রঙ তুলির প্রেয়সী
১৪.
‘ফাহি, ও ফাহি, এদিকে আয় তাড়াতাড়ি আয়। হ্যারে এতোদিন পরে বুঝি আমার নাতিটার অভিমান ভাঙ্গলো রে! ও বড় বৌমা, আরে কই গেলে তোমরা?’ হাঁক ছাড়লেন চাঁনতারা বেগম। মুখ তাঁর উজ্জ্বল। চোখ চিকচিক করছে খুশির অশ্রুতে। যেনো এক্ষুণি টুপ করে পড়বে গাল বেয়ে। শাড়ির আঁচলে সাবধানে চোখ মুছে নিলেন।
‘নানু, এভাবে চিল্লাতে তোমাকে কতোবার মানা করেছি বলোতো! এমন করলে শরীরের ক্ষতি হবে।’ চায়ের কাপটা বিছানার পাশে টুলের ওপর রেখে বললো নুহা।
‘আরে আমার তো ইচ্ছে করছে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচি। সেই শক্তি তো আর শরীরে নেই।’ উল্লাসে ফেটে পড়ে বললেন চাঁনতারা বেগম।
‘কী এমন হয়েছে শুনি? আর আমার মোবাইলটা কই রাখলা দাদু?’ রুমে ঢুকেই এদিক ওদিক নিজের মোবাইল খুঁজতে লাগলো ফাহি।
‘তোর মোবাইল নানুর হাতে।’ বললো নুহা। ফাহি চাঁনতারা বেগমের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ব্যাপার কী?’
চাঁনতারা বেগম ফাহির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা তো, বেশি করে তুঁতফল পেড়ে নিয়ে আসবি। কাঁচাগুলো ঝাল দিয়ে চাটনি করবি। ধনেপাতা দিবি। আদিয়া বলে দিয়েছে এমন করে রাখতে। আর পাকাগুলো আলাদা রাখবি। আমার জাওয়াদ খুব পছন্দ করে পাকা তুঁতফল।’
জাওয়াদের নাম শুনতেই চমকে উঠলো নুহা। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘যাওয়ার সময় সাথে নিয়ে যাবে? তাহলে হালকা পাকা যেগুলো সেগুলো গাছেই থাকুক। ওরা তো থাকবে আজকে সবাই। যাওয়ার সময় পাড়া যাবে। তখন পেকেও যাবে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। নুহা আপু ঠিক বলেছে।’ হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলালো ফাহি।
‘বেশি কথা বলিস কেন? যাওয়ার সময় তো নিয়ে যাবেই। এখন এসে খাবে না? আমি সেজন্যেই পাড়তে বলেছি।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন চাঁনতারা বেগম। তারপর টুলের ওপর থেকে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, ‘দুটোতে মিলে গল্পে লাগাইলি আমাকে। চা টা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। যাই তো একটু রান্নাঘরে। চা ও গরম করে দিতে বলবো।’
‘কিন্তু দাদু জাওয়াদ ভাইয়া তো আ…’
ফাহিকে থামিয়ে দিয়ে চাঁনতারা বেগম হেসে বললেন, ‘আসবে আসবে। জাওয়াদ আসবে। এক্ষুণি আমাকে রিয়াদ বললো। যাই যাই, আমি গিয়ে বলি পাটপাতা চাটনি আর কাঠাল বিচির ভর্তা করে রাখতে। আমার জাওয়াদটা কতো পছন্দ করে!’ বলে বেরিয়ে গেলেন উনি। উনি বেরিয়ে যেতেই ফাহি বললো, ‘নুহাপু! শুনলে তুমি? জাওয়াদ ভাইয়া আসবে! কত্তোদিন পর আমরা সব কাজিনসরা একসাথে হবো!’
নুহা যেন খানিক স্তব্ধ হলো। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা জাওয়াদ আসবে। জাওয়াদ সত্যিই আসবে? সে একবার তাকালো ফাহির দিকে। ফাহি হাসছে। হেসে দিলো নুহাও। কেমন যেন কান্না পেয়ে যাচ্ছিলো তার। কতোদিন… কতো কতো দিন পর দেখতে পাবে সে জাওয়াদকে…
_________________________
একটা গাড়িতে টুনি, হেলাল আহমেদ আর মুনতাহা যাচ্ছেন। আরেকটা গাড়িতে জাওয়াদ, রিয়াদ, আদিয়া আর তিথি। গাড়ি চলছিলো। হেলাল আহমেদ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসেছিলেন। পেছনে মুনতাহা আর টুনি। হেলাল আহমেদ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললেন, ‘জাওয়াদকে কীভাবে রাজি করালে?’
মুনতাহা বললেন, ‘আমি কিছুই করিনি। আমি তো ভেবেছিলাম বরাবরের মতোই তোমার ছেলে আসছেনা। আমিতো একটু আগেই দেখলাম গাড়িতে উঠছে। যা করার রিয়াদই করেছে।’
‘তাই বলো। যাই হোক, অনেকদিন পরে সবাই একসাথে যাচ্ছি। ভালো লাগছে খুব।’
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মুনতাহা কিছু বললেন না। সিটে হেলান দিয়ে বসলেন। পাশে বসা টুনি খানিকক্ষণ পরপর জানালার দিকে মুখ করে ওড়নায় মুখ চেপে হাসছে। তার কারণ হচ্ছে সামনে বসা ড্রাইভার আব্দুল লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়েছে ওকে। টুনির এই বারবার হাসি নজর এড়ালোনা মুনতাহার। তিনি একবার ওর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকালেন। টুনি ঘাড় ঘুরাতেই দেখে মুনতাহা কপাল কুঁচকে দেখছেন তাকে। সে চট করে আবার জানালার দিকে তাকালো। তার বুকটা দুরুদুরু করছে।
তিথি ডানদিকে বাকা হয়ে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। এক সেকেন্ডের জন্যও সে সোজা হয়ে বসতে পারছেনা। কারণ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে জাওয়াদ বসে আছে। লুকিং গ্লাসটা একেবারে নিজের দিকে দিয়ে রেখেছে। সোজা হয়ে বসলেই লুকিং গ্লাসে জাওয়াদের মুখ দেখা যাচ্ছে। তিথি ডানদিকে বসার কারণে জাওয়াদের ডানদিকের সাইডও দেখা যাচ্ছে। জাওয়াদ একটু মাথা নাড়ালেই তিথির চোখে চোখ পড়ছে। মহা মুশকিল হয়েছে, এদিকে একসাইড হয়ে বসতে বসতে ডান হাতটায় চাপ লাগছে, কোমরেও খানিক ব্যথা করছে। হঠাৎ পাশ থেকে আদিয়া বলে উঠলো, ‘এই তিথি, এভাবে বসেছিস কেন? এদিকে ফিরে বস গল্প করি।’
আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসলো তিথি। বসতেই চোখ পড়লো সামনে আর সেই একই অবস্থা! দেখলো জাওয়াদকে। সমস্যা হচ্ছে জাওয়াদকে দেখলে চোখ ফেরাতে পারছেনা তিথি। হালকা নীল রঙের একটা টি-শার্ট পরেছে সে। এই একেবারে নরমাল ড্রেসআপেও চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তিথির ওর দিকে তাকালেই। আরো বেশি লজ্জা লাগছে তিথির কারণ সেও একইরকম নীল রঙের টপস পরেছে। যদিও এখানে লজ্জা লাগার কিছু নেই তারপরেও তিথির খুব লজ্জা লাগছে। হঠাৎ করে তিথির কী হয়ে গেল, জাওয়াদের দিকে তাকালেই দুনিয়ার সব লজ্জা এসে তার ওপর ভর করে। এমন কেন হচ্ছে সে জানেনা। রিয়াদ ড্রাইভ করছিলো। সে বললো, ‘তিথি কিছু খাবে? চকলেট বা আইসক্রিম?’
‘ন-না ভাইয়া, লাগবেনা কিছু।’ মিনমিন করে বললো তিথি।
আদিয়া বললো, ‘এই আসার সময় না বললি আইসক্রিম খাবি?’
এটা শোনার সাথেসাথে পেছনে ফিরে তাকালো জাওয়াদ। তিথির চোখে চোখ পড়লো। তিথির যেন একটুর জন্য মনে হলো নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। সে চোখ ফিরিয়ে আদিয়াকে বললো, ‘না এখন লাগবেনা।’
‘একটু বনফুলেরর সামনে ব্রেক করিসতো রিয়াদ।’ জাওয়াদ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো। তারপর পেছনে ফিরে আদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন ফ্লেভার?’
আদিয়া খুশি হয়ে বললো, ‘চকলেট চকলেট।’
তিথি জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তিথি তুমি কোন ফ্লেভার খাবে?’
এই প্রথম জাওয়াদের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো তিথি। মেরুদণ্ডে যেনো এক শীতল বাতাসের ঝাপটা লাগলো। কানের মাঝে বাজতে লাগলো জাওয়াদের বলা লাইনটা, ‘তিথি তুমি কোন ফ্লেভার খাবে? তিথি তুমি কোন ফ্লেভার খাবে? তিথি তুমি কোন ফ্লেভার খাবে?…’
‘তিথি…’ আবার ডাকলো জাওয়াদ। হুঁশ হলো তিথির। সে বললো, ‘হ-হ্যাঁ!’
জাওয়াদ বললো, ‘বললেনা কোন ফ্লেভার?’
‘চ-চকলেট…’
‘কুল।’
বনফুলের সামনে গাড়ি থামালো রিয়াদ। জাওয়াদ নেমে গিয়ে তিনটা আইসক্রিম কিনে আনলো। এসে গাড়িতে বসে পেছনে আদিয়ার হাতে দুইটা দিলো। আর একটা সে নিজের হাতে রাখলো। রিয়াদ গাড়ি স্টার্ট দিলো। তিথি আইসক্রিমটা হাতে নিয়ে বসে থাকলো। আস্তে আস্তে আঙ্গুল বুলালো। একটু আগে এই আইসক্রিমটা জাওয়াদের হাতে ছিলো। জাওয়াদের হাতের ছোঁয়া আছে এটাতে। আনমনে হাসলো তিথি। আইসক্রিম খেতে খেতে সামনে তাকাতেই দেখে জাওয়াদ লুকিং গ্লাসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিজে একটু আইসক্রিম খাচ্ছে, তারপর হাত বাড়িয়ে রিয়াদকে খাইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাকিয়ে আছে লুকিং গ্লাসে তিথির দিকে। তিথির কেমন লাগলো। সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালার বাইরে তাকালো। কিছুক্ষণ পর আইসক্রিম শেষ করে আবার সামনে তাকাতেই দেখে জাওয়াদ তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য! এভাবে তাকাচ্ছে কেন? তিথির খুব অস্বস্তি হচ্ছে। সে নড়েচড়ে বসলো। এখনও জাওয়াদ তাকিয়ে আছে। নির্নিমেষ! তিথি একটু ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করলো, সাথেসাথে জাওয়াদ খুব অদ্ভুত ভাবে একটা হাসি দিলো চোখ ছোট ছোট করে। সেই হাসিতে কী ছিলো তিথি জানেনা। কিন্তু সেই হাসিটা দেখামাত্রই মনে হলো যেন তিথির বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো। তিথি সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আর চোখ খুলবেনা সে… একদম না…
_________
চলবে……….
@ফারজানা আহমেদ