#যে_পাখি_ঘর_বোঝে_না
পর্ব-০২
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
জানালার গ্রিল ধরে ধোঁয়াচ্ছন্ন রাতের আকাশটার দিকে চেয়ে আছে বহ্নিশিখা। শহরের আকাশে তেমন তারা দেখা যায় না। তবুও একমনে সে তারা খুঁজে ফেরে। অকারণেই এই খুঁজাখুঁজি। আশপাশটাকে উপেক্ষা করতে সে এই কাজ করে, কিন্তু সব কি উপেক্ষা করা যায়? সাতাশটা বসন্ত পেরিয়ে যাওয়া আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে না হওয়ার কষ্টে ছাঁদের সিঁড়িতে বসে কাঁদছেন ওর মা। বহ্নিশিখার মনে হয় সে যদি এমনই করে কাঁদতে পারত! বুকের ওপর চেপে থাকা পাথরটা বুঝি সরে যেত তখন। বড্ড ভার ভার লাগছে। একটু কি কাঁদবে সে?
“ফুপিমনি, তুমি কি কাঁদছ?”
কান্নার একটা তরঙ্গ বুকের ভেতর উঠেছিল। ভাতিজির গলা শুনে সেটাকে ও শান্ত করল। হেসে ভাতিজির দিকে ঘুরে বলল,
“তুই জানিস না তোর ফুপিমনি কাঁদে না? আই হেইট টিয়ার্স রোজেল।”
এমন অভিনয় করে বলল যে ছোট্ট রোজেল হেসে কুটি কুটি হয়। দু’হাত বাড়িয়ে দিলো ফুপির দিকে। বহ্নিশিখা ভাতিজিকে কোলে তুলে গালে চুমু খেয়ে শুধায়,
“খেয়েছিস?”
“হুম, গোতত আর পোলুয়াও।”
রোজেল হাসে। আজ পেট ভরে খেয়েছে সে। রোজ রোজ এ বাড়িতে ভালো খাবার হয় না। বড়ো ভাই বকুলের স্বল্প আয়ের টানাটানির সংসার। ভর্তা, ভাজি আর ছোটো মাছের তরকারি ছোট্ট রোজেলের মুখে রোচে না। প্রতিদিন খেতে বসলে বলবে,
“ফুপিমনি, গোতত খাব।” সব সময় এটা সেটা বুঝিয়ে খাওয়ানো যায় না। গোশত না পেয়ে অনেকসময় না খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে। বহ্নিশিখা খুব করে চেষ্টা করছে একটা চাকরীর। আগে একটা স্কুলে অস্থায়ীভাবে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল। করোনার কারণে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। বকুলের ওপর খুব চাপ পড়ছে। ওই অল্প বেতনে পাঁচটা পেট চালানো চাট্টিখানি কথা না। আজ আবার নতুন করে টাকা ধার করতে হয়েছিল আফরাজদের আগমন উপলক্ষ্যে। বয়স হচ্ছে বহ্নিশিখার। দেখতে শুনতে সে খারাপ না। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা না হলেও কালো বলে ধরা যায় না। ছেলেপক্ষের পছন্দ হয় কিন্তু ইনিয়েবিনিয়ে তারা যৌতুকের কথাটাও তোলে। সামান্য হলে না হয় হতো। লাখ টাকা চায় তারা। অত কোথায় পাবে ওরা? বাবার চিকিৎসাতে জমি যা ছিল বিক্রি করতে হয়েছে। শেষপর্যন্ত বাঁচানো যায়নি বাবাকে।
থাকার মধ্যে গ্রামের ভিটেটা আছে। বকুল সেটাও বিক্রি করতে রাজি একমাত্র বোনের আইবুড়ো দোষ ঘুচাতে। বহ্নিশিখা রাজি হয় না। যৌতুক দিয়ে বিয়ে করবে না। ভাইয়ের একমাত্র সম্বল ওই ভিটে বিক্রি করে তো নয়ই।
“ফুপিমনি?”
“হ্যাঁ, মা।”
“আব্বু আজকে আম্মুকে চড় মেরেছে। এই যে এমন করে।”
রোজেল নিজ হাতে গালে চড় মারার অভিনয় করে দেখায়। বহ্নিশিখার মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেল। ওর জন্য ভাই ভাবির মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। নিজের ভাগ্যের ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়। আর কত সবর করবে? আর যে ধৈর্যে কুলায় না। রোজেল ওকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়তে বেরিয়ে এলো বাইরে। রাত অনেক হয়েছে। খিদে লেগেছে ওর। টেনশনে সারাদিনে পানি ছাড়া কিছুই মুখে দেয়নি। রান্নাঘরের লাইট এখনও জ্বলতে দেখে একটু অবাক হলো। দরজার কাছে গিয়ে দেখল ওর ভাবি পিঁড়ির ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। একটু যেন কাঁপছে তার শরীর।
“কী হয়েছে ভাবি?”
নিশিতা প্রত্যুত্তর করল না। চোখ মুছে সোজা হয়ে বসল। বহ্নিশিখা কাছে গিয়ে বলল,
“ভাবি?”
“তোমার যা লাগবে নিয়ে এখান থেকে যাও বহ্নি।”
বহ্নিশিখা তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। নিশিতা এবার রেগে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওহ! তোমাকে যেতে বলার আমি কে? এই বাড়িতে আমি তো কেবল কাজের বেটি। মালিক, মালকিন তো তোমরা ভাই বোন।”
“এসব কী বলছ ভাবি?”
“কি বলছি বোঝো না? ইচ্ছে করে ন্যাকামি করলে আর কী করার।”
“নিশি!” বকুল রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নিশিতা তাকালও না ওর দিকে। বহ্নি ভাইয়ের সামনে এসে বলে,
“ভাবির গায়ে হাত তুলেছিস কেন ভাই? এমন কিছু তোর কাছে আশা করিনি আমি। মাফ চেয়ে ভাবিকে ঘরে নিয়ে যা।”
বকুল মাথা নাড়ায়। পরপর কয়টা সম্বন্ধ এসে ভেঙে গেল। এবার একপ্রকার ঠিক হয়েছিল বহ্নিশিখার বিয়ে। আলিম শেখ ওর বাবার বন্ধু হন। অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না ওদের সাথে। হঠাৎ একদিন বকুলের গ্যারাজে গাড়ি ঠিক করতে এসে দেখা হলো আবার। বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে মর্মাহত হন আলিম শেখ। বকুলের মায়ের সাথে দেখা করতে এসে বহ্নিশিখাকে দেখেন। শেষবার যখন দেখেছিলেন বহ্নি তখন কোলের শিশু। তখনই মনে মনে আশা করেছিলেন বন্ধুর সাথে আত্মীয়তা করবেন এই মেয়েকে পুত্রবধূ করে। সৃষ্টিকর্তা সেই জন্যই বোধহয় এত বছর পরে আবার এখানে নিয়ে এসেছিল তাঁকে। পাকা কথা দেন। বিশ্বাস ছিল ছেলে তার অবাধ্য হবে না। কিন্তু কে জানত ছেলে ওমন না করে বসবে! বকুলও তাঁর মতো ধরে নিয়েছিল বহ্নির বিয়েটা এবার হয়েই যাবে। লোকের নিন্দা আর অভাব থেকে মুক্তি পাবে বহ্নিশিখা। আশা ভাঙার ক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে নিশিতার শ্লেষাত্মক বাক্যতে। এই সংসারে বহ্নিশিখাকে ও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। বোনকে নিয়ে কটুকথা কিছুতেই সহ্য করে না বকুল। রাগের বশে হাতটা উঠে গিয়েছিল। পরে অবশ্য অনুতপ্ত, লজ্জিত হয়েছে। এই মুহূর্তে বহ্নিশিখার চোখে তাকাতেও লজ্জা করছে ওর। মাথা নিচু করে নিশিতার হাত ধরে বলল,
“ঘরে চলো নিশি।” নিশিতা হাত ছাড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ওরা ভাই বোন ভাবল এ বুঝি ওর অভিমান। বকুল স্ত্রীর পেছন পেছন ঘরে ঢুকল। বহ্নিশিখা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাবার প্লেট হাতে নেয়। এক টুকরো গোরুর গোশত, মুগ ডাল পাতে নিলো। এক গাল ভাত মুখের কাছে তুলতে আবার ভাই ভাবির চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পায়। বহ্নিশিখাকে এই সংসারের বোঝা ভাবে নিশিতা। ওর ধারণা এই সংসারের যত অশান্তি, অভাব সব বহ্নির কারণে। খিদে মিটল কিন্তু তৃপ্তি পেল না ও। শেষ কবে তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিল মনে নেই। রান্নাঘর পরিষ্কার করে ঘরে এলো। ওর মা এবং রোজেল খাটে শোয়া। চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে প্রশ্ন করে,
“মা ঘুমিয়েছ?”
না, জবাব নেই। হয়তো ইচ্ছে করেই জবাব দিচ্ছেন না ওর মা। রাগ করলে এমনই করেন। তাঁর ধারণা এবারও বিয়েটা বহ্নিশিখার তীক্ষ্ণ কথার কারণে ভেঙেছে। মেয়ের এই মুখের ওপর কথা বলে দেওয়া স্বভাব মনিরা পছন্দ করেন না। এ নিয়ে কত শাসন করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। বহ্নি অন্যায় সহ্য করতে পারে না। পূর্বে আরো প্রতিবাদী ছিল। সময়ের চপেটাঘাতে ইদানীং ওর প্রতিবাদী সত্ত্বা একটু যেন চাপা হয়েছে। চুল বেনী করে ঘুমন্ত রোজেলের কপালে চুমু দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুম আসছে না। পাশের ঘর থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে না আর। কাঁদছে ভাবি। বহ্নিশিখার বুকের ভেতর আবার ভারী হয়ে ওঠে। পাশ ফিরে খোলা জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। একসময় রাজ্যের ঘুম নেমে এলো ওর চোখে। আচমকা ঘুম ভাঙল ভাইয়ের আর্তনাদে। ধড়ফড় করে উঠে বসল। ওর মা মনিরাও উঠে বসলেন। আতঙ্কিত গলায় বললেন,
“কী হলো? কী হলো?”
ওরা খাট ছেড়ে নেমে বাইরে বেরিয়ে এলো। বকুল নিশিতাকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কোলের মধ্যে নেতিয়ে পড়ে আছে নিশিতার দেহ। স্বামীর ওপর অভিমান করে সে ঘরে থাকা ইদুর মারা ওষুধ খেয়ে নিয়েছে।
“বহ্নি তোর ভাবি বিষ খেয়েছে রে!”
বকুল পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। মনিরা আহাজারি করে বসে পড়লেন ফ্লোরে। বহ্নির হাত পা অসাড় হয়ে এলো। কী করবে এখন সে?
“বহ্নিরে নিশির কিছু হলে আমার আর রোজের কী হবে? এই নিশি চোখ খোলো না, নিশি।”
ভাইকে এমন করে কখনও কাঁদতে দেখেনি বহ্নিশিখা। চোখ জ্বলছে ভীষণভাবে ওর। ভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেল না। দৌড়ে গেল গেটের দিকে। ওর হাত পা কাঁপছে। তখনও ভোর হতে বাকি। রাস্তা শুনশান। দু একটা কুকুর ছাড়া আর কোনো জনমানবের দেখা নেই। ও উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগল। ওকে দেখে ছুটে এলো চৌকিদার।
“ওই মাইয়্যা এত রাইতে মাঝ রাস্তায় করো কী?”
“ভাই, আমার ভাবি বিষ খেয়েছে। ডাক্তারের কাছে নিতে হবে এক্ষুনি। একটা রিকশা দরকার।”
“এত রাইতে রিশকা কই পাইবা?”
“আপনার হাতে ধরি কিছু একটা ব্যবস্থা করুন ভাই।” বহ্নির গলা ধরে আসে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। চৌকিদার একটু ভেবে বলল,
“খাড়ান একটু।”
মিনিট দুই পরে একটা ভ্যান চালিয়ে ফিরে এলো চৌকিদার। সাথে আরো একজন ছেলে। ওরা বহ্নিদের বাড়ির সামনে এলো। এতক্ষণে মা আর ভাইয়ের কান্নাকাটিতে প্রতিবেশীরা জেগে গেছে। বকুল নিশিতার নিথর দেহটা বুকে জড়িয়ে বসে আছে বারান্দায়। রোজেল দাদির কোলে বসে কাঁদছে। ওর কোনো হুঁশ নেই। সকলে ধরাধরি করে নিশিতাকে ভ্যানে তুলল। রোজেলকে মায়ের কাছে রেখে বহ্নিশিখা বকুলের সাথে চলল হাসপাতালে।
নিশিতাকে ইমার্জেন্সি বিভাগে নেওয়া হয়েছে। বকুলের অবস্থা খুব খারাপ। স্ত্রী বিয়োগের আশঙ্কা তাকে প্রায় অসুস্থ, দূর্বল করে দিয়েছে। বহ্নির হাতে টাকা ছিল না। সাথে আসা প্রতিবেশীর দুজন ধারে কিছু টাকা দিলো। রিসেপশনে এলো মাকে একটা কল করতে। রোজেল খুব কাঁদছে। মনিরা বেগম কিছুতেই শান্ত করতে পারছেন না ওকে। মাকে শক্ত হতে বলে ফোন ছাড়ল বহ্নিশিখা। ভাবির এই অবস্থার জন্য নিজেকে দোষ দিতে লাগল সে। চুপচাপ একটা বিয়ে করে নিলে হয়তো আজ অন্যরকম হতো। আল্লাহর কাছে ব্যাকুল প্রার্থনা করছে তিনি যেন নিশিতাকে বাঁচিয়ে দেন। এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে হাঁটছিল। পেছন থেকে একটা গলার স্বরে থমকে দাঁড়ায়।
“বহ্নিশিখা!”
ঘুরে দাঁড়াতে আফরাজকে দেখতে পেল। ওরই মতো বিধ্বস্ত অবস্থা। চুল এলোমেলো, পরনের কাপড় কুঁচকে আছে। বেশ অবাক হলো হলো আফরাজের এই অপ্রত্যাশিত আগমনে।
“আপনি এখানে, এই সময়?”
প্রশ্ন করল আফরাজ। হঠাৎ বহ্নিশিখার চোখ গেল পাশের কেবিনের জানালার দিকে। বেডে শুয়ে আছেন আলিম শেখ।
“আপনি ঠিক আছেন বহ্নিশিখা?”
“জি।” নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো সে।
“কারো কি কিছু হয়েছে?”
একটু যেন উদ্বিগ্ন শোনালো আফরাজের গলা। বহ্নিশিখা মৃদু মাথা নাড়ায়।
“জি, আমার ভাবি বিষ খেয়েছে।”
আফরাজ চমকে ওঠে।
“সে কী! এখন কেমন আছেন উনি?”
বহ্নিশিখা জবাব দিলো না। হাঁটছে জরুরি বিভাগের দিকে। আফরাজ পেছন পেছন এলো। ইতস্তত করে একসময় গলা ঝেড়ে বলল,
“আপনার সাথে আমার জরুরি কথা ছিল বহ্নিশিখা।”
“শুনছি আমি।”
একটু সময় নিয়ে আফরাজ বলল,
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি।”
জমে যায় বহ্নিশিখার পা। একটা কঠিন নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরে ওদের চারিপাশে। বহ্নিশিখা ঘুরে দাঁড়ায়। আফরাজের চোখে চোখ রাখতে আফরাজ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কথাটা বোধহয় এই পরিস্থিতিতে বলা ঠিক হলো না। আফরাজের কেমন অস্থির লাগছে। মাথা ঘুরে বমির উদ্রেক হওয়ার ভাব। বহ্নিশিখা ঘুরে আবার পা বাড়াল সামনে। যেতে যেতে বলল,
“কিন্তু আমি রাজি না।”
চলবে,,,