#রজনী_প্রভাতে (শেষ পর্ব)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
১৯.
শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে নয় বছর আগে। কোনো এক মাঘের প্রভাত বেলায়। ছোট চাচীর সাথে খেজুরের রস নিয়ে তার বাবার বাড়িতে এসেছিল তাযীম। সেটাই তার প্রথমবার আসা জ্ঞান হওয়ার পরে। এর আগে যখন এসেছিল তখন চাচা আর চাচীর বিয়েতে এসেছিল সেও তখন এক কিংবা দুই বছর বয়সের ছিল। তাই এই মানুষজন কিংবা বাড়িটা তার কাছে অনেকটাই অচেনা ছিল। ছোট চাচীর বাবার বাড়ির খুব কম সদস্যের সাথেই দেখা হয়েছিল তার। এর মধ্যে একজন ছিল তটিনী। যার সাথে সেবারই প্রথম দেখা হয়েছিল। আর প্রথম দেখাতেই কি যেন হলো! কলেজ পড়ুয়া ছেলেটার হুট করেই একটা নতুন অনুভূতি হলো। চঞ্চলা, দুষ্টু একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগল। এতই ভালো লাগল যে শুধুই কোনো না কোনো উপায় খুঁজত মেয়েটার সাথে দেখা করার। দিনের পর দিন ছোট চাচীর বাবার বাড়িতে গিয়ে মোর্শেদের সাথে আড্ডা দিতো। সে ভাবটা করত এমন যেন সে মোর্শেদের কাছে এসেছে কিংবা কোনো দরকারি কাজে কিন্তু আসল কারণটা ছিল তটিনী।
এভাবে বছর ঘুরল। আরেকটু বড় হলো সে। আরেকটু বুঝদার হলো। এবং বুঝতে পারল যে, সে যে মেয়েটির জন্য এত পা’গ’ল সেই মেয়েটি তাকে দুই চোখেও স’হ্য করতে পারে না। তাযীমের এতে যে খুব ক’ষ্ট হতো তা না। বরং সে আরো ভালো করে মেয়েটিকে জ্বা’লা’তো। অযথাই এই সেই পরমায়েশ দিতো, এটা সেটা বলে খোঁ’চা দিতো। সবচেয়ে বি’র’ক্ত করত বুচি ডেকে। সে যখন বুঝতে পারল তটিনী তাকে যতটা অপছন্দ করে তার চেয়েও বেশি অপছন্দ করে এই বুচি ডাকটাকে। তখন থেকেই যেন লাগাম ছাড়া হয়ে পড়ল তার এই ডাক। তটিনীর ও একদিন ধৈর্যের সীমা ভা’ঙ’ল। তাযীম নিতে পারেনি তটিনীর ঔদ্ধত্যতা। ভেবেছিল বিচার দিলে তটিনী হয়তো একটু ভদ্র ভাবে কথা বলবে তার সাথে এবং তার নিজের একটা ভাব বাড়বে তটিনীর সামনে কিন্তু সেটা হয়নি। বরং যা হলো তা ভাবনারও বাইরে ছিল তার। তটিনী আর এলো না কোনো দিন তার সামনে। তিন চার বছরের অভ্যাসটা হুট করেই বদলে গেল। আর দেখা হলো না মেয়েটার সাথে। তাযীম নিরূপায় হয়ে পড়ে। তার যে তটিনী ছাড়া চলবে না সে তা আরো আগেই বুঝে গিয়েছে। অথচ মেয়েটা তাকে ছাড়া দিব্যি চলছে। তার ক’ষ্ট হতো। কয়েকবার চেষ্টা করেছে ক্ষ’মা চেয়ে নেওয়ার। মেয়েটা ধরা-ই দিল না!
এর মধ্যে আরো কিছু বছর কেটে গেল। তটিনীও কিশোরী থেকে যুবতী হলো। তাযীমও নিজের পায়ে দাঁড়ালো। নিজের একটা অবস্থান তৈরি করল। এর মধ্যে হঠাৎই আয়রার বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। তাযীম ভেবেছিল তটিনী আসবে না। কেননা আয়রার বড় বোনের বিয়েতেও সে আসেনি। যদিও তটিনী এসেছিল শুধু বিয়ের দিন কিন্তু দেখা হয়নি তার সাথে। তাই সে জানেই না তটিনী এসেছিল কিনা।
অফিসে কাজ থাকায় তাযীম একেবারে বিয়ের দিন যাবে বলেই ঠিক করেছিল। হঠাৎ করেই খবর পেল তটিনী এসেছে। তাযীম সব ফেলে বাড়ি ছুটল হন্তদন্ত হয়ে। আর বাড়ি ঢুকেই সে দর্শন পেল তার বহু বছরের আকাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটির। তাযীমের সারা দেহে তখন শীতল হাওয়া বয়ে যায়। এত গভীর অনুভূতি সে কতই না কঠোর ভাবে আড়াল করেছিল সেদিন। এক বারও তটিনীকে বুঝতে দিল না। বরং তাকে আগের মতোই কথা দিয়ে বি’র’ক্ত করল।
এরপর আরো দুটো দিন কাটল। তাযীমের মনে হলো তটিনী তাকে অন্যভাবে দেখছে। তটিনীর হাবভাব আচার-আচরণ কেমন যেন অন্যরকম লাগল তার চোখে। তার কাছে মনে হতে লাগল আগের মতো তটিনী বিরক্ত হয় না তার ওপর। বরং তাকে আশেপাশে দেখলেই ল’জ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। তাযীম হুট করেই ভাবল পরীক্ষা করা যাক। সে আগের মতোই তটিনীকে বুচি বলে ডাকল। তটিনী সেবার খুব বেশিই অভিমান করল। রা’গের বশে তাযীমকে কথা শোনাতেও ছাড়েনি। পরবর্তীতে অ’স’ভ্য বলল। তাযীমও অ’স’ভ্যতা কেমন হতে পারে তা বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে। অথচ এটা নিয়ে তটিনী বড় ধরনের ইস্যু ক্রিয়েট করতে পারত। যা সে করেনি। বরং এটাই ভাবিয়েছে তাযীমকে। এই মেয়েটা নিশ্চয়ই এই সুযোগে পুরোনো ক্ষ’তের প্র’তি’শো’ধ নিতে পারত। কিন্তু সে তা কেন করল না?
তাযীমের মা বাবা হজে যাচ্ছেন সামনে। এর মধ্যে তারা চাইছে তার বিয়েটা অনানুষ্ঠানিক ভাবে পড়িয়ে যেতে। মৈথীকে তার মা প্রথম পছন্দে রেখেছিলেন। মৈথীর কথা তুলতেই তাযীম সরাসরি নাকোচ করল। মৈথীকে আলাদা ভাবে বাইরে ডেকে যখন বলল যে বিয়েটা সে করতে পারবে না। মৈথী তখন কিছুই বলেনি। বরং সে নিজেই তটিনীকে বিয়ে করতে বলেছে। মৈথী মু’ক্তমনা মেয়ে। জে’দ রা’গ তার যে নেই তা নয়। তবে আত্মমর্যাদা খুইয়ে কারো পেছনে পড়ে থাকা তার সাথে যায় না। সে খুব সুক্ষ্ম ভাবে তাযীমকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার তাযীম না হলেও চলবে। বরং তার এমন কাউকেই দরকার যে তাকে ভালোবাসবে। জো’র করে আর সব হলেও ভালোবাসা তো হয় না।
অতঃপর তাযীম তার বাবা-মাকে জানায় সে তটিনীকে পছন্দ করে, বিয়ে করতে চায়। এতে আপত্তি করার তেমন কিছুই ছিল না। কেননা বংশ, মেয়ে দুটোই কোনো দিকে খা’রা’প নয়। তারা মেনে নিলেন। তবে তটিনীর বাড়ির দিক থেকে এটা প্রথমে মানেনি। চন্দ্রমল্লিকার আগে তটিনীর বিয়ের কথা তারা ভাবছেন না। কিন্তু সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। হজের সময় হয়ে আসছে। তাযীমের বাবা-মা আর এক সপ্তাহ আছেন। এবার তটিনীর ছোট ফুফু চেষ্টা চালান। ভাইদের বুঝিয়ে বলেন এটা পারিবারিক ভাবে হয়ে যাক আপাতত। এত দিকে জানানোর দরকার নেই। অনুষ্ঠান দুই বছর পরে হলেও সমস্যা নেই। তাযীম সুপাত্র তাই সবাই আর না করল না। চন্দ্রমল্লিকাও বলল তার সমস্যা নেই কোনো। বোন রাজি থাকলেই হলো। এই সবই তটিনীর কাছে আড়াল ছিল। কারণ সে যে সহজেই মানবে না তা সবাই জানত। সবাই জানে তার আর তাযীমের মধ্যে দ্ব’ন্দ রয়েছে। তবে এটা একসময় কা’টিয়ে উঠবে বিয়ে হলে এটাও সবাই ভেবে দেখল। এত কিছু হলেও তাযীমের মন মানছিল না। সে দেখা করতে গেল তটিনীর সাথে। তটিনীর কথা শুনে মনে হলো, তার সেই ধারণাটা ভুল ছিল না। তার মনেও যে দ্বি’ধা দ্ব’ন্দ ছিল তা কে’টে যায়।
তটিনীর সাথে তাযীমের দেখা হলো বিয়ের পরে। দেখা করার জন্য তাযীমকে তটিনীর রুমে যেতে হয়। তটিনীর রুমে গিয়ে সে দেখল তটিনী বিছানায় বসে কাঁদছে। তাযীম শুনেছিল চন্দ্রমল্লিকার মুখ থেকে যে একটু ব’কা’ঝ’কা করা হয়েছে তটিনীকে। রাজি হয়নি প্রথম দফায় তাই। তাযীমকে দেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তটিনী। তাযীম গম্ভীর গলায় বলল,
-‘কাঁদছ কেন?’
তটিনী কিছু বলল না। তাযীম একটু এগিয়ে এসে তটিনীর দিকে ঝুঁকে বলল,
-‘তুমি কি আমাকে বিয়ে করেছ বলে কাঁ’দ’ছ?’
তটিনী মাথা নাড়ল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
-‘আপনি এটা ঠিক করেননি। আমি আপনাকে মাফ করব না।’
তাযীম জোরে এক ধ’ম’ক দিলো তটিনীকে। তটিনী তাতে একটু কেঁ’পে উঠল।
-‘এই মেয়ে তোমার কাছে আমি মাফ চেয়েছি?’
তটিনী এমনটা আশা করেনি। সে এবার আরো বেশি করে কাঁদল। এই অস’হ্যকর মানুষটার সাথে একটা জীবন সে কীভাবে পার করবে? বাবা এটা কি করল! তার মেয়েকে এই ছেলেটা কতটা ক’ষ্ট দেয় সে কি জানে? জানলে কি দিতো বিয়ে? তটিনীর মনে হলো নতুন শুরুর চিন্তা করে বিয়েতে হ্যাঁ বলা তার উচিত হয়নি। আরেকটু ভাবতে পারত।
তাযীম পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা লাল রঙের লম্বা বক্স বের করল। বক্স খুলে একটা সুন্দর হী’রার প্যান্ডেন্ট বের করল। সেটা হাতে নিয়ে তটিনীকে বলল,
-‘কাছে এসো।’
তটিনী এক পা পিছিয়ে গেল। তাযীম বুঝল সবে তো শুরু, আরো পোহাতে হবে এই সব জ্বা’লা, য’ন্ত্র’না তাকে। অবাধ্য বউ পেয়েছে যে! সে নিজেই এগিয়ে গেল তটিনীর কাছে। ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। লাল জামদানিতে তটিনীকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। খোপা করায় খুব ম্যাচিউরড মনে হচ্ছে বাস্তবে যা সে নয়। তটিনী এক মুহূর্তে জন্য নিরব হয়ে গেল যখন তাযীম তাকে প্যান্ডেন্টটা পরিয়ে দিল। তটিনীকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে তার মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে তাযীম বলল,
-‘পার্ফেক্ট।’
এতক্ষণের কান্না সব কোথায় যে উধাও হলো তখন! তটিনী ল’জ্জা পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। তাযীম হেসে ফেলল। মনে মনে ভাবল, খুব জলদি মেয়েটিকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। এভাবে আর নয়, তার আগামী দিনের প্রতিটি রজনী প্রভাতে সে তটিনীকে কাছে চায়।
২০.
চন্দ্রমল্লিকা বসার ঘরের এক কোণে একজনকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল। মানুষটাকে সে আয়রাদের বাড়িতেও একবার দেখেছিল। চন্দ্রমল্লিকার খুব ইচ্ছে তার সাথে আলাপ করার। আজ ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে না পেরেই কাছে গেল।
-‘হাই, আমি চন্দ্রমল্লিকা। আপনি?’
চন্দ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। একটা কারণে তার মুড অফ। তার ওপর একটা অচেনা মেয়ের গায়ে পড়ে আলাপ করতে আসা তাকে আরো বি’র’ক্ত করল। সে চন্দ্রমল্লিকার দিকে না তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
-‘আপনি কে তা তো জানতে চাইনি। আমি কে তা বলতেও আমি আগ্রহী না।’
চন্দ্রমল্লিকা বুঝল লোকটা ভীষণ বি’র’ক্ত হয়েছে। লোকটার বি’র’ক্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিতেই যেন সে বলল,
-‘সমস্যা নেই। আমি আগে থেকেই জেনে নিয়েছি। আপনি হলেন চন্দ্র। আমার মল্লিকা নামের আগেও একটা চন্দ্র আছে। আমাদের নামের কী সুন্দর মিল না? যদি কাপল হই তবে ইজিলি চন্দ্রমল্লিকা বলে দেওয়া যাবে। কী বলেন!’
চন্দ্রর মুখটা হা হয়ে গেল। মেয়েটা এটা কেমন কথা বলল? অচেনা অজানা এক পুরুষকে এসে বলছে আমরা যদি কাপল হই! আরে এই টাইপের মেয়েকে তো চন্দ্র পছন্দই করেনা। আবার তার সাথে জুটি বাঁধবে? অসম্ভব! মেয়েটি নিতান্তই বে’হা’য়া, বে’শ’র’ম। উহু একটু ভুল হয়েছে, সুন্দরী বে’হা’য়া, বে’শ’র’ম মেয়ে। চন্দ্র মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে আরেকবার তাকালো। চন্দ্রমল্লিকা হাসছে। সে ভাবুক হয়ে পড়ল তাকে জোকার লাগছে কি না এই ভেবে!
সমাপ্ত।