#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-০৮
সময় যখন খারাপ হয় তখন সবকিছুই খারাপ লাগে। চেনা মুখগুলো হুট করেই অচেনা হয়ে যায়। এমন এমন ঘটনা সামনে এসে পড়ে যা দেখে মানুষ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া দেখাতেও ভুলে যায়। এমনই একটি পরিস্থিতি মিঠির সম্মুখে, পলি একটা বড় ব্যাগে মিঠির সমস্ত জামা-কাপড়,প্রয়োজনীয় জিনিস গোছাচ্ছে আর একাই বিড়বিড় করে কিছু বলে যাচ্ছে। প্রভা তার মা’কে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নত করে। থেমে থেমে কাঁপছে সে। নিশ্চয়ই কাঁদছে প্রভা। মিঠি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে,কিছুই বলার নেই। সবকিছু গুছিয়ে ফেলে পলি কঠিন গলায় বলল,
-টাকা আছে,নাকি রিকশা ভাড়া দিয়ে দিবো?
প্রভা ডাকল,
-মা!!
পলি পাষাণ চোখ করে মেয়ের দিকে তাকাতেই প্রভা চুপ হয়ে গেল। এতদিনের মমতাময়ী মায়ের মতো আন্টি হুট করেই এরকম রুক্ষমূর্তি ধারণ করবে,মিঠি কখনো কল্পনাও করেনি। পলি বলল,
-কীরে,দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দেখ মিঠি,তুই প্রভার ছোট বেলার বান্ধবী, তাই যখন বিপদে পড়ে এখানে এসে উঠেছিস, আমি মানা করিনি৷ কিন্তু এখন তো তোর মামা-মামী ফিরিয়ে নিতে চায়। তখন এখানে থেকে লাভ কী বল? নিজের বাড়ি ফিরে যা। পরের বাড়ি সবসময়ই পরের হয়। যতই সময় গড়াক না কেন,এই বাড়ি কখনো তোর হবে না।
মিঠি ঢোক চেঁপে কান্নাটাকে দাবানোর চেষ্টা করল। নিস্তরঙ্গ গলায় বলল,
-স্কুল থেকে কেউ এলে আমার সাথে সাথে তোমরাও বিপদে পড়বে,এজন্য আমাকে চলে যেতে বলছো,তাই না?
-হ্যাঁ,বলছি। এখানে আমার বিয়ের বয়সী একটা মেয়ে আছে। তোর জন্য নিজের মেয়ের গায়ে কোনোপ্রকার কলঙ্কের ছাপ আমি লাগতে দিতে পারি না। কথা বাড়াস না,যার জায়গা যেখানে,তাকে সেখানেই মানায়।
প্রভা কথা বলল মাঝ দিয়ে।
-মা,তুমি ভুল করছো। ওকে এভাবে অপমান করে বাসা থেকে বের করে দিতে পারো না।
-আমি কোনো ভুল করছি না আর না ওকে অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছি। ওর বাসায় ওকে ভদ্র ভাবেই যেতে বলছি। এটাকে যদি অপমান মনে করিস তবে তাই।
পলি ভেতরের ঘরে পা বাড়ালো। প্রভা নিঃশব্দে কাঁদছে। মিঠির চোখের কার্নিশ টপকে কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এলো। দ্রুততার সঙ্গে তা মুছে নিয়ে সে প্রভার দিকে এগুলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-তাকা আমার দিকে। এই প্রভা! তাকা..
প্রভা মিঠিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মিঠিও নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কেঁদে ফেলল প্রভার পিঠে মুখ ঠেকিয়ে। মিনিট কয়েক দুই বান্ধবী নিরবে কেঁদে গেল। একসময় মিঠি নিজেকে সামলে চোখ মুছে মুখ তুলে তাকাল। প্রভার চোখজোড়া মুছিয়ে দিয়ে বলল,
-ভালো মতো পড়াশোনা করিস। পড়ালেখা ছাড়া এই দুনিয়াটা খুব কঠিন রে। আর নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে কখনোই বিয়ে করিস না। আমার অবস্থা তো দেখলি! যা-ই করবি, সবসময় ভেবেচিন্তে করিস। আমার জীবনের হাল দেখে অন্তত শিক্ষা নিস। আমি আসি। আর কোনোদিন দেখা হবে কীনা জানি না। ভালো থাকিস সবসময় প্রভা। আমি তোর কথা কখনো ভুলবো না।
প্রভা ভেজা গলায় বলল,
-মায়ের উপর রাগ রাখিস না প্লিজ। বাসায় আসিস মাঝে মাঝে?
-আসবো। আর আন্টির উপর আমার কোনো রাগ নেই। উনিও উনার জায়গায় ঠিক। আমার জন্য তোর কোনো সমস্যা হোক,তা আমিও চাই না। যদি কোনো ভুলটুল করে থাকি, মাফ করে দিস বোন। কখনো দাবী রাখিস না। কখন যেন চলে যাই…!
প্রভা মিঠির মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরল।
-এভাবে বলিস না প্লিজ! আমি আসবো। যখনই সময় পাবো তোর বাড়িতে যাবো। তুইও আসিস। আর শোন,সবসময় শক্ত থাকিস। যা হয়েছে হয়েছে,জীবনে এগিয়ে যাস। তুই অনেক ভালো কিছু ডিজার্ভ করিস!
মিঠি মলিন ঠোঁটে অল্প হেসে বলল,
-প্রকৃতি কখনো শূন্যস্থান পছন্দ করে না। আবার কাউকে কাউকে চিরজীবন শূন্য করেই রাখে। আমার অবস্থা কোনটা,কে জানে! তবে মন বলছে,আমার একটা শেষ কাজ বাকী। ওটা করতে পারলে…
-কী কাজ?
প্রভার কান্না থেমেছে। তাকে এখন উৎসুক দেখাচ্ছে। মিঠি এক মুহূর্ত নিরব থেকে জবাব দিলো,
-না,কিছু না। আমি আসি। আন্টিকে আমার সালাম দিস।
মিঠি বেরিয়ে গেল। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলো প্রভা। যতক্ষণ চোখে মিঠির প্রতিচ্ছবি পড়ল, ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।
পড়ন্ত বিকেল। একটু একটু করে পৃথিবীর আলো কমছে। একসময় অন্ধকারের জ্বাল জড়িয়ে নিবে পুরো পৃথিবী। আলো ও অন্ধকারের মধ্যে একটাই পার্থক্য। অন্ধকারকে ডাকতে হয় না। সে যেখানে সেখানে এসে হামাগুড়ি খায়। আর আলোকে আনতে হলে তার জন্য একটু হলেও জায়গা করে দিতে হয়। সেই জায়গার ফাঁক গলে আলো ঝড়ে পড়ে। মিঠির জীবনটা হুট করেই অন্ধকারেই তলিয়ে গেছে। কোনো দরজা কী আদৌও খুলবে মনের ভেতর? যেন আবারও আলোতে ঝলমল করে উঠতে পারে তার জীবনযাত্রা? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত উঁচু করে রিকশা ডাকে মিঠি। রিকশা এলে তাতে উঠে পড়ে। এখান থেকে মামার বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। মিনিট তিরিশেক লাগবে পৌঁছোতে। মিঠি অসাড়তা অনুভব করছে। মৃদুমন্দ বাতাস,তবুও শরীর ঘামছে। স্বস্তির বালাই নেই। একটু দূরে পরিচিত একটি মুখ থেকে মিঠি থমকে গেল। ঠোঁট নাড়িয়ে অজান্তেই বেরোলো,
-এই মামা,দাঁড়াও!
রিকশাওয়ালা মামা সঙ্গে সঙ্গে রিকশা থামালেন। মিঠির দৃষ্টি অনেকটা দূরে দাঁড়ানো বাদলের উপর। বাদলকে চিনতে পেরে মিঠির মাথা ঘুরে উঠল। পেটের ভেতর মোচড় দিলো। ঘৃণায় এবং রাগে তার চোখজোড়া চকচক করছে। ঘৃণার পাশাপাশি বিস্ময় ভাবটাও তার চেহারায় ফুঁটে উঠল যখন দেখল বাদলের পাশেই সিথি দাঁড়িয়ে। সিথি তার ননদ ছিল! বিয়ের সময় এই মেয়েটির হৈচৈ দেখার মত ছিল। মিঠি চিনতে পেরেছে। একটুও ভুল হয়নি। এই মেয়েটা সিথিই! কিন্তু ও বাদলের সাথে কী করছে? মিঠির চিন্তারা ঘোড়ার ন্যায় দৌড়ে চলে। কতক্ষণ আহাম্মকের ন্যায় তাকিয়ে ছিলে,জানে না সে। হুশ ফিরে রিকশা ওয়ালার ডাকে,
-কী আপা? যাইবেন না? থামাইতে কইয়া তো আর কিছুই কইলেন না।
-উঁ? হ্যাঁ, মামা যাবো। যাও তুমি।
বলে পুনরায় ওদের দিকে তাকাল মিঠি। দু’জনে হাসাহাসি করছে খুব। রিকশা চলতে শুরু করল। মিঠি দৃষ্টি সরিয়ে সাত-পাঁচ ভাবনায় ডুবে গেল। ওদের ভেতর কী সম্পর্ক,কী চলছে,মিঠি জানে না। শুধু এইটুকু জানে,মুনীফের সঙ্গে তার যোগাযোগ করতে হবে৷ যে করেই হোক! সিথির সামনে বড়সড় বিপদ অপেক্ষা করছে৷ মেয়েটাকে বাঁচালে হয়তো তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হবে কিছুটা। হতে পারে,মুনীফও তাকে মাফ করে দিবে!
____
বাদল বলল,
-অনেকক্ষণ যাবত কথা বলতেছি। কেউ দেখলে সন্দেহ করে বসবে।
সিথি পাত্তা দিলো না সে কথার।
-করলে করুক, আমার ভয় নেই।
-তোমার ভাইয়া যদি…
সিথি যেন বাদলের না বলা বাকি কথাটুকু বুঝে ফেলল। চট করে জবাব দিলো,
-আমার ভাইয়া বুদ্ধিমান মানুষ। কারো সাথে একটু কথা বললেই যে কিছু হয়ে যায় না,সেটা সে বোঝে।
-তাই?
বাদল স্মিত হাসে।
-কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে,কিছু একটা হতে চলেছে আমাদের ভেতর।
সিথি লজ্জা পেল, চোখ নামিয়ে হালকা গলায় বলল,
-আপনি কী সবজান্তা নাকি?
-না,সবজান্তা নই,কিন্তু অনেক কিছুই ধারণা করতে পারি। তুমি যে আমাকে পছন্দ করেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলে সেটাও বুঝতে পেরেছিলাম!
বলেই হো হো করে হেসে ওঠে সে। সিথি জিভ কাটলো দাঁত দিয়ে। নত মুখেই শুধালো,
-আমি..আমি যাই।
বাদল হাসি থামিয়ে সিথির একটা হাত টেনে নিজের হাতের ভেতর নিলো। রহস্য করে বলল,
-আজকে ছেড়ে দিচ্ছি,একদিন কিন্তু ছাড়বো না।
সে কথার গভীরতা বোকা সিথি বুঝল না। আবেগে আপ্লুত হয়ে সে চলল বাড়ির পথে…
চলবে…