যে প্রেম এসেছিল পর্ব-১১+১২

0
606

#যে_প্রেম_এসেছিল
#পর্ব১১+১২
#Raiha_Zubair_Ripte

-“ মা উনার তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। এই মধ্য রাতে ডক্টর পাবো কোথায়?
মনোয়ারা বেগম ইন্দুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ইন্দুর কথা কর্ণকুহর হতেই এগিয়ে এসে তুহিনের কপালে হাত রাখে। আসলেই ছেলেটার শরীরে অনেক জ্বর। এই মধ্যে রাতে ডক্টর পাওয়া সম্ভব নয়। বাহিরে যে বৃষ্টি হচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে কিচেনে ছুটলো। ছোট বাটিতে পানি আর একটা ছোট কাপড় এনে ইন্দুর সামনে ধরে বলে-

-“ আপাতত মাথায় জল পট্টি দাও। আমি কিচেনে যাচ্ছি স্যুপ বানিয়ে আনছি,ঘরে মেডিসিন আছে। সেটা খাইয়ে দিলে কিছুটা কমে যাবে।

ইন্দু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালে মনোয়ারা বেগম কিচেনে চলে যায়। ইন্দু কাপড় টা জলে ভিজিয়ে তুহিনের মাথায় দিতেই তুহিন কেঁপে উঠে। রুমে এনেই ইন্দু তার বাবার লুঙ্গি আর একটা টি-শার্ট তুহিন কে পড়তে দিয়েছিলো। তখন অবশ্য হুঁশে ছিলো কিন্তু এখন জ্বর তাকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলছে।

লোকটার এই অবস্থার জন্য অবশ্যই ইন্দু দায়ী। জলপট্টি দেওয়ার মাঝে হঠাৎ ইন্দু খেয়াল করলো তুহিন কিছু বলছে বিরবির করে। ঠিক মতো শোনা যাচ্ছে না। কথাগুলো স্পষ্ট শোনার জন্য তুহিনের মুখের কাছে তার কান এগিয়ে নিলো। সহসা তুহিন জড়িয়ে ধরলো ইন্দুকে। এই প্রথম কোনো ছেলের সংস্পর্শে গেলো ইন্দু। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে। তুহিন খুব শক্তপোক্ত ভাবেই জড়িয়ে ধরেছে। আর এমন ভাবে বেকায়দায় আছে ইন্দু যে নিজের শক্তি ও খাটাতে পারছে না। বারবার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মা আসছে কি না। তার মা তাকে এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে সেটা মনে হতেই এবার নিজের হাত পা ছুঁড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।

ইন্দু তুহিনের গালে হাত রেখে বলে-
-“ তুহিন শুনতে পারছেন?
তুহিন চোখ বন্ধ রেখেই কপাল কুঁচকে জানান দেয় সে শুনতে পারছে। ইন্দু তপ্ত শ্বাস ফেললো তার মানে লোকটা সজ্ঞানে আছে।
-“ একটু হাতটা ঢিলে করুন আমি উঠবো।
তুহিন হাত ঢিলে করলো না। আরো চেপে ধরলো যাতে ইন্দু কোনো মতেই যেতে না পরে।
-“ আরে কি হলো আমি হাত ঢিলে করতে বলছি আপনি আরো চেপে ধরলেন কেনো?

তুহিন এবার বিরক্ত বোধ করলো।
-“ এই ইন্দুপ্রভা এমন বিরক্ত কেনো করছো। ও আমার ইন্দুপ্রভা ওকে আমি জড়িয়ে ধরেছি তুমি ছেড়ে দিতে বলার কে?
-“ আশ্চর্য আপনি আমায় ধরে রেখেছেন আর আমি বলবো না? প্লিজ ছাড়েন,আপনি অসুস্থ মা আপনার জন্য স্যুপ বানাতে গেছে, চলে আসলো বলে। এখন যদি এই অবস্থায় আমাকে দেখে কি ভাববে বুঝতে পারছেন?
-“ না ছেড়ে দিলেই ইন্দুপ্রভা হারিয়ে যাবে। জানো ইন্দু না আমাকে ভালোবাসে না। আমি অনেক ভালোবাসি তাকে। তার কি উচিত নয় আমার ভালোবাসা গ্রহন করা?

তুহিনের এমন বাচ্চমো কথা শুনে নৈঃশব্দ্যে হেঁসে দিলো ইন্দু।
-“ আচ্ছা ছেড়ে দিন ইন্দু আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। আর সেও আপনাকে ভালোবাসে। তার উচিত আপনার ভালোবাসা গ্রহন করা।

কথাটা তুহিনের কান অব্দি গেলো কি না জানা নেই কিন্তু তুহিনের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো, সাথে সাথে হাতের বাঁধন হালকা হলো। ইন্দু হাফ ছাড়লো। আর একটু হলে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে ছাড়তো এই ছেলে।

মনোয়ারা বেগম স্যুপ এনে ইন্দুর সামনে রেখে বলে-

-“ খাইয়ে দাও একটু আমি মেডিসিন আনছি।

ইন্দু একবার তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ মা ও তো শুয়ে আছে খাওয়াবো কিভাবে?
-“ ডেকে উঠাও।

মনোয়ারা বেগম চলে যেতেই ইন্দু আবার তুহিনের গালে হাত দিয়ে বলে-
-“ তুহিন একটু কষ্ট করে উঠুন না। কিছু খেয়ে মেডিসিন খেতে হবে।

তুহিনের কানে গেলো না কথাটা। ইন্দু আলতো করে তুহিনের গালে থাপ্পড় দেয়। তুহিন নড়েচড়ে উঠে। ইন্দু তুহিনের মাথার নিচ থেকে বালিশ টা নিয়ে খাটে সাথে হেলান দিয়ে রেখে বলে-
-“ একটু উঠে বসুন।

তুহিন পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। ইন্দু স্মিত হেসে বলে-
-“ কি হলো উঠুন খেতে হবে তো নাকি।

তুহিন পাশে তাকিয়ে দেখে স্যুপের বাটি। নাকমুখ কুঁচকে ফেলে।
-“ নাকমুখ কুঁচকে লাভ নেই খেতে হবে এটা।

তুহিন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে-
-“ খাবো না আমি আপনি খান।
-“ আমার আপনার মতো পঁচা শরীর না যে বৃষ্টি তে ভিজলাম আর জ্বরে বাঁধিয়ে ফেললাম। জ্বর হেহে আপনার এসেছে সেহেতু আপনারই খেতে হবে।
-“ বললাম তো খাবো না আমি।
-“ আমি আপনার না হ্যাঁ শুনতে চাই নি। আমি বলেছি খেতে হবে। উঠুন না হলে এই গরম স্যুপ শরীরে ঢেলে দিবো।
-“ হ্যাঁ পারেন তো সেটাই, কাটা গায়ে ক্ষত দিতে। কখনও তো মলম দিতে দেখলাম না।
-“ হ্যাঁ আমি মলম দিতে জানি না,আপনি কেনো ক্ষত নিতে আসেন।
-“ ক্ষত টা অমৃত মনে হয় তাই নিতে আসি বারংবার।
– “ তাহলে মলম পাওয়ার বৃথা আশা কেনো করেন?
– “ মাঝে মাঝে আশা করে ফেলি যদি ম্যাডামের মায়া দয়া হয় এই অধমের উপর।
– “ হবে না সারাজীবন ক্ষতই দিয়ে আসবে।

তুহিন অবাক হয়ে বলে-
-“ সারা জীবন!
ইন্দু স্যুপ খাইয়ে দিতে দিতে বলে-
-“ হ্যাঁ সারাজীবন যতদিন বেঁচে আছি ক্ষতই দিবো শুধু। আপনার ক্ষত পাওয়ার খুব ইচ্ছে না শখ মিটিয়ে দিবো।
তুহিন স্যুপ মুখে নিয়ে হাসি মুখে বলে-
-“ আমি অমৃত ভেবে সব সইয়ে নিবো।
-“ সইতে না পারলে খবর আছে তখন।
-“ ইন্দু পাশে থেকে যেই ক্ষত দিবে তা নির্দ্বিধায় আপন করে নিবে তুহিন।

কথার তালে তালে ইন্দু তুহিন কে স্যুপ খাইয়ে দেয়। মনোয়ারা বেগম মেডিসিন এনে ইন্দুর হাতে দিয়ে তুহিনের উদ্দেশ্যে বলে-

-“ ভালোবাসা ভালো কিন্তু অতিরিক্ত ভালোবাসা ভালো না। যেই ভালোবাসা তোমায় কষ্ট দেয় সেই ভালোবাস পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠো কেনো?

তুহিন ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ কি করবো আন্টি বলেন,কিছু মানুষের মন তো পাথরের মতো শক্ত, গলতে সময় লাগে। সেই সময়ের আগেই যদি ছেড়ে দেই তাহলে পাবো কি করে।

মনোয়ারা বেগম আর কিছু বললো না চোখের ইশারায় মেয়েকে নিজের রুমে যেতে বলে চলে গেলো। ইন্দু মেডিসিন টা তুহিন কে খাইয়ে দিয়ে বলে-
-“ এবার ঘুমান সকাল হতে হতে জ্বর চলে যাবে।

কথাটা বলে ইন্দু কাঁথা টা তুহিনের শরীরে দিয়ে দরজা চাপিয়ে চলে যায় মায়ের রুমে। মনোয়ারা বেগম বিছানায় বসে অপেক্ষা করছিলো ইন্দুর। ইন্দু আসতেই মনোয়ারা বেগম চোখের ইশারায় পাশে বসতে বলেন। ইন্দু বসে,মনোয়ারা বেগম কথাকে পেঁচিয়ে না বলে সোজা বলে উঠে-

-“ তুমি কি এখনও তুহিন কে ফিরিয়ে দিবে? দেখো ইন্দু নিজেকে তুচ্ছ ভেবো না। তুহিন যদি তোমার সব মেনে ভালোবাসতে পারে তুমি কেনো পারছো না? আমি মা হিসেবে সাজেস্ট করবো তুহিনের থেকে বেটার কাউকে পাবে না লাইফে।

ইন্দুর দৃষ্টি মেঝেতে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে-
-“ তুমি ঠিকই বলেছো মা,তুহিন কে ছাড়া অসম্ভব। তার ভালোবাসার কাছে আমি মাথা নত। তার মতো আমিও হয়তো তাকে এতো ভালোবাসি নি।
মনোয়ারা বেগম ইন্দুর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলে-
-“ তারমানে তুহিন কে ভালোবাসো?
-“ না বেসে কি উপায় আছে বলো? যেভাবে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মাথা খেয়ে ফেলতো,প্রতিদিন বাসা টু স্কুল অব্দি পেছন পেছন যেতো,না চাইতেও বেসে ফেলেছি ভালো।
-“ ছেলেটাকে আর কষ্ট দিয়ো না বলে দিয়ো নিকের মনের কথা।
-“ কিন্তু মা তুহিনের আম্মু তো আমায় মেনে নিবে না।
-“ চিন্তা করো না। দুজনে মিলে ঠিক মানিয়ে নিবে তাকে। মা তো রেগে বেশিদিন থাকতেই পারবে না।
-“আন্টি যতোদিন রাজি হবে না ততদিন আমি বিয়ে করবো না তুহিন কে।
-“ আচ্ছা বেশ,তবে তুহিন কে কষ্ট দিয়ো না। ছেলেটা তোমার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে,এখন তুমিও যদি তাকে না বুঝো তাহলে কে বুঝবে তাকে?
-“ রাত তো অনেক হলো,ঘুমানো উচিত এখন।

মনোয়ারা বেগম হুম বলে মা মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

সকাল সকাল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে তুহিন। মাথা টা ব্যাথা করছে। কাল রাতের সব কথাই তার মনে আছে। ইন্দু কফি হাতে করে রুমে প্রবেশ করে।
কফি টা তুহিনের সামনে ধরে বলে-
-“ কফি টা খেয়ে নিন মাথা ব্যাথা টা কমে যাবে।

তুহিন কফির মগ টা হাতে নিয়ে মুখে চুমুক দিতেই ইন্দু বলে উঠে-
-“ কিছু কথা বলার ছিলো।
-“ হু বলো শুনছি।
-“ আপনার মা তো আমাকে মেনে নিবে না।
-“ হ্যাঁ জানি,তবে একদিন ঠিক মেনে নিবে।
-“ কিন্তু আমি আপনার মায়ের দোয়া না নিয়ে বিয়ে করতে পারবো না।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই মুখ থেকে কফি ছিটকে পড়ে যায় তুহিনের। বিষম খায়। ইন্দু তুহিনের মাথায় আস্তে করে থাপ্পড় দিয়ে বলে-
-“ আস্তে খাবেন তো।
তুহিন অবক হয়ে বলে-
-“ তুমি আমায় বিয়ে করতে রাজি!
-“ যদি আপনার মা কে রাজি করাতে পারেন তবেই আমি রাজি।

মুহূর্তে তুহিনের মুখ চুপসে গেলো। একে ওকে রাজি করাতে করাতেই তো যৌবন অর্ধের বেশি পেড়িয়ে গেলো। তুহিন কে চুপ থাকতে দেখে ইন্দু বলে উঠল-
-“ কি হলো পারবেন না রাজি করাতে?
-“ পারতে হবে,আমি মা কে রাজি করাবো।
-“ আচ্ছা তাহলে আমার আপত্তি নেই।
-“ আচ্ছা হঠাৎ করে তোমার সুবুদ্ধি উদয় হলো কোথা থেকে?
-“ মানে?
-“ না মানে এই যে রাজি হয়ে গেলে বিয়ে করতে?
-“ তার মানে রাজি না হওয়াই ভালো ছিলো? আচ্ছা বেশ আপনাকে আমি বিয়ে করবো না।
-“ এই না না না আমি ওভাবে বলি নি। প্লিজ মত পাল্টিয়ো না।
-“ আচ্ছা শুনুন ফ্রেশ হয়ে নিন। হসপিটালে যাবেন না?
-“ হ্যাঁ যাবো।
-“ বাসায় যাবেন কবে?
-“ উমম কয়েকদিন পর যাবো আপাতত আমার ফ্লাটে গিয়ে উঠবো।

ইন্দু কতক্ষণ চুপ থেকে বলে-
-“ আচ্ছা তাহলে উঠুন এক সাথে বের হই। আর আপনার জামাকাপড় ভেজা। ঐ যে প্যাকেটে আপনার জন্য টিশার্ট আর প্যান্ট আছে ওগুলো পড়ে রেডি হবেন।

তুহিন প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বলে-
-“ এগুলো কই পেলে?
-“ মার্কেট থেকে এনেছি।
-“ বাহ বিয়ের আগেই আমাকে শপিং করে দিচ্ছো!
-“ বাজে কথা না বলে রেডি হয়ে আসুন।
-“ হ্যাঁ আসছি।

_________________________

-“ হ্যালো মা।
-“ ফোন দিয়েছিস কেনো?

তুহিন ভেবেছিল তার মা হয়তো জিজ্ঞেস করবে কেমন আছিস কিন্তু উল্টো এটা বলবে ভাবতে পারে নি। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল-
-“ কেমন আছো?
-“ সেটা তোর না জানলেও হবে।
-“ এখনও এভাবে কথা বলবে? ইন্দুকে মেনে নিলে কি এমন ক্ষতি হবে?
-“ আমি বলেছি তো ওকে মানবে না। বারবার ফোন দিয়ে এ কথা কেনো বলিস।
-“ বাই এনি চান্স ধরো আমি ম/রে গেলাম তখন তোমার এই সমাজ স্ট্যাটাস কি তোমায় দেখে রাখবে?
-“ চড়িয়ে গাল লাল করে দিবো।
-“ ইন্দুকে মেনে নাও। মেয়েটা তোমার দোয়া ছাড়া আমাকে বিয়ে করবে না।
-“ না মানবো না ফোন রাখ।

তনয়া বেগম ফোন কেটে দেয়। আজ তিন দিন হলো তুহিন তনয়া বেগম কে রাজি করানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তিনি তার কথার হেরফের করছেন না। নিজের মাথার চুল এখন নিজেরই টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। নিজেকে আয়নায় একবার দেখে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো। তার মা রাজি হবে না বুঝে গেছে তুহিন। এখন ইন্দুকেও সেটা বুঝতে হবে। ইন্দুর স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তুহিন। স্কুল ছুটির শেষে ইন্দু স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে সামনে তুহিন কে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠে। এগিয়ে যায় তুহিনের দিকে।

তুহিন ইন্দুর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে-
-“ আজকাল কার মানুষ গুলো কেমন জানো?

ইন্দু তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ কেমন?
-“ এই যে তারা হাজার টাকা হারিয়ে গেলে একশো বছর পর ও আফসোস করবে কিন্তু একটা মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে গেলে আফসোস করবে না। সময়ের সাথে সাথে ভুলে যাবে। তুমিও কি তাদের দলের মাঝে?
-” চুপ করেন তো। শুধু বাজে কথা বলেন।
তুহিন বেশখানিকটা সময় চুপ থেকে আবার বলে-
-“ ইন্দু শুনো।
-“ হু শোনান শুনছি।
-“ মা রাজি হচ্ছে না।

সহা ইন্দুর পা থেমে গেলো।
-“ ছেড়ে চলে যাবেন আমায়?
তুহিন ইন্দুর গালে হাত দিয়ে বলে-
-“ না চলো বিয়ে করি। মায়ের মানতে সময় লাগবে কিন্তু ঠিক মেনে নিবে।
-“ কিন্তু…
-“ কোনো কিন্তু নয়। আমি কালই তোমায় বিয়ে করবো আর আন্টি তো আছেই।
-“ মায়ের সাথে কথা বলবেন না?
-“ আমি আসার আগে আন্টিকে বলে দিছি। আমরা এখন শপিং করতে যাবো। কাল কোর্টে গিয়ে বিয়ে করবো।
-“ ভুল করছি না আমরা?
-“ এখানে ভুল কোথায় করলাম?
-“ আচ্ছা চলুন।

ইন্দু আর তুহিন শপিং মলের সামনে এসে ইন্দুর জন্য একটা লাল টকটকে বেনারসি আর নিজের জন্য একটা সাদা পাঞ্জাবি কিনে নিলো। খুবই সিম্পল ভাবে বিয়ে করবে সে। সাথে টুকটাক জুয়েলারি কিনে চলে আসলো।
ইন্দুকে তার বাসায় দিয়ে ইন্দুর মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলে চলে গেলো।

ইন্দুর মা মনোয়ারা বেগম খুব খুশি,কাল মেয়ের বিয়ে,তুহিন আগে থেকেই বলে রেখেছিল। তার ছোট্ট মেয়েটার কাল বিয়ে হয়ে যাবে। বাসা টা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। কথাটা ভেবে একটু খারাপ লাগলেও সেটা কে গাহ্য করলো না। বেনারসি শাড়ি টা মেয়ের মেয়ের শরীরে মেলে ধরলেন। ইন্দু লজ্জা পেলো। ইলিয়াস মা আর বোনের কার্যকলাপ দেখছে। ছোট্ট মন এইটুকু বুঝলো কাল তার বোনের বিয়ে। ইন্দু দের তেমন আত্নীয় স্বজন নেই বললেই চলে। বাবা মারা যাওয়ার কর সবার থেকে দুরত্ব বেড়েছে। নিজের এলাকা ছেড়ে এখানে এসে থেকেছে। যা আয়োজন করার তাকে একা হাতেই করতে হবে।

এরমধ্যে হঠাৎ ফোন বেজে উঠে ইন্দুর। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে স্মৃতি ফোন দিয়েছে। রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে স্মৃতি উৎফুল্ল নিয়ে বললো-
-“ কংগ্রেস ইন্দু শাদি মোবারক হো। অবশেষে বিয়ে করতে রাজি হলি। তুহিন ভাইয়া না বললে মনে হয় বলতি না তুই যে কাল বিয়ে করতে যাচ্ছিস।
-“ আমি নিজেও জানতাম না। স্কুল থেকে ফেরার পরই তুহিন বলেছে। আমি তোকে ফোন করে বলতামই।
-“ হয়েছে থাক শাক দিয়ে মাছ ঢাকা লাগবে না।
-“ কাল তাড়াতাড়ি আসবি।
-“ তোর বলার অপেক্ষায় কে আছে৷ রাত এখন বেশি না হলে আমি এখনই ছুটে চলে আসতাম।
-“ পাগলি মেয়ে।
-“ হ্যাঁ রাখি কাল সক্কাল সক্কাল চলে আসবো।

—————-
-“ কি রে তুই আন্টির অনুমতি না নিয়েই বিয়ের করতে যাচ্ছিস!

হঠাৎ সাগর আর নীলা কে নিজের কেবিনে দেখে ভ্রুকুটি করে ফেলে তুহিন। ফাইল টা সাইডে রেখে বলে-
-“ কে বললো অনুমতি নেই নি? আমি বলেছি কিন্তু মা রাজি হয় নি তাই একাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
-“ দেখছিস সাগর মেয়েটা কি রকম ব্রেণ ওয়াশ করেছে তুহিনের।
-“ জাস্ট শাট-আপ ও কেনো আমার ব্রেণ ওয়াশ করাবে।

তুহিনের ধমক শুনে সাগর বলে-
-“ আস্তে কথা বল। বিয়ে করছিস ভালো কথা, আন্টি কিন্তু বিষয় টা ভালো ভাবে নিচ্ছে না৷ এমনি ইন্দুকে সহ্য করতে পারছে না তার উপর এভাবে বিয়ে করলে আরো রেগে যাবে।
-“ প্যারা নিস না,বিয়ের পর আমি আর ইন্দু মায়ের সব রাগ ভেঙে দিবো।
-“ যা ভালো বুঝিস। তা কাল কখন যেতে হবে সাক্ষী হিসেবে?
-“ দুপুরের দিকে।
-“ বিয়ে করতে যাচ্ছিস ট্রিট তো পাই আমরা।
-“ হ্যাঁ দিবো বিয়ের পর এক বেলা বউয়ের হাতে রান্না খেতে দিবো।

___________

-“ এবার কি করবেন ভাবি? তুহিন তো ইন্দুকে কাল বিয়ে করবে। আপনি কি পারতেন না মেয়েটাকে মেনে নিতে? ছেলের সুখের জন্য তো বাবা মা কত কিছু করে।
-“ জেনেশুনে কি করে মেনে নিবো ইন্দুকে তুমিই বলো নিমির মা।
-“ মেয়েটা তো আগে থেকেই বলে দিলো,সে চাইলেই তো বিষয় টা লুকিয়ে রাখতে পারতো কই রাখছে নাকি আপনিই বলেন। সে তো তুহিন কেউ বুঝালো আপনার ছেলে তো বুঝলো না। আপনি ইচ্ছে করে আপনার আর ছেলের মাঝে দুরত্ব ক্রিয়েট করছেন।
-“ আমি কি করবো তাহলে?
-“ ইন্দুকে মেনে নিন। বয়স হচ্ছে আপনার। শেষ বয়সে কি ছেলের সাথে এমন করলে চলে বলেন? আল্লাহ না করুক অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়লে আপনাকে কে টানবে? আপনার স্ট্যাটাস সমাজ তো ঘুরেও তাকাবে না। আমি না হয় দু এক দিন করবো তারপর তো আমি নিজেও অতিষ্ঠ হবো। শেষ পর্যন্ত আপনার কিন্তু আপনার ছেলেকেই লাগবে।
-“ আচ্ছা তুমি তোমার বাসায় যাও একা থাকতে দাও আমায়। ভালো লাগছে না।

নিমির মা চলে আসে বাসা থেকে। ভালোই বুঝ দিয়েছে,কাজ হবে এতে।

_________

হঠাৎ মাঝরাতে ফোন বেজে উঠায় কিছু টা অবাক হয় তুহিন। কতক্ষণ আগেই ইন্দুর সাথে কথা বলেছে সে। এখন আবার কার ফোন। ফোন টা চোখের সামনে আনতেই দেখে তার মায়ের ফোন। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে ভেসে আসে-

-“ বিয়ে করছিস ভালো কথা। আমার পুত্র বঁধু কে জেনো আমি আমার বাসায় দেখি।
কথাটা সত্যি শুনলো নাকি তুহিন সেজন্য হাতে একটা চিমটি কাটে। না সত্যি শুনেছে।
-“ সত্যি বলতেছো?
-“ না মিথ্যা বলছি।
-“ জানি আমার মা মিথ্যা বলে না। আচ্ছা তোমাদের মেয়েদের মন এমন কেনো মা?
-“ কেমন?
-“ এই যে হুটহাট কখন মন বদলে ফেলো বুঝাই যায় না।
-“ বিয়ে করতেছিস কাল বিয়ের পর বুঝতে পারবি।
-“ হ্যাঁ তা ঠিক। একটা কথা বলি মা।
-“ কি?
-“ পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে সুখী মানুষ টা কে এখন জানো?
-“ কে?
-“ তোমার ছেলে তুহিন। আল্লাহ হঠাৎ করে জীবন টা পাল্টে দিলো। কয়েক দিনের ব্যাবধানে জীবনের সব ইচ্ছে গুলো একএক করে পূরণ করে দিচ্ছে। এটা মিরাক্কেল না বলো?
-“ মন থেকে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তিনি কখনই খালি হাতে ফিরায় না। কাল বিয়ে এখন ঘুমা,বিয়ের শেষে এক মুহূর্ত দেড়ি না করে ইন্দুকে এ বাড়ি নিয়ে আসবি।
-“ খুব শীগ্রই দেখা হচ্ছে মা। ইন্দুকে নিয়ে ফিরছি কাল তোমার কাছে। ভালোবাসি মা।
-“ পাগল ছেলে।

উদাস মুখে বসে আছে ইন্দু, একটু পর বিয়ে করতে যাবে,অথচ কেমন যেনো লাগছে। ইন্দুর মা ইন্দুকে পর্যবেক্ষণ করে বলে-
-“ কি হলো এভাবে বসে আছিস কেনো?
ইন্দু নড়েচড়ে বসলো।
-“ মা আমার কেমন যেনো লাগছে। তুহিনের মা রাজি না বিয়েতে। তার অমতে বিয়ে মন সায় দিচ্ছে না।
মনেয়ারা বেগম হাসে মনে মনে। ইন্দুকে তুহিন বলতে নিষেধ করেছে যে তার মা রাজি হয়েছে। সারপ্রাইজ দিবে। মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে-
-“ চিন্তা করো না সব ভালোই হবে। রেডি হয়ে নাও যেতে হবে তো।

ইন্দু মাথা নাড়িয়ে রেডি হয়ে নেয়। স্মৃতি হেল্প করলো সাজাতে। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে বধূ বেসে নিজে কে দেখে অজানা এক শীতল ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো শরীর বেয়ে। কখনও ভাবে নি এভাবে বউ সাজবে সে তুহিনের জন্য। তুহিন কে ইন্দু কখনও পাঞ্জাবি পড়া অবস্থায় দেখে নি। আচ্ছা কেমন লাগবে তুহিন কে পাঞ্জাবি পড়া অবস্থায়। নিশ্চয়ই সুদর্শন লাগবে। কথাগুলো ভেবে আনমনে হেসে ফেলে ইন্দু। স্মৃতি ইন্দুর অকারণে হাসি দেখে বলে-
-“ বিয়ের আগেই এমন হাসি, বিয়ের পর কিভাবে হাসবি তাহলে। চল বের হতে হবে।
ইন্দু হ্যাঁ বলে হাতে ফোন টা নিয়ে তুহিন কে মেসেজ দেয়। কাল রাতে বলে দিয়েছিল তার জন্য এক গুচ্ছ কাঠ গোলাপ আনতে। সেটা যেনো ঠিক মনে করে আনে সেজন্য মেসেজ দেয়। মেসেজ টা দিয়ে স্মৃতি ইন্দু মনোয়ারা বেগম আর ইলিয়াস বেরিয়ে যায়।

উকিলের চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। তুহিনের আসার নাম নেই। মিনিট বিশেক পর তুহিন ও তার ফ্রেন্ড রা আসে। ছেললটাকে কল্পমায় ভাবার থেকে বেশি সুদর্শন লাগছে। তুহিন ইন্দুর মায়ের কাছে গিয়ে কুশলাদি করে তাদের ভেতরে যেতে বলে। সবাই ভেতরে গেলে তুহিন ইন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে একপলকে তাকিয়ে থাকে ইন্দুর দিকে। মেয়েটার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেরে গেছে শাড়ি তে। কথাতেই আছে শাড়িতে নারী।
-“ সরি ইন্দু দেড়ি করার জন্য। আসলে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম দেখা করতে।

ইন্দু মাথা তুলে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ কি বললো আন্টি?
-“ বলে দিয়েছে তার ছেলের বউকে যেনো সোজা তার বাসায় নিয়ে যাই।
-“ সত্যি!
-“ হ্যাঁ সত্যি।
-“ আমার ফুল?

তুহিন একদম ভুলে গেছে ফুল আনতে। এই প্রথম তার ইন্দু একটা জিনিস চাইলে আর সে ভুলে গেলো। ভুলো মনটাকে ইচ্ছে মতে চড়াতে ইচ্ছে করলো তুহিনের। আশেপাশে তাকালো রাস্তার ওপাশে কয়েকটা ফুলের দোকান আছে। কিন্তু কাঠ গোলাপের দেখা পেলো না।
-“ ইন্দু কাঠ গোলাপ তো নেই। সাদা গোলাপে কি চলবে?
-“ হ্যাঁ চলবে।
-“ আচ্ছা তাহলে দাঁড়াও আমি এই যাবো আর আসবো তোমার ফুল নিয়ে।
-“ তাড়াতাড়ি আসবেন।
-“ হু।
কথাটা বলে তুহিন রাস্তার ওপাশে যায়। এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ নিয়ে টাকা দেয় দোকানদার কে। এর মধ্যে এক পিচ্চি এসে বলে-
-“ ভাইয়া আমার ফুল গুলান নেন। বেশি দাম না মাত্র পঞ্চাশ টাকা।

তুহিন দেখলো ছেলেটার কাছে পাঁচটার মতন লাল গোলাপ। কিছু একটা ভেবে ফুল গুলো নিয়ে দুইশত টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলে-
-“ বাকি টাকা লাগবে না তোমার কাছে রেখে দাও। আমার আর তোমার ঐ যে আপুটর(রাস্তার ওপর পাশে থাকা ইন্দুকে দেখিয়ে বলে) জন্য দোয়া করবে। আজ আমাদের বিয়ে।
ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। ইন্দু দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হলো। রোডের এপাশ থেকে হাত নাড়িয়ে বলে- আর কতক্ষণ।

তুহিন ফুল দেখিয়ে বলে- হয়ে গেছে আসছি আমি।

ইন্দু পাশে থাকা একটা গাছের নিচে বসার জায়গা দেখে সেদিকটায় যায় বসার জন্য। পেছন ঘুরে গাছের কাছটায় যেতেই এক শব্দ শুনতে পেয়ে পেছন ঘুরে। তুহিনের কন্ঠ ইন্দু বলে চিৎকার করলো। কিন্তু পেছনে ঘুরে এমন কিছু দেখবে তা কখনও কল্পনা করতে পারে নি ইন্দু। হাত পা কাঁপছে নিশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। নড়ার শক্ত পাচ্ছে না। চোখের সামনে দৃশ্য টা বারবার ভাসছে। লোকজন জড়ো হচ্ছে। হঠাৎ কারো ধাক্কায় হুঁশ ফিরে ইন্দুর। তুহিন বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। মাঝ রাস্তায় পড়ে আছে র’ক্তাক্ত এক নিথর দেহ। যার চোখ জোড়া তাকিয়ে আছে ইন্দুর পানে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে