গল্পের নাম : #রাত_বিকেলে_প্রেমের_কুঞ্জন
লেখিকা: #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্ব : ১ (সূচনা পর্ব)
_ “বাবা শেষমেশ এক ধর্ষি*তা মেয়ের সাথে তুমি আমার বিয়ে দিতে চাইছ। এই বিয়ে করতে আমি পারব না।”
বিয়ে বাড়িতে বরের কবুল বলার ঠিক আগ মুহূর্তে এমন কথা শুনে সবাই চমকে যায়। কথাটা শুনা মাত্রই রফিক আহমেদ তার বড় ছেলের গালে ঠাসস করে একটা চড় মেরে দেন। ইতোমধ্যে অনেকে কানাঘুসো করা শুরুও করে দিয়েছে। একজন মহিলা তো বলেও উঠল, ” এই মেয়েকে তো সবাই ভালোই জানতাম। আহারে বেচারির সাথে এমন কাজটা কে করেছে। আমরা তো এসব ব্যাপারে কিছু শুনলামই না।”
নিজের মেয়ের সম্পর্কে এসব কথা শুনে আর ঠিক থাকতে পারলেন না রহিমা বেগম। মুখে আচল দিয়ে কাদতে লাগতেন। তিনি আগেই তার ভাইকে বলেছিলেন একমাত্র মেয়ের বিয়েটা সে খুব সাদামাটা ভাবেই দিয়ে দিতে চান। যেন এসব বিষয় জানাজানি না হয়। কিন্তু ভাইয়ের জোড়াজুড়িতে তার ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে এত অনুষ্ঠান করে দিতে সে রাজি হয়েছে। রফিক আহমেদ সেই মহিলাকে ধমক দিয়ে উঠলেন।
রফিক : কিসব যাতা বলছেন। এমন কিছুই হয়নি মধুমিতা( রহিমার মেয়ে) এর সাথে।
রায়হান ( রফিকের ছেলে ) : খামাকা ওনাকে চুপ করিয়ে কি লাভ বাবা। উনিতো ঠিকই বলছেন। তোমরাইতো এতো বড় বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছো।
রহিমা : বাবা রায়হান। চুপ থাক বাবা। আমি তোর ফুপু তোর পায়ে পরি। এসব মিথ্যে অপবাদ আমার মেয়ের নামে তুই দিসনা।
রায়হান : মিথ্যে কেনো বলছ ফুপি। বলো তোমার মেয়েকে রিয়াদ নামের ছেলেটা উঠিয়ে নিয়ে যায়নি। রাখেনি নিজের কাছে একরাত। কিছু না করে ছেড়ে দিয়েছে বুঝি?
শুরু হলো সবার মাঝে তর্কাতর্কি। এতসব কিছুর মাঝেও একজন চুপ করে বসে চেয়ে আছে তাদের দিকে। পায়ে তার আলতা, হাত ভর্তি মেহেদী। গয়না দিয়ে পা থেকে মাথা অব্দি ভরপুর। চোখে টানা কাজল। গায়ে বিয়ের বেনারসি। মধুমিতার এসব আর কিছুই ভালো লাগছে না। বাবা বেচে থাকলে হয়ত এখন এসব তার সহ্য করতে হত না। উঠে এক দৌড়ে বিয়ের স্টেজ থেকে নেমে দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল সে। রহিমা বেগম দেখেও কিছু বলছেন না। সে জানে এখন কি হবে। গিয়েও কোনো লাভ নেই। রফিক ইতোমধ্যে বিয়ে বাড়ি থেকে সবার কাছে মাফ চেয়ে তাদের চলে যেতে বলেছেন। আর রায়হানকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে বলেছে চোখের সামনে থেকে চলে যেতে। তবে পাড়ার আন্টিরা যেতে অনিচ্ছুক। তাদেরতো এখনো কাটা গায়ে নুনের ছিটে দেয়া বাকি।
………..
মধুমিতা রুমের দরজা লাগিয়ে সেখানে বসেই কাদতে লাগল। আর জীবনের হিসেব কষতে লাগল।
মধুমিতা জাহান তুলি। কিছুদিন হয় এবার অনার্স ফাস্ট ইয়ারে উঠেছে। ঢাকা মেডিকেল এর ছাত্রী। ছোট থেকেই খুব চনচল ও মেধাবী। লম্বা, চেহেরা অনেক ফর্সা না হলেও মায়াবী। মধুমিতার বাবা নেই। মায়ের সাথে মামার বাড়িতেই ছোট থেকে বড় হয়েছে সে। দাদার বাড়িতে মাঝে মাঝে যাওয়া হয় তাদের। রায়হান হলো তার মামার বড় ছেলে। একসময় এই রায়হানই মধুমিতাকে পাওয়ার জন্য ছিল পাগল। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এই ছেলেই সবার সামনে মধুমিতাকে নিয়ে এত বড় একটা কথা বলে দিল। কথায় আছে না, মানুষ চেনা যায় বিপদে।
কিছুদিন আগের ঘটনা। রিয়াদ নামের পাড়ার এক বখাটে ছেলে মধুমিতাকে খুবই বিরক্ত করত। একদিন মধুমিতা সহ্য করতে না পেড়ে ভার্সিটির সবার সামনে তাকে চড় মেরে দেয়। এইটা যেন কাল হয়ে দাড়ায় তার জন্য। রিয়াদের ইগো হার্ট হয়। সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরার সময় মধুমিতাকে জোড় করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় রিয়াদ। এক হোটেলে অজ্ঞান করে নিয়ে যায় ওকে খারাপ কিছু করতে। তবে হয়ত সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিল মেয়েটার, ঐদিনই সেই হোটেলে ড্রা*গস খুজতে একদল পুলিশ আসায় সবাইকে ধরে নিয়ে যায়। মধুমিতাকে অতিরিক্ত ডোজ দেয়ার ফলে তার জ্ঞান ফিরতে সকাল হয়ে যায়।
এদিকে রহিমা মেয়েকে না পেয়ে যেন পাগল প্রায়। মধুমিতাকে বাসায় এনে রফিক ঠিক করে পাড়ায় এসব কিডন্যাপিং এর বিষয় ছড়ানোর আগেই তাড়াতাড়ি নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে মধুমিতার। তবে রায়হান এর মধুমিতার সতীত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ। এখন আর তাই সে মধুমিতাকে বিয়ে করতে চায়না। তবে মধুমিতা অনেকবার তাকে রিজেক্ট করেছে। সেই প্রতিশোধ নেয়াটা এখনও বাকি। তাই বিয়ে বাড়িতে এত কাহিনী করল সে।
………
“দেখলে গো ননদিনী, বিয়ে বাড়িতে সবার সামনে কি কান্ডটাই না হলো। এখন হয়ত তোমার মেয়েকে আর কেউ বিয়ে করবে না।”
হালিম বানানোর জন্য মাংস গুলো কে*টে কে*টে টুকরো করছিল রহিমা। তখনই রায়হানের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে থেমে যায় সে। এসব কিছুর পিছে যে রায়হানের মায়েরও হাত আছে তা খুব ভালো করে জানে রহিমা। নিজের বোনের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে না পাড়ার ক্ষোপটা হয়ত এখন ছাড়বে সে। রহিমা আর তার মেয়েকে কখনোই সহ্য করতে পারত না রায়হানের মা।
তাই এই বাড়িতে থাকতেও চায়নি রহিমা, তবে ভাইয়ের জোড়াজুড়ি তে বছরের বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকা হয় তার। মাঝে মাঝে শশুর বাড়ি গিয়ে সবার সাথে দেখে করে আসে সে। শশুর বাড়ির সবার সাথে তার সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। তবে সেখানে থাকলে যে বারবার *মৃত স্বামীর কথা মনে পড়ে।
তাই তারাও রহিমাকে তেমন জোড় করেনি সে বাসায় বেশিরভাগ থাকতে। কিন্তু সে বাড়ির দরজাটা সবসময় খোলা এই মা মেয়ের জন্য। বিয়েতে অবশ্য তারা কেউ আসেনি। এর একটা কারণ আছে। তারা কেউই রায়হানকে তেমন পছন্দ করত না। তবে এসব ভাবার বা কারো কথায় কান দেয়ার সময় নেই। ওদিকে মেয়েটা সারাদিন না খেয়ে আছে। তাইতো নিজ হাতে মধুমিতার পছন্দের হালিম বানাতে এসেছিল রহিমা। তাই নিজের কাজে আবার লেগে গেল।
………
“মধু। মা আমার। দরজাটা খুলতো। দেখ তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।” রহিমার কথায় হালকা নড়ে বসে মধুমিতা। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে বাহিরে অন্ধকার। রাত হয়ে গিয়েছে বুঝি? সময় কখন কাটলো বুঝতেই পারেনি সে। এখনো তার গায়ে বিয়ের সাজ। আস্তে করে উঠে দরজাটা খুলল সে।
মধুমিতা : মা।
মা ডাকটা শুনে যেন আত্মা কেপে উঠল রহিমার। কতটা যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে এই ডাকটার পিছনে। মেয়েটির চোখ মুখ ফুলে একাকার। কেদেছে হয়ত খুব। তবে রহিমাকে এখন ভেঙে পরলে চলবে না। তাকে শক্ত থাকতে হবে। মেয়েকে জোড় করে খায়িয়ে দিতে লাগল সে। মধুমিতাও না করতে পারল না। পেটে যে একটা দানাও পরেনি সকাল হতে।
মধুমিতা : মা। সবাই কি তোমাকে আমায় নিয়ে কথা শুনিয়েছে।
রহিমা : কিসব বলছিস। কে কি বলবে। আর তোর মার হাতে এত ফালতু সময় কোথায় বলতো?
মধুমিতা : আমি এখানে আর থাকতে চাইনা মা।
রহিমা : তুই চিন্তা করিসনা মা। কারো কোনো কথা তোকে শুনতে দিব না আমি। কালকেই তোর দাদুবাড়ি গিয়ে উঠব আমরা। সেখানে সবাইকে আমি সব জানিয়ে দিয়েছি। তোর বড় চাচা, ফুফু, তোর দাদি সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
মধুমিতা : আর মামাহ?
রহিমা (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) : তাকেও অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। এখন খেয়ে ঘুমিয়ে পরতো চুপ করে।
মধুমিতা মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। আর রহিমা হাত বোলাতে থাকে মেয়ের মাথায়। পরেরদিন সকালে তারা গিয়ে হাজির হয় মধুমিতার দাদুর বাড়িতে। ওনারা সবাই গ্রামেই থাকে। থাকবে নাই বা কেন? ওনারা তো জমিদার বংশ। গ্রামের প্রধান। সবার ভালোমন্দ তো তারাই দেখে।
বাড়ির সামনে নামতেই রহিমার যেন আর তর শইছে না। ভাবিকে মনের সব কথা বলে নিজেকে হালকা না করলে যে থাকতে পারবে না সে। তাই মধুমিতাকে রেখে নিজেই ব্যাগ নিয়ে আগে ডুকে গেল বাড়িতে। মায়ের কান্ড দেখে মধুমিতাও হেসে দিল। অনেকদিন পর গ্রামের গাছগাছালি পুকুর এসব দেখে তারও ভালো লাগছে খুব।
সেও তাই এদিক ওদিক তাকিয়ে ঢুকতে যাবে তখনই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিল। সে যাতে পড়ে না যায় তাই সামনের লোকটির শার্ট খামছি দিয়ে ধরল। ওদের মাথার উপর মধুমিতার ওড়না এসে পড়ে দুজনকে ডেকে ফেলেছে একদম। এমন সময় সামনের ব্যক্তিটির কন্ঠ শুনতে পায় মধুমিতা।
“ইউ স্টুপিড। কে তুমি? দেখে চলতে পারো না। আর আমার বাড়িতে চোরের মতো ঢুকছো কেন” ~
# চলবে কী?