#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-০৯
মিঠি ভেবেছিল, মামা-মামী ওর উপর ভীষণ রাগ করে থাকবেন। বাসায় যাওয়ার পর দুই কথা শুনিয়েও দিতে পারেন। কিন্তু ও’কে অবাক করে দিয়ে, তারা কেউ বাজে কোনো কথাই বলল না। বরং হৈচৈ করলেন এমনভাবে যেন মিঠি শ্বশুর বাড়ি থেকে প্রথম এলো! মিঠির মন খারাপ হয়ে গেল। এরকম দু’জন মানুষকে সে কী করে কষ্ট দিতে পারল! তার এই ভুলের কোনো প্রায়শ্চিত্ত কী নেই! তার দ্বারা এই ভুলগুলো না হলে কী খুব ক্ষতি হতো! মামা বাজারে গেলেন। মিঠি এসেছে,ওর জন্য বড় একটা মাছ কিনে আনতে হয়। কতদিন মেয়েটা অন্যের ঘরে ছিল,কী খেয়েছে না খেয়েছে! মামী পাশের বাসার রুনু আপাকে নিয়ে হাতে কাটা সেমাই পিঠা বানাতে বসলেন। মেয়েটার বড় পছন্দের। অন্যকিছু না খেতে চাইলেও এটা অন্তত খাবে! মিঠি ঘরে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে বাইরে এসে দেখল এলাহি কাজকারবার। মামীর খুশি যে প্রাণে আঁটছে না,তা দূর থেকে কতক্ষণ চুপচাপ দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে মামীর পাশে বসল।
-এসবের কী খুব দরকার মামী? আমি কী মেহমান তোমাদের?
-ধুর পাগল মেয়ে! মেহমান হবি কেন? তুই তো আমাদেরই মেয়ে! কতদিন পরের ঘরে ছিলি। ওখানে কেমন থেকেছিস কী জানে।
মিঠি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হালকা গলায় প্রশ্ন করল,
-মামী,তুমি আমার উপর রাগ করে আছো?
মামী পিঠা কাটছিলেন, মিঠির করা প্রশ্ন শুনে থেমে গেলেন। হতভম্ব চোখে মিঠির দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎই হেসে ফেললেন। বললেন,
-রাগ করে থাকবো কেন?
-আমি যে ভুল করেছি!
-ভুল তো মানুষের দ্বারাই হয় রে। আমরাও তো ভুল করেছি। তোকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিছি। যদি এটা না করতাম, তবে কী এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো?
মিঠি নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। মামী হতচকিত, হৈহৈ করে উঠলেন।
-আরে,কাঁদিস কেন! ইশশিরে.. বন্যা বানিয়ে ফেলবি দেখছি। এই চুপ,একদম চুপ! কাঁদিস না তো মিঠি। এবার কিন্তু সত্যি সত্যি রাগ করব!
মিঠি কান্না থামিয়ে নাক টেনে বলল,
-সজল আমার জন্য ভালো হতো না মামী। তোমরা সেটা বুঝতে পেরেই ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছিলে আমার। আমি বরং সেসবের পাত্তা না দিয়ে সবার মান সম্মান ডুবিয়ে সজলের কাছে চলে গিয়েছিলাম। অথচ আমি যে ওরকম বাজে একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো,তা কোনোদিন ভাবিনি।
মামী ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। সে শুধু জানে,মিঠি বিয়ের পর পালিয়ে প্রভাদের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। কিন্তু ও যে সজলের কাছে গিয়েছিল প্রথমে,তা জানতেন না। সহসা প্রশ্ন করে উঠলেন তিনি,
-আমাকে খুলে বল দেখি.. কী হইছে?
মিঠি ক্ষণ মুহূর্ত চুপচাপ ভাবল, বলবে কী বলবে না। ভেবে ঠিক করল, সে সব খুলেই বলবে৷ আর মিথ্যা নয়। আর কাদের থেকেই বা লুকোবে সে। এরা যে তার সবচাইতে আপনজন! মিঠি ধীরে ধীরে সবকিছু খুলে বললে মামীর কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হলো।
-মিঠি,সত্যি করে বল,তোর কোনো সর্বনাশ…
-না মামী, সত্যি বলছি, আমার সাথে আজেবাজে কিচ্ছু হতে পারে নাই। সজল হতে দেয় নাই। ও আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ঠিক, কিন্তু আমার সাথে পশুর মতো আচরণও করে নাই। উল্টো ওই ছেলেটা, বাদল নাম, ও’কে থামাতে গিয়ে মাইর খাইছে৷ ওই ছেলেটাই আসল নাটের গুরু। ওর জন্যেই আমার একটা খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হলো। সবাইকে ফুঁসলিয়েছে ও৷ সাথে যে দু’জন ছিল, ওই দুটোর চাইতেও বেশি দোষ ওর। আমি যদি একবার ও’কে সামনে পেতাম..!
মিঠি দাঁতে দাঁত ঘষলো। মামী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পিঠা বানাতে মনোযোগ দিলেন।
-শোন মা,জীবনটা অনেক কঠিন রে। মাথার উপর বড়দের ছায়া থাকবে যতক্ষণ,ততক্ষণই জীবনের সব সমস্যা সহজ হয়ে যায়। ভুল করে হলেও শিক্ষা পেয়েছিস তো! এই শিক্ষাটা অনেক বেশি জরুরি ছিল তোর জন্য। মাথায় রাখিস ঘটনাটা৷ এরপর থেকে কোনোকিছু করতে গেলে হাজারবার ভাবিস। আমাদের কথা না ভাব,অন্তত নিজের কথাটা আগে ভাবিস!
মিঠি চুপ করে রইলো। একটুপর মিনমিন করে মুনীফের প্রসঙ্গ তুললো।
-মামী, উনি..উনি এসেছিলেন এই বাসায়?
মামী তাকালেন, ‘উনি’ বলে কাকে সম্বোধন করা হয়েছে বুঝতে পেরে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। জবাবে বললেন,
-হুঁ,আসছিল।
-খুব চিৎকার চেঁচামেচি করছে?
-না। ছেলেটা ভালো। এসে শুধু তোর কীর্তিকাহিনী জানালো। তারপর বলল, এই সম্পর্কের কোনো মানেই হয় না। তুই যখন তোর পথ নিয়েছিস তখন সে-ও নিজের পথ বেছে নিবে। আর তোকে সে মানলে তার পরিবার মানবে কীনা সন্দেহ। সুতরাং তোর জন্য পরিবারের ভেতর আরও হাঙ্গামা দাঙ্গা করে লাভ কী! এছাড়া তুই যে আবার কখনো এরকম কাজ করবি না,তারই বা গ্যারান্টি কী? তাই সে তোর সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে নতুন পথে পা বাড়াতে চায়৷ এতেই নাকি সবার ভালো।
মিঠি আনমনে বলল,
-আমি আর কখনো তাকে অসম্মানিত করব না মামী।
-সেটা আমাকে বলে লাভ কী রে মা? যাকে বলার তাকে গিয়ে বল।
-আমি উনার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম মামী। আমাকে ফিরিয়ে নিতে বলতাম না,শুধু ক্ষমা চাইতাম। অথচ সে আমাকে ক্ষমা চাওয়ারও সুযোগ দিলো না। আমার সাথে কথাই বলল না!
মিঠির মুখ মলিন, মামীর ভয় হলো। মুনীফের প্রতি আবার কোনো দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে না তো মেয়েটার! মামীর কানে খবর এসেছে,ছেলেটার জন্য পাত্রী ঠিক করা হয়েছে৷ খুব দ্রুত সে আবার বিয়ের পীড়িতে বসবে। একটা ঝটকা খেয়ে নিজেকে সামলে নিতে পারলেও এই ঝটকা সইতে পারবে তো মিঠি? সব ভুলে পারবে কী জীবনে এগিয়ে যেতে? নাকী নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় নিজের অধিকার চাইবে মুনীফের কাছে? যদি এমনটা হয়,তবে খুব খারাপ হবে! একটা বড়সড় ঝামেলা সৃষ্টি হবে দুই পরিবারের মাঝে৷ মামী বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। কোনোপ্রকার ঝামেলা তিনি চান না। তাই মিঠির ভেতরে কী চলছে তা জানতে তিনি প্রশ্ন করলেন,
-হ্যাঁ রে মিঠি,একটা সত্যি কথা বলবি?
-কী মামী?
-মুনীফকে কী তুই পছন্দ করিস? নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার প্রতি কোনো দুর্বলতা তৈরি করছিস?
মিঠি তাচ্ছিল্য করে হাসল।
-করলেই বা কী! সে যে আমার ভাগ্যে নেই, আমি জানি। একদিনের জন্য হলেও তার মতো মানুষের স্ত্রী হতে পেরেছিলাম,এটাই সৌভাগ্য আমার! আর কিছু চাই না। শুধু শেষবার তার সাথে একটু কথা বলতে চাই। আমার যে খুব জরুরি কথা আছে উনার সাথে।
-কী এমন জরুরি কথা?
মিঠি জবাব দিলো না। সিথির সাথে বাদলের কীরকম সম্পর্ক তা না জেনে কাউকে কিছু বলাটা কতটুকু সমীচীন কে জানে! মিঠি কথা ঘুরাতে বলল,
-না মামী,এমনিই। ক্ষমা চাইবো উনার কাছে। এটাই..
মামী মৃদু শ্বাস ফেলে বললেন,
-ছেলেটাকে ফোন করে আসতে বলি?
মিঠির চোখ চকচক করে উঠলো।
-উনি কী আসবে?
-আমি জানি না। তবে চেষ্টা করে দেখবো। তবে তাকে বোঝানো যাবে না যে বাড়িতে আছিস। বলব যে তালাকের বিষয় নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। একটু যেন আসে। তাহলে আসতে পারে।
মিঠি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। উদাস চোখ মেলে আকাশ দেখল। ‘তালাক’ শব্দটার কত ক্ষমতা! একবার বলাতেই দুটো মানুষের মাঝের সমস্ত সম্পর্ক গুড়িয়ে ভাঙচুর করে দেয়! বুকটা কাঁপছে মিঠির। ইচ্ছে করছে,মুনীফের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভেঙেচুরে কেঁদে ফেলতে। হাতজোড় করে আর একটি বার সুযোগ চাইতে। কিন্তু সে জানে,মুনীফ আর কোনোদিন তাকে সুযোগ দিবে না!
____
-দাঁড়া…
ঘরের ভেতর ঢুকতেই বড় ভাইয়ের গম্ভীর কণ্ঠস্বর সিথির পিঠ দিয়ে ভয়ের শিহরণ বইয়ে দিলো। সিথির পা জোড়া থমকে দাঁড়াল, চোখে ভীতি, ঠোঁট কাঁপছে একটু একটু করে। সিথি নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করে চুপটি রইলো।
মুনীফ এগিয়ে এসে সিথির মুখোমুখি দাঁড়ায়। বিজ্ঞ চোখজোড়া দিয়ে সিথির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ শেষে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,
-কোথায় গেছিলি?
সিথি ঠোঁট ভেজায়। ঢোক গিলে জবাব দিলো,
-এইতো,একটু সামনে।
-বর্ষার ভাইকে কেন আসতে বলেছিস?
সিথি চমকালো। সে তো বর্ষার ভাইকে আসতে বলেনি। ছাদ থেকে যখন বাদলকে তাদের বাসার সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখল, তখন না ডেকে পারল না সে। এক দৌড়ে নিচে নেমে কোনোমতে তাকে ডাকতেই বাদলের মিষ্টি হাসি চোখে পড়ল এবং তৎক্ষনাৎ আরও বিগলিত হয়ে উঠল মন। এরপর দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরেই চলে গিয়েছিল। কিন্তু এই কথা ভাইয়া জানলো কী করে,তা ভেবে পাচ্ছে না সে। সিথিকে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুনীফ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। বলল,
-কান্ডজ্ঞান কী কোনোদিন হবে না? মেহমানকে নিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে কথা বলে কেউ? তাকে ঘরে ডেকে আনবি না!
সিথি স্বস্তি পেল। মেকী ধমক দিয়ে বলল,
-তাকে আমি বলছি না! সে না আসলে আমার দোষ? তুমি শুধু শুধু আমাকে বকা দিলে ভাইয়া।
-বারান্দা থেকেই তোদের দুটিতে দেখেছি আমি। ভেবেছিলাম তুই তাকে ডাকতে গেছিস। কিন্তু কথা বলতে বলতে যে অন্যদিকে চলে যাবি,তা ভাবিনি।
-আসলে এই সেই ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম একটু। সে তো তোমাদের বিয়ে নিয়ে দারুণ এক্সাইটেড। আমাকে শোনালো কী কী প্ল্যান করেছে তা সম্পর্কে। আমিও বললাম আমার প্ল্যানিং সম্পর্কে। এসব বলতে গিয়েই দেড়ি হয়ে গেল আর কী।
মুনীফ বলল,
-যাইহোক,এরপর কখনো দেখা হলে বাসায় ধরে নিয়ে আসবে। আমার হবু শালা সে। তাকে যথেষ্ট আপ্যায়ন না করলে কী হয় বল!
সিথি হাসলো। মুনীফের ফোনটা বেজে উঠলে সে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল।
____
প্রায় এক মাস পর মিঠিকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে উঠল মুনীফ। যদিও সেটা প্রকাশ করল না। ঈষৎ কুঁচকানো কপাল বিরক্তির আভাস দেয়,মিঠি বুঝতে পারল তাকে দেখে মুনীফ রেগে গিয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই। এই রাগ,এই বিরক্তি সাময়িক। সিথিকে সাবধান করতে বলতে হবে- যে করেই হোক! মুনীফ উঠে দাঁড়াল। যে ঘরে মিঠি ঢুকেছে সেখানে তার থাকার প্রয়োজন নেই। তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে মিঠি দ্রুততার সঙ্গে ডেকে উঠল,
-শুনুন!
উত্তরে মুনীফ বলল,
-আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। অন্তত তোমার মতো চরিত্রহীন না!
মিঠি থমকালো। মুনীফের যে আবারও বিয়ে ঠিক হয়েছে তা সে জানত না বা এরকম কিছু ভাবেওনি। মিঠির নিরুপায় লাগছে নিজেকে। চোখজোড়া ছলছল করে উঠলেও হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তড়িঘড়ি করে মুছে নিলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-অভিনন্দন আপনাকে। আপনার বিয়েতে আমি কোনোপ্রকার বাঁধার সৃষ্টি করব না। আমার কিছু কথা আছে সেটা বলতেই…
মুনীফ বলল,
-মাফ চাবে এইতো? দেখো,আমি তোমাকে মাফ করতে পারব কীনা জানি না। তুমি চলে যাওয়ার পর আমার ফ্যামিলি কী কী ফেস করেছে তা শুধু আমিই জানি! এমনকি, লোকে এটাও ইঙ্গিত দিয়েছে যে আমার ভেতরেই নাকি কোনো সমস্যা, নইলে বউ পালালো কেন! একবার ভাবতে পারো এসবকিছু তুমি?
মিঠি নত মুখে বলল,
-ভেবেছিলাম ক্ষমা চাইবো,কিন্তু এখন আর সেটাও চাইবো না। আপনারা আমার জন্য যথেষ্ট সহ্য করেছেন। আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
-ধানাই পানাই ছাড়ো। তালাকের সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে বললেই চলে। কাগজ গুলো রেডি হয়ে গেলেই তোমার কাছে পাঠিয়ে দিবো। সাইনটা করে দিবে,আশা করি।
মিঠি শুষ্ক গলায় বলল,
-পাঠাতে হবে না। আমি নিজেই গিয়ে নাহয় সাইন দিয়ে আসবো। আপনাকে আমার থেকে মুক্ত করতে একটুও ঝামেলা করব না,সত্যি! কিন্তু আমার কথাটা একটু শুনুন প্লিজ! সিথির ব্যাপারে..
এইবার মুনীফ সিরিয়াস হলো। ওর কপালে থাকা ভাঁজ গুলো মসৃণ হয়ে উঠল। মিঠি বলল,
-আগে বসেন। আমি সব বলছি।
মুনীফের তাড়া কণ্ঠ,
-যা বলার এভাবেই বলো। তোমার মামী মিথ্যে বলে আমাকে এখানে এনেছে৷ তুমি আছো জানলে কোনোদিনই আসতাম না। তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুত কথা শেষ করো।
আঘাত পেল মিঠি, মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠল। নিজের অনুভূতি গুলো অপ্রকাশিত রেখে সে বলতে শুরু করল,
-আপনাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর আমার ব্যাপারে ঠিক কতটুকু জেনেছেন,তা জানি না আমি৷ কিন্তু জানেন,আমি বিপদে পড়েছিলাম। আপনাকে ফাঁকি দিয়ে যাকে ভরসা করেছিলাম,সেই আমাকে বিপদে ফেলেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তার সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই বেঁচে ফিরতাম না আমি।
মিঠি থামল, সময় নিলো। মুনীফ বিস্ময় নিয়ে বলল,
-মানে!
-সজল আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। আপনার ছোঁয়া আমার শরীরে,অশুচি আমি..
-কিন্তু আমি তো তোমাকে এখন পর্যন্ত স্পর্শ করিনি!
স্মিতহাস্যে মিঠি বলল,
-সেটা আপনি আমি জানি,বিশ্বাস করি। সে জানেও না,বিশ্বাসও করবে না। তার মতে আমাকে বিয়ে করলে অন্যের খাওয়া জিনিস নিয়ে জীবন পার করতে হবে! আর আমাকে নাকি তার ফ্যামিলি মানবেও না। মূল কথা হচ্ছে,আমার উপর থেকে রুচি,ভালোবাসা,সবকিছুই হারিয়ে গেছে। নতুন জিনিস চোখে দেখেছে তো,তাই! সে যাইহোক, তার কথা বলে আর লাভ নেই। তার বিচার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু একজন আছে,যার বিচার আমি নিজে হাতে করতে চাই।
মিঠির চেহারা হুট করে শক্ত হয়ে উঠল। চোখে জ্বলছে স
ধিকিধিকি আগুন, মুনীফ স্পষ্ট লক্ষ্য করল তা।
-তুমি কী বলছো,কিছুই বুঝতে পারছি না আমি!
-আমি চলে আসতে চেয়েছিলাম,কিন্তু সজলের এক বন্ধু ও’কে ভুলভাল বুঝিয়ে আমাকে ভোগ করতে চেয়েছিল। আমাকে নিয়ে ফূর্তি করাই ছিল তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। একজন না,তিনজন, যদিও বাকি তিনজনের চেয়ে ওই একজনের ভূমিকাই মূখ্য। সে-ই নাটের গুরু! সে-ই পরিকল্পনা সাজিয়েছিল আমাকে নিয়ে। সজলকেও নিজের কথার জালে ফাঁসিয়ে আমাকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ওদের হাত থেকে বাঁচতে আমাকে সজলই সাহায্য করে। কিন্তু ওই জানো’য়ার,ওর চোখের চাউনি,ওর স্পর্শ, ওর ভাষা..আমি কিছুই ভুলিনি। ও’কে সামনে পেলে টু’ক’রো টু’ক’রো করতেও দুইবার ভাববো কীনা সন্দেহ! আজকে সেই জানো’য়ারকে দেখে এলাম আপনার বোনের সাথে দাঁড়িয়ে। আমি জানি না সে আপনাদের কী হয়! অথবা আপনার বোনই তাকে চেনে কীভাবে! শুধু জানি, ওই ছেলেটা ভালো না। মানুষের চেহারার অ’মা’নু’ষ ও। আপনার বোনের সাথে কী সম্পর্ক তা তো জানি না। তাই আপনাকে আগে জানানোর কথা মাথায় এলো। আপনি ছাড়া আপনার বোনকে কেউ বোঝাতে পারবে না। সিথিকে বলবেন, যা-ই করুক, ভেবেচিন্তে করতে। কিছু করে আমার মতো আফসোস না করতে হয়!
কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে মুনীফ। মিঠির কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না,অথচ মিঠির চেহারা দেখে অবিশ্বাস করারও উপায় নেই। ওর চেহারা বলে দিচ্ছে,ওই লোকটার প্রতি কতটা ঘৃণা জন্মেছে বুকের ভেতর। কিন্তু তার সাথে সিথি! কীভাবে কী! আর তাকে কী চিনে মুনীফ? তার নামটা.. মুনীফের মাথায় এই প্রশ্নটি জাগতেই সে হুড়মুড় করে জিজ্ঞেস করে,
-কী নাম? জানো তুমি?
মিঠি ঘাড় নাড়ায়,
-জানি। ওর নাম কখনো ভুলব না আমি। বাদল, বাদল নাম ওর।
‘বাদল’ নামটি শুনতেই বর্ষার কথা সবার আগে মনে পড়ে মুনীফের। তার হতচকিত মুখখানা ধীরে ধীরে ক্রোধের অনলে পুড়তে শুরু করল। বেশ ভালো কাহিনী সাজিয়েছে মেয়েটি! মুনীফকে পেতে,মুনীফের বিয়ে ভাঙতে এতটা নিচে নামতে পারল মিঠি!? বর্ষার ভাইকে জড়িয়ে আজেবাজে কথা বলতে একটুও বিবেকে বাঁধলো না? আর এত সুন্দর একটিং!
মুনীফ হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলল মুহুর্তেই। এত রাগ তার এর আগে কখনো হয়নি। উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে থাকা মিঠিকে সে দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো। মিঠি চমকে সরে যেতে চেয়েও পারল না। বিছানার উপর উপুড় করে চেপে ধরল তাকে মুনীফ। তারপর তার শরীরের উপর নিজেও ঝুঁকে পড়ল। পিঠে তীব্র ব্যথা হচ্ছে,অথচ মিঠির ভ্রুক্ষেপ নেই। এই প্রথম সে কারো এতটা কাছে এলো! তাও আবার নিজেরই স্বামী.. যার সঙ্গে ক’দিন বাদে অন্য একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে! মিঠিকে নিজের অনুভূতি সামলানোর সময়টুকুও দিলো না মুনীফ। তার আগেই কড়াকণ্ঠে বলল,
-তুমি এত খারাপ,আমি ভাবতেও পারিনি। বর্ষার ভাইয়ের ব্যাপারে এসব উল্টাপাল্টা বলে আমাকে বিয়ে করা থেকে ফিরিয়ে আনবে,এমনটা ভাবলে কী করে! মেয়ে,তোমার সমস্যা কী? আমাকে বিয়ে করলে,আমাকে অসম্মানিত করলে, এরপর যখন আবারও এগিয়ে যেতে চাইছি জীবনে,তখন এসব উদ্ভট নাটক শুরু করলে!
মুনীফ একাধারে চিল্লাচিল্লি করে যাচ্ছে। তার চিৎকারের স্বরে মামী ঘরে উপস্থিত হন। মিঠির গায়ের উপর মুনীফকে ঝুঁকে থাকতে দেখে থতমত খেলেন,লজ্জাও পেলেন। কিন্তু থামলেন না। মুনীফকে টেনে মিঠির উপর থেকে সরালেন। মুনীফ যেন মিঠিকে মারবে- এমন হাবভাব, থামানো যাচ্ছে না তাকে। মিঠি অবাক গলায় বলল,
-আমি কোনো বর্ষাকে চিনি না।
-ও, এখন না চেনার ভান করছো? তুমি চেনো না আমার হবু বউ কে? বাদল তো ওরই ছোট বোন। ওর বড় ভাইকে নিয়ে এতবড় অপবাদ দিতে তোমার মুখে বাঁধলো না? তুমি কী ভেবেছো,এসব শুনে আমি এই বিয়ে ভেঙে দিবো? কক্ষনো না। উল্টো এবার নির্ধারিত তারিখের আরও আগেই বিয়েটা করব। এটাই আমার ফাইনাল কথা। আমিও দেখবো,তুমি কত নিচে নামতে পারো!!
মিঠি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
-বিশ্বাস করেন,আমি যা বলছি,সব সত্যি! একবিন্দু মিথ্যা বলছি না।
-তাই? তাহলে প্রমাণ দাও তোমার কথার।
এইবার মিঠি চুপ হয়ে গেল। তার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই! মুনীফ ধমকে উঠল,
-কী,প্রমাণ চাওয়াতে কালো মুখ করে ফেললে কেন? প্রমাণ নেই,তাই তো? তাহলে আমিও তোমাকে বিশ্বাস করি না।
একটু থামলো মুনীফ,বুকের ভেতর অদ্ভুত ধরনের ব্যথা হচ্ছে একটা।
-তোমার মতো মেয়েকে আমি একদিন বিয়ে করেছিলাম ভাবতেও লজ্জা লাগছে আমার! ছিঃ! তোমার মুখটা যেন আমার কক্ষনো না দেখতে হয় আমার…
মুনীফ বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। মিঠির থমথমে মুখখানায় ধীরে ধীরে অশ্রু ঝড়ছে। এতটা অসহায় ও নিরুপায়,এর আগে কোনোদিন তো লাগেনি।
(চলবে)