রঙধনু পর্ব-০১ (season 2)

0
3120

রঙধনু?
দ্বিতীয়বার
তৃধা মোহিনী(ছদ্মনাম)
পর্ব এক

?

অন্ধকার ঘরে একটা ফ্রেমকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে মোহ..ফ্রেমে থাকা মানুষগুলো তার মায়ের ছবি..তার বাবা মায়ের ছবিটা দেখে কত রাত জেগে কেদেছে মোহ হিসেব নেই..হ্যা হিসাব নাই কারন, তার মা এই দুনিয়া ছেড়ে অনেক আল্লাহর কাছে চলে গেছে..

মোহর ফ্যামিলি বলতে আছে তার বাবা,সৎ মা আর ভাই..বাবা আগে ভালোবাসা প্রকাশ করলেও এখন তা প্রকাশ করে না কারন,তার সৎ মা চায় না মোহর উপর কোন আলগা পিরিত দেখাক..মোহর মা মারা যায় দ্বিতীয়বার সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে..দ্বিতীয় সন্তান যখন মৃত জন্ম নেয় তার মুখ দেখার আগেই মৃত সন্তান নিয়ে ওপারে পারি জমায় তার না..মোহর মায়ের ইন্টারনাল ব্লিডিং হওয়ার কারনে তাকে বাচানো সম্ভব হয় নি,বাচ্চা জন্ম দেয়ার আগেই পেটেই মারা যায় সে।।

মোহর বয়স যখন চার তখন মা হারা সন্তান সে..বাবা নতুন বিয়ে করলো..চাচীরা ভালোবাসতো যখন তার মা বেচে ছিলো,মা মারা যাওয়ার পর সে অবহেলার পাত্রি হয়ে গেছে সে সবার কাছে..তার বাবা নতুন বিয়ে করলো,তার মা মারা যাওয়ার চল্লিশ দিন হয় নি তখন ও..নতুন মায়ের কাছে ভালোবাসা পাবার জন্য মোহ সারাক্ষণ ঘুরঘুর করলেও,কপালে মার ছাড়া অন্য কোন তার শরীরে জুটে নি..সৎ মায়ের বাচ্চা হয়েছে ১০ বছর পর কিন্তু যখন থেকে উনি এসেছেন মোহকে সব ঘরের কাজ করতে দিতো।।

মোহ আস্তে আস্তে যখন বড় হলো,সৎ মায়ের জেদ চাপলো মোহকে বাড়ি থেকে বিদায় করার জন্য..ক্লাস নাইনে যখন মোহ উঠলো,তার বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো তার দ্বিগুন বয়স্ক লোকের সাথে..বাবার পা ধরে বলেছিলো,অনেক আকুতি মিনুতি করেছিলো যেন বিয়েটা না দেয় কিন্তু লাভ হয় নি..তার সৎ মা বলেছিলো যদি সে বিয়ে দিতে বাধা দেয় বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে,নিজের ছেলেকে নিয়ে চলে যায়।।

ক্লাস নাইনে মোহর বিয়ে হয়ে গেলো একটা বয়স্ক লোকের সাথে..যখন শ্বশুরবাড়িতে গেলো তখন যেয়ে জানতে পারলো লোকের আগের স্ত্রী আছে সাথে আগের দুইটা বাচ্চা..মোহ ভেবেছিলো এই বুঝি তার কপাল খুললো কিন্তু যেখানে নিজে নিজেকে সে অপয়া ভাবে,কপালে কি করে সাথ দেয়।।

মোহর স্বামীর প্রথম স্ত্রী মোহকে দেখে আতকে উঠে,কাছে এসে এক থাপ্পড় মেরে দেয়..নিজের বাড়ির লোক ডেকে আনে..বিচায় বসায়,কিন্তু মোহর স্বামী প্রমান করে মোহ আর তার ফ্যামিলি তাকে লোভ দেখিয়ে ফাসিয়ে বিয়ে করেছে..মোহর সৎ মাকে অনেক টাকা দিয়েছিলো তিনি বিয়ের জন্য কিন্তু তা প্রকাশ করলো না বিচারের ভয়ে।।

অবশেষে মোহকে ডিভোর্স দিয়ে সমাজে চোখের কাছে আরো এক নতুন পদবীতে জড়িত করলো,”ডিভোর্সি “..অদ্ভুত তাই না??জীবন কত সহজে রঙ বদলায়!!

ডিভোর্স দিয়ে মোহকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো স্বামী নামক শ্বশুরবাড়ি থেকে।।

ছোট বয়সে মা হারালো,ছোট বয়সে ডিভোর্সি পদ পেলো..জীবন কত কিছু শেখায়।।

১৫বছরের মোহ হাসতে ভুলে গেছে,খেলতে ভুলে গেছ..জীবনটা উপভোগ করার আগে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।।

ডিভোর্স হয়ে যখন মোহ আসলো তখন তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে না তার সৎ মা জানিয়ে দেয়..কিন্তু তার সৎ ভাই তাকে অনেক ভালোবাসতো..ছোট হলেও সব বুঝে ফেলতো সে,মোহকে ঘরে ঢুকতে দিবে না বলে যখন বাধ সাধলো তার ছোট ভাই রিহান।।

“তুমি যদি আপুকে ঢুকতে না দাও,আমিও আপুর সাথে বাড়ি থেকে চলে যাবো” রিহান বলেছিলো।।

রিহানের বলার জন্য তার সৎ মা আসতে দিলেও সেদিন রাতে খুব মেরেছিলো তাকে চুলার লাকড়ি দিয়ে…ব্যাথাতে কাতুর হয়ে সারারাত মাকে ডেকেছিলো সে।।

দিন যায় মাস যায় বছরও গেলো..মোহ ১৫ থেকে ২১ বছরে পা দিলো..সে এখন বর্তমানে সুপারশপে ছোটখাটো জব করে..কারন,সংসারে তার ইনকাম না থাকলে কপালে তার ভাত জুটবে না।।

অপরুপ অপ্সরীর অধিকার হওয়ার জন্য মোহর সৎমা তাকে আরো দেখতে পারে না…মোহর সুন্দরী থাকার কারনে অনেক বিয়ে এসেও ভেঙে গেছে..ওই যে সমাজের দেয়া নাম ডিভোর্সি.. যতবার বিয়ে ভাঙে ততবার সৎমায়ের মারের শিকার হয় সে..কিন্তু দুইবার থেকে রিহান বাচায় বলে মার খেতে হয় না তাকে..বাবা তার ব্যাপারে এতোবেশি উদাসীন যে সবসময় তার সৎমায়ের কথাতে উঠে আর বসে।।

নিজের স্টাডির খরচটা শুধু নিজে নেয়..স্কলারশিপ পাওয়ার সুবাদে, ভার্সিটির ফি তাকে দেয়া লাগে না কিন্তু কোচিং করার জন্য ত টাকা লাগে..এইভাবে চলছে কায়নাত আফ্রার জীবন..আসবে কি কেও জীবনে তার নাকি এইভাবে ঘুটে ঘুটে মরতে হবে তাকে কে জানে।।

লন্ডন,

নামীদামী হোটেলে চকমকে বেডের উপরে শুয়ে আছে নগ্ন অবস্থায় একটা বিদেশি নারী..মেয়েদের সাথে রাত কাটানো,ড্রিংক্স করা নিয়মিত অভ্যাস লন্ডনের টপ ব্যাচেলর বিলিয়নিয়ার “ফাইজান ফারিশ ফাজ”

ব্রেকিং নিউজে কারো নাম থাকলেই এই সুদর্শন পুরুষ থাকবেই থাকবে..নাম,জশ,খ্যাতি অহংকার,রাগ আর এটিউটিউড রক্তে তার কুটে কুটে মিশে আছে..মেয়েরা এই ছয় ফিট দেহের নীল চোখ ওয়ালা ফর্সা সুদর্শন পুরুষকে দেখে রাস্তা হুমড়ি দেয়..আর উনি এইসব হুমড়ি খাওয়া মেয়ে দেখে পৈশাচিক হাসি দেয়..একে ত তার চেহারা দুই টাকা..এতো টাকা তার যে তার সাত পুরুষ বসে বসে খেতে পারবে..তার একটাই ধারনা,”মেয়েরা শুধু টাকা বুঝে”।।

হোটেল থেকে বের হয়ে আসে,আজ তার লন্ডনে শেষ রাত হয়তো কারন,তার মা বাংলাদেশ ব্যাক করার জন্য আদেশ দিয়েছেন..বাংলাদেশ ব্যাক করার ইচ্ছা তার মনে যদিও বিন্দুমাত্র নেয় তবুও মায়ের কসমে বাধ্য হয়ে যাচ্ছে এক প্রকার..কাল বিকালে তার ফ্লাইট।।

গাড়ির উপর বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোয়া ছাড়ছে ফারিশ..

“অন্ধকার কিংবা আলো আমি সবখানে সেরা..আমি রাজা..এই ফারিশ কাওকে ভালোবাসতে পারবে না কিন্তু ফারিশকে সবাই ভালোবাসবে..ভালোবাসা বলতে কিছুই নেই..আমি খারাপ সো হোয়াট??আমি খারাপের রাজা!!” এই বলে বাকা হাসি দিয়ে গাড়ি নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্য ছুটলো।।

আরেকদিক,

বারান্দার ব্যালকনিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মোহ..তার ধারনা,সবথেকে যে তারাটি বেশি জ্বল জ্বল করছে সেটাই তার মা।।

“আমি ভালো আছি মা” মোহ কথাটি বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।।

সকালবেলা,

সকালে সবার জন্য নাস্তা তৈরি করছে মোহ..ফজরের নামাজ পরে আর ঘুমায় না,যা কাজ বাকি থাকে তা করে ডিউটিতে যায়,ডিউটি শেষ করে হয় কলেজ যায় না হয় বাসাই ফিরে এসে কোচিং।।

আজো তাই নাস্তা বানিয়ে,নিজে অল্প খেয়ে ভাইকে নিয়ে বের হলো স্কুলের জন্য..স্কুল তার ৮টায় তাই তাকে দ্রুত স্কুলে ঢুকিয়ে দিলো,তার ভাই যাওয়ার আগ দিয়ে টুপ করে বোনের গালে চুমু খেয়ে ভিতরে চলে গেলো।।

মোহ হেটে সুপারশপে গেলো..সুপারশপে বিভিন্ন লোক আসে,কেও হয়তো বাজে ইঙ্গিত করে কেও বা বাজে প্রস্তাব ও দেয় কিন্তু কি আর করার চাকরী না করলে খেতে পাবে না সে..

সারাদিন কাজ সারতে কলেজ যেতে কোচিং সারতে মোহর আজ বাড়িতে যাওয়া হয় নি কিন্তু বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি তার ফিরতে দেরী হবে..

সন্ধ্যাবেলা,

দেরী হয়ে যাওয়ার কারনে মোহ রিস্ক নিলো না হেটে যাওয়ার,বাসে উঠে পরলো।।

এদিকে ফারিশ বাংলাদেশ এসেই আগে নিজের ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড ক্লাবে ড্রিংক্স করতে চলে গিয়েছে..সেখান থেকে বেরিয়ে নিজে গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে ফিরছে বাড়ির দিকে কারন এখন না ফিরলে তার মা তাকে আস্ত রাখবে না।।

একদিকে মোহ বাসে করে আসছে আরেকদিকে ফারিশ তার নিউ ব্র‍্যান্ড ব্ল্যাক কারে করে আসছে,দুইজন এক রাস্তাতে করে ফিরছে শুধু গন্তব্য বিপরীত..এর মধ্যে কই থেকে একটা বাইক এসে ব্রেক ফেইল করে ফেলেছে, মাঝখানে বাইক দুই পাশে বাস আর কার..সময়মতো তারা দুইজন না থামালে আজ অঘটন ঘটে যেতো।।

হুট করে ব্রেক করায় বাসের ঝাকিতে মোহ আতকে উঠে,এদিকে ফারিশ গাড়িতে বসে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে বাইকের উপর মানুষটার দিকে..বের হয়ে কিছু কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের গাড়ির কাচ দিয়ে দেখতে পেলো,বাসের জানালা দিয়ে একটা মেয়ে মুখ বের করে কি হয়েছে তা দেখছে..সাদা ওড়না মাথায় দেয়াতে নুরানি ভাবটা যেন উপচে পরছে।।

মেয়েটা আর কেও না,জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখছে মোহ যে বাইরে কি হচ্ছে।।

মোহকে দেখার সাথে সাথে ফারিশের সারা শরীর বেয়ে মনে কারেন্ট বয়ে গেলো..চোখদুটো স্থির,বুক ধকধক, মন অস্থির..বুকে হাত দিয়ে দেখলো কেমন ঢিপঢিপ আওয়াজ আসছে..

আবারো তাকাতে যাবে মোহ জানালার বাইরে মুখ রাখে নি ভিতরে চলে গিয়েছে,কিন্তু তার আগে বাস তার কারকে ক্রস করে চলে গেলো।।

ফারিশ বুকে হাত দিয়ে গাড়িতে ওইভাবে কিছুক্ষন বসে রইলো..নিজে নিজে বলে উঠলো,

“ইমপসিবল”

কথাটা বলে রাগে মাথার রগ ফুটিয়ে তুলেছে,জোরে স্পিড বাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো।।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে