রঙ তুলির প্রেয়সী
১৬.
তিথি ভেবে রেখেছিলো মটর ঠিক হওয়ার পরে গোসল করে নেবে। কিন্তু আজ ঠিক করা যাবে না। যা গরম, গোসল না করলেও হবেনা। পুকুরেই গোসল করতে হবে। ইশ, আগে জানলে আদিয়ার সাথে গোসল করে নিতো। এখন একা একা করতে হবে। লাঞ্চেরও সময় হয়েছে, লাঞ্চ রেডি করা হচ্ছে। মনে মনে ঠিক করলো তিথি খাওয়াদাওয়া শেষে শান্তিতে গোসল করবে। বাথরুমে বালতিতে রাখা ছিলো কিছু পানি, সেগুলো দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। বাথরুম থেকে বেরোতেই আদিয়া বললো, ‘তিথি চল। খেতে ডাকছে।’
‘হুম।’ বলে আদিয়ার পিছু পিছু গেলো তিথি।
_____________
বড়মামার রুমটা হচ্ছে এখানে সবচেয়ে বড়। তাই এই রুমেই ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে খাবারের আয়োজন করা হলো। টেবিলে সবার জায়গা হয়না। তাছাড়া হেলাল আহমেদ এখানে এলে এভাবেই খেতে পছন্দ করেন। উনার মতে, সবাই একসাথে খাওয়ার মাঝেই আনন্দ। তিথি দেখলো সবাই গোল হয়ে বসে অপেক্ষা করছে বাকিদের জন্য। আদিয়া আর তিথি আসার সাথেসাথেই নুহা আর ফাহিও এলো। জাওয়াদের বড় মামা আফতাব হোসেন ফাহিকে ডেকে বললেন, ‘আয় এদিকে আয় তোরা। এখানে জায়গা আছে।’
রিয়াদ একটু বামে চাপলো। মনে প্রাণে চাইলো তার পাশেই যেনো ফাহি বসে। আর তা-ই হলো। আস্তে আস্তে জড়সড় হয়ে বসলো ফাহি, রিয়াদের পাশে। সবার অগোচরে একবার চোখাচোখি হলো দুজনের। নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিলো ফাহি। আদিয়া এসে বসলো ফাহির পাশে আর একেবারে শেষে তিথি বসলো। জাওয়াদ রিয়াদের পাশেই বসে আছে। জাওয়াদের পাশে জায়গা খালি দেখে খুশিমনে নুহা এসে বসেছে ওখানে। জাওয়াদ খেয়াল করেনি নুহা তার পাশে বসে আছে। নুহাও কোনো টু শব্দটি করলোনা। মুনতাহা সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করলো, ‘মা, ছোট মামাকে দেখছিনা যে?’
‘কী একটা জরুরি কাজের জন্য কল এসেছে। যেতে হয়েছে উনাকে।’ বললেন জাওয়াদের ছোট মামী আঞ্জুমান।
‘ওহ আচ্ছা, আর সাহিলের স্কুল যেনো ছুটি হয় কটায়?’
‘বিকেল চারটা।’
তিথি ফিসফিস করে আদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘সাহিল কে?’
আদিয়াও ফিসফিস করে জবাব দিলো, ‘ছোট মামার ছেলে। ক্লাস থ্রি তে পড়ে।’
‘আলতাব কি এবার ভালোভাবে কাজে মন দিলো?’ আফতাব হোসেন এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন হেলাল আহমেদ।
‘হ্যাঁ, করবেনা? ছেলে বড় হচ্ছে। দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে তো।’ খেতে খেতে বললেন আলতাফ হোসেন।
জাওয়াদের বড় মামি মেহেরুন তরকারির বাটি নিয়ে তিথির পাশে গেলেন। তিথির প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘শোনো মেয়ে, একদম লজ্জা পাবে না। কী পাখির মতো কুটকুট করে খাচ্ছো? ঠিকমতো খাবে। শরীর বাড়াও। এতো স্লিম ফিগার করতে হবেনা। তোমরা আজকালকার মেয়েরা না!’
তিথি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসলো। কথাটা শুনে জাওয়াদ একবার মাথা বাকিয়ে দেখলো তিথিকে। তারপর নিজেই আনমনে হেসে দিলো। মনে পড়ে গেলো তিথির সেই গানের কথা। হাসতে হাসতে একবার বামদিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে। নুহা তার পাশে বসে বসে খাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত যেনো সামলে উঠতে পারলোনা জাওয়াদ। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে রাগ হজম করলো। একটা মেয়ে কতোটা নির্লজ্জ হতে পারে? লজ্জা থাকলে এভাবে তার পাশে এসে বসার সাহস হতো না। জাওয়াদের ইচ্ছে করছে খাবার ছেড়ে উঠে যেতে। কিন্তু সব বড়রা এখানে, এমন করতে পারবেনা সে। জাওয়াদ খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নুহা ভয় ভয় চোখে তাকালো ওর দিকে। রিয়াদ জিজ্ঞেস করলো, ‘উঠলি কেন?’
‘গরম লাগছে এখানটায়। ঠিকমতো ফ্যানের বাতাস আসছেনা।’ গমগমে গলায় বললো জাওয়াদ।
‘কী বলিস? আমার তো ঠি…’ কথা বলতে গিয়ে রিয়াদের চোখ পড়লো নুহার দিকে। আসল ব্যাপারটা বুঝে গেল সে। কিছু বললোনা আর। জাওয়াদ হেটে গিয়ে তিথির পাশে বসে পড়লো। বসার সময় তিথির হাতের সাথে জাওয়াদের হাত ঘষা খেলো। তিথি সবে একটা লোকমা মুখে দিয়েছিলো। জাওয়াদের স্পর্শ পেয়ে যেয়ে সে সাথেসাথে বরফ হয়ে জমে গেল। মুখের খাবারটা সে গিলতে পারছেনা। হাতের যে জায়গায় হাওয়াদের ছোঁয়া লেগেছে সে জায়গাটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছেনা তিথি। মনে হচ্ছে সেই জায়গাটা খুলে পড়ে গেছে। তিথি খাবার মুখে নিয়ে একবার জাওয়াদের দিকে তাকালো। দেখলো জাওয়াদ মন দিয়ে খাচ্ছে। তিথি আদিয়ার দিকে একটু চেপে বসে খেতে লাগলো। কিন্তু বারবার অস্বস্তি হচ্ছে তার। আদিয়া তিথিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তিথি, পাটপাতা চাটনী নিবি?’
তিথি আমতাআমতা করে বললো, ‘ন-না, ক-কাঠাল বিচি ভর্তা দে।’
‘আমাকে দে, আদিয়া। পাটপাতা চাটনী।’ জাওয়াদ বললো।
আদিয়া তিথিকে কাঠাল বিচি ভর্তা দিয়ে তারপরে জাওয়াদের দিকে চাটনীর বাটিটা এগিয়ে দিলো। জাওয়াদ নিজের প্লেটে চাটনী নিতে নিতে বললো, ‘এটা খাওয়া অনেক ভালো, তিথি। খেতেও সুস্বাদু।’
সাথেসাথে তিথি নাকমুখ কুঁচকে বলে উঠলো, ‘এইগুলা খায় কেমন করে, আল্লাহ! কেমন পিচ্ছিল পিচ্ছিল। ভাতে মাখানোর সময় হাতে যখন লাগে, তখন একদম বাচ্চাদের নাক থেকে ঝরে পরা ইয়ের মতো লাগে দেখতে।’
সবাই খাওয়া থামিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তিথির দিকে। পাটপাতা জাওয়াদের অনেক পছন্দের। তারথেকেও বড় কথা, জাওয়াদ এসব কথাবার্তা মোটেও পছন্দ করেনা। মুনতাহা আর জাওয়াদের মামীদের মনে আতঙ্ক ভর করলো, জাওয়াদ না আবার রেগে যায়। আদিয়া ফাহির দিকে তাকিয়ে করুন মুখে ফিসফিস করে বললো, ‘বড় ভাইয়া রেগে যাবে এবার! এই মেয়েটাকে নিয়ে পারিনা।’
সবাইকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো জাওয়াদ। রিয়াদ আর হেলাল আহমেদ অনেক কষ্টে হাসি আটকে রেখেছিলেন, এবার উগড়ে দিলেন। তাদের দেখাদেখি বাকিরাও হাসতে লাগলো। তিথি মুচকি মুচকি হাসে। জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলে, ‘তিথি, তোমার কথায় মনে হচ্ছে তুমি বাচ্চাদের নাকের ইয়ে হাতে নিয়েছো।’
‘ছিঃ! কী খচ্চড়ের মতো কথাবার্তা। খাওয়ায় বসে এসব কী?’ রাগত্ব স্বরে বলে তিথি।
জাওয়াদ অবাক হয়ে বললো, ‘আইসসালা! শুরুটা করলে তুমি।’
‘একদম না, আমি নরমাল কথা বলেছি।’
‘তাহলে তো আমার টা দুধভাত।’
এইভাবে খাবার রেখে দুজনে তর্কাতর্কি করতে লাগলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, জাওয়াদ এর আগে কোনোদিন কারো সাথে একটার বেশি দুটো কথা বলেনি। সবাই যারপরনাই অবাক। আদিয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে একবার রিয়াদের দিকে তাকায়। দেখে রিয়াদ হাসছে। আদিয়া অনুভব করলো তার কেমন যেনো শান্তি শান্তি লাগছে। ভাইকে এতোদিন পর আগের মতো দেখতে পেয়ে হয়তো। আদিয়ার চোখ পড়লো তার মা বাবার দিকে। দুজনের মুখে তৃপ্তির হাসি।
মাথা নিচু করে খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে নুহা। আঙুল নাড়ছে শুধু। টুপ করে গাল বেয়ে এক ফোটা জলের রূপ নিয়ে গড়িয়ে পড়লো জেদ, হিংসা, রাগ। খুব কথা বলা হচ্ছে না? খুব হাসি হচ্ছে? জাওয়াদের শরীর ঘেষে বসা হচ্ছে। নুহার ইচ্ছে হচ্ছে সব পুড়িয়ে দিক, আগুন লাগিয়ে দিক। পুড়িয়ে ছারখার করে দিক সব। তিথিকেও…
__________________
বিকেল চারটা। ফাহি আর আদিয়া SOS খেলছিলো। খাতার মধ্যে কুতকুত খেলার ঘরের মতো অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর বানিয়ে, তার মধ্যে দুই পক্ষ S আর O এর মধ্যে যার যার ইচ্ছেমতো অক্ষর নিয়ে বসাতে থাকবে। যখন একজনের দানে এসে SOS মিলিত হয়ে যাবে তখনই গেইম হবে। এই খেলা টাকে SOS বলে। তিথি অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছে হাতে কাপড় নিয়ে, পুকুরে গোসল করবে বলে। আদিয়াকে সাথে নিয়ে যাবে। কিন্তু খেলাই শেষ হচ্ছেনা। এমন সময় নুহা আসলো। আদিয়া নুহাকে বললো, ‘নুহাপু ফ্রি আছো?’
নুহা একবার তিথির দিকে তাকালো। তারপর আদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, কেন?’
‘তিথিকে নিয়ে একটু পুকুরে যাবে? গোসল করে নিক।’
নুহা প্রচুর বিরক্ত হলো। কিন্তু প্রকাশ করলোনা। বললো, ‘ঠিক আছে।’ তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি বাইরে যাও। আসছি আমি।’
তিথি হেসে বেরিয়ে গেল। নুহা ওয়াশরুমে গেল। তারপর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুমের বাইরে যেতে নেবে তখনই আদিয়া বললো, ‘নুহাপু একটা মগ নিয়ে যাও প্লিজ। তিথি সাঁতার জানেনা। আর ওকে বলে দিও তিন নাম্বার সিড়িতে যেন না নামে। ওটাতো খুব পিচ্ছিল।’
নুহা খানিক চমকালো। তারপর তার মুখে হাসি ফুটলো। সে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল।
_________________
পুকুরের দু’ধারে প্রচুর বনুয়া গাছপালা। তিথি সেগুলো মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলো। চুল খুলে রাখা তিথির, সেই চুল কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর একটু উপরে এসে ঠেকেছে। সেদিকে তাকিয়ে নুহার যেন কপালের রগ ফুলে উঠতে চাইছে। জাওয়াদের লম্বা চুল পছন্দ! লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নুহা তাড়া দিয়ে বললো, ‘তিথি, তাড়াতাড়ি করো। যাও দুটো ডুব দিয়ে তাড়াতাড়ি আসো।’
তিথি আস্তে করে বললো, ‘আমিতো সাঁতার জানিনা, আপু।’
‘ডুব দিতে সাঁতার জানতে হয়না। তাছাড়া পাঁচ ছয় সিঁড়ি পর্যন্ত আমার ঠাই হয়, তাহলে তোমারও হবে। এতো ভয় পেওনা।’ বলে হাসলো নুহা। তিথি পানিতে থাকা প্রথম সিঁড়িতে পা দিলো। তারপর নুহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সাপ টাপ নেইতো আপু? অবশ্য সাপ যতোটা না ভয় পাই তারথেকেও জোঁকে ভয় পাই।’
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
‘আরে না। এসব নেই। পানিতে খুব বেশি হইচই না করলে জোঁক আসেনা।’
‘আচ্ছা।’ বলে আরেক সিঁড়ি নামলো তিথি। ভেতরে কেমন একটা ভয় ভয় কাজ করছে। এভাবে একা একা কোনোদিন পুকুরে নামে নি সে। নুহার চোখ তিথির পায়ের দিকে। নুহা অপেক্ষা করছে কখন তিন নাম্বার সিঁড়ির ওপর পা ফেলবে তিথি। যখনই তিন নাম্বার সিঁড়িতে ডান পা রাখলো তিথি, তখনই নুহা আতঙ্কিত গলায় বললো, ‘আরে তিথি, তোমার পায়ে তো জোঁক!’
কথাটা শোনার পর তিথির মনে হলো কেউ যেন তার কানে আগুন ঢেলে দিয়েছে। ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে আসতে চাইলো তিথি। ফলাফল- ভারসাম্য হারিয়ে পিছলা খেয়ে পানিতে আছড়ে পড়লো সে। সাঁতার না জানা তিথি চিৎকার করে নুহাকে ডাকছিলো আর হাতপা ছুড়ছিলো পানিতে। তা দেখে নুহা পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিলো। কিন্তু এই আনন্দ তো দেখানো যাবেনা। সে গলায় মেকি আতঙ্ক রেখে বললো, ‘আরে আরে, এ কী হলো, তুমি চিন্তা করো না তিথি। আমি কাউকে নিয়ে আসছি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।’ বলেই ছুট লাগালো নুহা। মুখে তার তৃপ্তির হাসি। এইখান থেকে চিৎকার দিয়ে গলা ফাটিয়ে দিলেও কেউ শুনবেনা বাড়িতে, কেউ না।
ঘরে আসার পর আদিয়া বললো, ‘তিথিকে ফেলে এলে যে?’
নুহা হেসে বললো, ‘আরে আমার সামনে গোসল করতে লজ্জা পাচ্ছিলো। বললো সে পারবে, আমাকে চলে আসতে বললো।’
‘ও।’ বলে আবার খেলায় মনোযোগ দিলো আদিয়া।
নুহা হাসছে। মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে তার।
_____________
চলবে………
@ফারজানা আহমেদ