যেমন শাশুড়ি তেমন বউ পর্ব-০৭

0
1303

যেমন শাশুড়ি তেমন বউ
#পর্ব- ০৭
#কামরুন নাহার স্মৃতি

মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধানেই আমি ওদের ভুলতে পারছি না, ভুলতে পারছি না ওদের মুখগুলো! মনে হয় যেন ওরা আমার খুব কাছে আর রাহাত ওতো একটা ভীতুর ডিম আমাকে ছাড়া একমুহূর্ত কাটাতে পারে না। কি জানি এই কয়েকটা দিনে রাহাত হয়তো মায়ের জেদের কাছে হেরে গিয়ে নতুন বউ ঘরে তুলেছে, হয়তো বউটা দেখতে বেশ সুন্দরী, আমার চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশি। মায়ের পছন্দ বলে কথা, আমার মতো নকল সোনা নিয়ে আসবে না নিশ্চয়, আসল সোনাই ঘরে তুলেছে। হয়তো রাহাত এখনো নতুন বউকে মেনে নেয়নি কিংবা একবার চোখ মেলে দেখেও নি। হয়তো বলেও দিয়েছে ও আমাকে ভালোবাসে, আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে মনের সিংহাসনের রানী করতে পারবে না। কি জানি হয়তো আমি সবই ভুল ভাবছি, নতুন মেয়েটাকেই মনের সিংহাসনে রানী করেছে আর আমাকে দাসি ভেবে ছুড়ে ফেলেছে। না আমি আর ভাবতে পারছি না, ভাবনাতে – স্বপ্নে কেন সবসময় খারাপটাই ভেসে আসে! আমার কেন যেন মনে হয় রাহাত ফিরবে, জানালায় এসে ডাকবে কিন্তু আমার আসতে দেরি দেখে অভিমানে ফিরে যাবে! কিন্তু আমি রাহাতকে অভিমান করে আর জিততে দেব না বরং ওকে চমকে দিয়ে আমিই জিতে যাব। কে জানে রুমি বাড়ি ফিরে কি অশান্তিটাই না করেছে, হয়তো কেঁদেছে কিংবা রাহাতকে ভীষণ বকেছে কারন মা’কে কিছু বলার মতো সাহস রুমির ও নেই। ধীরেধীরে কেমন যেন বুকের ভেতরটার ব্যথাটা বাড়ছে, প্রথম প্রথম কষ্ট কম হতো। মনকে বুঝিয়ে, শাসিয়ে কিংবা সম্পর্কের নানা ব্যাখ্যা শুনিয়ে চুপ করে রাখতাম কিন্তু মন এখন আর আমার কথা শোনে না বরং আমার কথাগুলোর বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কোন কারন ছাড়াই আজকাল কান্না পায়, মনের ভেতর বিষাদের হাওয়া সবসময় কি যেন হারানোর গল্প বলে যায়! মানুষ নিজের সাথে একাকী কথা বলতে পারে বলেই হয়তো বুকের উপর ব্যথা, কষ্ট আর যন্ত্রনার পাহাড় নিয়েও বেঁচে থাকে। একাকী – নিজের সাথে কথাবলা মানুষগুলোকে দেখলে আমার হাসি পেত অকারনেই অথচ আজ আমি নিজের সাথে কথা বলি একাকী। আয়নায় নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলি আবার কখনো কখনো রাহাতকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করি আপনমনেই, কখনো কখনো অভিমান আর কান্নার রং এ রাহাতকে রাঙিয়ে দেই। রাহাত হয়তো আমার চেয়েও বেশি কষ্ট পাচ্ছে, ছেলেটা কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারে না ; বুকের মধ্যে খুব যত্নে তুলে রাখে! সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারে না রাহাত, আমি যে ওর চোখের ভাষা ভীষণ রকম বুঝি! ওর অভিমান, ওর কষ্ট কিংবা না বলা হাহাকার খুব সহজেই ধরতে পারি। আমার জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া আকাশটা কালো মেঘে ঢাকা, দেখতে দেখতে বৃষ্টিও নামল। বৃষ্টির গায়ে রাহাতকে চিঠি লিখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে কিন্তু এ নিছক পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি চোখের পানি লুকানো যায় কোথায় যেন শুনেছিলাম, আজ মনের সুখে অনেক অনেক ভিজবো খোলা আকাশের দিকে পা বাড়ালাম। বাবা মা নিষেধ করেছে কিন্তু আমি বরাবরই তাদের অবাধ্য সন্তান, আজ বাধ্য হবো এটা ভাবাও ঠিক নয় নিশ্চয়। বৃষ্টিতে ভেজার কথা শুনলে রাহাত ভীষণ কথা শোনাতো। বলতো – জ্বর আসবে, মাথা ব্যথা করবে আর সবচেয়ে বড় কথা শুয়ে থাকতে হবে সবসময় তখন কিন্তু আমায় কিছু বলতে আসবে না। আর হ্যা জ্বর আসলে ইনজেকশনও দিতে হবে মনে রেখো। ইনজেকশনে আমার ছোটবেলা থেকেই ভয়। কিন্তু আজ রাহাত নেই আর রাহাতের শাসনও নেই। আজ বৃষ্টিতে ভেজায় কোন বাধা নেই।
বৃষ্টির গায়ে রাহাতের নামে চিঠি লিখতে খুব ইচ্ছে করছে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে – “ভালোবাসা যদি সত্যি হয় তবে তুমি আমার আর ভালোবাসা যদি মিথ্যে হয় তবুও তুমি আমার কারন সবকিছু মিথ্যে হলে মনটা মিথ্যে নয়, সেখানে শুধুই তোমারই নাম লেখা ।”
“আই লাভ ইউ রাহাত, আই মিস ইউ। ”
আমি পারলে রাহাতের কাছে থেকে যেতে পারতাম, তারজন্য হয়তো আমাদের আলাদা থাকতে হতো আর আমি নিশ্চিত বাবাও অনুমতি দিতো কিন্তু আমার কি অধিকার আছে এক মায়ের থেকে তার সন্তানকে ছিনিয়ে নেয়ার! আমার সাথে রাহাতের পরিচয় মাত্র কয়েকদিনের অথচ এই পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই রাহাতকে মা খুব যত্নে আগলে রেখেছে, সমস্ত বিপদআপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। আমার কি উচিত এই দু’দিনের সম্পর্কের জন্য জন্মের পূর্বের সম্পর্কটা ভেঙে চুরমার করা? নিশ্চয় না।
….
দেখতে দেখতে বৃষ্টি থেমে গেছে, কতক্ষণ ভিজেছি কে জানে! আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের হিসেব রাখার মতো আজ আর কেউ নেই, জীবনের প্রতিটা গল্পের প্রথম বা শেষ অক্ষরে আজ আর কেউ নেই। বিকেল থেকে গা একটু গরম গরম লাগছে, জ্বর জ্বর অনুভব হচ্ছে কেমন যেন! রাত বাড়ার সাথে সাথে জ্বরের মাত্রাও বাড়তে লাগল। মা নানাভাবে চেষ্টা করছে জ্বর কমানোর কিন্তু না কমার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছেনা। আমি ডাক্তার দেখাবো না বলে ছোট বাচ্চার মতো বায়না শুরু করেছি, ডাক্তার যদি ইনজেকশন দেয় তাহলে আমি হয়তো মরেই যাবো। বাবা কি করবে বুঝতে পারলো না কিন্তু আমার জেদ সত্ত্বেও ডাক্তার আনার সাহস হলো না। মা বললো, রাতটা কাটুক, সকালে না হয় ডাক্তার ডাকা হবে। বাবা ফোনটা অন করে দিয়ে গেল, রাতে কোন সমস্যা হলে আমি যেন ফোন দেই এই কথাটা বারবার বলে গেল। ও বাড়ি থেকে আসার পর ফোনটা হাতেই নেই নি, ইচ্ছে করে নেইনি তা না খুব ইচ্ছে করেছে ওদের ফোন দিতে, রাহাতকে ফোন দিতে কিন্তু না ফোনের দিকে চেয়ে থেকে আবার সামলে নিয়েছি নিজেকে। এ কয়েকদিনে ফোনে অনেক মেসেজ জমা হয়ে গেছে, তার প্রায় সবকটাই রাহাতের। এ কয়েকদিন কেমন করে কেটেছে ওর, কে জানে! ভীতুরামটা প্রচণ্ড ভালোবাসে আমাকে। মেসেজ দেখলাম কিন্তু রিপ্লে করতে মন সায় দিলনা। কয়েকমুহূর্ত পর ফোন বেজে উঠল, ফোনে রাহাতের ছবি ভেসে উঠল। ফোন বাজতে বাজতে কেটে গেল, আবার ফোন দিল রাহাত। আমি জানি ফোন না ধরলে ও বারবার ফোন দেবে যতক্ষণ না রিসিভ হবে, অনেকবার বুঝিয়েছি কিন্তু ও ওরটা ছাড়েনি। অগ্যতা ফোনটা রিসিভ কুরলাম
– হ্যালো
– কতবার ফোন দিয়েছি ধারনা আছে তোমার? মেসেজ এর রিপ্লে করতে তো পারতে! আমাকে ঠিক কতটা কষ্ট দিতে চেয়েছিলে বলবে কি প্লিজ!
– হুম।
– কি হুম? কথা বলতে পারো না, নাকি আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছেই করেনা!
– আমি তো ভাবলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।
– হ্যা, হয়ে গেছেই তো জেদি, বদমেজাজি আর ঝগড়ুটে মেয়েটার সাথে।
– ও, ভালো।
– ভালো আছো?
– হুম, খুব ভালো। তুমি?
– জানোই তো কেমন আছি, কেন মিছে প্রশ্ন করছো!
– ভালো লাগছে না, ঘুমাবো। রাখছি।
– কি হয়েছে তোমার? অসুস্থ?
– না, বললাম তো ঘুমাবো! বাই।
– বাই।
রাহাতকে ইগনোর করায় যতটা কষ্ট ওর হয়েছে, তার চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশি কষ্ট আমার হয়েছে, সে হয়তো কেউ জানে না আর কখনো জানবেও না। ভালোবাসার মানুষটাকে ইগনোর করা যে কতটা কষ্টের সে শুধুই মন জানে, অন্য কেউ জানে না।

রাতটা কেটেই গেল ভালোভাবে, আমি তো ভেবেছিলাম সকালের লাল সূর্যটা আমার আর দেখা হবে না, আর দেখা হবে না রাহাতের সেই হাসিমাখা মুখ। ওরা হয়তো আমায় দেখতে আসবে ঠিক সেইসময় যখন আমি বিদায় নিয়ে চলে যাব বহুদূরে।

সাত দিন হয়ে গেল আমি চলে এসেছি ও বাড়ি থেকে অথচ কেউ একবার জানারও চেষ্টা করেনি আমি কেমন আছি! ওদের ছেড়ে আদৌ ভালো আছি কি না। মানুষ কেন এতো নিষ্ঠুর হয় সত্যিই আমি জানিনা। কিন্তু আমার মন বলছে ওরা আসবে, আর কেউ না আসুক মা আসবে কেননা রাহাতকে নতুন বিয়ে করাতে গেলেও আমার মতটা নিতে হবে। বাবা, ভাবি, ভাই আর রাহাত কারো কি একবারো আমাকে দেখতে ইচ্ছে করেনা! রাহাতের হয়তো আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে ককরে, কথা বলতে ইচ্ছে ককরে। নয়তো ওরা চায় না আমার মুখটা আর ওদের দেখতে হোক। আমি জানিনা না এতোকিছু, আর কিভাবেই বা জানবো! মনের ভেতরের খবরটা কেও জানেনা। আমার রাহাতের মনের ভেতরটায় একবার দেখতে ইচ্ছে করে, সেখানে আমি কতটা যত্নে আর কতটা জায়গা জুড়ে আছি জানতে বড্ড ইচ্ছে হয়! জ্বর অনেকটা কমে গেছে হয়তো ইনজেকশন এর ভয়ে। যে ঘুমের যন্ত্রনায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে ছিলাম সবসময় অথচ সময়ের ব্যবধানে সেই ঘুমটাকেই হয়রান হয়ে খুঁজতে হয়!
….
সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমেছে আর দুপুর গড়িয়ে বিকেল, একসময় সন্ধ্যা আসবে তারপর রাত আর তার সাথে কেটে যাবে আরো একটা দিন। এসব ভাবতে ভাবতে মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
– স্মৃতি মা, দেখ কে এসেছে..!
– কে মা?
মনটা যেন ইশারায় বারবার বলছে রাহাত এসেছে। কিন্তু না ও কেন আসবে এখানে, অবশ্য আসতে পারে আমার থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে। ভাবতেই মনের আকাশে কালো মেঘ জমলো। মায়ের সাথে শাশুড়ি’মা ঘরে ঢুকলেন। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম, বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার জেদি শাশুড়ি’মা এখানে।
– কি হয়েছে? এই অসময়ে শুয়ে যে! জ্বর বাঁধিয়েছ নাকি?
– হুম….
রাহাতের বিয়ে দেবেন বলে আমার থেকে অনুমতি নিতে এসেছেন, তাইনা মা? একবার রাহাতকে সঙ্গে আনতে পারতেন শেষ বারের মতো একটু দেখতাম। তাতে কি, আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই মা। আমি কখনোই ওদের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবো না। মায়ের ইশারায় রাহাত ও ভেতরে ঢুকল, সাথে বাবা – ভাবি – ভাইও। রাহাতটা কেমন শুকিয়ে গেছে, কয়েকটা দিনে দাড়িগোঁফ গজিয়েছে আর দেখতে কেমন জোকার জোকার লাগছে। ঘুমায়নি মনে হয় ঠিকমতো চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। বাবাও কেমন যেন একটু শুকিয়ে গেছে নাকি এ আমার চোখের ভুল! বাবা শুকনো মুখে বললেন,
– জ্বর বাঁধিয়ে বেশ বিছানায় শুয়ে আছিস, আমরা কতকিছু ভেবে আসলাম। তা জ্বর কি করে এলো মা?
– বৃষ্টিতে ভিজে।
রাহাত কিছু বলল না শুধু আমার দিকে চোখ পাকালো, তাতে আমার কি! ও এখন আমার স্বামী বটে কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আর থাকবে না। মা সবার সাথে সুর মিলিয়ে বললো,
– ও কি শোনে আমাদের কোন কথা, কত বারন করলাম ভিজো না বৃষ্টিতে কিন্তু কানেই তুলল না!
– হু, এবার শালিসি হয়েছে মা। থামো।
– তোমার মা থামলেও শাশুড়ি’মা কিন্তু থামবে না। আমি যে কাজে এসেছি সে কাজ না করে একদম ফিরছি না। জ্বরটা তো ভালো করতে হবে নাকি!

এতো আদর, ভালোবাসা সব ওই একটা জিনিসের জন্যই। মানুষ কেমন নিজের স্বার্থের জন্য নিজেকে পালটে ফেলে ভাবতেই অবাক লাগে কিন্তু তাই বলে রাহাতও চায় আমার থেকে মুক্তি! কিন্তু আমি তো ওর মধ্যে কোন যন্ত্রনা, ব্যথা, কষ্ট কিংবা হারানোর ভয় অনুভব করছি না তাহলে কি ও নিজেও এটাই চায়। ওর চোখে আমি যা পড়তাম সবই কি তবে অভিনয়, ছলনা!

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে