রুপালি মেঘের খামে পর্ব-১০

0
663

#রুপালি_মেঘের_খামে
লিখা- Sidratul Muntaz

১০.
সকাল সকাল বাড়িতে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেন ফুলবানু। তার অভিযোগ হলো অরা তার চোখে সুই গেঁথে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তিনি আর এই বাড়িতে থাকবেন না। হয় এই মেয়েকে বের করতে হবে, নয়তো তিনি নিজে বের হয়ে যাবেন।

ফুলবানুর কথা কেউ বিশ্বাস করল না। প্রথম থেকেই তিনি অরাকে অপছন্দ করেন। তাছাড়া সামান্য বিষয় নিয়ে তিলকে তাল বানানো তার স্বভাব!

” সুমন, ও আমার বাপ। আজকা এর বিচার তুই করবি। নাইলে এই বাড়িতে আমি কোনোমতেই থাকমু না। ”

সুমন সাহেব বললেন,” আচ্ছা আম্মা, এটা কি একটা কথা?বউমার মতো শান্ত মেয়ে আপনার চোখ গেলে দিবে? অন্যকেউ হলেও আমি বিশ্বাস করতাম৷ কিন্তু ও কেন এই কাজ করবে? ওর সাথে কি আপনার শত্রুতা?”

নীলিমাও স্বামীর সাথে সুর মিলালেন,” হ্যাঁ মা, তাইতো। অরা তো নিজের ঘর থেকেও বের হয় না। প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলে না। সে কেন আপনার ঘরে ঢুকে আপনাকে হুমকি দিবে?”

” আমি কি তাইলে মিথ্যা কইতাছি? আমি কি মিথ্যুক? ও আল্লাহ, ওই দুইদিনের মাইয়া লাইগা এখন আমার পোলাও আমার কথা বিশ্বাস করে না। ওই ডাইনি কালো জাদু করছে সবাইরে। আল্লাহগো…”

ফুলবানু মাতম করতে লাগলেন। খুব হৈচৈপূর্ণ একটা অবস্থা তৈরী হয়েছে। এদিকে অরা নিজের ঘরে এসে চুপচাপ শুয়েছিল। এতো চিৎকার শুনতে পেয়ে উঠে এলো। সে জানতো এরকম হবে। কিন্তু ফুলবানুর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তিনি সবসময় উল্টা-পাল্টা বলেন।

ঘর থেকে বের হয়ে কিছুই যেন হয়নি এমন একটা ভাব ধরে অরা জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে সামিয়া? দাদীমা এতো চিৎকার করছে কেন?”

সামিয়া অবাক হয়ে বলল,” তুমি কিছু জানো না?”

” কি জানবো?”

সুমন সাহেব বললেন,” সকালে তুমি কোথায় ছিলে অরা?”

অরা হাই তুলে বলল,” এখনি তো সকাল বাবা। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। দাদীমার গলার আওয়াজ শুনে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ। কি হয়েছে?”

নীলিমা বললেন,” কিছু হয়নি। তুমি যাও, ঘরে যাও।”

” সব ঠিকাছে তো, মা?”

নীলিমা ইতস্তত করে স্বামীর দিকে চাইলেন। সুমন সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,” হ্যাঁ সব ঠিকাছে। তুমি যাও।”

অরা যাওয়ার আগে একবার আঁড়চোখে ফুলবানুর দিকে চাইল। তিনি চোখ বড় করে এমনভাবে অরাকে দেখছেন যেন এখনি তাকে ভস্ম করে দিবেন চোখের আগুন দিয়ে। তিনি বুঝে গেলেন এই মেয়ে হচ্ছে শান্ত-শিষ্ট লেজবিশিষ্ট কালসাপ। একে শায়েস্তা করা এতো সহজ হবে না। কিন্তু তিনিও হার মানবেন না৷ এই ঘটনা তিনি অবশ্যই মনে রাখবেন।

তন্বি ভার্সিটিতে এসে খুব চমকাল। সে শুনেছিল ফাইজান ভাইয়া খুলনা গেছেন। কিন্তু তিনি ফার্স্ট ইয়ারের কোয়ান্টাম মেকানিক্স ক্লাস নিচ্ছেন। মেয়েটি কি তাহলে তাকে মিথ্যা বলেছিল? কি আশ্চর্য!

ব্রেকটাইমে তন্বি ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ছুটে গেল। সামির তার টেবিলে বসে এসাইনমেন্ট দেখছে। কয়েকজন ছাত্রী ছিল রুমে। তারা চলে যাওয়ার পর তন্বি ঢুকল।

সামির আন্তরিক হেসে বলল,” কেমন আছো, তন্বি?”

তন্বি তার কপালের চুল কানে গুঁজে নরম হাসল,” ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

সামির চেয়ারে আয়েশ করে গা এলিয়ে বলল,” ভালো। তুমি কি কিছু বলতে এসেছিলে?”

“আপনি তিনদিন ধরে ভার্সিটি আসছেন না, তাই আমি আপনার বাড়িতে গেছিলাম আজ সকালে। ভাবলাম আপনি অসুস্থ কি-না…”

সামির একটু গম্ভীর হয়ে বলল,” আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম।”

” হ্যাঁ সেটাই আমাকে বলেছে সামিয়া। ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আপনি যেই বইটা অনেকদিন ধরে খুঁজছেন… সেটা অরিজিনাল কপি আমি সংগ্রহ করেছি। সামিয়ার কাছে দিয়ে এসেছি। বাসায় গেলেই পাবেন।”

” বলো কি? অরিজিনাল কপি কোথায় পেলে?” সামিরের চোখ ঝলমল করে উঠল।

তন্বি লাজুক কণ্ঠে বলল,” বাবা লন্ডন থেকে নিয়ে এসেছে। আমি বলে দিয়েছিলাম।”

” থ্যাঙ্কিউ। তুমি আমার কত বড় উপকার করেছো সেটা হয়তো নিজেও জানো না।”

তন্বি হাসল৷ তার চোখে পানি এসে গেল খুশিতে। সামির বলল,”বাসায় এসো আবার।”

” ঠিকাছে, আসব।”

তন্বি এই কথা বলেও দাঁড়িয়ে রইল। সামির জিজ্ঞেস করল,” মনে হয় তুমি আরও কিছু বলতে চাইছো।”

” বাবা একদিন আপনার সাথে চা খেতে চেয়েছেন, স্যার।”

” তোমার বাবা?”

” জ্বী, আমি জানি আপনি ব্যস্ত। কিন্তু যদি কখনও সময় হয়…”

” ঠিকাছে, আমি আসব। জানিয়ে দিও কবে আসতে হবে।”

তন্বির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল,” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”

সে যাওয়ার আগে একটা অদ্ভুত কাজ করল। ইচ্ছে করেই চেয়ারে ঝুলানো ব্লেজারে নিজের স্বর্ণের কানের দুল আটকে দিল। কাল সে ভার্সিটি আসবে না। তাহলে অন্তত এই কানের দুল দেওয়ার বাহানায় সামির তাদের বাড়ি আসবে!

সন্ধ্যায় একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হলো। সামির বাড়ি ফিরে এলো। অরা রান্নাঘরে গিয়ে বলল,” মা, আজকে রাতের রান্নাটা আমি করি?”

নীলিমা অবাক হয়ে বললেন,” হঠাৎ রান্না করতে চাইছো কেন?”

” এমনি.. ইচ্ছে করছে।” অরা মাথা নিচু করে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

নীলিমা ব্যাপারটা বুঝে গেলেন। হাসিমুখে বললেন,” ঠিকাছে, তোমার ইচ্ছা হলে করো।”

অরা খুব আড়ষ্টতা নিয়ে ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করল সামির কি কি খেতে পছন্দ করে। ফিরোজা বলল তার নাকি খাসির মাংস খুব পছন্দ। চিংড়ীও সে পছন্দ করে। ফ্রীজে সবই আছে। অরা ঠিক করল সাদা পোলাও, রেজালা আর চিংড়ীর মালাইকারি রান্না করবে। ক্ষমা চাওয়ার জন্য এর থেকে ভালো সুযোগ আর হয় না।

রান্নার হাত অরার বরাবরই খুব ভালো। সে আগ্রহ নিয়ে সব রান্না-বান্না শেষ করল। ফুলবানু রাত আটটার মধ্যে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েন৷ তাই তাকে সবার আগে খাবার দেওয়া হয়। অরার রান্না করা খাবার ফিরোজা নিজের হাতে বেড়ে ফুলবানুর ঘরে নিয়ে এলো।

” খালাম্মা, আজকা নতুন বউ রানছে। খায়া দ্যাখেন।”

ফুলবানু মুখবাঁকা করে বললেন,” ওই নটিবেটির রান্না আমি খামু না। কেডা জানে বিষ মিশায় রাখছে কি-না?”

” ছি, ছি, এসব কি বলেন? বিষ কেন মিশাইবো?”

” তুমি ওরে চিনো না। আমি চিনি৷ ওই মাইয়া একটা ডাইনি।”

রাতে সামির জানিয়ে দিল, সে ডিনারে কিছু খাবে না। শুধু এককাপ কফি। অরার খুব মনখারাপ হলো। সে রেঁধেছে বলেই কি সামির খাবে না? কফিটা অরা নিজেই বানিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু তার খুব অস্বস্তি লাগছিল।

দরজার সামনে এসে কয়েক মিনিট অযথাই দাঁড়িয়ে রইল অরা। নিজের শরীরটাকে এতো ভারী আগে কখনও লাগেনি। একেকটা কদম ফেলতেও কি কষ্ট! কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সে ফিরে এলো। ফিরোজাকে দিয়ে সামিরের কফি পাঠিয়ে দিল তবু নিজে গেল না। ওই ঘটনার পর সামিরের সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও তার হচ্ছে না। সে সামিয়ার ঘরে এসে চুপচাপ বসে রইল।

” ভাবি, তোমার কি হয়েছে? তুমি নাকি এখনও ভাইয়ার সাথে দেখা করোনি?”

অরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আমি পারব না, সামিয়া। উনি হয়তো এখনও খুব রেগে আছে।”

” কি এমন হয়েছিল তোমাদের মধ্যে একটু বলবে প্লিজ? আমার ভাইয়া কখনও কারো সাথে এতো রাগ করে না৷ সে তিনদিন ধরে বাড়ি আসেনি।”

অরার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। কি হয়েছিল সেই কথা সামিয়াকে বলা সম্ভব নয়। কাউকেই বলা সম্ভব নয়।সামিয়া তার হাত ধরে বলল,” তুমি এসো আমার সাথে। আমি তোমাকে ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”

” না, প্লিজ। আমি যাবো না।”

” আহা, এসো তো।”

সামিয়া অরাকে নিয়ে সামিরের ঘরের দিকে যেতে নিচ্ছিল। তখন সায়ান এসে উপস্থিত হলো। অরার উদ্দেশ্যে বলল,” ভাবি, এখনও রেডি হওনি তুমি? নয়টা বেজে যাচ্ছে। আমাদের বাস তো এগারোটায়।”

অরা বিস্মিত হয়ে বলল,” কিসের বাস?”

” ভাইয়া কি তোমাকে কিছু বলেনি?”

অরা তাকিয়ে রইল হাঁ করে। সামিয়া বলল,” ভাইয়া বলেনি। তুমি বলো, কি হয়েছে?”

সায়ান ইতস্তত করে বলল,” আমরা তো চট্টগ্রাম যাচ্ছি। ভাইয়া টিকিট কেটে এনেছে। আমাকে বলেছে ভাবিকে পৌঁছে দিতে।”

অরা নির্বাক হয়ে গেল। সামিয়া ভ্রু কুঁচকালো,” মানে কি? আজকে মাত্র ভাইয়া এলো। আর আজকেই ভাবি চলে যাবে? আমরা তো এই বিষয়ে কিছুই জানি না!”

অরা কয়েকমুহূর্ত চুপ থেকে হাসার ভাণ করে বলল,” আমি জানতাম….. ভুলে গেছিলাম।”

” সত্যি ভাবি? তুমিও জানতে?”

অরা ইচ্ছাকৃতই মিথ্যা বলল,” হুম।”

সায়ান বলল,” তাহলে দ্রুত রেডি হও ভাবি। আমি উবার কল করেছি। আসতে বিশমিনিটের মতো লাগবে।”

সামিয়া বিষয়টা মানতে পারছে না। অসহিষ্ণু গলায় বলল,” তুমি কেন যাবে? ভাবির সাথে বড়ভাইয়া গেলেই তো পারে।”

সায়ান চোখ গরম করে বলল,” ভাইয়ার এখানে কাজ আছে, তাই ভাইয়া যাবে না৷ তাছাড়া ভাবি তার ফ্যামিলিকে মিস করছে। আমি গেলে তোর কোনো অসুবিধা আছে?”

” তোমার মতলব কি বলোতো? চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য হঠাৎ খুব উৎসাহী মনে হচ্ছে! ভাবি, ওর হাব-ভাব কিন্তু আমার একটুও সুবিধার লাগছে না। আর মা-বাবা কি এসব জানে?”

অরার পা টলছে। চোখের পানি বাঁধ মানছে না। সামির এমন কেন করল? সে অরাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই টিকিট কেটে এনেছে৷ অর্থাৎ অরা এই বাড়িতে থাকুক এটা সে চায় না!

আলগোছে চোখ মুছে অরা বলল,” সায়ান ভাই, তুমি অপেক্ষা করো। আমি রেডি হচ্ছি।”

” ঠিকাছে ভাবি।”

ব্যাগ গুছানোর সময় অরার মনে পড়ল হঠাৎ সামিরের একটা জিনিস তার কাছে আছে। তন্বির আনা রঙিন প্যাকেটটা সে বের করল৷ এটার ভেতরে কি আছে জানার খুব কৌতুহল হলেও সে খোলেনি। খুলতে হলে প্যাকেটটা ছিঁড়তে হবে। তখন সামির বুঝে যেতো। অরা যাওয়ার সময় সামিয়ার কাছে প্যাকেটটা দিয়ে বলল,” সকালে একজন এসেছিল। সে তোমার ভাইয়াকে এটা দিতে বলেছে।”

সামিয়া আগ্রহের সাথে প্যাকেটটা হাতে নিল। কৌতুহলী কণ্ঠে শুধাল,” কি এটা?”

” আমি জানি না। ”

” ভাইয়া আমাকে একটা বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিল। এটাই মনে হয় তাহলে।”

অরা ভারী কণ্ঠে বলল,” হতে পারে। হয়তো খুব ইম্পোর্ট্যান্ট জিনিস। আমার থেকেও বেশি!”

সামিয়া মনখারাপের দৃষ্টিতে চাইল। অরার কাঁধে হাত রেখে বলল,” এভাবে বলছো কেন ভাবি? আমরা তোমাকে অনেক মিস করব। প্লিজ, দ্রুত ফিরে এসো!”

অরা হাসার ভাণ করে মাথা নাড়ল। নীলিমা আর সুমন সাহেবের থেকে বিদায় নিতে গেল সে। তারা খুব অবাক হয়েছেন যাওয়ার কথা শুনে৷ কিন্তু অরাকে বাঁধাও দিতে পারলেন না। মেয়েটার এমনিও মন খারাপ। বাড়ি গেলে যদি মনটা ভালো হয়, ক্ষতি কি? সামির হয়তো সেটা বুঝেই টিকিট কেটে এনেছে। নিজে যেতে পারছে না বলে ছোটভাইকে পাঠাচ্ছে। সবাই এমন ভাবলেও শুধুমাত্র অরাই জানে, এখানে ব্যাপারটা ভিন্ন৷ সামির সেদিনের ঘটনার প্রতিশোধ নিচ্ছে।

অরাও কিছু না বলে যেতে রাজি হয়ে গেল। সামির চাইছে না যেহেতু, সেও থাকবে না এখানে। চলেই যাবে। কিন্তু যাওয়ার আগে একবার ভাবল সামিরের সাথে দেখা করবে। শেষবার ক্ষমা চাইবে। ঘরে ঢোকার সময় দরজার ফাঁক থেকে দেখল সামির তন্বির প্যাকেটটা খুলছে৷ তার ঠোঁটে লেগে আছে মুচকি হাসি। অরা যে চলে যাচ্ছে এই নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা নেই বললেই চলে৷ অরা আর ভেতরে না ঢুকল না। তার চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে