#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৮
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৩৯,
পরদিন সকালবেলায়, নির্ঘুম এক রাত কাটিয়ে মাথা ব্যথায় কপাল চেপে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে রিয়ানা। সারারাত কেটেছে বাবার চিন্তায়। গ্রামে যাবে কি যাবেনা! এই দ্বিধায় ভুগছে সে। আয়াত ব্রেকফাস্ট বানিয়ে রিয়ানাকে উচ্চস্বরে ডাকছে রিয়ানাকে। সে বোনের কণ্ঠস্বর শুনতেই বসা থেকে উঠে দাড়ালো। শব্দ করেই জবাব দিলো,
“ফ্রেশ হয়ে আসছি আপু। তুই খেতে বস।”
এরপর চুলগুলো পেচিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে খোপার কাঠি মাথায় ঢুকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো রিয়ানা। এদিকে আয়াত আনমনা হয়ে বসেছিলো ডাইনিং টেবিলে। গ্রামে সে একা-ই যাবে। বাবা অসুস্থ! রিয়ানা না গেলেও তো কম শোরগোল হবে না। আবার নিয়ে গেলেও বোনের মনের ক্ষত তাজা বৈ শুকোবেনা। বাবা আর বোন! কার কথা ভাববে! মাথা ঘুরিয়ে উঠছে আয়াতের। এত দায়িত্ব আর ভালো লাগেনা তার। এরথেকে ভালো রিয়ানার ছোটো হত! জীবনে শান্তি থাকতো। আয়াত ফুঁপিয়ে উঠে। উপর দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে,
“ও মা! রেখে গেলে এ কোন দোটানায়! ছোটো বোনের জীবনে তোমার ছায়া! বাবার জীবনে তার মায়ের ছায়া দিয়ে আগলে রাখতে গিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি। তুমি থাকলে আজ সব ঠিক থাকতো মা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সবাই উপরে উপরে আমার আমি-টার হাসিখুশি চেহারা দেখে মনে করে আমার কষ্ট নেই! অথচ আমার ভেতর-টা রোজ জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে মা। তুমি ফিরে আসো, আমি একটু তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো। আমার আর সহ্য করার ক্ষমতা হচ্ছে না মা। কার কথা ভাববো! বাবার কথা ভাবলে খারাপ লাগে। বোনের কথা ভাবলেও খারাপ লাগে। মাঝখানে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়-টাই পাচ্ছি না। আমিও তো মানুষ মা। আমার খারাপ লাগাগুলোকে তো কেউ একটা বার নজর দিয়ে দেখে না। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে বাবার মন রাখতে গিয়ে বোনকে কষ্ট দিই! বোনের মন রাখতে গিয়ে বাবাকে কষ্ট দিই। দুজনের মন রাখতে গেলে তাদের থেকে-ই কষ্ট পাই। অথচ সেই কষ্ট লুকিয়ে ঠোঁটে ঝোলাতে হয় চওড়া হাসি। তুমি থাকলে আজ আমাদের পরিবার-টা সুন্দর থাকতো মা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! এই কথা-টা আমি কাউকে বলতে পারিনা মা। এ কোন দোটানায় আমায় রেখে গেলে! আমার তোমাকে প্রয়োজন মা। একজন মেয়ের জীবনে মায়ের যা অবদান! সেই অবদানের জন্য তোমায় আমার প্রয়োজন। আমি কার কাছে মায়ের পরশ পাবো বলো? বড় হয়ে এ কোন দোষ করলাম৷ আমি! যেদিকেই ভুল হয়! আমার শিক্ষার উপর আঙুল উঠে। মানুষ বলে, ছোটো বোনকে মানুষ করতে পারিনি! কেমন বড় বোন হলাম! বাবার আদর না পেয়েও শুনি বোনের কাছে, সব আদর ছিনিয়ে নিয়ে তাকে রগচটা বানিয়েছি। অথচ ওর চিন্তায় প্রতিটা নির্ঘুম রাত সাক্ষী আমার কি অবস্থা হয়! এই যে এখনও চিন্তা করছি! সাথে নিবো কিনা! নিতে চাইলে বলবে, কষ্ট দিতে নিয়ে যাচ্ছি। না নিয়ে যেতে চাইলে বলবে, বাবা শুধু আমার একার-ই। এভাবে আর জীবন-টা চলছেনা মা। আমার জীবনও এবার বুঝি থমকে যায়। তোমার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে মা।”
আয়াত আপন মনে একদমে কথাগুলো বলে ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রিয়ানা দরজার কাছে দাড়িয়ে সব-ই শুনলো। দু-কদম পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সে-ও ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। ছোট থেকে বড় হয়েছে। দেখেছে এই একজন মানুষ তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবেসে গেছে। তবুও চাইতে-না চাইতে, ইচ্ছে-য়-অনিচ্ছায় কষ্ট দিয়ে-ই গেছে। ভালোবাসার মূল্য কষ্ট দিয়ে-ই পরিশোধ করেছে। এভাবে আর কতদিন! এবার না হয় বোনকে একটু শান্তি দিলো। বোনের দিকে এগিয়ে আসলো রিয়ানা। কাঁধে হাত রেখে কাঁপা স্বরে বললো,
“আমিও গ্রামে যাবো আপু। অনেক লুকোচুরি হলো। এবার কষ্টের মুখোমুখি হয়ে কষ্ট টুকু পিছনে ফেলে আগাতে চাই। মানুষকে অনেক সুযোগ দিলাম কথা শোনানোর! এবার জবাব দেবার পালা। তোকে আর কষ্ট পেতে দেখতে পারবোনা। তুই সে মানুষ, যে আমায় মায়ের অভাব বুঝতে দিসনি। তবুও তোকে কষ্ট-ই দিয়ে গেছি। মেয়ে-রা তো হুটহাট মা-কে কষ্ট দেয়! ছোট বোন হিসেবে আমিও দিয়ে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করিস।”
৪০,
লাগাতার কলিং বেল বাজার শব্দে বিরক্ত হলো জুবায়ের। ফোন হাতরে সময় দেখে ন’টা বাজে। ফোনের স্কিনে রায়াদের নাম্বার থেকে ১০টা মিসড কল লেখা ভাসছে। আজ কাজ থেকেও ছুটি বিধায় সে পরে পরে ঘুমাচ্ছিলো। রাতে রায়াদ কল করার পর আর ঘুমানো হয়নি তার। ভোর রাতে চোখ লেগে আসে জুবায়েরের। তখন-ই ফজরের নামাজটা পরে সে ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু ন’টা বাজতেই রায়াদ আবার কল দিয়েছে। ফোন সাইলেন্ট থাকায় যার একটা কলও রিসিভ করতে পারেনি জুবায়ের। আবার কলিং বেলা বাজার শব্দ! জুবায়ের সন্দেহ করলো রায়াদ এসেছে। আলসেমি ভেঙে বিছানা ছাড়লো জুবায়ের। পায়ে স্লিপার গছিয়ে হাঁটা ধরলো দরজার দিকে। ড্রইং রুম পেরিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পেলো রায়াদকে। পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল, পরনে জিন্স, নরমাল-ই একটা স্কাই ব্লু কালারের শার্ট। যার হাতা কনুই অব্দি গোটানো। চুলগুলো উসকোখুসকো লাগলো জুবায়েরের কাছে। উজ্জল শ্যামবর্ণের পুরুষ-টির মুখায়বে মলিনতার ছাপ যেন জ্বলজ্বল করছে। বা হাতের আঙুলে বাইরের কি রিং ঝুলছে। রায়াদকে এত শ্রান্ত রুপে দেখে জুবায়ের থমকালো। রায়াদ সাধারণত সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু হঠাৎ করে তাকে এত অগোছালো অবস্থায় দেখে খানিক-টা বিস্মিত হয়েছে জুবায়ের। এজন্য রায়াদকে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো জুবায়ের। জুবায়েরকে দরজা আঁকড়ে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করতে দেখে রায়াদ বললো,
“সমস্যা কি তোর? আমায় কি পাবনা ফেরত পাগলের মতো লাগছে? নাকি মেয়েদের মতো ক্রাশ খেয়ে আমায় দেখছিস?”
“চুপ কর, নিজে-ই একটু ভেতরে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখ। প্রতিদিনের তুলনায় তোকে কেমন লাগছে! তাহলে বুঝবি ভুত দেখার মতো চমকে কেন গেছি?”
জুবায়ের বুকে হাত বেঁধে সরে দাড়িয়ে কথাগুলো বললো। রায়াদ কি রিং ঘুরাতে ঘুরাতে স্যান্ডেল খুলে বাসায় প্রবেশ করলো। সোজাসুজি ড্রইং রুমের সোফায় বসতে বসতে বললো,
“ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট বানা। দেখে তো মনে হচ্ছে আম-ই তোকে ডেকে তুললাম। যেখানে ডাকার কথা ভাবী-র। ডাকছি আমি। শালা নিজেও বিয়ে করবিনা, বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার সুযোগও দিবিনা। বুড়ো হলে বিয়ে করবি নাকি?”
জুবায়ের দরজা আঁটকে রায়াদের দিকে ফিরলো। দরজায় হেলান দিয়ে একপায়ের সাথে আরেক পা আড়াআড়ি ভাবে দিয়ে বললো,
“বউ তো পেয়ে-ই গিয়েছিলাম হারা’মি। খালি নিজের দোষে হারালাম। যদি জানতাম বউ-টা আয়াত! আমি জুবায়ের চৌধুরী রায়াদ কখনও মানা করতাম না।”
“পাইছো এক টাইটেল চৌধুরী। অথচ চৌধুরী বাড়ির সীমানাও আজ ৫বছরের কাছাকাছি বন্ধুত্বে দেখলাম না।”
জুবায়ের এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো রায়াদের পানে। থমথমে গলায় বললো,
“তুই কি আমার ১৪গুস্টির খপ্পড়ে গিয়ে পড়তে চাচ্ছিস? আমার কাজিন’রা আছে। তোরে পছন্দ হবে সিওর। যে পছন্দ করবে! ধরেবেধে দিবে তার গলায় ঝুলিয়ে।”
“সমস্যা নেই। তোর বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার সৌভাগ্য হবে না। নিজের বিয়ের-ই না হয় দাওয়াত খাওয়া হলো।”
“বিয়ে করতে এতদূর যাওয়ার কি দরকার? তোর আংকেলের দুই মেয়ের এক মেয়েরে বিয়ে করলেই তো পারিস!”
“আবে শালা! এক মেয়েরে তো তুই নিজের জন্য পছন্দ করে ফেলছিস! আরেক-টা তো আমার মতো বদরাগী। দুজনে এক হলে তো বাড়ি আর বাড়ি থাকবেনা! আগুণ লেগে ছাড়খাড় হবে।”
“কেন? কথাতেই তো আছে, যে যেমন! তার কপালে জুটে তেমন। আমি যেমন চঞ্চল, হাসিখুশি। একভাবে সন্ধান পেয়েও গেছি আয়াতের। আর তুই-ও বদরাগী, রিয়ানা-ও। ইমাজিন কর! তোরা দুইজন বিয়ে করলি! বিষয়-টা কেমন হবে? তোরা দুই-টাই তো এক।”
জুবায়ের মুখে হাত দিয়ে হাসি আঁটকে কথাগুলো বললো। রায়াদের মুখাভঙ্গি পাল্টালো। নিজের স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“যে যেমন, সে তেমন মানুষ পেলে দুনিয়ায় বিচ্ছেদ বলে শব্দ থাকতো না। এই কথা-টা শুধু যাদের সম্পর্ক টিকে যায় তাদের জন্য।”
জুবায়ের ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। রায়াদের দিকে এগিয়ে এসে পাশে আসলো। রায়াদ সবার সাথে গম্ভীর হলেও এক তার কাছে এসেই মনখুলে কথা বলে। তখন-ই গম্ভীর হয়! যখন রায়াদ কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকে। জুবায়ের বিষয়টা জানার জন্য রায়াদকে জিগাসা করে,
“কি নিয়ে টেনশন করছিস? বলে ফেল।”
রায়াদ হাঁটুর উপর দুহাতে ভর দিয়ে থুতুনিতে আঙুল ঠেকিয়ে বসে আছে। জুবায়েরের কথা শুনে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
” একটা জিনিস পেয়েছি রিয়ানা হোসাইনের। বুঝতে পারছিনা খুলে দেখব কিনা! এজন্য সকাল সকাল হন্তদন্ত হয়ে আসতে হলো। কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে-ই তোর কাছে ছুটে এসেছি।”
“কি পেয়েছিস?”
রায়াদ পকেট থেকে নিজের ফোন বের করলো। গ্যালারি ঘেঁটে একটা পিক বের করে জুবায়েরের দিকে এগিয়ে দিলো। জুবায়ের ফোন হাতে নিয়ে দেখলো একট ডায়েরীর ছবি। সে প্রশ্নাত্মক চাহনীতে তাকালো রায়াদের দিকে। রায়াদ সোফায় গা এলিয়ে দিলো, বললো,
“রিয়ানা হোসাইনের ডায়েরী। সাথে আনা সম্ভব হয়নি। অন্যের পার্সোনাল জিনিস। খুলে দেখা ঠিক হবেনা। আবার নিষিদ্ধ জিনিসে আগ্রহও বেশি। কি করবো বুঝতে না পেরে ছুটে আসা।”
“এটা ফোনেও বলা যেতো রায়াদ।”
“তুই রিসিভ করছিলিস না। ভাবলাম আবার বুঝি অসুস্থ হলি। এজন্ঢ় ছুটে আসা।”
রায়াদের তাকে নিয়ে চিন্তা দেখে অবাক হলো জুবায়ের। নিজের বিস্ময় চেপে রেখে জিগাসা করলো,
“কিন্তু তুই তার ডায়েরী পেলি কোথায়?”
চলবে
#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৯
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৪১,
জুবায়েরের প্রশ্নের কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না রায়াদ। ডায়েরী-টা তো সে নিজে গিয়ে রিয়ানার রুম থেকে আনেনি। তাদের ড্রইং রুমের সোফায় দেখে তুলে নিয়েছে। নিয়ে সোজা চলে এসেছে জুবায়েরের কাছে। ডায়েরীর উপরে নিচে নাম লেখার স্পেসে জ্বলজ্বল করছে রিয়ানার নাম। নাম দেখেই মূলত রায়াদের আগ্রহ জন্মায়। রায়াদকে ভাবুক দৃষ্টিতে এক নাগারে ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জুবায়ের জিগাসা করে,
“জবাব দেওয়া বাদ দিয়ে হুতুম পেঁচার মতো তাকিয়ে আছিস কেন?”
রায়াদ আমতা আমতা করে বলল,
“ডায়েরী পাওয়ার ঘটনা-টা বোধ হয় তুই বিশ্বাস করবিনা।”
“কেন করবোনা?”
রায়াদ সবকিছুই বিশ্লেষণ করলো রায়াদের কাছে। কিভাবে সে ডায়েরী-টা পেয়েছে জানালো। সব শুনে জুবায়ের বললো,
“কল দে রিয়ানার কাছে। ”
“কেন?”
“দিতে বলছি দে না! এত কথা কেন বাড়াস তুই?”
