যে পাখি ঘর বোঝে না পর্ব-০১

0
1867

#যে_পাখি_ঘর_বোঝে_না
পর্ব-০১
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

“দেখুন বহ্নিশিখা, বিয়েটা করা একপ্রকার অসম্ভব আমার পক্ষে। সাংসারিক কোনো সম্পর্কে বাঁধা পড়তে চাই না আমি।”

আফরাজ নত মুখে শান্ত গলায় বলল। বহ্নিশিখার রাগ হলো খুব। এসবই যখন মনে তবে এত দেখাদেখির নাটক কেন? গতকাল কল করে বলে দিতে পারত। অযথা সাজগোছ করতে হতো না তাকে। ওর ভাইয়াকেও ধারের টাকায় বাজার করা লাগত না। ক্ষতি তো এখন বহ্নিশিখাদেরই হলো। চাপা রাগে তিক্ত গলায় জবাব দিলো,
“ধন্যবাদ এত আগে মতপ্রকাশের জন্য। আর কিছু বলার বাকি আছে?”

মাথা নাড়ায় আফরাজ,
“না, নেই।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বহ্নিশিখা। আফরাজ আর কিছু বলল না। স্থির নেত্রে ফ্লোরে চেয়ে আছে। বহ্নিশিখা দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।

“আপনাদের আপ্যায়ন করতে হাজার খানেক টাকা ধার করতে হয়েছে আমার ভাইয়ের। মনে মনে যখন অনিচ্ছা ছিল তবে আসা কেন? ক্ষতি তো এখন আমাদেরই হলো? আপনাদের আর কী কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে চলে যাবেন।”

বহ্নিশিখার ঝাঁঝাল অনুযোগে একটু যেন ভড়কে গেল আফরাজ। লজ্জিত মুখে বলল,

“টাকাগুলো দিয়ে যাব আমি।”

আফরাজ উঠে দাঁড়ায়। বহ্নিশিখা কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে আঁচল ঝেড়ে বলল,

“তাই উচিত।”

তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল দরজার বাইরে। সিদ্ধান্ত খারাপ নেয়নি আফরাজ। বিয়ে সে কোনোদিন করবে না। এই মেয়েকে তো নয়ই। কেমন মুখের ওপর ঠাস ঠাস কথা বলে। বিয়ে হলে রক্ষে থাকত না। ওর শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট জীবনটাতে বিষম এক উৎপাত সৃষ্টি করত এই মুখরা রমণী। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। সাথে আগত আত্মীয়দের রেখেই লুকিয়ে চলে গেল বহ্নিশিখাদের বাড়ি থেকে। হঠাৎ মনে পড়ল টাকাগুলো দিয়ে আসেনি। গাড়ি রাস্তার একপাশে থামিয়ে প্রিয় বন্ধু এবং কাজিন আরশাদকে কল করে। রিসিভ করেই আরশাদ বলল,

“তুই কোথায় রাজ? এমন কেউ করে বল তো? মামা খুব রেগে আছেন। কী বলেছিস বহ্নিশিখাকে তুই? খুব কথা শুনিয়ে গেল আমাদের।”

আরশাদের গলা উদ্বিগ্ন শোনালো। আফরাজ আবার খুশি হলো নিজের সিদ্ধান্তের ওপর। মেয়েটার মধ্যে লাজুক ভাব নেই। ঠোঁটকাটা মেয়েরা বউ হিসেবে ভালো নয়, অন্তত তার জন্য তো নয়ই। নিজের স্বভাবসুলভ শান্ত গলায় জবাব দিলো,

“আমি বলেছি বিয়েটা করা সম্ভব নয়।”

“এবং কেন?”

“তুই তো জানিসই কেন? তবুও কেন প্রশ্ন করছিস?”

“করছি কারণ নতুন কারণটা আমি জানতাম না।”

“নতুন কারণ!”

“হ্যাঁ, নতুন কারণ। আগেরগুলো না হয় ঠিক ছিল কিন্তু নতুনটা! ছিঃ”

“শাদ! কী যা তা বলছিস? নতুন কী কারণ থাকবে? তাছাড়া ওই মেয়েকে বিয়ে না করার কোনো কারণই বলিনি আমি।”

“তাহলে এতবড়ো কথাটা ও বানিয়ে বানিয়ে বলেছে?”

“ফর গড সেক শাদ, কী বলেছে সেটা বল।” বিরক্ত আফরাজ। আরশাদ একটু গম্ভীর হয়ে বলল,

“ও বলেছে তুই গে। মেয়েতে তোর রুচি নেই। আর_”

বন্ধুকে থামিয়ে দেয় আফরাজ। শান্ত মস্তিষ্ক টগবগে করে উঠল। শেষমেশ গে! এই মেয়েকে ও ছাড়বে না।

“আমি আসছি। অপেক্ষা কর।”

“সরি মাই ডিয়ার কাজিন। আমরা অলরেডি গাড়িতে রওনা হয়েছি। আসো আজ বাসায় তোমার হবে। গে! ইয়াক!”

আরশাদ বমি ভাব করে কল কেটে দিলো। এত অসম্মান ইতোপূর্বে কখনও হয়নি আফরাজ। গাড়ি ঘুরাল আবার। বহ্নিশিখাদের বাড়ির বাইরের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে নামল। ওদের বাড়ির মূল গেট বন্ধ ভেতর থেকে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। বাড়িটিও তেমন। গেটের বাইরে কলিংবেলের ব্যবস্থা নেই। ছোট খোপের মতো গেটের দরজা। প্রথমবার ঢুকতে গিয়ে মাথায় লেগেছিল। তাই দেখে হেসেছিল সবাই। ঢোকার সময়ই বাধা পেয়েছিল। তখনই ফিরে গেলে ভালো হতো হয়তো। কয়েকবার পাতলা পাতের তৈরী গেটে করাঘাতের পর গেট খোলার শব্দ পেল। বহ্নিশিখা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আরশাদ ভেবেছিল ওকে দেখে চমকে যাবে। এই মেয়েকে নিয়ে কিছু আশা করাও ভুল। বহ্নিশিখা আগের মতো সেজে নেই। পরনের শাড়িটাও বদলেছে। একদম সাদামাটা লাগছে, কিন্তু চমৎকার লাগছে। নিজের মনকে কষে ধমক দিলো। মেয়েদের রূপ চোরাবালি সদৃশ্য। ওতে যে ডুবেছে সে মরেছে। আফরাজ ওমন মরণ চায় না। স্বাধীনতা চায় সে। নিঃসঙ্গতা বড়ো প্রিয় তার কাছে।

“কী প্রয়োজন?”

দুয়ারে মিসকিন দাঁড়ালে বুঝি লোকে এমন ভঙ্গিতে বলে। অপমানিত বোধ করছে আফরাজ। এদিক ওদিক চেয়ে কোনোমতে গলা ঝেড়ে বলল,

“আপনি কী বলেছেন আমার পরিবারকে?”

“আপনার মাথায় কি সমস্যা? ঠিকমতো মনে রাখতে পারেন না কিছু?” বেশ উঁচু গলায় জবাব দিলো বহ্নিশিখা। আশেপাশে দু একজন পথচারী আড়চোখে তাকাল ওদের দিকে। আফরাজ দাঁত কামড়ে বলল,

“একটু আস্তে কথা বলুন প্লিজ!”

“হু, আপনার পরিবারের লোকের মুখে একবার শুনেছেন। তারপর আবার সেই একই কথা শুনতে চাওয়ার মানে কী? হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করতে পারতেন কেন বলেছি। তাতে আপনার এবং আমার উভয়ের সময় লস হতো না।”

“মিস বহ্নিশিখা, কেন বলেছেন আপনি ওই কথা আমার সম্পর্কে? আমার সম্মানহানি করে কী লাভ হলো আপনার?” বুকে হাত ক্রস করে গম্ভীরমুখে বলল আফরাজ। বহ্নিশিখা গেট ছেড়ে বাইরে এলো। বলল,

“লাভ হয়নি তবে সমান সমান হয়েছে।”

“এবং কীভাবে? আমার যতদূর মনে পড়ে আপনার অপমান হয় এমন কিছুই আমি বলিনি।”

“বলেননি কিন্তু করেছেন। কোনটা গুরুতর বলা না করা?”

“ক্লিয়ার করুন মিস বহ্নিশিখা।”

“একটা মেয়েকে আপনার পরিবারের পছন্দ হলো। কদিন এলো গেল তারা। মহল্লার লোক জানাজানি হলো এই মেয়েকে দেখছে ছেলে পক্ষ। আপনার দাদি আমাকে দেখে নাত বউয়ের ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন। মহল্লার লোক জানল এবার অনুঢ়া এক মেয়ের বিয়ে নির্ধারণ হলো। নির্ধারণ মানে নিশ্চয় বোঝেন? এত কিছু যখন ঘটে গেল আপনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম ভাঙল চারিদিকে জানাজানির পর। সকলে যখন ভাবল আজ আংটি বদল হবে আপনি ভাবলেশহীন বলে গেলেন বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমিও মেনে নিলাম। কিন্তু মহাশয়, আগামীকাল মহল্লায় আমার মুখ দেখার জো থাকবে না। আমার যত খুঁত আছে সব মহল্লায় রসিয়ে রসিয়ে, দাদি, কাকি ভাবিদের নাক সিটকানির সাথে উচ্চারিত হবে। কিছু লোক আসবে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে। সান্ত্বনার ছলে খুব করে খোঁচা দেবে,”আহারে! কী কপাল নিয়ে জন্মেছিস। বিয়েটা হতে হতে ভেঙে গেল। তা কী দেখে অপছন্দ করল এবার, গায়ের রং না উচ্চতা দেখে?” এরপর সেই আবার একেকজনের কাছে গিয়ে একেক খুঁত বলে আমাকে নিয়ে উপহাস করবে। কোনো ছেলেপক্ষ আপাতত আর আসবে না। এলেও মোটা অংকের যৌতুক ধরবে ওই যে ওসব খুঁত বলে। এবার বলুন, মি.আফরাজ করিম শেখ, মানহানি সমান সমান হলো না কম বেশি। আর যদি বেশি তবে কার?”

আফরাজ আর কোনো কথা বলতে পারল না। চলে যাবে বলে ঘুরতে বহ্নিশিখা বলল,

“আমি তো কেবল আপনার আপনজনদের বলেছি মি.শেখ। আপনার কর্ম আমাকে পুরো মহল্লায় বদনাম করল। বদনাম হলাম তাতে অত কষ্ট নেই কিন্তু যৌতুকের টাকা বাড়িয়ে গেলেন রাগটা সেখানেই হলো। যা বলেছি তার জন্য দুঃখিত। আপনার বাবাকে কল করে মাফ চেয়ে নেবো আমি। পারলে মাফ করে দেবেন।”

আফরাজ ঘুরে দেখার আগেই গেটের ভেতর চলে গেল বহ্নিশিখা। বন্ধ গেটের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে গাড়ির দিকে চলল।

বহ্নিশিখা কথা রেখেছে। আফরাজ বাড়ি ফেরার পূর্বে সত্যিটা জানিয়েছে ওর পরিবারকে। তথাপি রেগে আছেন আলিম শেখ। ছেলের মুখ দর্শনও করবেন না। ছেলের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই তার। বিপি বেড়ে গেছে। মাথায় তেল পানি দিয়ে স্বামী সেবা করছেন রজিনা সুলতানা। আফরাজ আব্বুর পায়ের কাছে বসল। পায়ে হাত দিতে বিদ্যুৎগতিতে পা ছাড়িয়ে নিলেন আলিম শেখ। বহ্নি সত্যিটা বলে ক্ষমা চেয়েছে। মেয়েটাকে বড্ড ভালো লেগেছিল তার। সোজাসাপ্টা কথা বলে। সত্যি বলতে ভয় পায় না। কিন্তু আজ ওর একটা মিথ্যা আলিম শেখের ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে। ছেলে তার সংসার বিমুখ, একলা থাকে। ত্রিশ পেরিয়ে বত্রিশে বয়স পড়ল। এখনও বিয়ের কথা শুনলে ওর গায়ে জ্বর চলে আসে। ওর বিয়ে ভীতির এই কারণ এতদিন তেমন গুরুত্ব দেননি। আজ যখন মেয়েটা ওই শব্দটা তুলল মাথা ঘুরে গেল। শেষমেশ তার ছেলে কি না সমকামী? এই দিনও দেখার ছিল? আল্লাহ পাকের অসন্তোষ বড়ো ভয় পান আলিম শেখ। আর তার ছেলে যেচে গজব ডেকে আনছে। এসব হলো কেয়ামতের আলামত। লূত নবীর কওম ধ্বংস হয়েছিল এই সমকামিতার কারণে। এসব সাপোর্ট করাও গুনাহের শামিল।

“আব্বু, আপনি খাচ্ছেন না কেন? চলুন খেয়ে নেবেন।”

“রোজি, তোমার এই ছেলেকে আমার চোখের সামনে থেকে সরাও। ওর মুখ দেখাও পাপ। যা তুই আমার সামনে থেকে।”

“বউমা তো বলল ওসব কথা মিথ্যে। কেন আবার তুলছ সেই কথা?”

আলিম কিছু বলবেন তার আগেই আফরাজ মাকে বলে,

“বউমা কাকে বলছ মামনি? ওকে তো আমি বিয়ে করিনি। যাকে আমি বিয়ে করিনি সে তোমার বউমা হয় কী করে?”

“বিয়ে করোনি করবে। এক সপ্তাহের মধ্যে বহ্নিশিখাকে বিয়ে করবে তুমি আফরাজ।” আলিম জোর গলায় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। আফরাজ পিতার সামনে শান্ত অথচ দৃঢ়তার সাথে জবাব দিলো,

“আব্বু, জোরপূর্বক বিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিতে ঠিক নয়। ওসব বিয়ে সুখের হয় না।”

“তুমি যা করছ সেটাও শরীয়তের দৃষ্টিতে ঠিক না আফরাজ। বিয়ে ফরজ তোমার জন্য। ফরজ উপেক্ষা করা কবিরা গুনাহ।”

আফরাজ পিতার সাথে আর কোনো কথা বলতে চাচ্ছে না। কথা-কাটাকাটির মুড নেই। বিয়ে নিয়ে তো নয়ই। উঠে দাঁড়ায় সে। যেতে যেতে বলে,

“সংসার আমার ভালো লাগে না আব্বু। আর হ্যাঁ, আমি ছেলেতে রুচি রাখি না। আমি কেবল শান্তিতে একা থাকতে চাই। বিয়ে, সংসার এসব আমার দ্বারা সম্ভব না। আপনি মাথা থেকে ওসব বাজে চিন্তা ঝেড়ে খেতে আসুন।”

“তুমি বিয়ের কবুল না বলা সত্বে কিচ্ছুটি ছুঁয়ে দেখব না আমি। সে তুমি ইচ্ছেয় বিয়ে করো বা অনিচ্ছায়। দেখব পিতার জন্য কতটুকু দরদ তোমার মনে। একজন পিতা সারাটা জীবন সন্তানের জন্য উৎসর্গ করে। আর তুমি সামান্য বিয়ে করতে পারছ না? এই তোমার পিতার প্রতি কর্তব্যবোধ?”

আফরাজ রুমে বসে শুনল সে কথা। দু’হাতে চুল মুঠ করে ধরে আছে। ওই সামান্য বিয়েই সে করতে চাচ্ছে না। বিয়েতে কী আছে? কেন এমন উঠেপড়ে লেগেছে তার শান্তির জীবনে অশান্তি ঘটাতে? মন চাচ্ছে সব ছেড়ে একদিকে চলে যেতে। কিন্তু তা বোধহয় হতে দেবে না ওর আব্বু। শেষমেশ বাধ্য হয়ে বিয়েটা না তাকে করতেই হয়। উফ! ভাবলেই কেমন মাথা ভনভন করছে। শ্বাস ভারি হয়। বুকের পাশটাতে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে সে। সটান হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। বিয়ের কথা শুনলেই যার এই অবস্থা তার বিয়েটা হবে কী করে?

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে