইতেও ম্যালা বেশি টানে রে। না খাইয়া ছাড়মু নি? ট্যাকা পরে, আগে শান্তি।”
তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন গম্ভীর স্বরে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বলে ওঠে, “আহ! আস্তে! ভুলে যেও না এটা দিন। এখন মাঠে অনেক কৃষক আছে। তারা কেউ শুনে ফেললে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে।”
“আইলে ঐডারেও মা’ইরা দিমু, খেলা শ্যাষ।” কথাটা বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে তারা।
গম্ভীর লোকটার মুখশ্রী মুহূর্তেই লাল হয়ে ওঠে। আচমকা পাশে থাকা ছুড়িটা তুলে চেপে ধরে তার গলায়। রাগান্বিত স্বরে বলে, “খু’ন করতে করতে ডাল-ভাত হয়ে গেছে? জীবনের মায়া ফুরিয়ে গেছে বুঝি তোদের? নেশায় পড়ে ভুলে গিয়েছিস কার সামনে কী করছিস। আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে তোর এই কন্ঠনালীটাই উপরে নেব আমি।”
নিমেষেই কেটে যায় তাদের সমস্ত নেশা। শুকিয়ে আসে সকলের লোভে চকচক করা মুখশ্রীগুলো। বেশ খানিকটা সময় কেটে যায় কঠিন নীরবতার মাঝেই। ছুড়ি গলায় এসে ঠেকেছে, কথা বললেই ভবলীলা সাঙ্গ।
গম্ভীর লোকটা পুনরায় বলে ওঠে, “আমার লাগবে টাকা, শরীর নয়। খবরদার কেউ হাত বাড়াবি না ভুলেও। টাকার মেশিন নষ্ট হলে তোদের সবক’টাকে আমি মেরে পুঁতে দেবো ঐ বিলের পানিতে।”
ফট করে একজন বলে ওঠে, “হাতি বাঁইচা থাকলেও লাক ট্যাকা, মইরা গেলেও লাক ট্যাকা। জলপরির মতোন একটা জিনিসের দাম মরনের পরেও কমবো না। খাইয়া স্বাদ মিটাইয়া নিয়া মাই’রা ফালাইলেও ট্যাকার পরিমাণ এক চুল কইমা যাইব না।”
চলবে,,,,,