“আমার কাছে নাম্বার নেই।”
রায়াদ মুখ গোমড়া করে জবাব দিলো। জুবায়ের কপাল চাপরে বললো,
“সব সময় তো মেয়ে-টাকে অকারণে ঝাড়ির উপর রাখতে দেখলাম এ যাবত। নাম্বার থাকবে, তুই কল দিবি! এই আশা করাও বোকামি। এমন ভাবে ঝাড়ি দিস যেন তোর ঘরের বউ হয় রিয়ানা।”
“অযথা ফাল”তু কথা না বলে আইডিয়া দে কি করবো? আমার না ভীষণ করে ডায়েরী-টা পড়তে ইচ্ছে করছে। আবার অন্যের ব্যক্তিগত জিনিস। মনের মাঝে খচখচ করছে।”
“আপনার এই খচখচানিটা দূর করতেই কল দেওয়ার কথা বললাম জনাব। কিন্তু আপনার কাছে তো নাম্বার-ই নেই। রোজার কাছে নিশ্চিত আছে। কল দে ওর কাছে। নাম্বার নে রিয়ানার।”
“রোজা কি মনে করবে?”
“ফোন দিয়ে বল একটু জরুরী দরকার। তুই বাসায় নেই। এজন্য নাম্বার চাচ্ছিস।”
“যদি জিগাসা করে কি দরকার? কি জবাব দেবো?”
“আরে আমার ভাই! মেয়েদের মতো এত কথা ত্যানা প্যাচানো শুরু করলি কেন? রোজাকে একটা ধমক দিলেই তো দিয়ে দিবে। ”
রায়াদ জুবায়েরের ধমক শুনে রোজার কাছে কল দেয়। রোজা কল রিসিভ করতেই রায়াদ বলে উঠে,
“রিয়ানার নাম্বার-টা দে তো!”
“রিয়ানা আপুর নাম্বার? কিন্তু কেন?”
“তোকে দিতে বলেছি দে। এত কেন কেন শুরু করলি কেন?”
“আপুর নাম্বার আপু না দিলে আমি কেন দিবো? সবার প্রাইভেসি বলে একটা বিষয় আছে ভাইয়া।”
“প্রাইভেসির মাথায় বারি। দিতে বলছি দে। নয়তো ওনার ডায়েরী যে তুই চুরি করে আনছিস বলে দিবো!”
“ডায়েরীর বিষয়-টা তুমি কি করে জানলে? আমি তো তোমায় বলিনি। সোফায় রেখে পানি খেতে গেলাম। এসে দেখি নেই। আমি চুরি করে আনিনি। রিয়ানা আপু গ্রামে গেলো। আমি আরেকদিন আপুর ডায়েরী দেখে তাকিয়ে ছিলাম। আজ তাকে বিদায় দিতে গিয়ে ডায়েরী-টা নজরে পরে। আপুকে রিকুয়েষ্ট করি যেন দেয়। আপু দিলো ঠিক-ই। দেওয়ার সময় বললো এক পেইজ ছাড়া কোনো পেইজের ভাষা বুঝবোনা। বুঝতে পারলে যেন পড়ি। নতুবা যত্ন করে রেখে দিতে। অথচ না পড়তেই হারিয়ে বসলাম। আম্মু নেয়নি। তুমি ডায়েরীর কথা বলছো! তারমানে তুমি নিয়েছো? কোথায় তুমি? ডায়েরী-টা কোথায় ভাইয়া?”
রোজা হন্তদন্ত হয়ে একদমে কথাগুলো বলে থামলো। জুবায়ের ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রায়াদের দিকে। এই বললো সে জানেনা। অথচ এখন শুনছে রোজা চুরি করে এনেছে! মানে-টা কি? রায়াদ রোজার কথাগুলো শুনে বললো,
“হ্যাঁ, ডায়েরী-টা আমি সোফায় দেখে তুলে এনেছি। জুবায়েরের কাছে আছি। তুই এনেছিস আন্দাজ করেছিলাম। আবার আম্মুও আনতে পারে তার প্রিয় মেয়ের সম্পর্কে জানতে। কনফিউজড ছিলাম। তাই আন্দাজে বলে সিওর হলাম। তুই আনলে আমায় ধরতে দিবিনা বুঝে নিয়ে চলে আসছি। আম্মু আনলেও দিতো না। কারণ ডায়েরী তো! অনেকের গোপন কথা জানে। এখন নাম্বার-টা দে। আমি অনুমতি নিয়ে তবেই ডায়েরী খুলবো।”
“তুই হঠাৎ রিয়ানা আপুর গোপন কথা জানতে চাচ্ছিস?”
“মেয়ে-টা ভিনগ্রহের এলিয়েন কেন? এটা জানতেই ডায়েরী-টা নিয়েছি। এবার নাম্বার দে।”
৪২
রোজা বুঝলো তার ভাই নাম্বার না নিয়ে ছাড়বেনা। তাই কল কেটে মেসেজ করে নাম্বার-টা সেন্ড করলো রোজা। এরপর বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরলো। মাথায় ঘুরলো এক অদ্ভুত চিন্তা। তবে কি তার ভাই রিয়ানার প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে! হঠাৎ করে তাকে এত-টা জানার আগ্রহ। সপই আগ্রহের চোটে রিয়ানার সাথে কথা বলতেও ইচ্ছুক! বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো রোজার কাছে। সে মৃদু হেসে ভাবলো,
“রিয়ানা আপু ভাবী হলে ভালো-ই হবে। কিন্তু ডায়েরীর মাঝে বাংলা লেখা বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় ডায়েরী ভরিয়ে রাখা। ভাইয়া বুঝবে তো সব?”
এদিকে রায়াদ রোজার থেকে নাম্বার নিয়ে কল কাটতেই জুবায়ের প্রশ্ন ছুড়লো তার পানে। বললো,
“তুই বললি, তুই ডায়েরী আনিসনি। রোজা এনেছে এটাও তো বললিনা?”
“সন্দিগ্ধ ছিলাম কে এনেছে ভেবে! এবার নাম্বার নিয়ে কি করবো বল?”
“রিয়ানার কাছে কল দিবি। অদ্ভুদ প্রশ্ন করিস। নাম্বার নিয়ে মানুষ কি করে?”
“আমি কল দিবো? সেটাও রিয়ানা হোসাইনকে? রেগে ব্লক দিবে। আর৷ আমার অকারণে কারোর ব্লকলিস্টে থাকতে ইগোতে লাগে।”
“তাহলে পারমিশন ছাড়াই ডায়েরী পড়া শুরু কর। বেস্ট ওফ লাক। পরে আমায় সারাংশ জানিয়ে দিস।”
জুবায়ের উঠে দাড়ালো। ব্রেকফাস্ট বানাবে বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। রায়াদ অসহায় চাহনীতে তাকালো জুবায়েরের দিকে। চেঁচিয়ে বললো,
“তুই আমার বন্ধু নাকি শত্রু! আল্লাহ জানেন ভালো।”
“বন্ধু বলে আইডিয়া দিলাম। কিন্তু তোর পছন্দ হলোনা। ”
জুবায়ের জবাব দিয়েই কিচেনে ঢুকে পরলো। রায়াদ মনে দ্বিধাবোধ নিয়ে ডায়াল করে বসলো রিয়ানার নাম্বারে। ৩বার রিং হতেই রিয়ানা কল রিসিভ করে। রায়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠে,
“কে বলছেন?”
রিয়ানার কণ্ঠে হাত পা জমে যাবার যোগার হলো রায়াদের। জীবনে প্রথম বার সে দ্বিধার চোটে এত নার্ভাস হয়ে পরেছে। রিয়ানার শুধু খিটখিটে, মেজাজি কণ্ঠস্বর-ই শুনে এসেছে সে। আজ শান্ত কণ্ঠ শুনে একপ্রকার শীতলতা বয়ে গেল যেন রায়াদের মনে। সে কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে নম্র ভাবে বললো,
“আমি রায়াদ।”
রিয়ানা ধাক্কা খেলো বড়সড়। রায়াদ শাহনেওয়াজ তাকে কল করেছে! বিস্ময়কর ব্যাপার-স্যাপার। কিন্তু কি কারণে? রিয়ানা চট করে প্রশ্ন করে,
“কি কারণে কল করলেন?”
“গাড়ির শব্দ শোনা যায়! আপনারা কি গ্রামে যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ।”
“বাসে নাকি আমাদের গাড়িতে?”
“আপনি নিশ্চয় আমার সাথে এসব কুশল বিনিময় করতে কল করেননি? কি কারণে কল করেছেন? বলে ফেলুন। কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নই আমি।”
“আপনার ডায়েরী-টা আমার হাতে। আপনার অনুমতি চাই, এটা পড়ার জন্য আগ্রহ দমন করতে পারছিনা। এজন্য নিজের ব্যক্তিত্ব খুঁইয়ে বলতে বাধ্য হলাম। আবার আপনার অনুমতি ছাড়া পড়তেও অসস্তি লাগছিলো।”
রায়াদ একদমে কথাগুলো বলে নার্ভাসনেসে সোফায় মাথা এলিয়ে দিলো। তার গা রীতিমতো কাঁপছে। রিয়ানা বিস্তর হাসলো। বললো,
“ভাষা বুঝলে পড়তে পারেন। জানি নিষিদ্ধ জিনিসে আগ্রহ বেশি। অনুমতি দিলাম পড়ার। পড়তে পারলে জেনে নিন আমার আত্মকথন।”
রিয়ানা কল কেটে দিলো। রায়াদ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ফোনের স্কিনে রিয়ানার নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলো খানিক্ষন। রিয়ানার মতো শক্ত মনের মানুষ এত ইজিলি কারোর আগ্রহের দাম দিলো! মানতে পারছেনা রায়াদ। রিয়ানার কথা মাথায় আসলো। পড়তে পারলে পড়ুন! কি এমন আছে যে রায়াদ পড়তে পারবেনা? তৎক্ষনাৎ সে ডায়েরী হাতে তুলে নিলো। প্রথম পেইজে বাংলা লেখা ছাড়া কোনো একটা সিঙ্গেল অক্ষর নেই বাংলায়। সব জার্মানি বর্ণাক্ষরে লেখা। রায়াদের এসব দেখে মাথায় হাত। এজন্য এই মেয়ে এত ইজিলি ডায়েরী ছেড়ে দিয়েছে! জুবায়ের রায়াদের জন্য কফি বানিয়ে কফির মগ হাতে এসে তার পাশে বসলো। রায়াদের দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে শুধালো,
“এৃন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছিস কেন?”
রায়াদ কিছু বললো না। এক হাতে কফির মগ নিয়ে অন্য হাতে নিঃশব্দে ডায়েরী-টা এগিয়ে দিলো। জুবায়ের ডায়েরীর অবস্থা দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছেনা। তবুও রায়াদের অবস্থা দেখে সশব্দে হেঁসে ফেললো জুবায়ের। রায়াদ কফির মগে চুমুক দিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে বললো,
“বন্ধুর কষ্টে মজা নাও? শালা হারামি ভাবী আসলে তোরে রোজ জুতা ফিকে মারবে।”
“মজা না, ডায়েরীর সবগুলো পাতার পিক তোল। গুগলে গিয়ে ট্রান্সলেট করে পড়ে নে। কাহীনি খতম।”
জুবায়েরের কথা-টা মনে ধরলো রায়াদের। এছাড়া সে নিজেও জার্মানিতে মাস্টার্স শেষে স্টুডেন্ট ভিসায় ডাবল মাস্টার্সের জন্য এপ্লাই করতে ইচ্ছুক। এজন্য জার্মানির ভাষা শেখারও প্রয়াস করে যাচ্ছে। জুবায়ের এই কথা জানে। এজন্য আইডিয়া-টা দিলো। রায়াদ মৃদু হেসে বললো,
“তোর কাছে সবকিছুর সলিউশন আছে। এজন্য বারংবার তোর কাছে ছুটে আসি। ”
জুবায়ের আলতো হাসলো। হাসিমুখে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
“যে সবার সমস্যার সলিউশন দিতে পারে! বিশ্বাস কর, তার কাছে নিজের সমস্যার সমাধান থাকেনা।”
রায়াদের হাসি মিইয়ে গেলো। জুবায়েরে কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে চিন্তায় আছিস?”
“বাদ দে, তুই তোর কাজ শুরু কর। আমি তোর জন্য হালকা নাস্তা বানাই। ব্রেকফাস্ট করে তারপর বাসায় যাস। নয়তো শুয়ে পরিস ডায়েরী নিয়ে।”
জুবায়ের হেসে কথা-টা বলে উঠে চলে গেলো। রায়াদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই ছেলে যতটা উপরে দেখায় ভালো আছে! ভেতরে তার ১সিকিও ভালো নেই। কখনও মন খারাপের বিষয়-টা শেয়ারও করতে চায় না। রায়াদ অপেক্ষায় আছে কবে জুবায়ের নিজে সব জানাবে! সে কয়েক-টা লম্বা শ্বাস নিয়ে সব চিন্তা ভুলে মন দিলো ডায়েরীর দিকে। তারিখ দেখলো ৫ বছর আগে থেকে লেখা। মাঝে অনেক তারিখ গ্যাপ করে করে লেখা। তারিখগুলো ভাগ্যিসে ইংলিশে। নয়তো এটাও টের পেতোনা রায়াদ! যে কবে থেকে এখানে একটা মেয়ের গল্প জমা পরে। এই মেয়ে জার্মানি আছে ১২বছর হলো। পড়াশোনাও সব জার্মানি স্কুল-কলেজে। সেক্ষেত্রে নিজের ডায়েরী বাঙালি কারোর হাতে পরলে সহজে যেন তাকে জানতে না পারে! সেজন্য এমন বুদ্ধি খাটিয়েছে মেয়ে-টা। রিয়ানার বুদ্ধি দেখে বেশ খানিক্ষণ হাসলো রায়াদ। এরপর মনোযোগ দিলো গুগলে ট্রান্সলেট করার জন্য ছবি তুলতে। যে হাতের লেখা। ট্রান্সলেশন করতে পারলে হয়। সুন্দর-ই আছে, কিন্তু কম্পিউটারের টাইপ করা আর হাতের লেখা! বিস্তর পার্থক্য। শুধু ট্রান্সলেট হলে হয়। হাফ ছাড়লো রায়াদ।
৪৩,
রাস্তার দু-পাশে সবুজের সমারোহ। মাঝখান দিয়ে রাস্তার একপাশ দিয়ে শা শা করে ছুটছে গাড়ি। রিয়ানা ড্রাইভ করছে। ৯মাসের চেষ্টার পর গত ৪মাস হলো সে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে। স্টুডেন্ট হয়ে অনেক-টা পথ দূরে ক্লাস এটেন্ড করতে হয় বলে স্টুডেন্টদের জন্য একটা সুবিধা আছে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার। জার্মানির এই অমায়িক সবুজের সৌন্দর্যে বুদ হয়ে আছে সাজ্জাদ। অবশ্য জার্মানীর সব জায়গাতেই শীত কাল ব্যতিত সবসময়-ই সবুজের সমারোহ লক্ষ্য করা যায়। জানালায় হাত রেখে তাতে মাথা ঠেকিয়ে মন দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছে। আজ জার্মানিতে তার শেষ দিন। আগামীকাল সকালেই ফ্লাইট আছে তার। চলে যাবে! এজন্য রিয়ানার কাছে আবদার করেছিলো আজ যেনো তাকে নিয়ে রিয়ানা একটু ঘুরে বেড়ায়, সময় দেয়। রিয়ানা তার কথা ফেলেনি। গাড়ি নিয়ে সাজ্জাদের সাথে বেরিয়ে পরেছে। ঘুরতে এনেছে জার্মানির ভিলেজ সাইডে। শহর থেকে ১২-১৪কিলোমিটার ভেতর থেকেই জার্মানিদের গ্রাম শুরু হয়। জার্মানিরা তাদের গ্রামকে সাধারণত ডর্ফ বলে পরিচিত করে থাকে। একেকটা গ্রামে ৫০০এর বেশি পরিবার থাকেনা। জার্মানিদের গ্রাম আর শহর পার্থক্য করার জো নেই। শুধু একটা-ই পার্থক্য নজরে আসে শহরে বাড়ির পর বাড়ি। গ্রামে বাড়ির পেছনে বিশাল জমি। রাস্তার ধারঘেষে সবুজ গাছের বাগান। তার পিছনে বাড়ি। বাড়ির পিছনে তাদের জমি। যেখানে তারা আবাদ করে। পশুপালন করে। জার্মানির স্থায়ী বাসিন্দা-রা ভীষণ পশু ভালোবাসে। তারা আবাদ ফসলের পাশাপাশি ঘোড়া, গরু, ছাগল, ভেড়া, রাজহাঁস, বিভিন্ন জাতের পাখি পালন করে। অনেকে ব্যক্তিগত ভাবে কুকুর, বিড়ালও পালন করে। বাংলাদেশে যেমন এক পৌরসভায় এক গ্রাম শেষে অন্য গ্রাম শুরু হয়! জার্মানিতেও তেমন এক গ্রাম শেষে অন্য গ্রাম শুরু হয়। আর রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড দিয়ে সেই অন্য গ্রাম শুরু হওয়ার চিহ্ন লেখা থাকে। রিয়ানা ড্রাইভ করে এক গ্রাম ছাড়িয়ে অন্য গ্রামে প্রবেশ করলো। সাজ্জাদ আজ কথা বলছেনা। চুপচাপ শুধু প্রকৃতি দেখে যাচ্ছে। সাজ্জাদের এই চুপ থাকা-টা মানতে পারছেনা রিয়ানা। কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে তার। সাজ্জাদ চলে যাবে শুনে ভীষণ হাসফাসও লাগছিলো তার। তবে কি সে সাজ্জাদকে ভালোবাসতে বসেছে। না এমন-টা হবার নয়। রিয়ানা মনকে বুঝ দিলো। রাস্তার একপাশে পার্কিং স্পেস দেখে গাড়ি থামালো। সাজ্জাদ চমকালো। সে প্রকৃতিতে এতটা বিভোর ছিলো যে গাড়ি থামতেই চমকে উঠেছে। গাড়ি থামতেই সাজ্জাদ রিয়ানার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“গাড়ি থামালে যে?”
“হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো। আর আপনিও আজ চুপচাপ। কথা ফোঁটাতে থামলাম।”
রিয়ানার সোজাসাপটা উত্তর। সাজ্জাদ মৃদু হাসলো। সে রিয়ানার পানে তাকিয়ে মলিন মুখে বললো,
“আপনি বড্ড নিষ্ঠুর মানবী রিয়ানা হোসাইন। চলে যাচ্ছি। তবুও ছু”ড়ির আঘাতে ক্ষ”ত সৃষ্টি করে দম নেন।”
রিয়ানা হাসলো সাজ্জাদের সম্মোধন পরিবর্তনে। আর থামলো না। গাড়ি আবার স্টার্ট করলো। সাজ্জাদ দমে গেলো রিয়ানার নিরবতায়। আবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বাইরের দিকে। নজরে পরলো ১২-১৩বছরের বাচ্চা-রা সাইকেল রাইড করে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। কাঁধে স্কুল ব্যাগ। রাস্তার দুপাশে চিরসবুজ গাছ দাড়িয়ে। এই প্রকৃতির মাঝে বাচ্চাগুলো যেন জীবন্ত সৌন্দর্য। সাজ্জাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আজ মনে হচ্ছে জীবন-টা সেই ১২-১৩বছরেই সুন্দর ছিলো। শীতের শুরু প্রায়। সূর্য তাড়াতাড়ি-ই অস্ত যাবার পথে। রিয়ানা ৩টা গ্রাম ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। বাড়ি এসে সাজ্জাদ গাড়ি থেকে নামার সময় রিয়ানার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“তবে আমি আমার সুযোগ-টা যথার্থ কাজে লাগাতে পারলাম না মিস রিয়ানা।”
“আপনি সুযোগ পেয়েও পাননি। এজন্য ব্যর্থ হলেন। কারণ আমার মনে আপনার জন্য অনুভূতি নেই। কিন্তু আপনিও দমাবার পাত্র নন। এজন্য দমিয়ে দিতে কথাটুকু বলেছিলাম। আমায় ক্ষমা করবেন।”
“আপনি এক নিষ্ঠুর মায়াবিনী। বিষাদ রঙে রাঙানো এক পাষাণী। আপনি ভালো থাকবেন। আমি সাজ্জাদ হোসাইন আপনাকে কখনও বিরক্ত করবোনা। কিন্তু দুয়া করি, আমার মতো ভালো আপনিও কাউকে একদিন বাসবেন। সে যেন এরকমই আপনাকে সুযোগ দিয়েও না দেয়। আপনি যেন তাকে হারিয়ে ফেলেন। যেমন-টা আমি হারালাম। আমি ভালো মানুষ নই। আমার ভালো থাকা কেড়ে নিলেন। আপনার ভালো থাকাও আমি চাইবোনা।”
রিয়ানা সাজ্জাদের কথার প্রতুত্তরে হাসলো শুধু। সাজ্জাদ নিরাশ হলো। ভেবেছিলো রিয়ানা রেগে কিছু বলবে হয়তো। সেটাও বললোনা। সে রিয়ানার দিকে শেষ বারের মতো তাকিয়ে বললো,
“আপনি অনুভূতি শূণ্য এক কাঠপুতুল রিয়ানা হোসাইন। আপনি মানুষের অনুভূতি বুঝেন না। একটা রিকুয়েষ্ট। আমি যাওয়ার আগে আপনি আর বাসায় ঢুকিয়েন না। কোনো এক ফ্রেন্ডের বাসায় নয়তো নাইট ক্লাবে আমি যাওয়ার আগ অব্দি সময়গুলো কাটিয়ে দিয়েন। আমি চলে গেলে ফিরবেন বাসায়। আমি চাচাকে মানিয়ে নিবো।”
“অনুভূতি বুঝলেই কষ্ট সাজ্জাদ ভাই। যেমন-টা আপনি পাচ্ছেন। গাড়ি থেকে নামুন। আমি চলে যাই!”
সাজ্জাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নামতেই গাড়ি-টা শা করে চলে গেলো। সাজ্জাদের বুক জুড়ে হাহাকার। ষোড়শী কন্যার মনে একাদোক্কা খেলতে নেমে সে হেরে গেলো। বাজে ভাবে হেরে গেলো। কিন্তু সেই ষোড়শী কন্যা আজীবন মনের কোণায় হয়তো থেকেই যাবে। যথারিতী সাজ্জদের কথামতো সাজ্জাদ যাওয়ার পরেই ফিরেছিলো রিয়ানা। সেদিন-ই ছিলো সাজ্জাদের সাথে জার্মানিতে শেষ দেখা। এরপর দেখা হয়েছিলো সাজ্জাদের বিয়ের দিন। তখন রিয়ানা সবে ১৮তে পা দিয়েছে। ক্লাস ইলেভেন কমপ্লিট। সামার ভ্যাকেশন শুরু হয়ে গেছে। সাজ্জাদ চলে আসার পর তার প্রতি-টা অনুপস্থিতি রিয়ানাকে অনুভব করিয়েছিলো সে দুর্বল হয়েছিলো সাজ্জাদের প্রতি। শুধু নিজের জেদের কাছে হার মানবেনা বলে স্বীকার করেনি। সেই দুর্বলতা ধীরে ধীরে রিয়ানা বড় হওয়ার সাথে সাথে ভালোবাসায় রুপ নিয়েছিলো। নিজের অনুভূতি গুলো বুঝতে শিখে, নিজেকে একটু সামলে বাংলাদেশের সমাজপ চলার মতো নিজেকে পরিবর্তন করে ভ্যাকেশন ছিলো, সেই ভ্যাকেশনে মুখোমুখি হতে চেয়েছিলো রিয়ানা। সেই চাওয়া তার সর্বনাশ ছিলো। যতদিনে সে বাংলাদেশে পা রাখলো! এসে দেখলো সাজ্জাদের বিয়ে। আর তার বাবা মূলত এই বিয়েকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে তাদের নিয়ে এসেছে। সেদিন রিয়ানা কূল হারিয়েছিলো। সাজ্জাদের বিয়ে ধুমধামে উপভোগ করে জার্মানিতে ফিরেছিলো। মনের কোঠায় বন্দী করে রেখেছিলো নিজের অনুভূতি।
আজ আবার সেই কূলের মুখোমুখি, যাকে সে হারিয়েছে। গ্রামের বাড়ির গেটের সামনে পা ফেলতেই সাজ্জাদের মুখো হলো রিয়ানা। তবে সাজ্জাদকে দেখে তার কোনো অনুভূতি অনুভব হলোনা। বুকের মধ্যিখান-টায় বিচ্ছেদের যন্ত্রণায়! না পাওয়ার হাহাকারে পুড়লো না। সে আয়াতের পাশে দাড়িয়ে তার হাত শক্ত করে ধরে নিচুস্বরে বললো,
“আমি তার প্রতি টান অনুভব করছিনা কেন আপা! তবে কি সত্যি আমি অনুভূতি শূণ্য পাষাণীতে পরিবর্তন হয়ে গেলাম?”
চলবে?