#রঙ বেরঙের খেলা
#আলিশা
#পর্ব_৫
ক্ষুধার তাড়নায় চোখের ক্লান্তি ছুটে পালালো। ঘুম ছিল নাকি জ্ঞান ছিল না তা সাবিহা বুঝতে পারছে না। দেহ অসাড়, ক্লান্ত, ব্যাথায় কাতর। মাথার মধ্যে যেন ধুপ ধুপ করে কেউ হাটাহাটি করে জ্বালা দিচ্ছে। সাবিহার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো। চোখ মুখ শক্ত তার। শুধু রাগ আর কান্নার সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক অভিব্যাক্তি ছেয়ে আছে মুখে। সরু, চিকন, চিত্তাকর্ষণের নাকটা দমে দমে ফুলে উঠছে। রক্তের লাল আভা নাক, কান জুড়ে। সত্যি সত্যিই সভ্য অসভ্য ব্যাবহারটা করেছে তার সাথে। সাবিহার বাইশ বছর ধরে আগলে রাখা অহংকার গোপনে এক রাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বুক ভরা কষ্ট আর মাথা জুড়ে থাকা রাগ নিয়ে ডান পাশে দৃষ্টি দিলো সাবিহা। শূন্য, ফাঁকা ওপাশ। সভ্য নেই। গত রাতে সাবিহা কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। সভ্য বন্ধ চোখে শুধু শুনে গেছে সাবিহার কান্না। এক মুহূর্তে যখন সাবিহা সভ্যকে রাগে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে গেলো বিছানা থেকে ঠিক তখন সভ্য হাত মুচড়ে দিলো তার। এতোটাই নিষ্ঠুর ছিল তার আচরণ। সাবিহার রাগ হলো। গতরাতের ঝাঁঝটা সে এখন মেটাতে হুট করে শোয়া অবস্থাতেই পাশের বালিশটা ছুড়ে দিলো মেঝেতে। এমন সময়ই সভ্যর আগমন হলো ঘরে। মেরুর রাঙা শার্টের হাটা গুটাতে গুটাতে সে প্রবেশ করেছে। সাবিহার রাগ সভ্যকে দেখে তুঙ্গে উঠলো। সভ্য নিশ্চয়ই ফোন নিতে এসেছে। সাবিহার মাথার কাছেই ছিল ফোনটা। সভ্য যখন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে বিছানার কাছে গেলো। হাত বাড়ালো ফোনের দিকে ঠিক তখনই সাবিহা ছো মেরে ফোনটা নিয়ে পাশের দেওয়ালে ছুঁড়ে মারলো। সভ্য চমকে উঠলো। চোখ দু’টো যেন দেখলো মারুত চুল্লি।
— ঠিক এভাবেই আপনাকেও ছুড়ে ফেলার ইচ্ছে হচ্ছে আমার।
চিবানো কথা সাবিহার। সভ্য বাধ্য হলো পূর্ণ দৃষ্টিতে সাবিহার দিকে তাকাতে। তার ইচ্ছে ছিল না এঘরে আসার। এক্ষুনি বেড়িয়ে যাচ্ছিলো অনির্দিষ্ট দিনের মতো। মাত্রই ফোনের জন্য আসা। নিজের প্রথম পদক্ষেপ তো গত রাতে সম্পন্ন হয়েছে। এক ধাপ নিচে নামিয়ে দিয়েছে সাবিহার অহংকার।
— কয়লা ধুলেও সত্যিই ময়লা যায় না। সাবিহা, তোমায় আমি হাতে না মেরে ভাতে মারবো। তৈরি থেকো।
হাসি মুখের তিতা কথা সভ্যর। সাবিহা রেগে গেলো পুনরায়। সেও বিছানায় শুয়েই চিবিয়ে বলে উঠলো
— আমারও ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না।
সভ্য এবার মন থেকে মুচকি হাসলো। নিজ থেকেই ঝুঁকে পরলো সাবিহার মুখের উপর। সাবিহা বুঝি তার নিশ্বাস গুণে বলে দিতে পারবে এমন দশা। সভ্য তার গভীর চোখের গভীর দৃষ্টি সাবিহার মুখে তাক করে রহস্যের সুরে বলল
— তোমার পাতিলের ভাত খেয়ে উজাড় করে দিয়েছি আমি।
— সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। একদিন বেড শেয়ার করেই ভাববেন না আপনি জিতে গেছেন। আমি আগেও বলেছি আপনার সাথে আমি সংসার করবো না এখনও বলছি। আপনাকে আমার অসহ্য লাগে, এখন ঘৃণাও করছে।
— তোমার মুখের নেগেটিভ কথাগুলোই একদিন অ্যাফারমেটিভ হবে।
কথাটা বলে সভ্য আর এক সেকেন্ড রইলো না সাবিহার সম্মুখে। ফোনটাও কুড়াতে গেলো না। সে আর আস্ত নেই তা বোঝাই যাচ্ছে।
.
সভ্য সাবিহার রুম থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটা দিলো মায়ের কলেজের উদ্দেশ্যে। ফারজানা বেগম পেশায় একজন শিক্ষিকা। আধা সরকারি কলেজে তিনি কর্মরত। শশুর বাড়ি থেকে তিনি চাকরি করেন না। আলাদা ফ্লাট আছে তার। সভ্যর বাবা ছিলেন একজন ব্যাংকার। টাকা পয়সা এই বিত্তবান সমাজে বাস করার মতোই প্রচুর ছিল। একটা ফ্লাট কিনেছিলেন। এক ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে ওখানেই চৌদ্দ বছর সংসার করার পর তিনি বিদায় নেন চিরতরে। সভ্য আর সভ্যর মা সেই ফ্লাটেই থেকে আসছেন। তারপর সভ্য পড়ালেখার খাতিরে ঢাকা পরি জমায়। বাড়িতে আসা যাওয়া হয় হুটহাট। এভাবেই কাটে মা ছেলের দিন। তিন মিনিট হেঁটে রাস্তার মোড়ে পৌছে সভ্য রিকশা নিলো। মায়ের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্য তার টাকা। ফোন কিনতে হবে। মডেলিং-এ উঠার জন্য একটা কাউকে লাগবে। এমনি হুট করে তো আর মডেলিং এর খাতায় নাম লেখানো যাবে না। সাবিহাকে দেখিয়ে দিতে হবে সভ্যর একটা থু থুর দমও একদিন লাখ টাকা হবে। আর রূপ? শরীরের চামড়াটা তো আর ফর্সা করা যাবে না। তবে চকচকে ঝকঝকে করা যাবে। সাবিহা দু বছর হলো মডেলিং করছে। এখন অব্দি থিয়েটারে উঠতে পারেনি। ওর সবই ভালো হয় শুধু ক্যামেরার সম্মুখে গেলে আড়ষ্টতা কাটে না। আর অহংকারের জন্য সবার চোখে সে তিক্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলেই পরিচিত। কেউ মন থেকে ভালোবেসে তার সাথে কাজ করতে চায় না। ভাবনার মাঝে একসময় সভ্য পৌছে গেলো কলেজ গেটের সামনে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে মায়ের খোঁজ করতে লাগলো। আয়া জানালো ফারজানা ম্যাম ক্লাসে আছেন। সভ্য তথ্য নিয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করগে লাগলো। ইট সিমেন্টে গোল করে বাঁধানো বসার আসনে বকুল তলার সভ্য দাড়িয়ে রইলো। এখানে কেউ নেই। বাকি দিকে ছাত্র ছাত্রী ছোট খাটো দল নিয়ে বসে আছে আবার কেউ দাড়িয়ে আছে। সভ্য চোখে মুখে মৃদু বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে মায়ের জন্য। ইদানীং এত্ত গরম কেন পরেছে? পুরোনো কালের মানুষদের মতো মাথায় ছাতা নিয়ে হাঁটার জোগাড়। তার উপর কালো মানুষদের আরেক বিপত্তি। গরমে, ঘামে চেহারার রং আরো এক ধাপ মলিন হয়।
— এক্সকিউজ মি ভাইয়া।
ভাবনার মাঝে মেয়েলী রিনরিনে কন্ঠস্বর। সভ্য কুঁচকানো মুখ কুঁচকে ফেলল। এই গরমে আবার কোন মেয়ে মাথা গরম করতে আসলো? সভ্য বিরক্ত হলো প্রচুর। এ কারণেই তার মায়ের কলেজে আসতে ইচ্ছে করে না। এলেই মেয়েরা হ্যান ত্যান কাহিনি শুরু করে। স্টুডেন্ট জাতীর একটা মহা কর্ম হলো শিক্ষকের ছেলে মেয়ের সাথে প্রাঙ্ক করা। একবার তো একটা মেয়ে হাত পেতে সভ্যর হাতে কলম ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল
” যখন আপনি আপনার চোখের ভারি পল্লবে আলতো করে পলক ফেলেন তখন আমার নিশ্বাস আটকে আসে। আপনার গভীর, মায়া ভরপুর চোখের বড় বড় পাপড়ি বিশিষ্ট পল্লব দুইটা আমার মনে প্রেমের জোয়ার তোলে। অপরূপ সুন্দর আপনার চোখের হাসি। আমি কি আপনার ফোন নাম্বারটা পেতে পারি?”
এ ছিল এক কবি লারকি। সেদিন সভ্য মেয়েটার কথার আধা অংশই বোঝেনি। ছোট থেকেই তার কবিতা বা কবি কবি ভাবের উপমা, উপাংশ মাথায় ধরে না। মুহূর্তেই অতীতের ডায়েরির একটা পাতায় চোখ বুলিয়ে নিলো সভ্য। অতঃপর চাইলো আগন্তের পানে। চোখ ফেলতেই মিষ্টি একটা হাসি উপহার পেলো সভ্য। সুষ্মিতা রয়ে সয়ে বলে উঠলো
— সরি, আপনাকে হয়তো বিরক্ত করতে আসলাম। আসলে আমার একটা জরুরি ফোন করার ছিল। আপনি কি একটু আপনার ফোনটা আমায় দিতে পারবেন? দেওয়া যাবে কি?
সভ্যর প্রথমেই অচেনা মেয়েটাকে দেখে বুকের কষ্ট জেগে উঠেছে। রাগ হয়েছে। সাবিহার মতোই অপরূপ এই মেয়েটা। সভ্যর মনে তিক্ততা জন্মে গেছে রূপসীদের নামে। সে চোখ ফিরিয়ে নিলো মেয়েটা হতে। গম্ভীর সুরে বলে উঠলো
— সরি। আমি আপনাকে ফোন দিতে পারবো না।
সুষ্মিতা কুঞ্চিত কপালে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো সভ্যর পানে। বলে উঠতে পারলো না তৎক্ষনাৎ কিছু। আচ্ছা তাকে দেখে কি অভদ্র বা ছ্যাচড়া মনে হচ্ছে? একবার ভাবনা অনুযায়ী পরখ করলো সুস্মিতা নিজের পানে। কটকটে হলুদ রঙের একটা গাউন তার পরনে। পায়ে খর্বিত বেশ চমৎকার একটা জুতো সোভা পাচ্ছে। সুস্মিতা আত্মবিশ্বাসী হলেও আজ যেন ধাঁধায় পরে গেলো। বুদ্ধিমতী মেয়েটা থতমত ভাব কেটে উঠতে পারছে না। এরই মাঝে সভ্যর ডাক এলো। ফারজানা বেগম অদূর হতে ডাকছেন। সভ্য সুষ্মিতা কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। সুস্মিতা হাত বাড়ালো অজান্তেই। কিছু নেই বলার তবুও মন চাইলো কিছু বলতে। কিন্তু কি বলবে? ভেবে না পেয়ে নামিয়ে নিলো হাত। ডাকা হলো না। শুধু ক্ষণকাল স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। হুট করে এক সময় আপন মনে বলে উঠলো
— ছেলেটার চোখ দু’টো চমৎকার। বাবা তো ওদিন বলল চোখ সুন্দর দেখে একটা হিরো লাগবে তার। চোখ সুন্দর হিরো মিলছে না।
— ম্যাম স্যার ফোন করেছে।
সুস্মিতার ভাবনার মাঝেই তার ড্রাইভার ডেকে উঠলো। তার বাবা ছায়াছবি নিয়ে সবসময় ব্যাস্ত। হিরো হিরোইনদের পরিচালনা করার মাঝে হুট করে মেয়ের একটু খোঁজ খবরও রাখে বটে। সুস্মিতা দৌড়ে গেলো। এখন বাবার সঙ্গে কথা না হলে আর আগামী দশ ঘন্টায় কথা বলার ভাগ্য হবে না। ড্রাইভারের হাত থেকে ফোন নিয়ে সে অভিমানী সুরে আল্লাদ করে বাবাকে বলতে লাগলো
— আব্বু আমার ফোনটা আজকে হেরে গেছে। আমায় কি একটা ফোন কিনে দেবে? তুমি যদি আমায় ফোন কিনে দাও তাহলে আমি তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো।
ওপাশে ভারি কন্ঠ হতে হাসির ঝঙ্কার উঠলো। মেয়ের আহ্লাদী অবুঝ কথায় ভারি আনন্দ পান মোবারক হোসেন। সে জানে তার মেয়ে ইচ্ছে করেই অবুঝ অবুঝ কথা বলে। বাবার মুখে হাসি ফোটাতে।
চলবে…..
#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#বোনাস_পার্ট
— কত টাকা লাগবে বাপ?
ফারজানা বেগম ব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বললেন। সভ্য তার মোটা নয় পুরু নয় এমন সুন্দর ওষ্ঠাধর উল্টিয়ে ক্ষণিক ভেবে বলল
— চল্লিশ দিয়েই পার করা যাবে।
ফারজানা বেগম ব্যাগ থেকে একটা চাবি বের করে ছেলের হাতে দিতে দিতে বললেন
— আমার ঘরের ড্রেসিন টেবিলের ছোট ড্রয়ারে আছে। ওখান থেকে নিয়ে নিস। আর হ্যা, ফোন ভাঙলো কিভাবে?
সভ্য নিরদ্বিধায় বলে দিলো
— সাবিহা দেওয়ালে ছুঁড়ে মেরেছিল।
ফারজানা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হুট করে ব্যাস্ত মুখ ভঙ্গিতে নেমে এলো চিন্তার গাঢ় ছায়া।
— তুই কি চাস সাবিহার সাথে সংসার করতে?
সভ্য মায়ের কথায় প্রচন্ড গম্ভীর হয়ে গেলো। হাতের চাবিটা এহাত হতে ওহাতে মনোযোগ সহকারে স্থানান্তর করতে করতে বলল
— জানি না মা।
কথাটা বলে সভ্য মায়ের সম্মুখ হতে চলে এলো। ফারজানা বেগমকে আর এ বিষয় এগিয়ে নিয়ে যেতে দিলেন না। সে চায় সাবিহাকে জ্বালাতে। হৃদয় পুড়িয়ে খাঁক করে দিতে। সাবিহার মুখ থেকে শুনতে চায়
” আমার আপনাকে চাই সভ্য ভাই”
ভাবতে গিয়ে সভ্যর বুক চিঁড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। গত রাতের অমানবিক আচরের জন্য সে কখনো নুইয়ে পরছে তো কখনো জেগে উঠছে। ক’বার মেজাজ ঠিক রাখা যায়? সভ্যর রাগ বরাবরই উঁচু। এক চিপা, দুই চিপা, তিন চিপায় তো লেবুও তিতা হয়। আর সে তো মানুষ। অহরহ বার নিজের মাকে নিয়ে অপমান বাণী শুনতে কষ্ট হয় সভ্যর। সাবিহা তো পারতো রূপের অহংকার না করে সভ্যকে মেনে নিতে। সুখী একটা দম্পত্য জীবন তারাও পেতো। কিন্তু সাবিহা তা করলো না। উল্টো অপমান করতে লাগলো সীমা ছেড়ে। হয়তোবা সভ্য এবারও রাগে ভুল কিছুই করেছে। তবে তার মন বলে করা উচিত ছিল। সে যোগ্য হবে ঠিকই। অন্য ভাবেও হয়তো সাবিহাকে অপমানের পাল্টা জবাবা দিতে পারতো। কিন্তু সাবিহাকে জ্বালাতে পারতো না। সাবিহাকে নিজের মায়ায় বাঁধতে পারতো না। সেসময় সাবিহা এসে কখনো বলবে না তার সভ্যকে চাই। সে অন্য কাউকে জীবন সাজাতে ব্যাস্ত হতো। ভাবনা এখানেই সমাপ্তি করলো সভ্য। তবে নিয়তি হয়তো এখানে সমাপ্ত করেনি। হয়তো সে সভ্যর ভুলকে ভুল করে দেবে। নয়তো এই ভুলকে টেনে এনে কাল করে দাঁড় করিয়ে দেবে সামনের দিনগুলোতে।
.
রাত অনেক হয়ে এলো। শহর জুড়ে তবুও ব্যাস্ততা। মোবারক হোসেন মেয়ের বিশাল বড় বেলকনিতে দাড়িয়ে আছেন। চোখ ঘুরিয়ে দেখছেন মেয়ের রুমটা। এখানে ওখানে শুধু সবুজ রঙের সমাহার। টবের মেলা মেয়ের ঘরে। এমনকি তার মেয়ের বিছানার পেছনের দেয়ালটা পর্যন্ত সবুজ কার্পেট দিয়ে মোড়ানো। হাসলেন মোবারক হোসেন। মেয়ে যেন অতি দ্রুতই বড় হয়ে গেছে। এখন তার জন্য শাহজাদা খুঁজতে হবে। ভাবতেই ঠোঁটে হাসি আর বুকে বয়াথা এসে হানা দেয়। মা মরা মেয়েটা বাবার ব্যাস্ততা দেখতে দেখতে বড় হলো। কখনো অভিযোগ পর্যন্ত করলো না। বলল না
” বাবা তুমি আমায় একটুও আদর করো না। আমার জন্য তোমার সময়ই হয় না”
— বাবা, তুমি আমায় এতো আদর কেন করো? এতো ব্যাস্ত থেকেও আমার জন্য তুমি সময় ঠিকই বের করো।
সুস্মিতার হাসি মুখের কন্ঠ। ভাবনার মাঝে এমন কথা শুনে একটুও চমকালেন না মোবারক হোসেন। বরং হেসে উঠলেন। বেলকনি হতে ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললেন
— কিভাবে বুঝিস তুই? আমার ভাবনা গুলো খুব বুঝিস।
সুষ্মিতা ভেজা মুখে তোয়ালে চেপে বলল
— তুমি তো আমার ঘরে আসলে এটাই চিন্তা করো। তুমি আমায় সময় দিতে পারো না, আমি অনেক ভালো, অভিযোগ করি না।
— আমার মার্জিয়া যে আসলেই ভালো।
সুষ্মিতা হাসলো। হাতের তোয়ালে বিছানার এক কোণে রাখতে গিয়ে নজরে এলো তার ফেন। উৎফুল্ল মনে সে বাবাকে বলল
— বাবা তুমি ফোন এনেছো? তাহলে তো সারপ্রাইজ দিতেই হয় তোমাকে।
— হুম কি সারপ্রাইজ?
— তার আগে একটা কথা বাবা। তুমি আমাকে সুষ্মিতা বলে ডাকো না কেন?
— এ কথা তো তুমি জানো। সুষ্মিতা নামটা তোমার মা রেখেছিল। সুষ্মিতা ডাকতে গেলে তোমার মায়ের কথা মনে পরে।
— আচ্ছা। তাহলে আমি শুধুই মার্জিয়া। সুষ্মিতা নয়। এবার শোন, তোমার সুন্দর চোখের হিরো পেয়ে গেছি বাবা। আজ রাজশাহীতে গিয়েছিলাম ছোট খালা মণির কাছে। তনু আবার কলেজে ছিল। ওকে রিসিভ করতে গিয়ে হিরোর সাথে দেখা হয়ে গেছে।
মোবারক হোসেন মেয়ের কথায় বিস্মিত ও আনন্দিত। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন
— হাইট কেমন? পাঁচ ফুট সাতের বেশি হবে তো? কি করে ছেলে?
— কি করে তা জানি না বাবা। তবে অনেক বেশি স্মার্ট। চোখ গুলো সত্যিই দারুণ বাবা। অশোকের পুত্র কুনালের মতো হবে মনে হয়। আর হাইট পাঁচ ফুট নয়ের মতো হবে। এরচেয়ে বেশিও হতে পারে কিন্তু কম হবে না। কিন্তু গায়ের রংটা মলিন বাবা।
মোবারক হোসেন মেয়ের কথার পিঠে বললেন
— গায়ের রং কোনো ফ্যাক্ট নয়। স্মার্ট হলে সবাইকে সুন্দর লাগে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাই আসল। আর মিডিয়া জগতে আসলে কালো মানুষ সামা হয়ে যায় আর সামা মানুষ ফর্সা হয়ে যায় মা।
মার্জিয়া হাসলো। ভাবলো কিছু একটু সময় নিয়ে। তারপর বলল
— সে কোনো মডেল নয় মনে হয়। মডেল না হলে, অভিজ্ঞতা না থাকলে তো হুট করে তাকে সিনেমায় তোলা যাবে না তাই না বাবা?
— হুম।
— আমি তো তাকে চিনিও না বাবা। তুমি না হয় তার আশা ছেড়ে দাও। অন্য কাউকে খোঁজো। সে নিজেও মিডিয়া জগৎ পছন্দ করে কিনা সেটাও একটা ব্যাপার।
মোবারক হোসেন সায় জানালেন মেয়ের কথায়। এক কথা দু কথা বলতে বলতে তারা প্রসঙ্গ পাল্টে নিলো। মেতে উঠলো খোশগল্পে।
.
বড্ড বেশিই ব্যাস্ত সভ্য। জিম করা, রুটিন মাফিক খাওয়া, বড় বড় মডেলদের সম্পর্কে স্টাডি করতে গিয়ে তার দম ফেলবার সময় হচ্ছে না। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে জেদ চেপে থাকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর। আজ পনেরো হয়ে যাচ্ছে। ছোটাছুটি, দৌড় ঝাপের উপর আছে সে। এক বন্ধুর সাহায্যে বহু কষ্টে সাক্ষাৎ করা হয়েছিলো এক কোম্পানির সাথে। পত্রিকায় ছবি ছাপাবে তারা ছেলেদের পোষাক নিয়ে। সভ্য যোগাযোগ করলো। বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে ঠাঁই হয়েছে তার। দশ দিন হলো প্রচেষ্টা করে, পরিশ্রম করে সিলেক্ট হয়েছে। কাল তার যথাসময়ে যেতে হবে তাদের কাছে। ভালোয় ভালোয় সব হলেই হয়। এরমাঝে সাবিহার সাথে আর কোনো প্রকার যোগাযোগ হয়নি তার। সাবিহার মা বাবা সভ্যর মায়ের সাথে অবশ্য মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের বিষয়ে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা দু’জনের অবস্থা। কেউ কারো ধার ধারছে না। তারা চিন্তিত।
চলবে….