রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-১২+১৩

0
662

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১২
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

২৫,
আচমকা-ই চোখের চশমা-টার গ্লাস ভেঙে যাওয়ায় রায়াদের সাথে বের হতে হয়েছে রিয়ানা-কে। আপাতত এমন কেউ নেই যে, তার সাথে বেরুবে। আয়াতও তো তপমন কিছু চিনে না বিধায় রায়াদ-কেই সাথে পাঠালেন ফাতেহা খানম। জুবায়েরের উপর বড্ড রাগ হচ্ছে রিয়ানার। ঐ লোক-টার জন্যই এখন এই ঘাড়ত্যাড়া লোকের সাথে বেরুতে হলো তাকে। সিড়ি দিয়ে হাঁটার সময় চোখ কোথায় রাখে! কে জানে? রিয়ানা নিচে নামছিলো দোকানে আইসক্রিম কিনবে বলে। তখনই রায়াদ এবং জুবায়ের উপরে উঠছিলো। ব্যস ওরা দুজন কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় রিয়ানা-কে কেউ খেয়াল করেনি। রিয়ানা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে ধরেও দুজন বলিষ্ঠ মানুষ-কে পাশ কাটানো যায়! ব্যালেন্স হারিয়ে রিয়ানা-ই পরে যায়। চোখের চশমা-টা তার নিচে পরে গ্লাসগুলো ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়৷ এমনিতেও দেশে আসার পর সে সচরাচর চশমা পরতো না। কিন্তু চোখের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় চশমা পরলো! আর সেদিন-ই ভাঙতে হলো চশমা-টাকে! রিয়ানা তপ্তশ্বাস ছাড়লো। রায়াদের বাইকের পিছনে বসেছে সে। এক হাত রায়াদের কাঁধে দিয়ে রেখেছে সেইফ-টির জন্য। রাস্তায় একটু গ্যাপ আসায় সে খাঁমচে ধরলো রায়াদের শার্ট। আঙুল শার্টের উপর দিয়েই কাঁধে ডেবে গেলো যেনো। রায়াদ দাঁতে দাঁত পিষে ব্যথা সহ্য করে নিলো। কিছু বললোনা। মুখ খুললেই ঝগড়া হবে এই ঘাড়ের রগ ত্যাড়া কন্যার সাথে৷ যা এই মুহুর্তে রায়াদ মোটেও চাইছে না৷ এজন্য নিজেকে দমিয়ে রাখলো রায়াদ। নেহাৎ-ই মায়ের আদেশ। নতুবা রিয়ানাকে নিয়ে রাস্তায় একা বেরুনোর কোনো প্রশ্ন-ই উঠে না৷ ব্যবহারের যে ছিড়ি এই মেয়ের! কাঙ্ক্ষিত দোকানের সামনে এসে বাইক সাইড করলো রায়াদ। পার্কিং করে বাইক লক করে রিয়ানার দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরে। রিয়ানা বাইক থেকে নেমে কোনোমতে পরনের ওরনা-টাকে সামলে সামনের দিকে আগায়৷ এই লোক-টার সাথে আসার দরুণ জিন্সের সাথে লং কামিজ পরেছে রিয়ানা। মাথায় সুন্দর করে ওরনা দিয়ে শরীর ঢেকে সেপ্টিপিন লাগিয়ে দিয়েছে রোজা। তবেই রায়াদ নিয়ে আসতে রাজী হয়েছে। এরথেকে তো ভালো জুবায়ের লোক-টা। বিরক্তিকর হোক, তবু রায়াদের মতো বদ-মেজাজী নয়। দুই বদ-মেজাজী একত্রে! কখন যে কোন ইস্যু নিয়ে তর্কাতর্কি লেগে যায়! ঠিক নেই। রিয়ানা রায়াদের পিছুপিছু হেঁটে মার্কেটে ঢুকলো। চোখ-টা দিয়ে দূরের জিনিস ঝাপসা না দেখলে আর পানি না আসলে! রিয়ানা চশমা কিনতে এত তাড়াহুড়ো করতো না। ভার মে যাক চশমা, তবুও রায়াদের সাথে কোথাও নড়তো না। এই লোক তার পারসোনালিটি-কে নড়িয়ে নড়বড়ে করে দিয়েছে। শর্ট জিন্স টপস ছাড়িয়ে লং ড্রেস পড়তে হচ্ছে। যদিয়ো শরীর কাপড়ে আবৃত থাকায় ভদ্র, সুন্দর লাগছে। কিন্তু রিয়ানা তো চায় না এমন লাগুক তাকে। সবাই ঘৃণা করুক এটাই তো চায়। সারা দুনিয়া যেখানে ঘৃণা করে, সেখানে একজন তাকে ভালোবেসেছিলো। সেই বাসুক। তার পরিবর্তনে নতুন করে আর ভালো না-ই বা বাসলো। রিয়ানা মার্কেটের এক দোকানের দেয়ালে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আনমনে এটাই ভাবলো। রায়াদ চশমার দোকানের সামনে দাড়িয়ে রিয়ানাকে পাশে না পেয়ে আশপাশ টায় চোখ বুলালো। অদূরে দাড়িয়ে থাকা মেয়ে-টির কাজ দেখে সে হতভম্ব। জনসম্মুখে কে আয়না পেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখে? আর কেউ কি করে রায়াদের জানা নেই! কিন্তু এই রিয়ানা হোসাইন তো একপিস! তার দ্বারা সব সম্ভব। সে বাজখাই গলায় হাঁক ছাড়লো, বললো,

“বাসায় ফিরতে হবে আমাদের। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। রঙঢঙ শেষ হলে সব ডিটেইলস বলে নিজের পছন্দের ফ্রেমের চশমা-টা নিয়ে নিলে ভালো হতো৷ যত্তোসব উটকো ঝামেলা।”

২৬,
রিয়ানার কানে কথাগুলো পৌছাতেই মুখ গোমড়া করে ফেললো রিয়ানা। নতুন একটা ফ্যাশনের সাথে পরিচিত হয়েছে। একটু দেখছে। তাতেও এই লোকের সমস্যা। রিয়ানা মেজাজ হারিয়ে খটখট শব্দে ফ্লোর কাঁপিয়ে হেঁটে যেনো রায়াদের পাশে পৌছালো। রিয়ানা যেতেই রিয়াদ ইশারা করে চশমা চয়েজ করতে বললো। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। নয়তো রোজা-কে সাথে পাঠিয়ে দিতো রায়াদ। এমনি জুবায়েরের সাথে তার অনেক কথা জমে আছে। ওর কথার পুরো মানে বুঝেনি রায়াদ। রাস্তায় কথা বলতে বলতে বাইক রাইড করা অনুচিত বলে জুবায়ের চুপ করিয়ে দিয়েছিলো তাকে। বাসায় গিয়েও আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হলো না। এই দূরন্ত মানুষটিকে নিয়ে আসতে হলো এখানে। রায়াদ হাফ নিঃশ্বাস ছাড়লো। রিয়ানা সব চয়েজ করে রায়াদকে বিষয়-টা বোঝাতেই রায়াদ দাম জিগাসা করে। দামাদামি করে চশমা কেনা শেষ হলে রিয়ানা চশমা-টা আর প্যাকেট করায় না। সোজা চোখে পরে নেয়। সেই অবস্থায় রায়াদ এক পলক রিয়ানাকে দেখলো। আনমনে ভাবলো, ‘সভ্য ড্রেস বাংলাদেশের সাথে মানানসই, চোখে চশমা। কিউট একটা মেয়ে। কেনো যে সবটা সময় জল্লাদের বংশধরের মতো নিজের রুপ প্রকাশ করে! কে জানে! রায়াদ বিল মিটিয়ে আবারও ইশারায় রিয়ানাকে বেরুতে বলে মার্কেট থেকে। দুজনেই সমান তালে হেঁটে এসে প্রথমে রায়াদ, এরপর রিয়ানা এসে উঠে বসলো। রিয়ানা বসতেই রায়াদ বাইক স্টার্ট দেয়। একটু বেশি স্পিডে বাইক চালাতেই রিয়ানা দুহাতে রায়াদের শার্ট খামচে ধরে। রায়াদ ফের বিরক্ত হয়। কিন্তু এবার চুপ থাকলো না। বললো,

“আপনি কি আপনার নখ আমার শরীরে ডাবিয়ে আমায় ক্ষত-বিক্ষত করার প্ল্যানে আছেন?”

“আপনি অল্প স্পিডে বাইক চালালেই পারতেন।”

রিয়ানার উত্তরে রায়াদ স্পিড কমিয়ে দেয়। বাসায় যাওয়া জরুরী। জুবায়ের অপেক্ষা করছে। সেখানে এই মেয়ের ভয়ের অভাব নেই। উফফ খোদা। মনে মনে আফসোস জাগে রায়াদের। কোন কু-ক্ষণে যে মায়ের কথা রাখতে গিয়েছিলো! রায়াদ স্পিড কমাতেই রিয়ানা নিজের হাত সরিয়ে নেয়৷ বাসা আর কিছুদূর পরেই। তখনই রিয়ানার নজরে পরলো ফুচকা স্টল৷ সে রায়াদের পিঠে ধুপধাপ থাবা বসিয়ে বসিয়ে বলতে শুরু করে,

“এই আমার জন্য আপনার ট্রিট বাকি আছে না? চকলেট আইস্কিম বলেছিলেন৷ আজ আমি ওসব চাইনা। প্লিজ ফুচকা খাই। প্লিজ এক প্লেট। রোজার কলেজে গিয়ে খেয়েছিলাম। এত্ত মজা এগুলো, একেকটা আস্তে রসগোল্লা। বিদেশে তো এগুলো খুজেই পাওয়া যায় না। আফসোস হয় ভীষণ।”

রায়াদ রিয়ানার বাচ্চাসুলভ আচরণ থেকে বারণ করলোনা। ফুচকা স্টলে বসে রিয়ানাকে ইশারা করলো বসতে। রিয়ানা খুশি মনে বসে পরলো রায়াদের পাশে। রায়াদ এক নজর রিয়ানাকে দেখলো। দেখা হওয়ার পর থেকে এই প্রথম রিয়ানা-কে উৎফুল্ল দেখলো রায়াদ। এজন্য মন সায় না দিলেও রিয়ানার খুশি-টা নষ্ট করলো না। চেয়ারে বসে ২প্লেট ফুচকার অর্ডার দিলো। এক প্লেট দিলে রিয়ানা হয়তো সে খাবেনা দেখে খাওয়ার কথা তুলবে। তার প্লেট থেকে তুলে খাওয়ানোর বদলে নিজের জন্য অর্ডার করা-ই ভালো মনে হলো রায়াদের। দুজনে অপেক্ষা করতে লাগলো ফুচকার জন্য।

বাসার ছাদে মাদুর পেতে বসে আছে জুবায়ের, রোজা, আয়াত। তিনজনই ছাদটাকে একটু ডেকোরেট করতে করতে হাঁপিয়ে বসে পরেছে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে৷ রিয়ানার জন্য একটা সারপ্রাইজ রেডি করতে চাচ্ছে ওরা৷ এজন্য ইচ্ছে করেই রায়াদের সাথে একা পাঠিয়ে দিয়েছে। যেনো ওরা মনমতো সব সাজাতে পারে। প্ল্যান ছিলো রোজা আর আয়াতের। জুবায়েরকে পেয়ে টেনে এনেছে রোজা। লম্বা মানুষের কাজগুলো জুবায়ের-ই ভালো পারবে করে দিতে, এজন্য টেনে এনেছে। এমনিতেও আয়াত টেনশনে ছিলো রিয়ানাকে আড়াল করে এতসব আয়োজন কি করে করবে! কিন্তু চশমা ভাঙার উছিলায় সব সমস্যার সমাধান ঘটলো। তিনজনেই যখন কাজের শেষ প্রান্তে এসে হাঁপিয়ে গেলো। তখনই ফাতেহা খানম অতিকষ্টে হেঁটে সিড়ি পেরিয়ে ছাঁদে আসলেন৷ রোজা মা-কে দেখেই চট করে বসা থেকে দাড়িয়ে বললো,

“তুমি ছাদে আসলে কেনো মা? তোমার হাঁটুতেও সমস্যা৷ ভুলে গেলে?”

“কাজ কতদূর দেখতে এলাম। মন সুস্থ তো সব সুস্থ। রাখ তোদের অসুস্থতা। কাজ ফেলে বসে আছিস কেনো অলসের দল!”

তিনজনেই খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠে ফাতেহা খানমের ধমকের সুর শুনে। জুবায়ের বললো,

“আন্টি তোমার ধমক দেওয়া মোটেও রিয়েলিস্টিক মনে হয় না। অযথা কেন যে ধমক দাও? বুঝিনা।”

“আমিয়ো এতসব বুঝিনা। কাজ শেষ কর৷ কিন্তু আয়াত মা সবই বুঝলাম যে, তোরা রিয়ুকে সারপ্রাইজ দিবি বলে এসব করছিস৷ কিন্তু উপলক্ষ কি? এটাই তো বুঝলাম না। ”

আয়াত মুচকি হেসে বললো,

“রিয়ানা আসুক আন্টি। টের পাবে সবই। আপাতত কাজ শেষ করি। রোজা, জুবায়ের ভাই! কাজ শেষ করি। লেগে পরেন আপনারা।”

ফাতেহা খানম কথা বাড়ালেন না। এক পাশে বসে কাজ করা দেখতে লাগলেন। পুরো ছাদের চেহারা-ই পাল্টে দিচ্ছে এরা৷ সুন্দরই হচ্ছে। শুধু এখন অপেক্ষা যে, এত সাজানোর উপলক্ষ-টা ঠিক কি!

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৩
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

২৭,
বাসায় এসে বাসার পরিবেশ দেখে পুরোই ঘোরের মাঝে আছে রিয়ানা। এটা বাসা না ফুলের বাগান নাকি বেলুনে ফ্যাক্টরি! বুঝতে পারছেনা রিয়ানা। দরজা খুলে ড্রইং রুমে পা দিতেই সে হতভম্ব। চারদিকে নজর বুলিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো সে। তখুনি আয়াত পার্টি স্প্রে ছিটিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

“শুভ জন্মদিন আমার পরি। শুভ শুভ শুভ জন্মদিন।”

রিয়ানা দুহাতে পার্টি স্প্রে-র ফেনা পরিস্কার করতে করতে থমথমে গলায় বললো,

“এসব কি আপু? যেসব আমার পছন্দ নয়, তোর সেগুলোই করতে হয় সবসময়?”

“রাগছিস কেনো? তোর পছন্দ না-ই বা হতে পারে। তোর বড় বোন হিসেবে ছোট বোনকে ঘিরে কি আমার কোনো শখ থাকতে পারে না?”

“না, পারেনা আপু। সে-ই বোন-টা যদি আমি হই! সেক্ষেত্রে জোড় খাঁটিয়ে বলছি হতে পারেনা।”

“রিয়ু!”

আয়াত থমকে বিস্মিত চাহনীতে আঁতকে রিয়ানাকে ডেকে উঠলো। রিয়ানার মাঝে কোনো রকম হেলদোল দেখা দিলো না। সে আয়াতের দিকে এক হাত উচিয়ে বললো,

“তোমার পরিচয় হানিফ হোসাইনের আদরের বড় মেয়ে। যে বাবার কথা মতো চলবে, ভদ্র মেয়ে হবে। আমি কোনো টাই নই। আমার জন্য তোমার সম্মান নষ্ট হয়৷ আমার জন্য তোমার বাবার সাথে তোমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাই এসব না করা-ই ভালো আপু। হানিফ সাহেব দেখলে আবার চিল্লাপাল্লা করবেন। বাই দ্যা ওয়ে, তিনি কি দেখেননি? এগুলো করলে কি করে?”

আয়াত তপ্তশ্বাস ছাড়লো। হতাশ হয়ে দৃষ্টি নামিয়ে বললো,

“বাদ দে সেসব। আজ তোর জন্মদিন। ভাবলাম তোর খুশির জন্য কিছু করি! আন্টি, রোজা, আমি মিলে সব আয়োজন করলাম। তোর জন্য ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ রেডি করেছি। ভেবেছিলাম শুধু সেটুকুই করবো। পরে রোজা বললো বাসা-টাও একটু সাজাই! যেনো সাজানো গোছানো জায়গা থেকে একজন সাজানো ছোট্ট পরি সেখানে উপস্থিত হয়। তোর রুমে ড্রেস বের করে রেখেছি। সব রাগকে সাইডে রেখে যদি আন্টি এবং রোজার মুখের দিকে তাকিয়ে ছাঁদে আসতিস! খুশি হতাম।”

রিয়ানার নিজের বোনের জন্য মায়া হলো। আয়াতকে সে সবসময়ই ভালোবাসে। কিন্তু এই দিন-টায় আয়াতের এহেন বিভ্রম মানতে পারছেনা সে। আর কেউ না জানুক! এই তারিখ-টার সাথে রিয়ানার কি ব্যথা জড়িয়ে আছে। যেন তেন ব্যথা নয়। মনের ব্যথা। যেই ব্যথা প্রতিনিয়ত মনে ছুড়ি বসিয়ে রক্তক্ষরণের মতো তাজা হয়ে যাতনা দেয়। রিয়ানা লম্বা ভাবে শ্বাস নিয়ে নিজের রাগ দমানোর চেষ্টা করলো। চোখ বন্ধ করে আয়াতকে বললো,

“আজকের দিন-টায় এমন না করলেও পারতি আপু। জানিস তো গত ৫বছর ধরে এই দিন-টা আমার জীবনে অভিশাপ। অবশ্য ৫বছর ধরে সত্যি-টা জেনে অভিশাপ। যখন না জানতাম! তখনও অভিশাপের ন্যায়-ই ছিলো। তবে যন্ত্রণা কম ছিলো।”

আয়াত দৃষ্টি তুলে তাকালো। কয়েক কদম এগিয়ে এসে বোনের সামনে দাড়িয়ে গালে হাত দিয়ে বললো,

“জীবন নদীর স্রোত রিয়ু। জোয়ার-ভাটা দু’টোই আসে। তাই বলে তোকে যে সবসময় জোয়ারের স্রোতেই গা ভাসিয়ে দুঃখগুলো আঁকড়ে জীবনে আগাতে হবে! এমন দুঃখগুলো আঁকড়ে সুখ খোঁজার চেষ্টা ছেড়ে দিলে! এটা কেমন জীবন হলো রিয়ু?”

“আমি তাকে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে সুখগুলোকেও নির্বাসিত করেছি আপু।”

কথা-টা বলেই রুমের দিকে পা বাড়ালো রিয়ানা। আয়াত পেছন থেকে চিল্লিয়ে বললো,

“ছাঁদে অপেক্ষা করবো তোর জন্য। রেডি হয়ে বোনকে কখনও ভালোবাসলে চলে আসিস। নতুবা ধরে নেবো ছোট বোনের প্রতি আমার সব ভালোবাসা মিথ্যা ছিল। বড় বোন হিসেবে আমি ব্যর্থ। আমায় ব্যর্থতার গ্লানিতে পোড়াতে চাইলে আসবিনা। আর আমার হাসিটুকু তোর কাছে মূল্যবান হলে আসবি।”

আয়াত রুম ছাড়লো। রিয়ানা পিছন ফিরে বোনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আনমনে বিরবির করে বললো,

” তোমার এটা কেমন জেদ আপু? সীন ক্রিয়েট করে বসবে বাবা। রাতের বাজে ৮টা। তবুও বাসায় কেনো নেই তিনি! থাকলে তো এসব হওয়ার কথা নয়। থাক সেসব। তোমার জেদও বজায় থাকবে, আমারও। দেখি কোন জেদের পাল্লা ভারী!”

২৮,
ছাঁদে দাড়িয়ে রিয়ানার অপেক্ষায় সকলে। ফাতেহা খানম চেয়ারে বসে আছেন। রোজা, আয়াত, জুবায়ের ছাঁদেই হাঁটাহাঁটি করে যাচ্ছে সমানতালে। তিনজনের অপেক্ষা রিয়ানা আসবে তো! ইয়াসিন সাহেব এবং হানিফ সাহেব দুজনই দোকানে রয়ে গেছেন। ইয়াসিন সাহেব বন্ধুকে সাথে নিয়ে গিয়েছেন নিজের ব্যবসার অবস্থা দেখানোর জন্য। ফিরতে ফিরতে হয়তো রাত এগারোটা বাজবে। ততক্ষণে সব আনন্দ করা শেষ হয়ে যাবে। হানিফ টেরও পাবেন না। এসব ভেবেই তো সব আয়োজন করেছে আয়াত। এখন সে এসবে না আসলে মাথা উঁচিয়ে সবার সামনে দাড়াতে পারবে তো সে! বড় বোন ভালোবেসে এত আয়োজন করেছে! অথচ ছোট বোন তার মান রাখলোনা! বিষয়-টা কেমন অপমান জনক নয়? আয়াত আনমনে এসব ভেবে একহাতে অন্য হাত কচলাতে কচলাতে ছাঁদের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় দ্রুত গতিতে পায়চারি করে যাচ্ছে। রোজা আর জুবায়ের ক্লান্ত হয়ে ছাঁদেই বসে পরেছে। রায়াদ বিরক্ত হয়ে ছাঁদের রেলিঙ ঘেষে রেলিঙে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সীমাবদ্ধ নিশির আঁধারে জ্বলজ্বলে তারায় ভরা আকাশে। এক মেয়ের জন্য কত হয়রানি হবে আর! বাসায় এসে রুমে একটু ঘুমাতে চাইলো সে! ফ্রেশ হয়ে বের হতেই জুবায়ের টেনে উপরে আনলো। এক জুবায়ের-ই পরিবারের পর তার ভীষণ রকম দু্র্বলতা। যতই রাগ-ধার দেখাক সে! জুবায়েরের সামনে নরম হয়ে যায় রায়াদ। বন্ধুত্বের বন্ধন-টা এতটাই দৃঢ় দুজনের৷ জুবায়ের এক পলক ছাঁদে প্রবেশের দরজার দিকে তাকিয়ে রায়াদের দিকে চোখ ফেরালো। বসা থেকে উঠে রায়াদের পাশে দাড়ালো। রায়াদ জুবায়েরের উপস্থিতি টের পেয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এক নজর জুবায়েরকে দেখলো। এরপর আগের ন্যায় তাকিয়ে রইলো। জুবায়ের-ই মুখ খুললো এবার। ফিসফিসে স্বরে বললো,

“মন খারাপ?”

“ছেলেদের আবার মন খারাপ হয়?”

“কেনো হয় না বলছিস? ছেলে-রা কি মানুষ নয়? আমার তো হয় মন খারাপ। ভীষণ রকম হয়। হাসতে হাসতে দম আঁটকে কান্না আসার ফিলিংস-টা না রায়াদ! বলে বোঝানোর মতো না। ছেলেদের কাঁদতে হয় না। সব সামলাতে হয়। এই কথার উপর ভিত্তি করে কান্নাগুলোও হজম করতে গিয়ে ভীষণ রকম মন খারাপ হয়।”

“ছেলেদের মন খারাপ হতে পারলে কান্না কেনো করতে পারবেনা তারা?”

“মন খারাপেও ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তোলা যায় রায়াদ। কান্নার সময় চাইলেও কান্না থামানো যায় না।”

রায়াদ মুচকি হাসলো। ছাদের এক কোণায় লাগানো এক লাইটের আলোয় জুবায়েরের সেই হাসি চক্ষুগোচর হলো না। রায়াদের জবাব না পেয়ে জুবায়ের শব্দ করে শ্বাস ফেললো। পেছন ফিরে তাকিয়ে দাড়ালো রেলিঙে হেলান দিয়ে৷ তখনই দেখলো ছাঁদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে রিয়ানা। পরনে ফিরোজা নীল রঙের ক্রপ টপের লেহেঙ্গা, যেটা আবার স্লিভলেস। ক্রপ টপ হওয়ায় পেটের অনেকাংশ সদৃশতায় ভালো ভাবেই ফুটে উঠেছে। জুবায়ের দৃষ্টি অবনত করে নিলো। হতে পারে এসব ড্রেস এখন নরমাল। কিন্তু বাঙালি সাধারণ পরিবারের ছায়ায় বড় হওয়া জুবায়েরের কাছে লজ্জা জনক-ই লাগছে কিছু-টা। আয়াতের নজরে রিয়ানা পরতেই বোনের ড্রেস দেখে হতবাক। সে যেখানে লং গাউন রেখে এসেছিলো ফুল স্লিভের। সেখানে রিয়ানা এটা কি ড্রেস পরলো! এটা অন্য ক্ষেত্রে নরমাল হলেও রায়াদদের পরিবারে এসব এলাউ না। রোজা হা হয়ে তাকিয়ে রিয়ানাকে দেখছে। ফাতেহা খানম নিশ্চুপে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এই মেয়ের ড্রেসআপ কবে যে শুধরাবে! সেই আশায় আছেন তিনি। আয়াত সে তো হন্তদন্ত হয়ে বোনের সামনে এসে কাতর স্বরে বললো,

“আমি তোর জন্য এত ভালোবেসে একটা ড্রেস এনে রেখেছিলাম! সপটা না পরে এটা কি পরেছিস! স্লিভ না থাকলো সমস্যা নেই। কিন্তু পেট বেরিয়ে আছে । এই খেয়াল করেছিস?”

রিয়ানার মাঝে তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বোনকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে সাজিয়ে রাখা কেকের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো,

“বললাম না, তোর জেদ আমার জেদ দু’টোই বজায় থাকবে আপু। এটা তোর আমায় না জানিয়ে এসব আয়োজন করার শাস্তি।”

২৯,
রিয়ানার কণ্ঠস্বর কানে যেতেই চকিতে পেছন ফিরে তাকালো রায়াদ। আয়াত রিয়ানাকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। ফাতেহা খানম এবং রোজা রিয়ানা এবং আয়াতের এক পাশে দাড়িয়ে দুবোনের কথা কাটাকাটি দেখছে। আয়াত পোশাক পাল্টাতে বলছে, আর রিয়ানা রিফিউজ করছে আয়াতকে। এসব নিয়েই দুজনের মাঝে ছোটো খাটো তর্ক চলছে। এদিকে রায়াদ রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বাকিদের মতোই হতবাক সে। মুহুর্তে রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো রায়াদের। কপালের রগ দপদপ করছে যেনো। অসভ্য মেয়ে, পরপুরুষের খেয়াল নেই! সব সীমা পার করে আজ পেটের অধিকাংশ বের করে ড্রেস পরেছে। রায়াদ রেগে হাত মুঠো করে রাগ কমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলোনা। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে শুরু করলো। জুবায়ের বুঝলো রায়াদ রাগ করেছে। সে পরিস্থিতি ঠান্ডা রাখতেই রায়াদের এক নিজের হাতে মুঠো করে নিয়ে আস্তে-ই বললো,

“যার যার পোশাকের স্বাধীনতা তার কাছে রায়াদ। আমরা বলার কেউ না। ভুলে যাস না উনি এদেশে বড়-ই হোননি। উনার কাছে এসব পোশাক আশাক কিছু-ই নয়। উনি এসব পরেই অভ্যস্ত আর কমফোর্টও। আমাদের অধিকার নেই কারোর কমফোর্ট জোন ব্রেক করার।”

“জাস্ট শাট আপ জুবায়ের। ওয়েস্টার্ন ড্রেস তো আমাদের বোন রোজা-ও পরে। ভদ্র, সভ্য হয়েই পরে। এই মেয়ের কি সেই সেন্স নেই! আমি তুই দুজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক বাসায় আছি জেনেও এমন ড্রেস পরে আসলো! এটা কি উনি জার্মানি পেয়েছে? ভুলে গেছে সে বাংলাদেশে আছে। আমার উচিত মনে করিয়ে দেওয়া।”

রায়াদ ক্ষিপ্ত গলায় আওয়াজ নামিয়েই উত্তর দিলো জুবায়েরের কথায়। জুবায়ের ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। জুবায়েরকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,

“বাদ দে না ভাই। যার জীবন সে বুঝুক। আমরা কে কিছু বলার? জানিনা কেনো আয়াতের মতো ভদ্র, নম্র মেয়ের বোন এমন হলো! কিছু বলেও লাভ নেই। উল্টে কথা বাড়বে।”

“একটা কথা কি জানিস জুবায়ের!”

“কি কথা?”

“আমার আর তোর কপালে আয়াতের মতো ভদ্র মেয়ে জোটার বদলে রিয়ানার মতো বাত্তামিজ মেয়ে-ই জুটবে দেখিস। আমরা অতি ভালো সরল সহজ থাকতে চাই এজন্য। আর ভালো ছেলেদের কপালে ভালো মেয়ে জুটে না। চোখের সামনে একটা মেয়ে ভদ্রতা পেরিয়ে ড্রেস পরেছে দেখেও ভদ্র হয়ে দাড়িয়ে আছি। এরথেকে ভালো বিষয় আর কি হতে পারে বল?”

রায়াদ দাঁত কটমটিয়ে কথা-টা বললো। জুবায়ের হাসি আঁটকানোর চেষ্টায় মত্ত হলো রায়াদের কথায়। ফানি হলেও সত্যি কথা-ই বলেছে রায়াদ। কিন্তু তার কপালে তো ভালো মেয়ে-ই জুটেছিলো। কিন্তু সে ভেঙে এসেছে। এটা রায়াদকে জানানো হয়নি। জানানোর উদ্দেশ্যে বললো,

“কিন্তু আমার কপালে তো আয়াত-ই জুটেছিলো রায়াদ। আমি-ই ভেঙে দিয়েছিলাম। এখন আফসোস করতে হবে দেখছি!”

রায়াদ জুবায়েরের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। বিস্ময় সহিত বললো,

“কি সব বলছিস উল্টাপাল্টা?”

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে