#যে_প্রেম_এসেছিল
#পর্ব৮
#Raiha_Zubair_Ripte
চারদিকে আঁধার নেমে এসেছে। শীতকাল পাঁচ টা বাজতে না বাজতেই চারদিকে আঁধার ঘুনিয়ে আসে। মসজিদের মাইক থেকে আজান ভেসে আসছে। খোলা উদ্যান মাঠটায় বসে থাকতে থাকতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে বুঝতে পারে নি ইন্দু। কাঁধের ব্যাগ টা ভালো করে কাঁধে নিয়ে বাড়ির মুখে হাঁটা ধরলো।
হাঁটতে গিয়ে বুঝলো তার পা আর চলছে না,ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ছে। হাঁটার শক্তি পাচ্ছে না। কোনো রকমে থেমে থেমে বাসা অব্দি চলে হেঁটে আসলো। সদর দরজায় আসতেই দেখে মনোয়ারা বেগম ইন্দু কে দেখা মাত্রই ছুটে চলে আসে। মেয়ের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বুকটা মুচড়ে উঠল। তাহলে কি সে ভুল ছিলো। চোখ ফুলে গেছে, দেখেই বুঝা গেছে অনেক্ক্ষণ কেঁদেছে মেয়েটা।
মনোয়ারা বেগম জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে। বেশকিছুক্ষণ জড়িয়ে ছেড়ে দিয়ে মেয়ের মুখ দু হাতের মধ্যে নিয়ে বলে-
-“ এমন বিধ্বস্ত লাগছে কেনো? তুহিন ফিরিয়ে দিয়েছে?
ইন্দু মুখ থেকে তার মায়ের হাত সরিয়ে বলে-
-“ কোন ছেলে এমন মেয়েকে এক্সসেপ্ট করে?
কথাটা বলে মনোয়ারা বেগম কে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের রুমে চলে যায় ইন্দু। মেয়েকে একা থাকতে দেওয়া শ্রেয় বলে আর আটকায় নি মনোয়ারা বেগম।
ইন্দু রুমে এসে ব্যাগটা টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে। ক্ষনে ক্ষনে কান্না গুলো উপচে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। না এবার আর কাঁদল না ইন্দু। যথাসম্ভব নিজেকে আটকালো। ঘন্টাখানেক পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথা ধরছে খুব না ঘুমালে যন্ত্রণা গুলো তাড়া করে বেড়াবে। মনোয়ার বেগম রাতে দিকে মেয়ের রুমে আসেন খেতে ডাকার জন্য কিন্তু ইন্দু না করে দেয় তার খেতে ইচ্ছে করছে না।
মনোয়ারা বেগম তপ্ত শ্বাস ফেলে। মেয়েটার জীবনে সুখেরা ধরা দিবে কবে জানা নেই। তুহিনের চোখে অসীম ভালোবাসা দেখেছিলো ইন্দুর জন্য, সেগুলো মিথ্যা হয়ে গেলো সব তাহলে!
-“ মে আই কাম ইন স্যার?
ডক্টর সুমন নিজের কেবিনে বসে ছিলো। হঠাৎ তুহিন কে দেখে বলে-
-“ হ্যাঁ আসো ভেতরে।
তুহিন ভেতরে আসলো। সুমন চোখের ইশারায় চেয়ারে আসতে বললো
-“ স্যার একটা জরুরি কথা বলার ছিলো।
-“ হ্যাঁ বলো তুহিন।
-“ আচ্ছা স্যার যাদের শারীরিক গঠন মেয়েদের মতো সব কিছু সেম মেয়ে কিন্তু তার পিরিয়ড নামক জিনিস টা হয় না। এক্ষেত্রে কি কোনো সলিউশন আছে?
সুমন ভ্রুকুটি করলো। হাতে থাকা কলম টা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো-
-“ ব্যাপার টা কি বলো তো?
-“ আসলে স্যার ব্যাপার টা হলো একটা মেয়ে বয়স যার বয়স চব্বিশ কিন্তু এখনো পিরিয়ড হয় নি।
-“ সে কি ডক্টর দেখানো উচিত ছিল তো।
-“ আমার মাথা কাজ করছিলো না তখন তাই ভ ক্রমে জিজ্ঞেস করতে পারি নি।
-“ আমার মনে হয় না মেয়েটা কোনো চেষ্টা বাকি রেখেছে। এই পিরিয়ড টা মূলত ১২-১৩ বছর থেকে শুরু হয়। তখন যদি না হয় তখন ডক্টর দেখাতে হয়। সেখানে মেয়েটার বয়স চব্বিশ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই কোনো পথ নেই এখন আর।
-“ এটার কোনো চিকিৎসা নেই?
-“ আগে মেয়েটার থেকে সব বিস্তারিত জেনে আমাকে জানাও সলিউশন থাকলে অবশ্যই বলবো। এই পিরিয়ড প্রসেস টা সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার দান। এমন যদি হতো যে দু একবার হয়েছে দ্যান আর হয় নি তাহলে না হয় সলিউশন বের করা যেত। কিন্তু তার তো একবারের জন্য ও হয় নি।
-“ ঠিক আছে স্যার আমি আসি তাহলে।
তুহিন কেবিন থেকে বের হয় যেটুকু আশার আলো ছিলো এখন সেটাও নিভু নিভু। মেয়েটা এতো দিন নিজেকে কিভাবে সামলিয়ে এসেছে ভাবতেই তুহিনের বুক টা দুমড়ে মুচড়ে উঠল।
এই একটা কারনে মেয়েটা তাকে এভয়ড করলো। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এক নির্জন রাস্তায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো তুহিন। সে কোনো মতেই ইন্দুকে ছাড়তে পারবে না। সে তো ইন্দুকে ভালোবেসেছে মাঝ পথে ছেড়ে দেওয়ার জন্য না। কোনো একটা রাস্তা তার নিজেরই বের করতে হবে।
কথাগুলো ভেবে বসা থেকে উঠে বাসার দিকে হাঁটা ধরলো।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে মায়ের রুমে গেলো। তুহিনের মা বালিশে কাভার লাগাচ্ছিল। তুহিন পেছন থেকে মা কে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ ছেলে কে জড়িয়ে ধরতে দেখে কিছু টা অবাক হয় তনয়া বেগম। ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে-
-“ হঠাৎ আজ মা কে জড়িয়ে ধরলি।
তুহিন মাথা উঁচু না করেই বলে-
-“ কেনো আমি কি জড়িয়ে ধরতে পারি না?
-“ অবশ্যই পারিস। মন খারাপ?
-“ না। একটা সলিউশন খুঁজছি।
-“ কিসের সলিউশন?
তুহিন তার মাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসলো। চোখের ইশারায় তার মাকেও বসতে বললো। তনয়া বেগম বসে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো।
তুহিন তার মায়ের হাত টা ধরে বলে-
-“ আচ্ছা মা একটা মেয়ের যদি পিরিয়ড না হয় তার কি সংসার করা বারন?
তনয়া বেগম অনেকটা অবাক হন ছেলের কথা শুনে। তার ছেলে কখনও এসব কথা বলে না। ছেলের দিকে পলকহীন ভাবে চেয়ে বলে-
-“ হঠাৎ এ কথা কেনো বলছিস?
-“ আচ্ছা তুমি তো মা তাই না,তোমার কি মনে হয় পিরিয়ড না হওয়ার পেছনে কি একটা মেয়ের হাত থাকে?
-“ অবশ্যই না। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর দান।
-“ তাহলে কি একটা মেয়ের বয়স চব্বিশ হওয়ার পর ও যদি এটা না হয় তাহলে কি তাকে বিয়ে করা বারন?
তনয়া বেগম সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ তুই কার কথা বলতে চাইছিস তুহিন?
-“ আমার এক পেসেন্টের মা। তার হয় নি পিরিয়ড কিন্তু তাকে একটা ছেলে পাগলের মতো ভালোবাসে,তার কাছে এটা কোনো বড় সমস্যা মনে হচ্ছে না। তাকে যদি ছেলেটা বিয়ে করে ঘরে নেয় তাহলে কি খুব অন্যায় হবে?
-“ ছেলেটা মনে হয় অনেক আবেগপ্রবণ। বাস্তবতা খুব কম জানে। কোনো মা বাবা চাইবে না ওমন মেয়ে ঘরের বউ করে নিতে যেখানে সেই মেয়েকে বিয়ে করলে তাদের বংশ বৃদ্ধি হবে না। তাদের অস্তিত্ব ওখানেই শেষ।
-“ কিন্তু ছেলেটা তো অনেক ভালোবাসে মা মেয়েটাকে। সে তো তার ত্রুটি গুলো না জেনেই তাকে ভালোবেসেছে,মেয়েটাকে ছাড়া অন্য কাউকে সে কল্পনাই করতে পারে না। বাবা মায়ের কি উচিত না ছেলেটার ইচ্ছে টাকে প্রাধান্য দেওয়া?
-“ ছেলে যদি জেনেশুনে বা না জেনেশুনে আগুনে হাত দিতে চায় তাহলে বাবা মা অবশ্যই আটকাবে। ছেলেটার উচিত মেয়েটাকে ভুলে যাওয়া।
তুহিন অবাক হয় মায়ের কথা শুনে।
-“ তুমি এ কথা বলছো মা! বাই এনি চান্স যদি আৃার ছোট বোন থাকতো আর তার এমন সমস্যা হতো তুমি কি করতা? তার দোষ দিতা?
-“ অবশ্যই না। তুই এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস কেনো?
-“ এমনি মা। একটা কথা বলবো?
-“ হুমম বল।
-“ আজ তোমাকে অন্য রকম লাগলো মা।
-“ হঠাৎ এ কথা কেনো?
-“ এই যে কি নির্দ্বিধায় বলে দিলে ভুলে যেতে। একটু মেয়েটার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবতে। হয়তো এটা বলতে পারতে না।
কথাটা বলেই তুহিন চলে গেলো। তনয়া বেগম থম মেরে বসে রইলো। সত্যি কি সে বাস্তবতা বুঝাতে গিয়ে নিজের মেন্টালিটি কে ছোট করে ফেললো?
_________________
নতুন একটা সকাল,সবার জীবনে নতুন নতুন কিছু মোড় নিয়ে আসে রাত পোহানোর পর এই সকাল। ইন্দু সেই সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছে কাল এখন ভোর পাঁচটা বাজে। আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। বিছানা থেকে উঠে ওজু করে নামাজে দাঁড়ায়। মন ভালো করার এই তো একটা মেডিসিন। তার মনের সব কথা নির্দ্বিধায় যাকে বলতে পারে। মোনাজাতে রবের নিকট বুকের মধ্যে রাখা চাপা কথা গুলো বলে মন টাকে হালকা করলো।
মোনাজাত শেষ করে রুমে থেকে বের হতেই দেখে রান্না ঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ ভেসে আসছে। মনোয়ারা বেগম রান্না করছেন। ইন্দু সেদিকে একবার চেয়ে গায়ে চাদর টা জড়িয়ে বাহিরে বেরিয়ে যায়। প্রায় মিনিট বিশেকের মতো হাটাহাটি করে বাসায় ফিরে রেডি হয়ে খেয়ে দেয়ে স্বাভাবিক ভাবে স্কুলে চলে যায়।
মনোয়ারা বেগম অবাক হয় মেয়ের এমন স্বাভাবিক আচরণ দেখে। মেয়ে বের হলে ঘরের দরজা আটকিয়ে ইলিয়াস কে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে।
#চলবে?