#রঙ বেরঙের খেলা
#আলিশা
#পর্ব_৮+৯
দিন শুরু হচ্ছে আশার আলো দিয়ে। একেকটা দিনে সভ্য সফলতার একেকটা সিঁড়ি ডিঙ্গাতে আকুল হয়ে থাকে। আজ দেড় মাস চলছে মডেলিং-এর। দু’টো টিভিসি সম্পন্ন তার। দু’টোই সুষ্মিতার সাথে। এখন অলিতে-গলিতে, বড় বড় বিল্ডিংয়ের মাথায়, রাস্তার দোকানগুলোতে চোখ ফেললে কম বেশি দেখা যায়। ঐ তো সভ্য হাসি মুখে সফট ড্রিংকস – এর বোতল হাতে দাড়িয়ে আছে। দুষ্টু দুষ্টু হাসি। পাশেই সুষ্মিতা অভিমানী মুখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেননা সভ্য তার সাধের কোকোকোলার বোতল ছিনিয়ে নিয়ে নিজে গলাধঃকরণ করেছে। আরেকটা টিভিসির বিলবোর্ড হলো সভ্য সুষ্মিতার লম্বা চুলের বেণী টেনে ধরেছে। মুখে সেই ভুবন ভুলানো হাসি। আর চোখে মাদকময় মজা। সুষ্মিতা সেখানে এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে যাতে ঝাঁক ঝাঁক বিরক্তি আর অল্প একটু ভালোলাগার আভাস পাওয়া যায়। এই টিভিসিটা তেলের ছিল। দু’জনে মিলে বেশ জমজমাট হয়ে যাচ্ছে মিডিয়া জগতে। সুষ্মিতা সাপোর্ট করে সভ্যকে। কাজের মাঝে কায়দায় সভ্যকে এগিয়ে নিতে চায়। পরোক্ষভাবে পাশে দাঁড়ায়। তবে মুখ ফুটে, এগিয়ে গিয়ে খোলাখুলি কখনো সাহায্য করে না। সভ্য কাজের বাইরে মিশতে চায় না সুষ্মিতার সাথে। আর না সাহায্য নিতে চায়। নিজের কর্ম দিয়ে উঁচু হতে চায়। কারো সাহায্য নিয়ে এগিয়ে গেলে সে প্রকৃত জয়ের আনন্দ অনুভব করতে পারবে না বলে তার ধারণা। তাই সুষ্মিতা চাইলেও আর বলেনি সিনেমার কথা। শুধায়নি, সভ্য তার বাবার চোখ সুন্দর হিরো হবে কিনা।
সভ্য অতি শীঘ্রই এই কয়েকদিনে ডিরেক্টর দের নজরে পরে গেছে। এখন তার ডাক আসে এ প্রতিষ্ঠান হতে ও প্রতিষ্ঠান হতে। খবরের কাজগের ফ্রন্ট পেজে তার ছবি ছাপানোই থাকে। কখনো ফ্যাশন মডেলের কখনো টিভিসি মডেলের। ইনকামও ভালোই হচ্ছে। মায়ের কাছে আর খরচ চাইতে হয় না। সুহালেই দিন যায় নিজের টাকায়।
আজ সভ্যর আরো একটা টিভিসি আছে। নতুন এটা। আজ থেকেই তার রিহার্সাল শুরু হবে। সভ্য তৈরি হচ্ছে। গঠন আগের চেয়ে আরো চমৎকার হয়েছে, চুলের কাটিং পাল্টিয়েছে, গায়ের রংটাও ঝকমক করে এখন। কালোরা কখনো খারাপ দেখতে হয় না। খারাপ হয় ঐ মানুষ গুলো, জঘন্য লেভেলের খারাপ হয় তাদের চোখ গুলো যারা কালো রং পছন্দ করে না। বিচ্ছিরি, নিকৃষ্ট তাদের মন মানুষিকতা যারা রঙ নিয়ে দেমাক করে। সভ্য কালো তবে অসুন্দর নয়। এই জনমে তাকে সাবিহা ছাড়া ওমন করে অসুন্দর কেউ বলেনি। বরং বলেছে, সভ্য দর্শনে প্রিন্স। হতে পারে ব্লাক প্রিন্স। তবে এতো বেশিও কালো না। এখন মিডিয়ায় পা রেখে স্যামলার ঘরে নাম উঠে গেছে। তাই তার গায়ে ছাই রাঙা শার্টটা দারুন মানিয়েছে । সভ্য শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে একবার নিজেকে ভালো করে পরখ করলো। দিন কয়েক আগে ডিরেক্টর আজগর আলী তাকে ভয়ংকর এক কথা বলেছে। ” সভ্য তোমার চোখ দেখে আমি তোমার প্রেমে পরে গেছি”
সভ্যর মুখে তখন পানি ছিল। বেচারার আর পানি খাওয়া হয়নি। ঝট করে মুখের পানি বেসামাল বেগে ছিটকে যায়। এবং ভয়াবহ দুঃখের বিষয় হলো পানিটা গিয়ে পরে সুষ্মিতার গায়ে এবং প্লেটে। ছিহ! ভাবতেই সভ্যর মাথা নিচু হয়ে আসে। সুষ্মিতারও বা কি দরকার ছিল লান্সে সভ্যর মুখোমুখি বসার? অগত্যা সুষ্মিতাকে সরি বলতে হয়েছে। মেয়েটা নেহায়েত ঠান্ডা মস্তিষ্ক নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে অন্যথায় মনে হয় সভ্যর মাথায় পানি ঢালতো। না শুধু পানি নয়, দুর্গন্ধ যুক্ত নর্দমার পানি। সভ্যর ভাবনার মাঝে হেসে উঠলো।
.
নিজেকে পরিপাটি করে ঠিক করে দশটার নাগাদ সভ্য চলে এলো স্টুডিওতে। প্রথমেই তার দর্শন হলো সুস্মিতার সাথে। বেহাল দশা বেচারীর। ডান পা এক বালতি পানির মধ্যে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে সুষ্মিতা বন্ধ চোখে বসে আছে। সভ্য অবাক হলো কিঞ্চিৎ। কৌতুহল জাগলো মনে। কি হয়েছে মেয়েটার? সভ্যর হঠাৎ মায়া হলো। এক মাসের বেশি ধরে কাজ করছে। আলাদা এক টান পরে গেছে। মিডিয়া জগতে এসে তার বেশ কিছু ভালো বন্ধুও জুটেছে। মন খুলে কথা বলা, হাসি ঠাট্টা, আলাপ আলোচনা করা যায় যাদের সাথে। সুষ্মিতাও তার মধ্যে একজন। সভ্য চোখ ঘুরিয়ে নিলো পুরো হল রুমটায়। যে যার যার কাজে ব্যাস্ত। সভ্য এগিয়ে গেলো সুস্মিতার নিকট। উদ্দেশ্য ছিল খোঁজ নেওয়ার। জানার কথা ছিল সুষ্মিতার কি হয়েছে। কিন্তু কাছে যেতেই হুট করে অস্বস্তি ঘিরে ফেলল তাকে। মনে হলো তার বৈশিষ্ট্যে নেই মেয়েদের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলা। সভ্য চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। ঠিক সেই সময় আচমকা সুষ্মিতা চোখ মেলে তাকালো। সভ্য থতমত খেয়ে গেলো। সে আর সরে আসতে পারলো না। সুষ্মিতা চোখ খুলেই মলিন একটা হাসি দিয়েছে। সভ্যও তার নিমিত্তে ঠোঁট প্রসারিত করলো। বলে উঠলো
— রাম্প কি যাম্প হয়ে গেছে?
সুষ্মিতা হেঁসে উঠলো। ঠিক তার নামের মতোই সুন্দর তার হাসি। এজন্যই মা তার নাম রেখেছিলেন সুষ্মিতা। অর্থ যে নারী সুন্দর করে হাসতে পারে।
— ওরকমই হয়ে গেছে। আসলে পেন্সিল শু পরার অভ্যেস খুবই কম। আজ হঠাৎ তাল সামলাতে না পেরে… পা ভেঙে ফেললাম।
— আজ টিভিসি টা আপনার ছিল না?
— হুম ছিল। কিন্তু আমি তো এই অবস্থায় করতে পারবো না। নতুন মডেল ঠিক করা হয়েছে।
আচমকা এক রাশ অভিমান জমে গেলো সুষ্মিতার মনে। সভ্য বুঝলোই না সে অভিমান। সে ‘ওহ’ বলে প্রস্থান করলো সুষ্মিতার সম্মুখ হতে। বুকটা ভার হয়ে গেলো সুষ্মিতার। প্রথম দিকে পায়ে তীব্র ব্যাথা থাকলেও সভ্যকে দেখে হুট করে তারা উড়ে গিয়েছিল অজানায়৷ কিন্তু এখন সাথে করে যেন আরো ব্যাথা এনে হারিয়ে যাওয়া ব্যাথা জায়গা করে নিলো মনে। ওমন কেন ছেলেটা? একটু পাশে বসতো, বলতো” কিচ্ছু হবে না ঠিক হয়ে যাবেন। কিন্তু সে কিছুই বলল না। উল্টো চলে গেলো কোনো খোঁজ না নিয়েই। সুষ্মিতা চোখ বন্ধ করে নিলো পুনরায়। ভেবে বসলো সে আর চোখ খুলবে না যতক্ষণ সভ্যর রিহার্সাল শেষ হবে। সে সইতে পারবে না, মানতে পারবে না মন কেড়ে নেওয়া ব্যাক্তিকে অন্য মেয়ের সাথে শুটিং করা দেখতে। সুষ্মিতা ভাবতে গিয়ে আপন মনে বিরবির করে উঠলো
” সে কেন বোঝে না কেন জানে না নেশা ধরায় যে তার চোখ দুখানা। আমার লাগলো যে হায় প্রেমের হাওয়া, তাকে পাওয়ার ভীষণ তাড়া, কিন্তু সে যে আমার খোঁজই রাখে না। শুধু রিহার্সালের সময় কথা কয় অন্য সময় কয় না। বজ্জাত বেডা।”
.
— বড়সড় মডেল হয়ে যাচ্ছেন। বাহ!
— তোমার দোয়ায়।
সভ্যর জ্বালিয়ে দেওয়া কথা। সাবিহার চোখ মুখ আগুনের ফুল্কি হয়ে গেলো। সুষ্মিতার পরিবর্তে তাকে ডাকা হয়েছে। সভ্য একটুও অপ্রস্তুত নয়। বরং সে যেন খুশি। আজ সমানে সমানে সামনাসামনি লড়াই। সাবিহা দেখবে আর জ্বলবে। সেই জ্বলানির ক্ষততে সভ্য কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে।
— বিলবোর্ডে দু একটা ছবি উঠলেই বড় মডেল হওয়া যায় না।
— হুম একারণেই তো বারবার ভুল করছো। একটা শুটও একশোবার করা লাগছে তোমার জন্য।
সভ্যর বিতৃষ্ণা নিয়ে বলা কথা। সাবিহা অপমানে রাগে লাল হয়ে গেলো। সভ্য চাইলোও না সাবিহার মুখের দিকে। সে আলগোছে উঠে চলে গেলো ডিরেক্টরে কাছে। সাবিহাও গেলো পিছুপিছু। তার পরনে শাড়ি, সভ্যর পরলে পাঞ্জাবি। টিভিসির বিষয় প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে। প্রথমে সাবিহার হুড়মুড় করে হাঁটতে গিয়ে ধপাস করে সভ্যর ওপর পরতে হবে। সভ্য আবার পরবে সাবিহাকে নিয়ে চেয়ারে বসে। কিন্তু চেয়ার এতোই মজবুত আর শক্ত যে দু’জনের ভরেও ভাঙবে না। সভ্য তো প্রথম বার রিহার্সালের সময় মুখ টিপে হেসেছে। কিনা কি দিয়ে কি করে। কোত্থেকে কোথায় গিয়ে কি হয়। আজব দুনিয়া।
প্রস্তুত সবাই। শুট রেডি। সাবিহা হুড়মুড় করে আসছে। তার মুখে ঝলমলে হাসি। সুন্দর হচ্ছে। ডিরেক্টর উৎসাহ দিচ্ছে। সভ্যর উপর পরার আগে সাবিহার মুখের হাসি এমনই থাকবে। কিন্তু মাঝপথে ঘটে গেলো অঘটন। সাবিহার মুখের হাসি ক্রমশ নিভে যাচ্ছে। মুখ কুঁচকে ফেলছে সাবিহা। সভ্য না চাইতেও অবাক হলো। ডিরেক্টর ধমকা ধমকি শুরু করে দিয়েছে। সাবিহার হেলদোল নেই। তার ভেতরে যেন অস্বস্তি হচ্ছে। অসুস্থ লাগছে নিজেকে। হঠাৎ সে এক অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটিয়ে দিলো। সভ্যর কাছাকাছি এসেই আচমকা হড়বড় করে বমি করে দিলো। সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলো। কোটর বিস্তর চাহনি। সাবিহা নেতিয়ে পরলো। সভ্য চোখ মুখ কুঁচকে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। সাবিহার মুখের জিনিস গুলো ঠিক তার বুকে এসে লেপ্টে গেছে। একটা মেয়ে এগিয়ে এলো সাবিহার নিকট। সত্যিই সাবিহার বেহাল দশা। সে দ্বিতীয় বার আবারও মেঝেতে গরগর করে বমি করে দিলো। মাথা ঘোরাচ্ছে আচমকা।
চলবে…….
#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_৯
দু দুবার বমি করে নেতিয়ে যাওয়া শরীর আরো অসাড় করে দিলো সাবিহা। যে মেয়েটা তার দশা দেখে এগিয়ে এসেছিল তাকেও হুট করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। মেয়েটা চমকে গেলো। সাবিহা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো
— প্লিজ আমার কাছে এসো না। পারফিউমের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না।
নীরবে আহত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে মেয়েটা পিছিয়ে এলো। সভ্য আধবোজা চোখে হনহন করে চলে গেলো ওয়াশরুমে। সে ভয়ংকর অস্বাচ্ছন্দ্যে চোখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। চোখ খুলে বুকের দিকে তাকাতেই সেও গরগর করে পেটের সব উন্মুক্ত করে দেবে। ছোট থেকেই সে খুঁত খুঁত মনের অধিকারী। সাবিহা মেঝেতে বসে দু’হাতে মাথা ধরে ঝিমোচ্ছে। ডিরেক্টরের মায়া হলো। মেয়ের মতো বয়সের সাবিহা। সকলের মাঝে কেউ কেউ বমি দেখে বিদ্বেষ মনা হয়ে চলে গেলো। শুধু রয়ে গেলো তিনজন। ডিরেক্টর, আগের সেই মেয়েটা আর একটা ছেলে। মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারা। অত্যন্ত সুন্দর মেয়েটা ঝিম মেরে প্রায় অগোছালো দশায় বসে আছে মেঝেতে। ধাতস্থ করতে ব্যাস্ত সে নিজেকে। চোখ মুখে রক্তিমা আভা খেলা করছে। সুন্দর মানুষ আরো সুন্দর হয়ে গেছে, বড্ড মায়াবী লাগছে।
— সাবিহা, উঠতে পারবে? ওয়াশরুমে যাও।
ডিরেক্টর কোমল স্বরে বলে উঠলো। সাবিহার চোখ বেয়ে হঠাৎ জল গড়িয়ে পরলো। ওয়াশরুমে যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু বমির ভাবটা যায়নি। মনে হচ্ছে উঠে দাড়ালেই মাথা ঘুরবে, আবারও বমি করে ভাসিয়ে দেবে ফ্লোর। বড্ড বিচ্ছিরি কান্ড হবে।
— তুমি উঠো। ভয় পেও না। কেউ কিছু বলবে না। তোরা ওকে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে যাও।
আবারও স্নেহ বাণী শোনালো ডিরেক্টর। তোরা মেয়েটা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো সাবিহার কাছে। সাবিহা বলেছিল তার পারফিউমের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না। নাকে মুখে বাম হাত চেপে সাবিহা উঠে দাড়ালো। তোরাকে আর ধরতে দিলো না। সঙ্কোচ আর লজ্জা যেন তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে। সে ছুটলো ওয়াশরুমের দিকে। যাবার আগে শ্রদ্ধেয় এক দৃষ্টি ডিরেক্টরকে দেখিয়ে গেলো। ওয়াশরুমের দরজায় যখন সে পৌছালো তখন সভ্য পাশের অন্য এক ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। কেউ তার শার্ট এনে দিয়েছে। এক হাতে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে আর অন্য হাতে ওয়েট টিস্যু নিয়ে মুখ মুছছে। সাবিহার একবার দৃষ্টি বিনিময় হলো সভ্যর সাথে। সেকেন্ড না গড়াতেই সভ্য চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেমন এক বিরক্তি আর অচেনা দৃষ্টির হদিস ছিল তার চোখে। সাবিহা শুধু দেখে গেলো। হুট করে তার বুকটা বিষিয়ে উঠলো। জ্বলে উঠলো, পুড়তে লাগলো হৃদয়। সভ্যর কি একটু উচিত ছিল না সাবিহা কে ওয়াশরুম অব্দি নিয়ে আসা? সবাই এখানে পর, চেনা হয়েও অচেনা। কিন্তু সভ্য তো সাবিহার কিছু না হয়েও কিছু। সাবিহা আকাশসম মন খারাপ নিয়ে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। আচমকা তার মন ওলোট পালোট। নিজের অজান্তে এলো এক ভয়াবহ ভাবনা। সভ্য তো সুষ্মিতার সাথে ভালোই ঢলাঢলি করে ছবি উঠতে পারে। আর সাবিহা একটু বমি করে দিতেই মুখ কুঁচকে ওয়াশরুমে দৌড় দিলো।
ফ্রেশ হয়ে সভ্য এগিয়ে গেলো সুষ্মিতার দিকে। ওখানেই বসার কয়েকটা চেয়ার আছে। বাকি জায়গা গুলো পূর্ণ। শুটিং স্থানের বেশ কিছু জায়গা জুড়ে সাবিহার উগড়ানো খাদ্য। দু একটা চেয়ার থাকলেও বসে থাকা যাবে না। সভ্য সুষ্মিতার ওদিকে এগিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা চেয়ার ছেড়ে দিয়ে দূরে বসলো। সুষ্মিতা আড় চোখে দেখলো। সভ্যর গলা ভেজা, চোখের বড় পাপড়ি গুলোয় পানির ছিটেফোঁটা। জড়িয়ে ধরে আছে তারা পাল্লব। বুকটা ধুকপুক করে উঠলো সুষ্মিতার। মন বলে এই ছেলেটা পৃথিবীর সমস্ত আকর্ষণ নিজের করে নিয়েছে। এই যে হাঁটুতে দু’হাতের কণুই রেখে ফোন ঘাটছে এতেও আছে বিশাল মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতা যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে বলে ‘ডুবে ডুবে জল খেয়ে যা’। সুষ্মিতা হাসলো। সভ্যকে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হলো সুষ্মিতা। কিন্তু এর মাঝে আকস্মিক এক কান্ড। সুষ্মিতার আন্তরআত্মা লাফিয়ে উঠলো। ওয়াশরুম থেকে চিৎকার করে বেরিয়ে আসছে সাবিহা। তার মুখের বুলিই একটা ‘ সভ্য ভাই, সভ্য ভাই’। ভারী আতঙ্কের গলা। সভ্য ততক্ষণে হকচকিয়ে উঠে পরেছে। সাবিহা হলরুমে এসে কান্না জুড়ে দিয়েছে। সবই চোখের পলকে হচ্ছে। সুষ্মিতার ডাগর চোখ জোড়া অদ্ভুত অবুঝপনায় ছেয়ে গেলো। হল রুমের আনাচে-কানাচের কীটপতঙ্গ গুলোও যেন ছুটে এলো সাবিহার কাছে। বিধ্বস্ত তার চেহারা। ভয়ের ছাপ চোখ মুছে অত্যধিক গাঢ়। কান্নায় দম আটকে যাওয়ার মতো দশা তার। সে কাউকে কিছু বলতো। মুখ হা করেছে। কিন্তু বলার আগেই আকস্মিক ঢল খেয়ে টুপ করে পরে গেলো মেঝেতে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো কয়েকটা মেয়ে। সভ্যও বিষ্ময় নিয়ে এগিয়ে গেলো। সুষ্মিতা কিছুই অন্তঃকরণ করতে পারলো না। পারলো না কেউই কিছু বুঝতে। হঠাৎ এমন কান্ড আস্ত নাটকীয় বৈ অন্য কিছু মনে হচ্ছে না।
.
অবচেতন সাবিহাকে মাথায় পানি ঢেলে, হাতে পায়ে তেল দিয়ে যখন জ্ঞান ফেরানো হলো তখনও সে ভয়ে তটস্থ। মাথা দিয়ে রক্ত রক্ত চুইয়ে পরে ঘারে জমে গেছে। কিছুটা জমেছে শাড়িতেও। এ দশা কারো চোখে পরেনি। সাবিহা যখন জ্ঞান ফিরে পেয়ে বলল তখন সবাই চরম অবাক। ডাক্তার ডাকতে চাইলো সবাই। কিন্তু সাবিহা বাঁধা দিলো। সে দৌড়ে সভ্যর কাছে গিয়ে বলল সে রাজশাহী যেতে চায়। তাকে এখনই এই মুহূর্তে রাজশাহী রেখে আসা হোক। সভ্য অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিল সাবিহার দ্বিধাহীন আবদারে। সকলে সরু চোখে চাইলো তার দিকে। সভ্য পরিচয়ে বলল তারা কাজিন। সভ্যর ছোট চাচার মেয়ে সাবিহা। এর বাইরের কঠিন সম্পর্কের কথা বলার মানেই হয় না। তারা কেউই তো মানে না এসম্পর্ক। উপস্থিত সকলে যখন জানলো সভ্য আর সাবিহা একই বাড়ির ছেলে মেয়ে তখন সবাই সাবিহার জন্য দুশ্চিন্তা করা ছেড়ে দিলো। ভার অর্পণ করলো সভ্যর কাঁধে। ডিরেক্টর আদেশ করলেন সভ্যকে যেন সে সাবিহাকে পৌঁছে দেয় উত্তম ভাবে বাসায়। সভ্য হাশফাশ করে উঠলো। ভোলে নি সে “অমাবস্যা, ভুত, মা ছেলে দু’জনেই কালো” – এর মতো বলা কথাগুলো। ওসব মনে জেগে উঠলে ফিরেও তাকাতে ইচ্ছে করে না সাবিহার পানে। শুধু চোখ দিয়ে ঝরে অঝোর ধারায় ঘৃণা। কিন্তু এই ঢাকা শহরে একা ছাড়াতে ইচ্ছে করলেও ছাড়া যাচ্ছে না সাবিহাকে। কিছু হলে ইমেজ নষ্ট তারই হবে। সভ্য তবুও ঠিক করলো ঘৃণ্যময়ী পাত্রীকে সে নিজে পৌঁছে দেবে না বাসায়। ফোন করলো আশরাফুল ইসলামকে। কিন্তু ঐ যে ভাগ্য! সেই যে তার নিয়তি। ফোন ধরলো না সাবিহার বাবা। সভ্য রেগে গেলো। থম মেরে কিয়ৎক্ষণ দাড়িয়ে থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো স্টুডিও থেকে। সাবিহা পিছু পিছু গেলো। কান্না তার চোখ মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। মাথার অসহ্য ব্যাথায় মন বলে এখনই বুঝি ঢলে পরবে মাটিতে। লুটিয়ে পরবে দেহখানি। সভ্য পিছু ফিরে তাকালোও না। সাবিহাকে সোহাগ করে ধরে নিয়ে আসা তো মাইল মাইল সূদুরের ব্যাপার।
.
মাথায় ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে গাড়ি ধরতে যেতে যেতে বেলা গড়িয়ে গেছে। আকাশপথে উড়াউড়ি করে জোয়ারে মেঘ। দিবস ফুরিয়ে আসছে রজনী। সূর্যের অন্ত তেজটায় গা ঘেমে শার্ট লেপ্টে গেছে সভ্যর গায়ে। গাড়ি মিললো না এ রাস্তায়। আচমকা নাকি এখান থেকে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত আজ গাড়ি চলাচল স্থগিত। সভ্য কুঞ্চিত কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে হাঁটছে। সাবিহা পাশেই। কেন সে আতক্ঙিত। কেন তখন ওভাবে ওয়াশরুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো তা সভ্য শোনার আগ্রহ প্রকাশ করেই নি। বিন্দুমাত্র না। স্টুডিও থেকে বেরিয়েছে নাগাদ মুখে মৌনতা।
–আমি হাঁটতে পারবো না।
হঠাৎ সাবিহার কান্নার সহিত বলা কন্ঠ। সভ্য কুঁচকানো ভ্রুতে পেছন ফিরে চাইলো। ধপাস করে বসে পরে রাস্তায় সাবিহা। সভ্য বলার কিছু পেলো না। তবে ঈষৎ অবাকতা ঠিকই ছুঁয়ে দিলো তাকে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে গেছে। হয়তো নামাজের সময় তাই রাস্তা প্রায় শুনশান। যানবাহন বলতে শুধু ধা করে মাঝেমাঝে দু একটা বাইক চলছে।
— আমার মাথা ব্যাথা করছে। ডিরেক্টরের ছেলে আমাকে মাথায় স্টিলের একটা দন্ড দায়ে বারি দিয়েছিল। আমার বমি বমিও লাগছে।
সাবিহা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল। সভ্য অবাক হলো। ডিরেক্টরের ছেলে কেন সাবিহাকে মারতে যাবে? মনে প্রশ্ন নিয়ে সভ্য দু’পা এগিয়ে সাবিহার কাছে দাঁড়ালো। সাবিহার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো তখনই। সে আবারও ফুপিয়ে ওঠা কান্না থমকে দিয়ে বলল
— আমি ওয়াশরুমে একা ছিলাম ও আমার সাথে নোংরামি করতে চেয়েছিল ওমনি আমি বেরিয়ে….
এটুকুই বলতে পারবো সাবিহা। তার পরই কান্নার দাপটে অস্পষ্ট হলো গলা। সভ্য হাসলো। অবজ্ঞা ভরা বিষমাখা হাসি। সাবিহা রাস্তার ধারের গাছের নিচে বসে কেঁদেই যাচ্ছে। রোড সাইডের বাসার বেলকনিতে কেউ দাড়িয়ে ছিল। অদ্ভুত চোখ মেলে সেই কিশোরী তাকিয়ে আছে। সভ্য বলল
— নিশ্চয়ই ভাত ছিটাতে গিয়েছিলে। ভাত ছিটালে তো কাক আসবেই।
সাবিহা কিছু বলল না। সভ্য খুব নজর করে হঠাৎ সাবিহা কে দেখলো। তারপরই চোখ গেলো উপরে। অচেনা মেয়েটার দিকে। সে বেলকনি হতে বড় বড় চোখ মেলে দেখছে তাদের। সভ্য সাবিহার নিকট গিয়ে বলল
— ওঠো, এটা হওয়ারই কথা। বাসায় চলো। রাস্তায় বসে নাটক কোরো না।
— আমি হাঁটতে পারবো না। আমার মাথা ব্যাথা করছে।
সভ্য এবার চরম বিরক্ত হলো। সময়ের গতিতে রাত বাড়ছে। শহরে এই পরন্ত বিকেলে না আবার ছিনতাই কারী আসে। আবার না ডিরেক্টরের ছেলের মতো অন্য কেউ আসে। ভাবনা বড্ড অস্বস্তিকর হলো। উপায় মিলল না। সাবিহা উঠছেও না। সভ্য পরাজিত, ক্লান্ত, বেদনার পথিক হয়ে অগত্যা অবধারিতভাবে কোলে তুলে নিলো সাবিহাকে। সাবিহার কান্নার জোর আরো বেড়ে গেলো। সে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো। এবার জল গড়িয়ে কানে যাচ্ছে। সে সভ্যর উদ্দেশ্যে বলল
— আমার মনে হয় সব শেষ। আপনিও ভালো না। আপনিই আমার সব শেষ করে দিয়েছেন। আমি কিছু হলে আমি আপনাকে ছাড়বো না। মিডিয়ায় নাম উজ্জ্বল হওয়ার আগেই আমি শেষ করে দেবো আপনার ভবিষ্যত।
সভ্য নির্বিকার হয়ে হাঁটতে লাগলো। বুঝলো না সে সাবিহার কথা। সাবিহা কেঁদেই যাচ্ছে। সভ্য একসময় শুধু বলল
— আমি তোমায় শখ করে কোলে তুলিনি সাবিহা। তুমি আমার কাছে আনলিমিটেড বিরক্তিকর। আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি ঘৃণার পাত্রী।
চলবে…………..
#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#বোনাস_পার্ট
বেশ কিছু দূর পর্যন্ত কোলে নিয়ে যেতে হয়েছে সাবিহাকে। তারপর বাসে ওঠা। সেখানে আরেক বিপত্তি পিছু ছাড়েনি। সাবিহার বারংবার তলপেট মুচড়ে উঠেছে। বাসের উদ্ভট এক গন্ধ নাকি তাকে জ্বালিয়ে মারছে। সভ্য সাবিহার পাশাপাশি বসা। বাস ছাড়ার আগ মুহূর্তে সভ্য দোকান থেকে কিছু পলিথিন আর পানির একটা বোতল ক্রয় করলো। সে নিশ্চিত ছিল সাবিহা আবারও সব খাদ্য উগড়ে দেবে। একটু আগে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যা যা খাইয়েছে সব বেরিয়ে আসবে। ভাবনার কোনো ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা না রেখে সত্যিই সাবিহা পরপর চার বার বমি করেছে বাসের মধ্যে। চলন্ত বাস। সভ্যর তখন মর মর দশা। সাবিহাকে একটার পর একটা পলিথিন দিতে দিতে সে হয়রান। একটু পর পর সাবিহা ঢলে পরে সভ্যর উপর। আবার হুশ ফিরতই মাথা তুলে জানালার দিকে হেলিয়ে দেয়। জেদ চাপে মনে। ভয়ে, রাগে, দুঃখে শুধু চোখে পানি চলে আসে। তীব্র কষ্ট যখন জেঁকে ধরে তখন আবার সভ্যর দিকে অসহায় আর কঠিন্যতায় ভরপুর দৃষ্টি তাক করে বলে
” আমার আশঙ্কা ঠিক হলে আমি আপনাকে ছাড়বো না। ”
সভ্য বোঝেই না সাবিহার কথা। অবজ্ঞায় পায়ে ঠেলে দেয়। মর্মার্থ উদ্ধার করারা মতো চিন্তা তার মাথাতেই আসে না। সে নিজেও অস্থায়ী খুটির মতো হেলেদুলে পরছিলো। বন্ধ চোখে উদ্গিরণ আটকাতে ব্যাস্ত। এক মুহূর্তে গিয়ে তার মনে হলো, তার মাঝেও বোধ হয় অহংকারের ছিটেফোঁটা আছে। এটা বোধ হয় তাদের বংশের আঁচ। আচ্ছা, কারো ওয়াক্ করা দেখে নিজের ওয়াক্ ওয়াক্ অনুভূতি হওয়া কি অহংকারের সামিল? সভ্য ভাবনার মাঝে নিঃশব্দে হাসলো। চোখ তার বন্ধ, পিঠ ঠেস দিয়ে রাখা বাসের ছিটে। সাবিহা বোধ করি তার হাসি দেখলো। তাকে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতে শোনা গেলো
— নিষ্ঠুর, অসভ্য মানুষ। নামের অপমান। সভ্য নাম হলেও চরম লেভেলের অসভ্য। আলট্রা অসভ্য।
সাবিহার কথা কানে আসতেই সভ্য ঝট করে চোখ মেলে চাইলো। সাবিহা ততক্ষণে নিজে চোখ সরিয়ে আঁধারের সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত। শব্দহীন কথা। সভ্য কিছু বলল না। তবে নীরবে সে রাগ নিবারণ করলো হাতের পলিথিন দিয়ে। হুট করে অতি শান্ত ছায়া মুখে নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো জানালার দিকে। যা পাঁচ সাতটা পলিথিন ছিল আলগোছে ছেড়ে দিলো জানালা দিয়ে। সেকেন্ড লাগলো না সেগুলোর নিজেদের অন্য অস্তিত্ব খুঁজে নিতে। উড়ে উড়ে যেন তারা মহা আনন্দে চলে গেলো। সাবিহা হতভম্বের দরুন হা করতে বাধ্য হলো। অসহায়ত্বের মিছিল ছাপিয়ে গেলো চোখ দু’খানায়। সভ্য করলো কি? তার যদি আবার বমি পায়? সাবিহা ঘুরে উঠে সভ্যর দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল
— এটা কি করলেন? আমার আবার বমি আসলে আপনার বুকের উপর করবো কিন্তু।
সভ্যর কোনো বিশেষ অভিব্যাক্তি প্রকাশ পেলো না সাবিহার কথার পিঠে । সে বিযুক্ত আঁখিতে আয়েশ করে বসে আছে। ভাব তার ঔদাসিন্য। সাবিহা এতো অনেক বেশি খাবারও খায়নি যে চার পাঁচ বার ওয়াক্ করার পরও তার পেটে কিছু থাকবে।
ঘুম নেমেছিল নয়নে। সুন্দর এক স্বপ্নও মিলেছিল স্বপনে। কিন্তু মাঝপথে হুট করে বাগড়া দিলো কেউ। মাথার সাথে মাথার সংঘর্ষ। ঠক করে আওয়াজ হলো। সভ্যর অপুষ্ট ঘুম তৎক্ষনাৎ উড়ে গেলো। চোখ মেলে কুঁচকানো কপালে চাইলো পাশে। সাবিহা দেহের সর্ব ভার তার উপর। বেঘোরে ঘুমায় সাবিহা। মাথাটা নিশ্চিতে রাখা সভ্যর কাঁধে। একহাতে শার্টের কলার খামচে ধরা। সভ্য অনিমেষ তাকিয়ে দেখলো ক্ষণকাল। পলক পরলো না চোখের তীব্র অবজ্ঞায় বা ভাবশূন্যতায়। এমন দশা কাটিয়ে উঠতে সভ্যর সেকেন্ড বিশেক লাগলো। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চাইলো সম্মুখে। ড্রাইভার যে কাঁচ দিয়ে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করে নিরন্তর ছুটে চালায় বাস সে কাচে সভ্যর মনোযোগ নিবদ্ধ। রাস্তা তিমিরে ডুবন্ত। হঠাৎ বহু দূর পরপর সাড়ি সাড়ি কিছু আলোর ছটা দেখা যায়। রাস্তার মাঝে ঠাঁই নিয়ে তারা অপরূপ হয়ে গেছে। সভ্য বুক ভারি করা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিলো চোখের পলকে। বিরবির করে বলে উঠলো শক্ত কন্ঠে
— স্বার্থপর!
.
রাত দু’টোর সময় সভ্য সাবিহাকে নিয়ে রাজশাহী পৌঁছালো। বাসায় দিয়ে নিজেও সাবিহার মায়ের থেকে তার ঘরের চাবি নিলো। শার্টে পানি ফেলেছে সাবিহা। শার্ট পাল্টে আবার তার ছোট মায়ের হাতে চাবি দিয়ে প্রস্থান করলো তৎক্ষনাৎ। টেনেও ধরে রাখা গেলো না তাকে। রাহেলা ইসলাম বেশ খানিকটা পথ সভ্যর পিছু পিছু গিয়ে অতঃপর বিদায় দিলো। সভ্য বেশ ভদ্রতাসূচক আচরণই করলো। রাহেলা ইসলাম আজ হুট করে সভ্যকে দেখে অপ্রস্তুত অনুভব করেছেন। কেমন পর পর লেগেছে। দামি দামি মনে হয়েছে। এই ছেলেকেই তো টিভিতে দেখা যায়। যখন বাংলা চ্যানেল গুলোতে বিরতি দেয় তখন দেখা যায় সভ্য একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে কেমন কেমন করছে। ভয় হয় সাবিহার মায়ের। অজানা, অহেতুক মন কু ডাকে। সাবিহা তো অবুঝের মতো অবজ্ঞা করে যায় সভ্যকে। সভ্যও যে ঢের বুদ্ধিমান, শীতল স্বভাবের তাও না। দু’জনেই শুধু পারে দলা দলা জেদ ছুড়ে মারতে। সংসার কি এদের স্থায়ী হবে? সভ্যর দিকে ঘুরতেই চায় না সাবিহা। সভ্যও যে এসে সাবিহার সাথে সৌহার্দ্য দেখাবে সেটাও করে না। দু’জনেই চলে নিজ অভিমতে। না কেউ বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে, না এক ছাদের নিচে মাথা রাখছে। সাবিহা পূর্বে ডিভোর্সের জন্য ছটফট করলেও ইদানীং কেমন হেলদোল দেয় না। বিষন্ন মন নিয়ে শুধু দিন পার করে।
.
আজ এই ঘন হওয়া অন্ধকার অন্ত হয়ে রাত্রি পেরিয়ে যাবে। সাবিহার চোখে ঘুম এসে ধরা দেবে না। বাসায় এসেই সে অস্থিরতা ওপর শাওয়ার নিয়ে আচমকা বমির হিসাব মিলাতে ব্যাস্ত। ইউটিউব দেখা শেষ। একটা সদ্য শিশু পেটে অবস্থান কালে কেমন হয় মায়ের দশা তা দেখলো সাবিহা। হৃদপিন্ড যেন ছুটে পালিয়ে যেতে চাইছে। হিসাব করলো সেই ডেইট। দু মাস হলো স্কিপ হয়েছে। মস্তিষ্কে একের পর এক আতঙ্কিত খবর পোঁছাতেই ক্রমশ থরথর করে হাত পায়ে কাঁপন ধরলো সাবিহার। শক্তি পাওয়া যাচ্ছে না শরীরে। বিছানা থেকে উঠার সাধ্য হচ্ছে না। সাবিহা বিরবির করে বলে উঠলো
— আল্লাহ, এমন কিছু যেন না হয়।
.
কিন্তু এমন দোয়া কবুল হলো না। পরদিন সাবিহা চলে গেলো হসপিটালে। ভয় রূপান্তরিত হলো বিপদে। ডাক্তার সোজাসাপটা রিপোর্ট দেখে বলে দিলো সাবিহা অন্তঃসত্ত্বা।
চলবে…..