#যে_প্রেম_এসেছিল
#পর্ব৭ (বোনাস পর্ব)
#Raiha_Zubair_Ripte
-“ কি হেল্প করা লাগবে বলেন।
তুহিন উপর থেকে নিচ অব্দি ইন্দুপ্রভা কে পরখ করে নিলো। বুকে হাত গুঁজে বলে-
-“ ডাকার সাথে সাথে চলে আসলে নট ব্যাড। একটু হলেও মনে জায়গা করে নিতে পেরেছি তাই তো?
ইন্দু বিরক্ত হলো নিজের করা কান্ডকারখানা দেখে। লোকটার কথায় এসেও বিপাকে পড়েছে।
-“ আচ্ছা তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।
কথাটা বলে ইন্দু চলে যেতে নিলে তুহিন বলে উঠে-
-“ যেয়ো না ইন্দু,সাত টা দিন দেখি নি একটু দাঁড়াও তোমায় দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটাই।
ইন্দু দাঁড়িয়ে গেলো। পেছন ফেরার সাহস হয় না। লোকটাকে সেদিন কত কিছু বললো তবুও লোকটা আবার এসেছে। নিজেকে শক্ত করলো ইন্দু পেছন ঘুরে তুহিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে-
-“ আপনি কতটুকু ভালোবাসেন আমায়?
তুহিন হাসলো। নির্বিকারে জবাব দিলো-
-“ ভালোবাসা কি পরিমাপ করা যায় আদৌও! এই যে তুমি কি কখনও মাটি থেকে আকাশের মাঝে যে ব্যাবধান সেটা পরিমাপ করতে পারবে?
-“ এটার সাথে ওটার তুলনা কিভাবে হয়?
-“ এই যে তুমিই প্রশ্ন করছো তোমায় আমি কতোটা ভালোবাসি। মাটি থেকে আকাশের মাঝে যেটুকু ব্যাবধান আমি সেটুকুই ভালোবাসি তোমায়।
-“ শুনেন আমি আপনাকে একটা কথা বলবো,আমার মনে হয় কথাটা শুনলে আপনি আর আমার পেছন ঘুরে সময় নষ্ট করবেন না।
তুহিন ভ্রুকুটি করে।
-“ কি কথা?
-“ কাল ফ্রী আছেন?
-“ হ্যাঁ।
-“ তাহলে বিকেল তিনটায় আমার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন,আমার ব্যাপারে আপনাকে আমি সব বলবো। এরপর আর জীবনেও আপনি আমার সামনে আসবেন না।
তুহিন মুখটা থমথমে করে বলে-
-“ তাহলে আর বলা দরকার নেই।
-“ দরকার আছে তাই বলতে চাইছি। আপনি চলে আসবেন ঠিক সময়ে,এখন আসি।
কথাটা বলে ইন্দু চলে যায়। শুধু শুধু ছেলেটাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার মানে হয় না। ছেলেটা সাময়িক কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই।
তুহিন ঠাই দাঁড়িয়ে ইন্দুর যাওয়া দেখলো। ইন্দু চোখের আড়াল হতেই এলোমেলো পায়ে হেঁটে বাসায় আসলো। কাল কি এমন ইন্দুর ব্যাপারে সত্যি বলবে ইন্দু। এমন কোনো সত্যি শুনতে চায় না তুহিন যেটায় তাদের মাঝে দুরত্ব বাড়বে।
ইন্দু বাসায় আসতেই ইন্দুর মা মনোয়ারা বেগম বলে উঠে –
-“ বলে দিয়েছো সব?
ইন্দু সোফায় বসে পড়লো। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো-
-“ সাহস পাই নি মা বলার। কাল আসতে বলেছি কাল যে করেই হোক বলতে হবে। উনার এমন পাগলামি ভালো লাগছে না। সামনে থাকলে দূরে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আবার চোখের আড়াল হলে পাগল পাগল লাগে। আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি মা।
মনোয়ারা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়ে যে তুহিন কে ভালোবেসে ফেলছে এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। সামনে কি অপেক্ষা করছে কেউ জানে না।
-“ ভেঙে পড়ো না মা,সব ঠিক হবে। তুহিন বুঝবে তোমাকে। আমি দেখেছি ছেলেটা তোমায় কতোটা ভালোবাসে। এই তো সেদিন তার নম্বর ব্লক করছিলে দেখে ভোর বেলা থেকে তুহিন কে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। অনেক্ষন দেখার পর আর না পেরে আমি নিজেই চলে যাই নিচে। তুহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলি-
-“ তুমিই তুহিন?”
ইন্দুর মা’কে আকস্মিক সামনে দেখে কিছুটা ভরকে যায় তুহিন৷ নিজেকে সামলিয়ে বলে-
-“ আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আপনি ঠিক ধরেছেন আমিই তুহিন।”
-“ তুমি সেই ভোর বেলা থেকে এখানে দাঁড়ায় আছো কেনো? সমস্যা কি তোমার?”
-“ আসলে আন্টি আপনার মেয়েটা না আমায় বুঝতেই চায় না। কাল পইপই করে বলে দিয়েছি নাম্বার ব্লক করতে না তবুও ব্লক করে রেখে দিছে। সেজন্য দাঁড়িয়ে আছি।”
-“ ইন্দুকে ভালোবাসো?”
-“ ভীষণ ভালোবাসি আন্টি।”
-“ এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বাসায় চলো। ”
-“ আপনাদের বাসায় আন্টি? ”
-“ হুম।”
-“ আন্টি ইন্দু রাগ করবে।”
-“ করলে আমি আছি তো। সামলে নিবো।”
-“ শিওর। ”
-“ হুমম।”
ইন্দু মাথা তুলে তাকায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ মা তুহিন যদি আমায় ঘৃণা করে তখন কি করবো আমি।
-“ ঘৃণা কেনো করবে? আর ঘৃণা করলে বুঝবি তোর মা মিথ্যা ছিলো।
-“ কেউ কি চাইবে মা সে বাবা মা না হয়ে সারাজীবন পাড় করতে? সবার ভেতরই বাবা মা হবার ইচ্ছে থাকে তুহিনের ও আছে।
-“ কাল বলে দেখ সত্যি টা। আর এসব নিয়ে টেনশন করবি না একদম যা হবে ভালোর জন্য ই হবে। যা রুমে গিয়ে রেস্ট নে।
ইন্দু তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো।
এদিকে তুহিন একদণ্ড স্থীর হয়ে বসে থাকতে পারছে না। ইন্দু কি এমন বলতে পারে কথাটা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় টা মনে হচ্ছে যেতেই চাচ্ছে না।
কোনো রকমে রাত টা পার করলো তুহিন, সকালে তড়িঘড়ি করে কিছুটা মুখে নিয়ে হসপিটালে গেলো সেখানে হাতের কাজ সেরে দুপুরেই বেড়িয়ে পড়ে। ইন্দুর স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজতেই যেনো তুহিনের হৃদপিণ্ড টা কেঁপে উঠলো আচমকা। সামনে তাকাতেই দেখে ইন্দু আসতেছে।
তুহিন এক ঢোক গিলে। ইন্দু তুহিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। একপলক তুহিনের দিকে তাকিয়ে চোখ নিচে নামায়।
-“ চলুন স্কুলের পাশে যে খোলা উদ্যান আছে ওখানে।
ইন্দু সামনে হাঁটে আর তুহিন ইন্দুর পেছনে। খোলা উদ্যানের সামনে এসে একটা বেঞ্চে বসে পড়ে ইন্দু। তুহিন দাঁড়িয়ে ইন্দুকে দেখে। ইন্দু কাঁধে থাকা ব্যাগটা থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেয়ে নেয়। ইশারায় তুহিন কে পাশে বসতে বলে।
তুহিন চুপচাপ ইন্দুর পাশে বসে। ইন্দু জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট টা ভিজিয়ে বলে-
-“ তুহিন আমি আপনাকে আমার ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। আপনি তো জানেন মেয়েদের বিষয়ে সব। পিরিয়ড নামক শব্দটার সাথে তো আপনি পরিচিত।
তুহিন মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। ইন্দু তপ্ত শ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগে-
-“ আমার বয়স চব্বিশ হতে চললো আমার এখনও পিরিয়ড হয় নি। আই থিংক আপনি বুঝতে পেরেছেন। আমি আর চার পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত না। আমাদের সমাজে যাদের পিরিয়ড হয় না তাদের কিসের সাথে তুলনা করে আপনি তো জানেন। বাংলা ভাষায় বলতে গেলে হি/জড়া। আমি আপনাকে শুরু থেকেই বুঝিয়ে এসেছি। আপনি বুঝলেন না তাই আমাকেই বলতে হলো। আমাকে বিয়ে করলে কখনও বাবা হবার স্বাদ গ্রহন করতে পারবেন না। আর আমি চাইবো না আমার জন্য আপনার ক্ষতি হোক। এই পিরিয়ড ই একটা মেয়ের বাচ্চা হওয়ার সক্ষমতা প্রুফ করে। আমার হয় নি পিরিয়ড, আমি মা হতে অক্ষম। আপনি চাইবেন না এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসতে বা জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে।
তার থেকে পালাতে মিথ্যা বলছে ইন্দু। স্মিত হেসে বললো-
-“ মিথ্যা কেনো বলছো ইন্দু? আমার থেকে পালাতে? দেখো আমি তোমাকে ভালোবাসি মিথ্যা বলো না প্লিজ।
ইন্দু বসা থেকে উঠে দাড়ালো।
-“ আমি মিথ্যা বলছি না তুহিন। আমি সত্যি বলেছি। আপনাকে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ? আমি সত্যি মা হতে অক্ষম। মা হবার মতো এবেলিটি আমার নেই। সৃষ্টি কর্তা সেই সুযোগ আমায় দেয় নি।
তুহিন নির্বাক, কি বলা উচিত মাথায় আসছে না। মেয়েটা মা হতে অক্ষম! পিরিয়ড না হলে তো মা হওয়া ইম্পসিবল। এমনি অন্য সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করে না হয় সারানো যেতো কিন্তু পিরিয়ড এটা কি করে ঠিক করা যায়!
-“ আমরা না হয় বাচ্চা এডপ্ট করবো ইন্দু।
তুহিনের চোখ মুখে অসহায়ত্ব।
ইন্দু তাচ্ছিল্যর হাসি মুখে এনে বলে-
-“ জীবন টা কোনো সিনেমা বা গল্প না তুহিন। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। বাচ্চা এডপ্ট আর নিজের বাচ্চা এক হয় কখনও? আমার সমস্যা আপনার তো না। আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করলে বাবা হতে পারবেন। আর আমাকে করতে চাইলে সারাজীবন আফসোস করতে করতে পার করতে হবে।
-“ লাস্ট বারের মতো কিছু চাইবো দিবে ইন্দু?
ইন্দু ভ্রুকুটি করে বললো-কি?
-“ একটু খানি জড়িয়ে ধরতে চাই। প্লিজ না করো না।
কথাটা বলে তুহিন ইন্দুর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। ইন্দুকে জড়িয়ে ধরলো। ইন্দু চোখ বন্ধ করে ফেললো। দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্নিশ বেয়ে। মিনিট পাঁচেক পর তুহিন ইন্দু কে ছেড়ে দিলো। ইন্দুর চোখ মুখে আছড়ে পড়া চুল গুলো আলতো হাতে কানের পেছন গুঁজে দিয়ে কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে বলে-
-“ সাবধানে বাসায় যাবে। ভালো থেকো।
কথাটা বলে তুহিন চলে যায়। তুহিনের যাওয়ার পানে ইন্দু তাকিয়ে থাকে। নিজের ভাগ্য নিয়ে আজ নিজেরই উপহাস করতে ইচ্ছে করছে। খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে ইন্দুর। চিৎকার করে কান্না করলে হয়তো মনের ভেতরে থাকা কষ্ট গুলো একটু বেড়িয়ে আসতো। আর পাঁচ টা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হলেও তো পারতো। তুহিন ও বুঝলো না,মা তার মানে ভুল ছিলো। তুহিনের ভালোবাসা কর্পূরের মতো উবে গেছে সত্যি টা শোনার পর। কোনো ছেলের পক্ষে তো সম্ভব না এমন মেয়ে বিয়ে করা। তুহিনের দোষ নেই এখানে।
কথাগুলো আনমনে ভেবে এলোমেলো পায়ে বাসার পথে হাঁটা ধরলো ইন্দু। কয়েকদিন কষ্ট হবে তারপর সব ভুলে আবার নতুন ভাবে বাঁচবে সবাই।
#চলবে?