রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0
1000

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ৩৮(শেষপর্ব)
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১০০,
সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে একত্রে নাস্তা করতে বসেছে রবিউল চৌধুরী, ডালিয়া চৌধুরী, জুবায়ের, আয়াত জুবায়েরের বোন তিয়াসা। বাসার সার্ভেন্ট নাস্তা সার্ভ করে দিয়েছে। জুবায়েরের পরিবার অনেক-টা স্বাভাবিক এখন। মাঝখানে দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরও দু’টো বছর। জুবায়েরের দাদু হামিদ চৌধুরী মৃত্যুশয্যায় পরে যখন তাকে অনুরোধ করেছিলো বাড়িতে থেকে যেতে! জুবায়ের আর তার দাদুকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। জার্মানি থেকে ফিরেছিলো দাদুর অসুস্থতার খবরে। তিনমাস না থেকেই ফিরে এসেছিলো। আসার এক সপ্তাহ পরপরই তিনি মারা যান। এরপর তার দাফন কার্যক্রম সেরে জুবায়ের আর ফেরেনি। দাদুর কথামতো তার চেয়ারে বসেছে অফিসে৷ হামিদ চৌধুরী মারা যাবার আগে ছেলের কাছে মা-মরা ছেলে-টাকে একটু আগলে রাখার কথা বলে গেছেন তার ছেলেকে। রবিউল চৌধুরী সময়ের সাথে নিজেই সব-টা উপলব্ধি করেছেন। ছেলের সাথে দূরত্ব কমানোর চেষ্টায় উনিও মত্ত। ডালিয়া চৌধুরী নিজেও সময়ের সাথে নিজের ভুল নামক অন্যায়গুলো বুঝতে পারেন। যখন দেখলেন জুবায়েরের জন্য উনার নিজের ছেলেদের কোনো ক্ষতি হয়নি! অপরাধ বোধে নিজেও ভেতরে ভেতরে ভুগেন। এজন্য এখন একটু চুপচাপ-ই থাকেন। জুবায়ের আর আয়াতকে মায়ের ভালোবাসায় আগলে রাখার চেষ্টা করেন। তার ছেলে দু’টোকে ঢাকা শহরে পড়াশোনা করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা জুবায়ের করে দিয়েছে। ব্যবসার সমান তিন-টা ভাগ হয়েছে তিন ভাইয়ের নামে। বোনের হকও জুবায়ের আগেই বুঝিয়ে দিয়েছে। যার ভাগ সে সময় মতো বুঝে নিবে। জুবায়ের বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব আগলে রাখার পাল্লায় নেমেছে। কতদিনের স্বপ্ন তার পরিবারকে একসাথে নিয়ে জীবন কাটানো! সব-টাই হচ্ছে শুধু মাঝখানে তার দাদুভাইকে কাছে পাওয়া হলো না। খেতে খেতে এসব ভেবেই বুকের মাঝে মোচর দিয়ে উঠে জুবায়েরের। আয়াত জুবায়েরকে খাওয়া রেখে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলে উঠে,

“কি হলো আপনার? এমন চুপ করে বসে আছেন যে খাওয়া রেখে?”

“কিছু হয়নি। খাচ্ছি।”

আয়াত বুঝলো কিছু হয়েছে। জুবায়ের এড়িয়ে গেলো। পরে রুমে গিয়ে শুনে নিবে। ডালিয়া চৌধুরী এরমাঝে বললেন,

“মেয়ে কি ঘুমাচ্ছে বউমা?”

“তার আর কাজ কি মা? সে রাত জেগে থাকবে। ভোর হতে ঘুমাবে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।”

ওহ হ্যাঁ! আয়াত আর জুবায়েরের মেয়ে হয়েছে। বয়স ৯মাস চলছে। নাম তাজকিয়া চৌধুরী। যার হাসি কান্নায় পুরো বাড়ি মেতে উঠে এখন। রবিউল চৌধুরী খেতে খেতে বললেন,

“তোমার স্বামী-ই এমন করতো মা। তার মেয়ে আর ব্যতিক্রম হবে কেন? হলে বাবার ধারা বজায় আর কই থাকলো।”

“ওমনি আমার কথা টানতে হলো?”

জুবায়ের মেকি রাগ দেখিয়ে বললো। রবিউল চৌধুরী হেসে বললেন,

“বাপকে বেটি। বলবো না তো কি করবো?”

এরমাঝেই তাজকিয়ার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। রামিসা চুপচাপ খাচ্ছিলো। এ বছর সে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। বিয়ের কথা বলা হয়েছিলো তাকে। পড়াশোনা শেষ করে জব করতে চেয়েছে। বাবা আর ভাই তাকে আর জোড় করেনি। পড়া শেষ করে আপাতত চাকরির এপ্লাই করছে। পছন্দের মানুষও আছে। তার ক্লাসমেইট ছেলে-টা। তসর চাকরি হয়ে গেলে বিয়ে-টা করার ইচ্ছে দুজনের-ই। পরিবার আর অমত করেনি এসে। তাজকিয়ার কান্নার আওয়াজে সে বললো,

“ভাবীর তো খাওয়া শেষ হয়নি। আমার খাওয়া শেষ। আমি গিয়ে মনিকে দেখছি।”

আয়াত মাথা দুলায়। রামিসা উঠে হাত ধুয়ে চলে যায়। সে তাজকিয়াকে মনি বলেই ডাকে। তখন ডালিয়া চৌধুরী বললেন,

“আজ তো বউমার বোন আর বোন জামাই ফিরছে। বলি তোমরা কি ও বাড়ি যাবে?”

“আমরা না আম্মা। আমরা সবাই যাচ্ছি।”

আয়াত বললো। রবিউল চৌধুরী বললেন,

“আমরা গিয়ে কি করবো মা?”

“বিয়ের সময় কেউ উপস্থিত ছিলো না বাবা। ওরা ফিরবে। বাবা সবাইকে তো এজন্য ইনভাইট করেছে।”

আয়াতের কথার জবাবে ডালিয়া চৌধুরী বললেন,

“খাওয়া দাওয়া শেষ করো। এরপর তৈরি হওয়া যাবে ক্ষণ।”

১০১,
উনার কথায় আয়াত মাথা দুলালো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে উপর তলায় নিজেদের রুমের দিকে পা বাড়ালো। মেয়ের কান্না থেমেছে। ফুফুর কোল পেলে সব ভুলে যায় মেয়ে-টা। এজন্য হয়তো বলে ফুফু-ভাতিজী এক জাত। জুবায়েরও খাওয়া শেষ করে উপর তলায় পা বাড়ায়। এত বছরের অভিমান কি দুবছরেই গলে যায়! বাবা মায়ের সাথে থাকলেও সম্পর্ক-টা একদম সহজ হয়নি। মনে মনে ভালোবাসলেও প্রকাশ করে জুবায়ের। রবিউল চৌধুরী বুঝতে পারেন। তবুও চুপ থাকেন। নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করেন ছেলের অভিমান গলানোর। ছোটো থেকে ব্যবসার কাজের পিছনে ছুটে যে অবহেলা-টা ছেলেমেয়েকে করেছেন! তা এ বয়সে এসে এখন টের পান। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রবিউল চৌধুরী। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন জীবনে টাকা-ই সব হয়না সবক্ষেত্রে। বাবার স্নেহ দেওয়ার ক্ষেত্রে তো একদমই নয়। ডালিয়া চৌধুরী স্বামীর গোমড়া মুখ দেখে বলেন,

“ছেলে-টা আমাদের সাথে সহজ হতে পারে না। এটাই ভাবছো তো?”

রবিউল চৌধুরী মাথা নাড়ালেন। ডালিয়া চৌধুরী হতাশ হয়ে বললেন,

“সব-টা দোষ আমার-ই। আমার ভুলে, আমার অন্যায়ে এ অবস্থা। তোমাদের কারোর ক্ষমা পাবার যোগ্য আমি নই।”

“ছাড়ো এসব। নিয়তিতে যা ছিলো। ওটাই হয়েছে।”

“আচ্ছা, সেসব বাদ তবে। চলো রেডি হও। বেয়াই সাহেবও আজ ফিরবেন। না গেলে কেমন একটা দেখাবে। অসম্মান করা হবে উনাকে।”

“যাবো, চলো তুমিও তৈরি হও।”

এরপর দুজন-ই উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে নিলো। ডালিয়া চৌধুরী সার্ভেন্টকে সব গুছিয়ে রাখতে বলে রুমে চলে গেলেন।

আয়াত রুমে এসে দেখে তাজকিয়াকে নিয়ে সারা রুমময় হেঁটে তার পিঠে ছোট ছোট চাপর দিয়ে কান্না থামাচ্ছে। সে যেতেই রামিসা থেমে যায়। আয়াত মেয়ের সামনে গিয়ে হাসিমুখে হাত এগিয়ে দেয়। মেয়ে-টা আরও বেলা করে উঠে। কিন্তু আজ সময়ের আগেই উঠলো। নয়তো একা রেখে নিচে যেত-ই না। মা-কে দেখে আস্তে কান্নারত তাজকিয়া খিলখিলিয়ে হেসে মায়ের কোলে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠেছে তো! রামিসাকে দেখে কান্নার আওয়াজ কমলেও কান্না একেবারে থামেনি। রামিসা তখণি ভাইকে রুমে আসতে দেখে ভাই-ভাবীকে একা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। যাওয়ার সময় তাকে জুবায়ের বললো,

“তৈরি হয়ে নিস। তুইও যাচ্ছিস।”

১০২,
রামিসা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। আয়াত মেয়ে-কে এতক্ষণে ফিডিং করাতে বসে গেছে বিছানায়। জুবায়ের তার পিছনে বসে আয়াতের খোঁপা খুলে দেয়। চুলে মুখ গুঁজে বলে,

“বাচ্চাকে পেয়ে স্বামীকে আর আদর-সোহাগ, ভালোবাসা দিতে হয় না তাই না?”

“বিয়ের সময় ভালোবাসা স্বামী-স্ত্রীর ভাগে থাকে। এরপর সন্তান আসলে সে পায়। তারপর সন্তানের সন্তান! মানে নাতীপুতি? তারা আসলে তখন তারা পায় ভালোবাসা। তো আপনাকে আদর-সোহাগ, ভালোবাসা কি করে দিই বলুন?”

আয়াত হেসেই বললো। জুবায়ের স্মিত হাসলো আয়াতের কথায়। কোমড়ে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে ধরে নিজের সাথে লেপ্টে নিয়ে নেশাতুর কণ্ঠে বলে,

“সে যে আসার আসুক। আমার বউয়ের প্রতি আমার ভালোবাসা এজন্মে কমবে না।”

“ইশশশ, এত ভালোবাসতে হবেনা আপাতত। যান গোসল দিয়ে নিন। তৈরি হয়ে যেতে হবে। তার আগে বলুন খাবার টেবিলে মন খারাপ কেন ছিলো?”

“সবদিকেই নজর দিতে হয় বুঝি?”

“হ্যাঁ হয়। এবার বলুন তো কারণ-টা!”

“দাদুকে মিস করছিলাম।”

“আচ্ছা বুঝলাম। তবে আল্লাহর বান্দা, উনি উনার বান্দাকে নিয়ে নিয়েছেন। মনে পরলে মন খারাপ তো হবে-ই। তবে আমরা তার জন্য মন খারাপ স্থায়ী না করে তার জন্য দুয়া করতে পারি।”

“বউ-টা আমার। তুমি থাকতে আমার মন খারাপ স্থায়ী কখনও হবে না। কি সুন্দর আগলে নাও। শুধু একটু মিস করি দাদুর সাথে কাটানো সময় গুলো। মা মারা গেলে সে আমাদের আগলে রেখেছিলেন। ছোটো-মা খারাপ ব্যবহার করলে বুকে আগলে নিতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। কান্না পেলে জড়িয়ে কাঁদতে পারতাম। দেখতে দেখতে দু’টো বছর কেটে গেলো উনাকে ছাড়া। মানুষ এমন-ই। একটা সময় এভাবে-ই চলে যাবে। রেখে যাবে একরাশ স্মৃতি।”

“আমি এত স্মৃতি আগলে বাঁচতে পারবোনা। দহনে পুড়বো রোজ। একাকিত্বে মরবো। এরথেকে ভালো আমাদের মৃত্যু যেন একসাথে হয়।”

জুবায়ের মুচকি হাসলো। আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তাজকিয়াকে ফিডিং করানো শেষ হতেই আয়াত বললো,

“দেখি ছাড়ুন। মেয়ে-কে আগে তৈরি করি৷ নয়তো নিজে আর তৈরি হওয়ার সুযোগ পাবোনা। ক্যাসেট বাজতেই থাকবে।”

জুবায়ের আয়াতকে ছেড়ে তাজকিয়াকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো,

“একদম আমার মা-কে ক্যাসেট বলবেনা। সে আমার রাজকন্যা। আমার মা। আমার মায়ের ছায়া খুজে পাই আমার মেয়ের মাঝে। আমার মা আমার রাজকন্যা।”

“একটু আগে কে জানি বলছিলো মেয়েকে পেয়ে তাকে ভুলে গেছি?”

“ও তো এমনি বলেছে সে। যাও আমার মেয়ে-কে আমি তৈরি করে নিচ্ছি। তুমি রেডি হয়ে নাও। আর শুনো!”

আয়াত আলমারি থেকে কাপড় বের করতে ব্যস্ত ছিলো। জুবায়েরের ডাকে ফিরে তাকিয়ে বললো,

“বলুন জনাব।”

“শাড়ি পরো আজ। চুল খোঁপা করে বেধো। যাওয়ার পথে তাজা বেলি ফুলের গাজরা কিনে পরিয়ে দিবো। অনেকদিন হলো তোমায় এভাবে গাজরা পরানো হয়না।”

আয়াত হাসলো। লোক-টা বদলায়নি। আজও সেই প্রথম দিনের মতোই আছে। ভালোবাসা দিনকে দিন বাড়ছে। কমছে না একটুও। প্রেগন্যন্সির সময় কম জ্বালায়নি সে জুবায়েরকে। বাচ্চা হওয়ার পর কেমন মেয়ের সাথে রাত জাগতে হতো। সারাদিন অফিস সামলে এসে কত রাত গেছে যে সে ঘুমিয়েছে জুবায়েরের পরশে। আর জুবায়ের মেয়ে-কে কোলে নিয়ে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস এই লোক-টাকে স্বামী হিসেবে কবুল করেছিলো। নয়তো এত ভালোবাসা পাওয়া! মিস হয়ে যেত। মানুষ-টা তার কথা রেখেছে। শুভ্রতায় সূচনা হওয়া সম্পর্ক-টাকে শুভ্রতায় মুড়িয়ে রেখেছে। একফোঁটা কাঁদা ছুড়তে দেয়নি কখনও। দেখা গেছে মেয়ে-কে সময় দিতে গিয়ে জুবায়েরকে সে অবহেলা করেছে। কিন্তু লোক-টা তাকে একটুও অবহেলা করেনি। বাচ্চা হওয়ার পর তার সৌন্দর্য কমে গিয়েছিলো। মাতৃত্বে তো এটা নরমাল বিষয়। তবুও এটাকে স্পেশাল ফিল করিয়েছে জুবায়ের। তার পানে কি সুন্দর মুগ্ধতা নিয়ে তাকাতো। এখনও তাকায়। তখন যেন মুগ্ধতা একটু বেশি-ই খুঁজে পেত আয়াত। কি দেখছো এত! জিগাসা করলে কি সুন্দর করে জবাব দিতো, ‘মাতৃত্বের সৌন্দর্যে সাজানো আমার বউকে।’

“কি হলো! কি দেখছো এত? যাও তৈরি হও। আর মেয়ে-র গোসলের জন্য গামলাভর্তি পানি এনে বারান্দায় দিয়ে যাও। আমি আজ আমার মেয়ে-কে গোসল করিয়ে দিবো।”

আগের এই মিষ্টিমধুর সময়ের ভাবনায় মত্ত হয়ে পরেছিলো আয়াত। জুবায়েরের ডাকে কাপড় সব বের করে রেখে জবাব দিলো,

“বাবা-মেয়ে পাগল বানিয়ে ছাড়বে আমায়। একটু শান্তিমতো তাদের দেখতেও দিবেনা।”

“পরে স্পেশাল ভাবে দেইখো বউ। মেয়ে ঘুমালে। আপাতত যাও পানি আনো।”

জুবায়েরের দুষ্টমি বুঝলো আয়াত। ঠোঁট ভেঙচিয়ে বললো,

“যে মেয়ে আপনার। রাত কেন! দিনেও কোনোদিন সুযোগ পাবেন না। সেখানে তো স্পেশাল দেখা!”

জুবায়ের হেসে ফেললো শব্দ করেই। বললো,

“অনেক হলো! ১০টা বাজছে অলরেডি। ওরা ঢাকা থেকে আসতে আসতে ১টা বাজবে। আমাদের এখান থেকে যেতে হবে তৈরি হয়ে। যাও গোসল করো।”

আয়াত আর কথা বাড়ালো না৷ মেয়ের গোসল করার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজেও গোসল করতে ঢুকে পরলো। মেয়ে তো পানি পেয়ে খুব খুশি। গামলার মাঝে বসে খিলখিলিয়ে হাসছে। জুবায়ের মেয়েকে গোসল করিয়ে দিতে দিতে নিজেও যেন বাচ্চায় পরিণত হয়েছে। রবিউল চৌধুরী ছেলের কাছে এসেছিলেন যাওয়ার সময় মিষ্টি কিনবে নাকি! এখনই আনাবে! এটা জানতে। বারান্দার দরজার কাছাকাছি এসে বাবা-মেয়ের এমন মিষ্টি মুহুর্ত দেখে মনে মনে শান্তি পেলেন। আনমনে ভাবলেন,

“প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। এই আনন্দ টিকে থাকুক।”

আনন্দ আর নষ্ট করতে চাইলেন না। বিষয়-টা পরে ভাবা যাবে। তিনি রুম ছাড়লেন।

১০৪,
বাড়ির বাইরের ফটকের সামনে গাড়ি থামলে ৭মাসের প্রেগন্যান্ট উঁচু পেট-টায় হাত রেখে নামলো রিয়ানা। তার হাত ধরে রেখেছে রায়াদ। সে আগেই নেমে হাত বাড়িয়েছিলো রিয়ানার পানে। রিয়ানা নেমেই সে হাত ধরেছে। সামনে থেকে নামলেন হানিফ হোসাইন। পিছনে আরও একটা গাড়ি এসে থামলো। তা থেকে নামলো ভ্লাদ, মাদালিনা আর তাহিয়া। এ তিন-টা মানুষ তাকে ছেড়ে থাকতে নারাজ। এজন্য সাথে সাথে বাংলাদেশে এসে থামলো। ভ্লাদ আর মাদালিনা বিয়ে নিয়েছে। তাহিয়া দেশে আসলো। রিয়ানার বাড়ি ঘুরে গিয়ে সেও বিয়ে করবে বাবা মায়ের পছন্দ মতো। তার পিছনে আরও একটা গাড়ি থামলো। ওটা থেকে নামলেন ইয়াসিন শাহনেওয়াজ, ফাতেহা খানম এবং রোজা। রোজা এসেই ভাবীর অপর হাত ধরে দাড়িয়ে পরলো। মেয়ে-টা বড় হয়েছে। ২০বছরের যুবতী সে। তার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসলো রিয়ানা। রেখে গেছিলো ১৭বছরের এক উঠতি বয়সের কিশোরী। কেমন চোখের পলকে তিনবছর পেরিয়ে বড় হয়ে গেছে সে। এখন আগের মতো বাচ্চামি করে না, জেদ করেনা। তার উপর বেশ অভিমান জমিয়ে রেখেছে না বলে আলে গিয়েছিলো বলে। গিয়েও কথা বলেনি। বলেছে বিয়ের পর। অথচ আসার পর একটুও পিছু ছাড়েনা তার। কখন কি প্রয়োজন হয় খেয়াল রাখছে সবসময়। সবাই দৃষ্টি ফেলে সামনের দিকে। ফটকের একপাশে জ্বলজ্বল করছে ‘হোসাইন ভিলা’ লেখা-টা। বাড়ি-টা একটু মেরামত করা হয়েছে। আগে বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গা ছিলো। এখন ঘের দিয়ে গেট করা হয়েছে। দুতলা বাড়ি টাকে তিনতলা করা হয়েছে। পুরো বাড়িতে নজর বুলাতেই গেইট খুলে গেলো। সামনে প্রজ্বলিত হলো চেনা কিছু মুখ। মিষ্টির বাটি আর পানির গ্লাস ট্রে তে সাজিয়ে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে অন্তি, তার পাশে আসিফা বেগম এবং রিফা। রিফার বিয়ে হয়েছে সাজ্জাদেরই বন্ধুর সাথে। আজ রুয়ানা আসবে বলে সে বাবার বাসায় এসেছে। তার স্বামী প্রবাসে থাকার ফলে সাথে নেই। পেছনে সাজ্জাদ, আরিফ হোসাইন। বাড়ির মূল দরজায় দাড়িয়ে আছে জুবায়ের-আয়াত। জুবায়েরের কোলে তাজকিয়া। অন্য পাশে রবিউল চৌধুরী, ডালিয়া চৌধুরী আর রামিসা দাড়ানো। সবাই যেন অধির আগ্রহে তাদের-ই অপেক্ষা করছিলো। অন্তি এগিয়ে আসলো রিয়ানার দিকে। মিষ্টির ট্রে রিফার হাতে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। ধরেই হু হু করে কেঁদে উঠলো। রিয়ানা হকচকিত হয়ে যায়। উপস্থিত সকলেই অন্তির কান্নার মানে পেলো না। রিয়ানা তার পিঠে হাত বুলিয়ে আস্তেধীরে শুধালো,

“কি হলো ভাবী? কাঁদছেন কেন?”

“আজ আমার আনন্দের দিন রিয়ু। খুশির চোঁটে কান্না পাচ্ছে। একদিন আমার ভুলে বাড়ি ছেড়েছিলে। ভেবেছিলাম আর হয়তো আসবেনা। আমায় হয়তো ক্ষমা করোনি। কিন্তু আজ তোমাদের দেখে আমার অনেক শান্তি লাগছে। ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা।”

রিয়ানা মৃদু হাসলো। ভালোবাসার পরশ পেয়ে মেয়ে-টা হয়তো বদলেছে। কিন্তু তার চাপা স্বভাব, রাগ, তেজ কিছু কমেনি। শুধু সময় আর মানুষ ভেদে প্রকাশ করে এটুকুই যা পার্থক্য এসেছে। নিজের স্বভাবসুলভ কারণে সে অন্তির কথার জবাব দিলো না। কি বলবে! ভেবে পেলো না। আসিফা বেগম বললেন,

“মেয়ে-টা কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবে? নাও মিষ্টিমুখ করিয়ে ঘরে তুলো আগে।”

অন্তি মিষ্টিমুখ করিয়ে দিলো। অল্প একটু পানি খাইয়ে হাত ধরে বাড়িতে প্রবেশ করালো। সবাইকে দেখলেও অন্তির আর সাজ্জাদের ছেলে কে না দেখতে না পেয়ে অন্তিকে শুধালো,

“ভাবী সামিহ কোথায়? ”

সাজ্জাদ এবং অন্তির ছেলের নাম সামিহ। বয়স ১বছর ১০মাস চলছে। হাঁটা শিখেছে। পুরো বাড়ি মাথায় করে রাখে। অন্তি হেসে বললে,

“সে আর কোথায় থাকবে? জেগে থাকলে পুরো বাড়ি ছুটে বেড়ায়। ঘুমাচ্ছে বলে শান্ত বাড়ি।”

১০৫
রিয়ানা হাসলো তার কথায়। রায়াদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে বসেছে৷ সবাই গোল হয়ে ড্রইং রুমেই বসে পরেছে। ভ্লাদ আর মাদালিনা বাংলা কিছু বুঝছেনা। শুধু তাহিয়াকে কনুই দিয়ে খোঁচাচ্ছে। তাহিয়া বিরক্ত হলেও অন্যেদেশের মানুষ তাদের দেশে এস তাদের আড্ডায় শামিল হতে চাচ্ছে! আগ্রহ দেখাচ্ছে! এজন্য তাহিয়া বিরক্ত হতে হতেও হয়না। সাইকোলজি নিয়ে তিন বছরের ব্যাচেলর কোর্স করা শেষ রিয়ানা, তাহিয়া, ভ্লাদ, মাদালিনা চারজনেরই। এবার আবার মাইন্ড এড ব্রেইন সাবজেক্ট নিয়ে ওর চারজনই একত্রে মাস্টার্স করবে। এরপর ডক্টরাল ডিগ্রী নিয়ে প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট হিসেবে সুইচ করতে পারবে ওরা। তিনবছরের ৬টা সেমিস্টার শেষ হওয়ায় ওদের দেশে আসা। এছাড়াও রিয়ানার বেবি হবে। সেই কারণে মূলত দেশে আসা। আর তাদের দেশ কেমন! এটা দেখতেই ভ্লাদ আর মাদালিনার আগমন এখানে। রিয়ানা সবার সাথে টুকটাক কুশলাদি বিনিময় করে একটু পরপর যপন হাঁপিয়ে উঠছিলো। রায়াদ বিষয়-টা খেয়াল করে ওর পাশেই বসা ছিলো বলে ফিসফিস করে বললো,

“ফ্রেশ হবে তাইনা? একটু রেস্টেরও প্রয়োজন। বললাম এত জার্নি করো না এই অবস্থায়। একদেশ থেকে দৌড়ে এদেশে এসে একদিন দম না নিয়ে আবার এখানে আসলে! একটু রেস্ট করে আগামীকাল আসলে কি হতো?”

“উফ থামবেন আপনি? আসতে না আসতেই বকা শুরু। এই লোককপ নিয়ে পারা যায় না।”

রিয়ানা খিটখিটে গলায় বললো। রায়াদ তাতে একটুও মন খারপ করলো না। জানে রিয়ানার মুড সুইং হয়। তাই হেসেই বললো,

“আচ্ছা থামলাম। চলো ফ্রেশ হবে। ”

রিয়ানা মাথা নাড়ালো। রায়াদ আয়াতকে ডেকে ইশারায় বোঝালো রিয়ানাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। আয়াত বসা থেকে উঠে এসে বোনকে হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলো। সিড়ি ভেঙে উপরে উঠবে! এজন্য রিয়ানার থাকার ব্যবস্থা নিচ তলার এক রুমে করেছে অন্তি। সে উঠে এসে রুম দেখিয়ে দিলো। তাতেই যেন সস্তি মিললো রিয়ানার। অবশেষে তার অপমান কাজে লেগেছে তবে। একদম পার্ফেক্ট বউ। সে প্রশান্তির হাসি হাসলো। রায়াদও পিছু পিছু ফ্রেশ হতে চলে গেলো। দূর থেকে সোফায় বসে সাজ্জাদ সবই খেয়াল করলো। সবার সুখ দেখে আনমনে ভাবলো,

“অতীত থাকে সবার-ই। সেই অতীতকে ঘিরে আঁটকে থাকলে এই সুখ গুলো জীবনে আসে না। মুভ ওন করতে হয়। শুধু প্রয়োজন একটা সঠিক মানুষের। রিয়ানার জন্য রায়াদকে চয়েজ করে তবে ভুল করিনি। এটিটিউড কুইন! এভাবেই সুখে থাকো, ভালো থাকো। তোমায় আমি পাইনি সে আফসোস আমার নেই। অন্তি আমার কপালে ছিলো। প্রথমে আফসোস থাকলেও এখন মিটে গেছে। আমি ভালো একা থাকি কি করে বলো! তোমায় কোনো একটা সময় ভালোবাসি বলেছিলাম। বলেছিলে না! আমি ছাড়া তোমায় কেউ ভালোবাসি বলেনি! এই কথা-টা সারাজীবন থাক বলে জেদ করেছিলাম আমি। কিন্তু সময় আমায় বুঝিয়েছে এই কথা-টা একটুও মানায় না জীবনে। একজনকে অবশ্যই প্রয়োজন। তাই চেয়েছি আমার পরেও কেউ একজন তোমায় ভালোবাসুক। তার ভালোবাসা আমার ভালোবাসাকেও ছাঁপিয়ে যাক। তোমায় তোমার মতো করে জেদের সহিত আগলে রাখুক। রায়াদ তা পেরেছে। আমার কোনো আফসোস নেই আর। জীবনে স্ত্রী থাকা সত্বেও পরনারীর কথা ভাবা অন্যায়। আমি তোমায় ভাবছিনা কিন্তু! শুধু কোথাও একটা মনে হয় আমিও ভালোবাসি বলেছিলাম তোমায়। সেসব এখন অতীত। এভাবেই সুখে থাকো তুমি।”

১০৬,
অন্তি তাহিয়া, ভ্লাদ, মাদালিনাকে ডেকে নিয়ে রুম দেখিয়ে দিলো। বড়-রা সব গল্পগুজবে ব্যস্ত। আরিফ হোসাইন- আসিফা বেগম, ইয়াসিন শাহনেওয়াজ-ফাতেহা খানম, রবিউল চৌধুরী-ডালিয়া চৌধুরী হানিফ হোসাইন সব বেয়াই বিয়াইন মিলে গল্পগুজবে ব্যস্ত। অন্তির বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক ধীরে ধীরে একটু স্বাভাবিক হয়েছে। তবে তারা কমই আসেন এখানে। আজ আরিফ হোসাইন আসতে বলার পরি তারা আসেননি। আসলে মেয়ের কোনো ভুল থাকলে! তার শ্বশুর বাড়িতে নিজেদের সম্মানের জায়গা নড়বড়ে হয়ে যায়। যতই মেয়ের শ্বশুর বাড়ির মানুষ ভালো হোক। তবুও একটু চক্ষুলজ্জা বলে বিষয়-টা তো থাকে। এরমাঝে মেয়ের কাছে নিজের হীন কাজের জন্য মা অপমানিত হয়েছিলো! তার আর সাহস কই মেয়ের চোখে চোখ রাখা! এজন্য যত-টা কম আসা যায়, ততটাই কম আসেন উনারা। শুধু নাতীকে দেখার মন হলে উনারা আসেন।

সব মা বাবাকে একসাথে দেখে অন্তি এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সামিহ উঠে পরায় তাকে আনতে রুমের দিকে পা বাড়ায়। হাত মুখ ধুয়ে আনিয়ে খাইয়ে দেয় একটু। এরপর তাহিয়া এসে সামিহকে দেখে আগ বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। সামিহ বাচ্চা-টা অন্য রকম। সাধারণত বাচ্চা-রা অপরিচিত মানুষ দেখলে কান্না করে। কিন্তু সে অপরিচিত মানুষ দেখলেই আনন্দে তাদের পিছনে পিছনেই ঘুরে আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। তাহিয়ার কোলে সামিহকে দিয়ে অন্তি খাবার আয়োজন করতে যায়। তার সাথে আয়াত আর রিফাও হাত লাগায়। রোজা আর তাহিয়া মিলে সামিহকে নিয়ে খেলতে শুরু করে ড্রইং রুমে৷

রিয়ানা রুম থেকে বেরিয়ে এসে সবার দিকে এক নজর চোখ বুলায়। পুরো পরিবার আজ একসাথে। কত সুন্দর লাগছে। সবাই এমন বাঁধনে বেঁধে থাকুক। বাবার উপর চোখ পরতেই রিয়ানার চোখে জল জমে। এই মানুষ-টার উপর তার অভিমানের পাহাড় হয়তো এ জীবনে গলবে না। এত এত অবহেলা-অপমানের ব্যথা কি এত সহজে মুছে যায় জীবন থেকে? তবুও সম্পর্ক-টা অনেক-টা স্বাভাবিক হয়েছে উনার সাথে। মাঝে একবার হানিফ হোসাইন একটু বেশি-ই অসুস্থ হয়েছিলেন। তখন রিয়ানা শত অভিযোগ অভিমানেও মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারেনি। শত হোক দিনশেষে বাবা তো! এজন্য বাবা বলে আবারও ডাকতে শুরু করে। হানিফ হোসাইন এখন নিজের মতো চেষ্টা করেন দুই মেয়ে-কে সমান ভাবে ভালোবাসার। এই মেয়ে দুটোই তো উনার স্ত্রীর শেষ স্মৃতি। রিয়ানার এসব আকাশ কুসুম চিন্তার মাঝেই সামিহ দৌড়ে এসে রিয়ানার লং গাউন ধরে টানতে শুরু করে। তাকে দেখে মিষ্টি হাসে রিয়ানা। পেট উঁচু হওয়ায় উবু হয়ে বসতে পারেনা। তাহিয়াকে ইশারায় ডেকে সামিহকে কোলে নিয়ে তার সামনে তুলে ধরতে বলে। তাহিয়া তা করতেই রিয়ানার সামিহর গালে কয়েকটা চুমু খেয়ে বসে। তখনই সাজ্জাদ এগিয়ে আসে। এসে সামিহকে কোলে নিয়ে বলে,

“সব ডাক ডাকতে শিখলেও ফুফু ডাক-টা ফুটেনি। বাই দ্যা রিয়ু, তোমার মেয়ে হলে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিবো ওকে?”

“বাব্বাহ আমার বাচ্চা পয়দা না হতেই আমায় ছাড়া বিয়ের প্রস্তাবও ঠিক করা হচ্ছে?”

রায়াদ রুম থেকে বের হতে হতে কথা-টা বললো। তাহিয়া সহ বাকি তিনজনও হেসে ফেললো। সাজ্জাদ বললো,

“কি করবো? ছেলে আমার যে পাকা! বড় হলে কার মেয়ে অরে আনে তার তো ঠিক নেই। তাই বড় হওয়ার সাথে সাথে তোমাদের মেয়েকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, বাবা এটা তোর বউ। প্রেম ভালোবাসা যা করতে হয়! এর সাথেই করিস।”

রায়াদও হেসে ফেললো। তাদের সাথে যোগদান করলো জুবায়ের। সে-ও পেছন থেকে সব খেয়াল করে বসা থেকে উঠে এসেছিলো। তার কানে কথা পরতেই বললো,

“আর ওদের দুজনের মাঝে ঘটকালি করবে আমার মেয়ে।”

“বাপরে দুলাভাই! এখনই মেয়ে-কে ঘটক বানিয়ে দিলেন? তবে এখন ছাড়ুন এসব কথা। আগে আমার মেয়ে হয় কিনা! দেখা যাক।”

রিয়ানা কথা-টা বললো। তখনই অন্তি সবাইকে ডাক ছাড়ে খাবারের জন্য। রায়াদ রিয়ানাকে ধরে সাবধানে সেদিকে পা বাড়ায়। মেয়ে-টার শরীর এমনি দুর্বল। এরমাঝে প্রেগন্যান্ট। এজন্য প্রতি কদমেই সে ভীত থাকে। সাজ্জাদের মনের খুশি দ্বিগুণ হলো রায়াদকে এতটা কেয়ারিং হতে দেখে। সেও ছেলেকে কোলে নিয়ে পা বাড়ালো খাবার টেবিলে।

১০৭,
সময় টা রাত। ছেলে-কে ঘুম পাড়িয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে অন্তি। বালিশে মাথা ঠেঁকিয়ে অপর পাশে শোয়া রত সাজ্জাদকে বলে,

“রিয়ানা ভালো আছে। দেখতেই কত ভালো লাগছে তাই না?”

“একটু বেশিই ভালো লাগছে। অগোছালো জীবন-টা রায়াদ গুছিয়ে দিয়েছে। এটাই ভালো হয়েছে।”

“রিয়ানা তোমায় সুযোগ দিলে আমার জায়গায় ও থাকতো তাই না?”

অন্তি হাসিমুখেই কথা-টা বললো। সাজ্জাদ বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে ছেলে-কে একটু সাইড দিকে শুইয়ে দিলো। বালিশ দিয়ে ঘের দিয়ে অন্তির পাশে শুয়ে পরলো। অন্তি বলে উঠলো,

“আরে কি করছেন?”

সাজ্জাদ অন্তিকে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ ডুবিয়ে বললো,

“যতবার আমার অতীত টানবে! এভাবেই তোমার অধিকার তোমায় বুঝিয়ে দিবো। মনে রেখো আমার বর্তমান আর ভবিষ্যত টা তুমি আমাদের ছেলে। ”

অন্তি তৃপ্তিতে চোখ বুজলো। সাজ্জাদ একটু কাছে আসতেই সে ছেলের দিকে এক পলক তাকিয়ে সাজ্জাদকে কাছে টেনে নিলো। আজ একটু ভালোবাসলে ক্ষতি কি তাতে? সাজ্জাদ একটু না অনেক-টা বেশি-ই ভালোবাসুক তাকে। সুখের ছোঁয়ায় অন্তি সাজ্জাদকে জাপ্টে জড়িয়ে সব কিছু ভুলে যেতে মত্ত হয়ে পরলো।

মেয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দুইপাশে একহাতে ভর দিয়ে মাথা উঁচিয়ে শুয়ে থাকা একবার বাবাকে তো একবার মা-কে দেখছে। আর খিলখিল করে হেসে উঠে হাত পা নাড়িয়ে হাসছে। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে আয়াত আর জুবায়ের বিরক্ত হয়ে মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে দুপাশে শুয়ে হাতের তালুতে ভর দিয়ে শুয়ে একবার মেয়েকে তো আরেক দুজনের মাঝে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এরপ দুজনই বিরক্তি ঝেড়ে ফিক করে হেসে উঠলো। আয়াত বললো,

“চালাক বাপের চালাক মেয়ে। আরও মাইয়ারে বলেন, মা তোমার মাকে।একটু আদর করবো। তুমি ঘুমাও। যাক মাইয়া আজ আমায় বাঁচিয়ে দিচ্ছে।”

“মাইয়া যখন বাপের রোমাসন্সে ব্যাঘাত ঘটায়! কি বলবো আর? আজ এতদিন পর সবাইকে হাসিখুশি দেখে খুশির ঠ্যলায় ভাবলাম বউকে একটু আদর করি! ওমাহ! আমার মাইয়া তো পেঁচার মতো চোখ করে তাকিয়ে তাকিয়ে খেলছে।”

আয়াত সশব্দে হাসলো এবার জুবায়েরের কথায়। জুবায়ের তা দেখে সটান হয়ে শুয়ে বললো,

“না হয়, আমরা তিনজনই জাগবো। আমার আম্মা খেলবে। আমরা দুজন দেখবো। তবে রিয়ানা স্বাভাবিক হয়েছে আর রায়াদের সাথে ভালো আছে! এটাই কম খুশির খবর নাকি?”

আয়াত মেয়ের পাশে বালিশ দিয়ে বুছানা ছাড়লো। রুমে থাকা সিঙ্গেল সোফা থেকে কুশন তুলে আরও একটু উঁচু করে দিয়ে জুবায়েরের বুকের উপর মাথা দিয়ে উপুর হয়ে সটান হয়ে পায়ে পা মিলিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে শুয়ে পরলো। চোখ বন্ধ করে জুবায়রের ঠোঁটে চুমু দিয়ে বললো,

“ওরা এভাবেই ভালো থাকুক। আর আপনি আমি এভাবেই।”

রুমের মাঝে অস্থির হয়ে এমাথা-ওমাথা পায়চারি করছে রিয়ানা। কোমড় ধরে এসেছে। চোখে ঘুম নেই। রায়াদ গালে হাত দিয়ে সোফায় বসে হাঁটা রত রিয়ানার দেখছে আর হতাশ হচ্ছে। মেয়ে-টা একটুও নিজের ভালো আজও বোঝেনা। রেস্ট করা রেখে এই মাঝ রাত্তিরে ঘরময় কেমন হেঁটে বেড়াচ্ছে। রায়াদ এবার উঠে দাড়ালো। রিয়ানার বাহু ধরে রুমের জানালার কাছে এনে দাড় করালো। রিয়ানা বিরক্ত হয়ে বললো,

“আরে কি করছেন? ছাড়ুন তো! আমি হাঁটবো। আমার ভালো লাগছেনা।”

রায়াদ জানালা খুলে দিয়ে রিয়ানাকে দাড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি রেখে বললো,

“বাইরের মুক্ত বাতাসে শ্বাস নাও লম্বা করে। ঐ দেখো আকাশে চাঁদ। চলো দুজন চন্দ্রবিলাস করি। বাসর রাতে তো করতে পারিনি। আজ করি। এভাবে হাঁটলে কোমড়ের ব্যথা না কমে উল্টে পা ব্যথা করবে শুভ্রপরি।”

রিয়ানাকে রায়াদ শুভ্রপরি বলেই ডাকে। রায়াদের কান্ডে রিয়ানা দূর আকাশে চাঁদের পানে দৃষ্টি মেলে বললো,

“সবাই অনেক ভালো আছে রায়াদ। এভাবেই তারা ভালো থাকুক। আপনিও আমার রঙিন খাম হয়ে বিষাদের চিঠিগুলো নিজের মাঝে জমিয়ে নিয়ে রঙিন রঙধনুতে রাঙিয়ে দিয়েছেন আমায়৷ এই এখনই একটু অস্থির লাগছিলো। একসময় যাকে ভালোবেসে বিষাদে মুড়িয়েছিলাম নিজেকে! আজ তাকে দেখে একটু খারাপ লাগছিলো। এটা অনুচিত। তবুও লাগলো। আপনার মাঝে সব জমা করলাম।”

রায়াদ মৃদু হেসে রিয়ানার কাঁধে চুমু দিয়ে বললো,

“আজ থেকে একযুগ পরে গিয়েও সাজ্জাদ ভাইকে দেখে আপনার একটু হলেও খারাপ লাগবে। ব্যাপার না এটা। উল্টে যদি খারাপ না লাগে তখন বুঝবেন ভালোবাসা মিথ্যা ছিলো। অপূর্ণ ভালোবাসা যদি ব্যথায় না দেয়! তবে সে টা আবার কেমন ভালোবাসা হলো বলুন আমার শুভ্রপরি?”

আপনাকে আমি ভালোবাসি রায়াদ শাহনেওয়াজ। আমার ভুলচুক সব জেনেই আমায় এভাবে আগলানোর জন্য আপনাকে এত্ত এত্ত ভালোবাসা।”

“আপনাকে আমিও ভালোবাসি মিসেস রিয়ানা হোসাইন। আপনার সব-টা এভাবেই আমার মাঝে জমা করবেন। আমি যে আপনার #রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি।”

এভাবেই ভালো থাকুক রিয়ানা-রায়াদ, আয়াত-জুবায়ের, অন্তি-সাজ্জাদ। তাদের বিষাদগুলো রঙিন খামে মুড়িয়ে উড়িয়ে দিয়ে এভাবেই ভালো থাকুক।

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে