#যে_পাখি_ঘর_বোঝে_না
পর্ব-০৭
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
কাজী এই নিয়ে চারবার বললেন,”বলুন মা, কবুল।”
গত তিনবারের মতো এবারও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে বহ্নিশিখা। কী ভেবে এসেছিল আর হচ্ছে কী এখন! আফরাজ বলেছিল “বিয়েতে রাজি” এ কথাটা বললেই যথেষ্ট। ওর কথামতো এখানে এসে আলিম শেখকে বলেছিল এ বিয়েতে আর অমত নেই। ব্যস! শুরু হলো আরেক নাটক। আফরাজ রোজিনাকে তখন বলেছিল পিতাকে জানাতে বহ্নিশিখাকে নিয়ে ফিরছে সে। আলিম শেখ কম চতুর নন। সাক্ষী সহ কাজী জোগাড় করে রেখেছিলেন। বহ্নিশিখা আর আফরাজ যখনই বলল ওরা বিয়েতে রাজি, ওমনি কাজীকে ডেকে এনে বললেন,
“তাহলে আর দেরি কেন? হয়ে যাক বিয়েটা। শুভস্য শীঘ্রম।”
বজ্রাহতের ন্যায় একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল বহ্নিশিখা আর আফরাজ। পেছনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসছিল আরশাদ। বিড়বিড় করে বলছিল,”পড়েছে মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। এবার এ দুটোর স্বাধীনতা খর্ব হবেই।” পরাধীন লোক অন্যের স্বাধীনতা দেখতে পারে না। আরশাদও চায় বন্ধুর এই স্বাধীনতা খর্ব হোক।
আলিম শেখ সন্দিগ্ধ চোখে চাইলেন ওদের দিকে। বহ্নিশিখা রাগত মুখে চেয়ে আছে আফরাজের পানে। আফরাজের লড়াই করার মনবল শেষ আজ। সামনে খাবার, ঔষুধ আর ডাক্তার। আলিম শেখ পণ করেছে যতক্ষণ ওরা কবুল না বলবে তিনি কিছুই ছুঁয়ে দেখবেন না। বাবার মুমূর্ষ মুখটা আফরাজকে নত হতে বাধ্য করে। কিন্তু বহ্নিশিখা ওদের রক্ত সম্পর্কীয় কেউ নয়, সুতরাং ওর নত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আফরাজ তাকাতে পারছে না ওর দিকে। কোন মুখে তাকাবে? মেয়েটা হয়তো ওকে এখন মিথ্যাবাদী, প্রতারক ভাবছে। কাজী পুনরায় একই বাক্য বলতে গেলে আলিম শেখ দুর্বল হাতটা সামান্য তুলে থামিয়ে দেন। ছেলের মুখের দিকে রুষ্ট হয়ে বলেন,
“তোমরা মিথ্যে বলেছিলে?”
আফরাজ মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ, কিছু মিথ্যে তো ছিল। আলিম শেখের মুখখানা বড়ো করুণ হয়ে গেল। দৈহিক দুর্বলতার কাছে জেদ, রাগ সবই যেন অসহায় এই মুহূর্তে। ভাঙা গলায় বললেন,
“সন্তানকে সংসারি দেখতে চাওয়া কি অন্যায় রাজ? আর বলব না বিয়ের কথা। আর বাধ্য করব না। যাও। চলে যাও আমার সামনে থেকে।”
নিজের রাশভারি স্বভাব ভুলে আজ তিনি শিশুর ন্যায় কেঁদে উঠলেন। আফরাজ হাতটা ধরতে গেলে সরিয়ে নেন। পিতার হাত নয় যেন নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। ভীষণ কষ্ট হলো আফরাজের। সোজা হয়ে দাঁড়াল। আজ সে নিজের ভয়কে হারাবে। হয় হোক শত সহস্র যন্ত্রণা তবুও সে বিয়ে করবে। বিয়ে! সামাজিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া কারো সাথে। বিয়ে! একই ছাঁদ, ঘর আর বিছানা শেয়ার করা। বিয়ে! নিজের সময়টুকু কাওকে দেওয়া। বিয়ে! অনেক দায়িত্ব। বিয়ে! কারো প্রতি বিশ্বাস রাখা। কাওকে নিজের বিশ্বাস এবং হৃদয়টা দিয়ে দেওয়া। তারপর সেই অফেরতযোগ্য বিশ্বাস আর হৃদয়ের ওপর একক আধিপত্য জমিয়ে বসবে সঙ্গিনী। আফরাজ বহ্নিশিখার দিকে তাকায়। বহ্নিশিখা! হ্যাঁ, এই মেয়েকে সে এসব সবকিছু দেবে। নিজের বিশ্বাস আর হৃদয়ও। এক কদম ওর দিকে এগোয়। হঠাৎ আবার থমকে দাঁড়ায়। যদি ভেঙে দেয় ওর বিশ্বাস আর হৃদয়? যদি যথেষ্ট না হয় আফরাজ ওর জন্য? অস্বাভাবিকভাবে ঘামতে লাগল আফরাজ। গলা শুকিয়ে এসেছে ওর। বহ্নিশিখার কপাল কুঁচকে গেল ওর চোখে চোখ রেখে।
“ঠিক আছেন আপনি?”
অজান্তে বহ্নিশিখার হাতটা আফরাজের বাহুর ওপর থামে৷ আফরাজ আতঙ্কিত চোখে তাকায় ওর বাহুতে থামা হাতের দিকে। বহ্নিশিখা দেখতে পেয়ে চট করে হাতটা সরিয়ে বলল,
“সরি।”
সলজ্জে মুখ ঘুরিয়ে নিলো বহ্নিশিখা। যে হাতে আফরাজের বাহু স্পর্শ করেছিল সেটার মুঠ শক্ত করল। আফরাজ ওর দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে। এই মেয়েকে কী বিশ্বাস করা যায়? একবার কি চেষ্টা করবে ও? অন্তত বাবার জন্য!
“রোজিনা সবাইকে এখান থেকে যেতে বলো। আমার বড্ড মাথা ধরেছে।”
“কবুল, কবুল এবং কবুল।”
উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত। কাজী চশমা ঠিক করে পুনরায় বসলেন। খাতাটা মেললেন কোলের ওপর রেখে। বহ্নিশিখার মুখে রা নেই। কেমন করে এই মুহূর্তে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে ভেবে পাচ্ছে না। আফরাজ রোবটের ন্যায় ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাতটা ধরে বলে,
“যে কারণেই কবুল বলি মন থেকে বলছি। সারাজীবনের জন্য বলছি, বহ্নিশিখা। আমি আমাকে আপনার কাছে সঁপে দিচ্ছি। বিনিময়ে আপনার বিশ্বাস আমাকে দিন আর আমারটা আপনি নিন।”
বহ্নিশিখা বিস্ময় চেপে গলা ঝেড়ে বলল,
“বিশ্বাস একদিনে তৈরি হয় না মি.শেখ।”
“আমি জানি। কিন্তু শুরুটা তো কোনো একদিনই করতে হবে। তবে সেটা আজ থেকে হোক।”
দুজনের দৃষ্টি স্থির পরস্পরের দিকে। এই স্থিরতা বিশ্বাস শুরুর। কিন্তু আচমকা বহ্নিশিখার হৃদয়ের দুয়ারের খিল নড়ে উঠল। অবিশ্বাসের মরচেধরা জং এর এক খাবলা খসে গেল খিলের এক প্রান্ত থেকে। নির্নিমেষ চোখের পাতা কাঁপল কিঞ্চিৎ।
“মেয়ে কি কবুল বলবে?”
“বলব।” মন্ত্রমুগ্ধের মতো জবাব দিলো বহ্নিশিখা। কাজি নিয়ম অনুসারে সব বলে বললেন,
“বলুন, কবুল।”
বহ্নিশিখা একইভাবে ওই বাদামী নেত্রে চেয়ে বলল,
“কবুল, কবুল এবং কবুল।”
আলিম শেখের অনুরোধ পুনরায় কাজী ওদের বিয়ে ধীরস্থিরভাবে, সঠিক নিয়ম মেনে পড়ালেন। আফরাজের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ও বিয়ে করেছে। বিয়ে! সামনে বসা আরশাদের ঠোঁটে বিজয়ী হাসি। কপট রাগ হলো বন্ধুর ওপর। মুখটা শক্ত করে পিতার পায়ের কাছে বসল। রোজিনা আলিম শেখকে খাইয়ে দিচ্ছেন। শিওরের পাশের চেয়ারে বসে আছে বহ্নিশিখা। ওর পরনে লাল বেনারসি নেই, চকমকে সাজে সজ্জিত নয়। তবুও কী এক বিমুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে আছে ওর মধ্যে। হেসে হেসে কথা বলছে শ্বশুরের সাথে বহ্নিশিখা। এই মেয়েকে হাসতে কি ও পূর্বে দেখেছিল? চমৎকার হাসি ওর। এত চমৎকার যে আফরাজের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি জেগে উঠল।
“প্রেম, প্রেম গন্ধ পাচ্ছি কোথাও যেন।” ওর কানের কাছে চাপা গলায় বলল আরশাদ। তারপর নাক শুকতে লাগল ওর কাঁধে। আফরাজের ঠোঁটের ক্ষীণ হাসি নিভে গেল। ওর গম্ভীর মুখ দেখে আরশাদ বলল,
“পাচ্ছিস গন্ধটা? বেশ তীব্র কিন্তু। পাচ্ছিস না? তবে তোর নাসারন্ধ্রের শিরা উপশিরায় গোলোযোগ আছে।”
“শাট আপ।” দাঁত কামড়ে বলল আফরাজ। আলিম শেখ আর রোজিনা কথা বলছেন বহ্নিশিখার সাথে। আরশাদ মুচকি হেসে বলল,
“লেইট একটা ব্যাচেলর পার্টি হবে না কি জান?”
আফরাজ ওর গলায় এক বাহু জড়িয়ে বেরিয়ে গেল বেডের বাইরে। বহ্নিশিখার চেয়ে রইল সেদিকে।
“ওরা টম অ্যান্ড জেরি। এত বড়ো হয়েছে তবুও চলে ওদের এই বাঁদরামো। যেন ছোট্ট দুটো দুরন্ত বালক।”
হাসলেন রোজিনা। বহ্নিশিখাও হাসল একটু। আলিম শেখ ওর মুখের দিকে চেয়ে বলল,
“বহ্নি মা, একটা কথা বলব তোমাকে?”
“বলুন না আঙ্কেল।”
আলিম শেখ এবং রোজিনা ঠোঁট টিপে হাসলেন। বহ্নিশিখা বুঝল না এর কারণ। সলজ্জে কোলে রাখা হাতটার দিকে চেয়ে রইল। রোজিনা বলল,
“আঙ্কেল বলার দিন শেষ বউ মা। বলো আব্বু, ঠিক আছে? ”
“এত প্রেশার দিয়ো না রোজি। একটু সময় দাও ওকে।”
রোজিনা মাথা নাড়ালেন। খাবারের ট্রে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে বহ্নিশিখা বলল,
“আমি রেখে আসছি। আপনি বসুন।”
স্বামী স্ত্রী খুশি হয় পুত্রবধূর আচরণে। বহ্নিশিখা ট্রে অন্যপাশে রেখে আলিম শেখের পায়ের কাছে দাঁড়াল।
“ওখানে দাঁড়ালে কেন মা? এদিকে এসে বসো। তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।” আলিম শেখ বললেন
বহ্নিশিখা বসল আগের জায়গায়। আলিম শেখ দুচোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ থম ধরে আধশোয়া হয়ে রইলেন। বহ্নিশিখা অপেক্ষা করছে। আলিম শেখ চোখ মেললেন। বেডের গুমোট বাতাবরণ কেটে গেল আলিম শেখ গলা ঝাড়তে।
“তুমি কি আজ ঝোঁকের বসে কবুল বললে মা?”
বহ্নিশিখা এর জবাব সহসা দিতে পারল না। অনেক ভাবল। ভেবে ভেবে সিদ্ধান্তে উপনীত হলো নিছক ঝোঁকের বসে কবুল বলেনি। তবে কেন বলেছে সেটার ব্যাখ্যাও গুছিয়ে দিতে পারবে না এই মুহূর্তে।
“জি, না।”
“তুমি ওর সম্পর্কে সব জেনে-বুঝে বিয়েতে রাজি হয়েছ, না অন্য কারণ ছিল?”
অন্য কারণ ছিল এবং আছে। আজ বাড়িতে অযাচিত না হলে, সেখান থেকে বেরিয়ে না এলে বহ্নিশিখা হয়তো এ বিয়েতে মত দিতো না। আফরাজের প্রতি মন দুর্বল হলেও না।
“অন্য কোনো কারণ নেই। তিনি আমাকে সব বলেছেন। সব জেনেশুনেই রাজি হয়েছি আমি।”
“কেন?”
বহ্নিশিখা এবার তাকাতে বাধ্য হলো শ্বশুরের মুখের দিকে। ঢোক গিললো ও। দৃষ্টি নত করে বলল,
“বোধহয় তাকে বিশ্বাস করেছি বলে।”
রোজিনা হাসলেন। আলিম শেখ স্ত্রীর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকান। রোজিনা স্বামীর মুখপানে চেয়ে বললেন,
“একদিন আমিও তাই ভেবেছিলাম বউ মা। কিন্তু সেটাই পুরোপুরি সত্যি ছিল না।”
বহ্নিশিখা ঠোঁট চেপে আছে। হ্যাঁ, ওর কথাটাও পুরোপুরি সত্যি ছিল না। এর সাথে কিছু একটা মিথ্যা জড়িয়ে আছে। মিথ্যাটা হলো, ও কেবল আফরাজকে বিশ্বাস করেছে বলেই কবুল বলেনি। সত্যিটা হলো, আফরাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। যাকে বলে প্রেমে পড়া। যা বহ্নিশিখা স্বীকার করতে নারাজ। এখনও সে দুচোখ বন্ধ করে অনুচ্চস্বরে বলল,
“না না, বিশ্বাস ছাড়া এ আর কিছু না।”
আচ্ছা বিশ্বাস আর ভালোবাসার মাঝে দুরত্ব কতখানি?
চলবে,,,