#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-০৭
সূর্যের লম্বা কিরণ মিঠির মাথার তালুর উপর তীর্যক ভাবে পড়ছে। ভেতরে ভেতরে ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। এত গরম! মিঠির মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বিরক্তিকর আওয়াজ বের হলো। রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে চলেছে সে। ভাবছে জীবনের মিল না হওয়া অনেক গল্পের কথা। দু’দিন আগে মিঠি যখন স্কুলে ছিল, তখন নাকী মামা-মামী এসেছিলেন প্রভাদের বাড়িতে। প্রভাকে বারবার জিজ্ঞেস করার পরও মিঠি কোন স্কুলে চাকরি করে তা বলেনি সে। মিঠির অনুমতি ছাড়া কাউকে কিছু বলতে পারবে না। মামা-মামী নাকী অনুরোধ করে গেছে,মিঠিকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আর খবর দিয়েছে, মুনীফ তাকে তালাক দিয়েছে। খুব দ্রুতই কাগজে কলমে বাস্তবায়িত হবে তা। বাসায় ফেরার পর সব শুনে মিঠির বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল। একটি ভুল! তার জীবনের সবকিছু উলোটপালোট করে দিয়েছে। মুনীফের দোষ নেই। ভুল সে করেছে,তার শাস্তিও পাচ্ছে। না জানি জীবন তাকে আর কোন মোড়ে এনে দাঁড় করাবে! মুনীফের তার প্রতি না আছে কোনো টান, অথবা অনুভূতি। সেসব কিছু জন্মানোর আগেই তো মিঠি দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে দূ’জনের মধ্য। মিঠির খুব ইচ্ছে করে সেই দিনে ফিরে যেতে,যেদিন তাদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল। যদি একবার ফিরে যেতে পারত, তবে আর কখনোই মুনীফকে ছেড়ে চলে যেতো না। মুনীফের মতো ভালো লোক দ্বিতীয়টি দেখেনি সে।
স্কুলের সামনে চলে আসায় নিজের চিন্তাগুলোর লাগাম টেনে ধরল মিঠি। পুনরায় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই সম্মুখীন হলো সোহেল স্যারের। স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। বাসায় বউ-বাচ্চা সব থাকা সত্ত্বেও মিঠির পেছনে সব কয়েকদিন যাবত আঠার মতো লেগেছে! মিঠি যেখানেই যায়,যা-ই করতে যায়,সব জায়গাতেই সোহেল স্যারের ছায়া পড়ে। আকারে ইঙ্গিতে বারবার কু-প্রস্তাব দিয়েছে। মিঠি সেসব পাত্তা দেয়নি। সে হাপিয়ে উঠেছে নিজের প্রতি। জীবন এত সমস্যার সৃষ্টি কেন করে,কে জানে!
-আমি কখন থেকে আপনার অপেক্ষা করে আছি! আজ স্কুল আসতে এত দেড়ি করলেন যে?
সোহেল স্যারের অতিরিক্ত গদগদ ভাব মিঠির ভেতরে আগুন ধরালো। নিজেকে সামলে নিয়ে সে উত্তর দিলো,
-শরীরটা ভালো নেই।
বলেই টিচার্সরুমের দিকে এগোলো। আজ সে ক্লাস নিবে না, কয়েকদিন ছুটি চাওয়ার জন্য এসেছে। নিজের একটা বিশ্রাম প্রয়োজন। শারীরিক ভাবে,মানসিক ভাবে সে ভীষণ ক্লান্ত!
সোহেল স্যারও পেছন পেছন এলেন।
-ওহ! কী হয়েছে আপনার? জানতে পারি কী?
মিঠির ইচ্ছে হলো,কঠিন করে বলতে,না পারেন না। আপনার জানার কোনো অধিকার নাই। কে আপনি?
কিন্তু মুখে বলল,
-এমনিই। একটু জ্বর জ্বর ভাব। তেমন কিছু না। প্রিন্সিপাল স্যার স্কুলে আছেন?
-হুম, আছেন। কেন?
-কয়েকদিন ছুটি নিতে চাচ্ছি।
বলে মিঠি প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষের দিকে এগোতে নিলে সোহেল স্যার আচমকা ওর হাত চেপে ধরল। মিঠি চমকে উঠল। টিচার্স রুমে কেউ নেই। সব টিচাররা যার যার ক্লাসে নিশ্চয়ই! মিঠির মনে পড়ে গেল বাদলের কথা। বাদলও একই ভাবে তার হাত চেপে ধরেছিল!
সোহেল ভ্রুবিলাস করে বললেন,
-আমার থেকে পালিয়ে থাকতে চাচ্ছেন দেখেই কী ছুটি নিতে এসেছেন?
মিঠি শক্ত করে বলল,
-হাত ছাড়ুন।
সোহেল ছাড়লেন না,বরং তার ঠোঁটের হাসি আরেকটু দীর্ঘ হলো।
-না,ছাড়বো না। আপনি বোঝেন না কেন আমি কী চাই?
-আপনার স্ত্রী আছে,বাচ্চা আছে। এই কথাটা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি।
-উঁহু,যাইনি। বিয়ে করেছি বলে নিজের জীবন,যৌবন সব স্ত্রীর নামেও লিখে দেইনি। আমার নিজের চাওয়া পাওয়া বলে কী কিছু থাকতে পারে না?
-কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে। সেই চাওয়া পাওয়া মেটানোর জায়গাও আছে,জানেন তো? নামটা শুনতে অবশ্য খারাপই লাগে। কিন্তু কী আর করা! আপনার এত চাওয়া পাওয়া যখন তখন পূরণ তো করতেই হয়। আর সেই পূরণের জন্য এদেশে পতিতা পল্লীর অভাব নেই বুঝেছেন?
সোহেল এমন ভাবে হাসলেন যেন মিঠি কোনো কৌতুক বলেছে।
-আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আমার হাতটা এখনো ধরে রেখেছেন!
মিঠি হাত মোচড় দিলো ছুটিয়ে নেওয়ার আশায়,সোহেল আরও শক্ত করে চেপে ধরলেন।
-আমার সাহসের এক আনাও দেখাই নাই। যদি দেখাতাম তাহলে মুখ দিয়ে এই লেকচার গুলো বেরোতো না। চোখের উপর তাকিয়ে কথাই বলতে পারতে না।
মিঠির রাগ বাড়ছে। চোখের পাতায় বারবার ভেসে উঠছে বাদলের কর্মকাণ্ড। এভাবেই হাত চেপে ধরেছিল সে। তার হায়নার চাহনি এখন সোহেলের মাঝেও দেখা যাচ্ছে। মিঠির কী যে হলো, সে আচমকা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। শক্ত করে ঝাড়া মারতেই সোহেলের হাত ফসকে গেল, তৎক্ষনাৎ একটা কাঠের চেয়ার তুলে নিয়ে সোহেলের গায়ের উপর আঘাত করে বসল সে। সোহেল হতভম্ব, কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা সূক্ষ্ম, তীব্র মাথা অনুভব করল মাথায়। মাথার এক পাশ ফেটে গেছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। মিঠি ফোঁসফোঁস আওয়াজে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রক্ত বেরোতে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। হুট করে আসা উত্তেজনা, ক্রোধ, আক্রোশ মুহূর্তেই উবে গেল। চোখেমুখে ভীতির ছায়া পড়ল। কিছুই ভাবতে পারছে না। দ্রুত পায়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো একপ্রকার ছুটতে ছুটতে। পা জোড়া কাঁপছে তার। মনে হচ্ছে হাঁটু ভেঙে রাস্তাতেই বসে পড়বে সে।
____
সিথির জ্ঞান ফিরেছে। তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে কাউচের উপরে। তার পাশে মুনীফ, বাবা বসে। একটু দূরে শেফালি বেগম উগ্র চোখ তাকিয়ে রয়েছেন। মেয়ে দেখতে এসে কী ঝামেলায় ফেলল তাকে মেয়েটি! যখন বাদলের কোলে চড়ে ঘরে এলো.. ছিঃ! ছিঃ! কী লজ্জাজনক পরিস্থিতি।
সিথি ভয়ে ভয়ে উঠে বসল। মুনীফ গম্ভীর গলাতে প্রশ্ন করল,
-ঠিক আছিস তুই?
সিথি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল,মুখে কিছু বলার সাহস হলো না। তার চোখ মায়ের উপরেই বিদ্ধ। আজ বাসায় গিয়ে তার খবর করবে মা, সিথি আগেই টের পেল। মুনীফের বাবা হাতজোড় করে বারবার সবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। মেয়ে দেখতে এসে এভাবে সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলার কারণে। যদিও বর্ষার বাবা-মা কেউ কিছুই মনে করলেন না। উল্টো তাদেরকে নিশ্চিন্ত থাকতে বললেন। তবুও শেফালি বেগম ক্ষমা প্রার্থনা করে সবার থেকে বিদায় নিলেন।
বাসায় এসে সিথিকে জেরার মুখে পড়তে হলো। কী কারণে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল তা বারবার জিজ্ঞেস করার পরও সিথি কিছুই বলতে পারল না মুখ ফুঁটে। মনে মনে যুতসই জবাব খুঁজে বেড়ালো। মিনমিনিয়ে বলল,
-হঠাৎ রোদে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
-তো বাহিরে গেছিলে ক্যান? আমরা সব ঘরের মধ্যে,তুইও ঘরের ভেতর থাকবি। ওখানে গিয়েও লাফালাফি! বর্ষার ভাইয়ের কোলে চড়ে তারপর এলি! ছিঃ! ছিঃ!- সবাই কীরকম চোখ করে তাকিয়ে ছিল।
শেফালি বেগম একাধারে বকে গেলেন যদিও তার শেষ কোনো কথাই সিথির কর্ণকুহরে পৌঁছুলো না। তার কানের ভেতর বাজছে,সে বাদলের কোলে চড়েছে! মুহূর্তেই সমস্ত মন খারাপ উড়ে গেল। পুলকিত বোধ করল সিথি। শেফালি বেগম বকেটকে হয়রান হয়ে থামলেন, সিথি পাখির মতো উড়ে নিজের ঘরে এলো। আসার আগে মুনীফের থেকে জেনে নিলো,বর্ষার ভাইয়ের নাম কী! ফেসবুকে ঢুকে বাদল লিখে সার্চ করতেই একগাদা আইডি বেরোলো। এর ভেতর কোনোটাতেই বাদলের ছবি দেখতে পেল না। একটা হতাশা বোধ তৈরি হলো তার ভেতরে। কোনটা বাদলের আইডি কে জানে! নাকি সে আইডিই চালায় না? এই যুগে এসে ফেসবুক চালায় না এরকম মানুষ খুব কম। অবশ্যই সে চালায়, হতে পারে আইডির নাম ভিন্ন। অথবা বাদলের আগে পরে অন্য কোনো নাম যুক্ত যা সিথি জানে না। তাহলে বাদলকে কী করে খুঁজে বের করবে! সিথি ভেবে পেল না। মুনীফের বিয়ে হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তবে সিথি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,দ্বিতীয় বার যখনই বাদলের সাথে দেখা হবে তার, অজ্ঞান না হয়ে আগে তার ফেসবুক আইডি চাইবে। চাইলে দিবে কী? কী ভাববে তাকে! নতুন চিন্তারা এসে ভর করল সিথির মাথায়।
____
পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে প্রভা ঘুরে তাকাল। দেখল,শুকনো চেহারা নিয়ে মিঠি দাঁড়িয়ে। প্রভা বুঝতে পারল,কিছু একটা হয়েছে। নইলে একটু আগেই তো স্কুলে গিয়েছিল সে! প্রভা হাতের কাজ রেখে উঠে আসলো। ওড়নার আঁচলে হাত জোড়া মুছে নিয়ে বলল,
-তুই? এখন? সব ঠিক আছে?
মিঠি হ্যাঁ,না কিছুই বলল না। নির্বাক তাকিয়ে রইলো। প্রভার উদ্বেগ বাড়লো এবার। কাছে এসে জোরালো গলায় বলল,
-কীরে?কথা শুনিসনি?কী হয়েছে?
ভয়ার্ত গলায় মিঠি জবাব দেয়,
-একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছি রে।
-দুর্ঘটনা! মানে কী? কী হইছে,খুল বল আমাকে।
মিঠি ঢোক গিলে, বড় করে শ্বাস টেনে নিয়ে ফুসফুস ভর্তি করল। নিভে যাওয়া গলায় বলল,
-তোকে বলেছিলাম না,সোহেল স্যার আমাকে ডিস্টার্ব করেন প্রচুর?
-হু..
-সে আজকে সুযোগ পেয়ে আমার হাত ধরছিল। আমার সাথে জোরাজুরি করছিল খুব, আমি নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি আর।
প্রভা চোখ বড় বড় করে বলল,
-তুই কী করে আসছিস,বল তো..
-ইয়ে মানে..
মিঠি ঘাবড়ায়, বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। প্রভা অভয় প্রদান করলে মিঠি শুকনো গলায় বলল,
-কাঠের চেয়ার দিয়ে বারি মারছি। অত শক্তি আমার ভেতর কোথা থেকে এলো,কে জানে। বুঝিনি যে তার মাথা ফেটে যাবে।
প্রভা স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। মিঠি আচমকা কেঁদে ফেলল। তার সাথে এসব কী হচ্ছে! এইরকম জীবন সে কী চেয়েছিল কোনোকালে? দু’হাতে মুখ ঢেকে অকস্মাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। ঘরের ভেতর থেকে পলি ছুটে এলেন। আজকে তার শরীর বিশেষ ভালো না থাকায় হাসপাতালে যাননি,ছুটি নিয়েছিলেন। তিনি এসে প্রভাকে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর মিঠিকে কাঁদতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-কীরে,কী হইছে ওর? এই প্রভা.. বল আমাকে।
প্রভা পাথর গলায় মিঠির কৃতকর্মের কথা জানালো মা’কে। সব শুনে পলিও চুপ হয়ে গেলেন। মিঠি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আমি আর ওই স্কুলে যাব না। কোনোদিন যাব না..
ঘরের ভেতর চলে গেল মিঠি। প্রভা দুঃখী চোখে তাকিয়ে রইলো। সে নিজেও বা কী করবে মিঠির জন্য! অপরদিকে পলির মনে আচমকা আশংকার উদয় হয়। মিঠিও কী তার ঘাড়েই চেপে বসবে শেষমেশ? যদি স্কুল থেকে লোক এসে হাঙ্গামা করে তখন?আর এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো,মিঠিকে এই বাড়িতে জায়গা দেওয়াই সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল। আর নয়,মিঠিকে এই বাড়ি ছাড়তে হবে এবং তা আজ,এখনই!!
চলবে..