“যেমন শাশুড়ি তেমন বউ ”
(অন্তিম পর্ব)
শাশুড়ি’মা শান্ত গলায় বললেন,
– আমি তোমাদের বিয়েটা কেন মানতে পারিনি জানো? আমার মনে হয়েছিল তুমি আমার থেকে আমার ছেলেকে, আমার এতোদিনের সাজানো পরিবারকে কেড়ে নিতে এসেছ! আমার দেখা চারপাশের সব শাশুড়ির মতো আমাকেও অচল পয়সা করে রেখে দেবে, তাই আমি তোমাকে সহ্য করতে পারিনি।
– আমি জানি মা।
শাশুড়ি’মাকে এতোটা শান্ত গলায় এর আগে কথা বলতে শুনিনি। কথা বলতে বলতে উনার গলাটা ধরে আসছিল, আমি বুঝতে পারছি।
– আমি তোমার কথা না শুনে রুমির সাথে অন্যায় করেছি। আমার তো মনে হয়েছিল তুমি আমার ছেলে আর পরিবারের সাথে সাথে রুমিকেও কেড়ে নিচ্ছ! আমি চেয়েছিলাম রুমির বিয়ে হোক কিন্তু ওর কান্না ঝরা সংসার হোক আমি এটা চাইনি, বিশ্বাস করো আমি চাইনি। তুমি যখন বারবার বলছিলে ভালো করে জানতে তখন আমি নিজের অধিকার ফলাতে গিয়ে মেয়েটাকেই বলি দিলাম!
– মা কি হয়েছে রুমির?
– তুমি বলেছিলে ছেলেটার খোঁজ নিতে কিন্তু আমি নিতে দিইনি। আর এটাই আমার কাল হলো!
– কি হয়েছে সেটা তো বলবেন!
– ছেলেটার অন্য একটা মেয়ের সাথে…….
রুমিকে বলেছে এসব মেনে নিয়ে থাকলে থাকবে নইলে যেন চলে যায়! আমিও বলেছি রুমিকে চলে আসতে কিন্তু আমার মেয়েটা আসবে না। বলেছে, সত্যিকার বিয়ে একটা মানুষের জীবনে একবারই হয়। আমি না হয় এইসবকিছু ভাগ্যের পরিহাস ভেবেই মেনে নিলাম।
– আগেই বলেছিলাম মা, এটা আপনাদের সময় না!
– হ্যা মা, সব ভুল আমার। এই ভুলের কোন ক্ষমা নেই। না তোমার কাছে আর না আমার মেয়ের কাছে! একটা মেয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে কতটা কষ্ট হয় আমি বুঝতে পেরেছি। আমার মেয়েটার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে হয়তো তোমার স্বপ্নগুলো ভাঙ্গার শাস্তি এটা কিন্তু দেখো সেই শাস্তিটা আমার মেয়েকে পেতে হলো! ওর তো দোষ ছিলনা তবুও। তুমি পারতে আমার ছেলেটাকে নিয়ে আলাদা সংসার বাঁধতে, আমি জানি রাহাত তোমাকে খুব ভালোবাসে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও নিশ্চয় আলাদা রাখতে রাজি হতো কিন্তু তুমি এইটুকু একটা মেয়ে আমাকে কি না দয়া করে ছেলে – সংসার ফিরিয়ে দিলে, নিজের সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গেচুরে আমার স্বপ্নগুলো গড়ে দিলে! এতোটা শক্তি তুমি কই পেয়েছো!
আমি সবসময় নিজে যা ভেবেছি তাই করেছি, ভুল হলেও কেউ বলার সাহস দেখায় নি। আমি ভীষণ রকম রাগী, তাই সবাই আমার থেকে দূরে দূরে থাকে আমি বুঝতে পারি!
– না মা, এমন কিছু না।
– কেন মিথ্যে বলছো, মিথ্যে মানায় না তোমার মুখে! আমি আসলে রাহাতের এমন একটা বউ চেয়েছিলাম যাকে আমি ডানে বললে ডানে যাবে আর বামে বললে বামেই।
– আমি কোনদিন তেমন হতে পারবো না মা।
– আমি জানি কিন্তু তুমি জানোনা তোমার এই সরলতা, সত্যি বলার ক্ষমতা একটা মানুষকে কতোটা কাছে টানতে পারে!
আমি জানিনা এই মুহূর্তে আমার কিছু বলার আছে কি না কিন্তু যার কাছে মানুষ সবচেয়ে বেশি ঘৃনা পায় তার মুখে প্রশংসা শুনলে যে কারো মুখের কথা আটকে যাবে! অবিশ্বাসের চোখে তাকানো ছাড়া আর কিই বা করার থাকে!
– তুমি ওই বাড়ি থেকে চলে আসার পর থেকে আমার তোমায় খুব মনে পড়েছে তা হয়তো না কিন্তু তোমার ভয়হীন তাকানো আর মিষ্টি মিষ্টি ঝগড়া খুব মনে পড়ে।
– হ্যা মা, ঝগড়া তো শুধু আমিই করতে পারি।
– ওই বাড়িতে কেউ আমার সাথে মনখোলা কথা বলেনা। আচ্ছা মা, আমি কি খুব খারাপ মানুষ! আমি হয়তো একটু বেশিই রাগী তাই বলে কি ভালোবাসি না। আমিও একটা মানুষ বলো, আবেগ – ভালোবাসা – আনন্দ – বেদনা আমারও তো হয় বলো.. কষ্ট লুকাতে লুকাতে সময় আমাকে রাগী করে দিয়েছে, তাতে আমার কি দোষ বলোতো?
– কোন দোষ নেই মা। আমি জানি তো আপনার রাগের আড়ালে লুকিয়ে আছে অনেক ভালোবাসা। আসলে আপনার ভালোবাসা সবসময় রাগের চাঁদরে ঢাকা থাকে অবহেলা পাবার ভয়ে। কিন্তু কয়জন পারে এভাবে সত্যি কথাগুলো স্বীকার করতে?
বাবা হাসতে হাসতে বললেন,
– ঠিক বলেছিস, এই না হলে আমার বউ!
– জানো তো বৌমা, এ কয়টা দিন রাহাত, তোমার বাবা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে আর সত্যি বলতে কি তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো আমারও খুব মনে পড়ছিল । তবে ওরা সবাই তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তুমি চলে আসার পর বুঝেছি সত্যিই কেন বউরা শাশুড়ির শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।
আমি হা করে চেয়ে আছি, কি বলব ভেবেই পাচ্ছিনা। আমি স্বপ্ন দেখছি না তো, রাগী শাশুড়ি’মা কি না এসব বলছে। আবার আমাকে বৌমা বলছে…!
– মুখে মশা ঢুকবে। এমনিতেই জ্বর বাঁধিয়েছ আবার কোন রোগ বাঁধবে কে জানে!
রাহাত দাঁত কেলিয়ে বলল,
– মা ইনজেকশন দিলে সব জ্বর ভালো হয়ে যাবে।
ও জানেই ইনজেকশন এ আমি ভয় পাই তবুও কিনা ইনজেকশন এর কথাটাই বারবার তুলছে। মনে চাচ্ছে ওকে কি যে করি! ভীতুরামটার সাহসটা একটু বেশিই বেড়েছে।
– না, আমার জ্বর আমারই থাক।
আমার বাবা বললেন,
– আমি তোমার সাথে একমত, জ্বর কি কারো পর বলো!
– দেখো আমি যে কাজে এসেছি সে কাজ না করে কিন্তু ফিরবো না আর আমি তোমার শাশুড়ি বলে কথা, যা বলেছি তা তো করবোই।
– ও, সবকিছু তাহলে ওই কাজটার জন্যই।
একটা ছোট্ট কাজ করবে বলে সবাই কি অভিনয়টাই না করছে। কি ভাবছে ওরা আমি রাহাতকে ছাড়বো না, যদি ধরে রাখার হতো তাহলে সেদিনই ছাড়তাম না।
– হ্যা মা, বলেন না কি করতে হবে?
– আগে বলো ঝগড়া করবে তো আমার সাথে?
– যেখানে থাকার প্রশ্ন আসেনা সেখানে ঝগড়ার প্রশ্ন কোথা থেকে আসে, মা?
শাশুড়ি’মা আর কিছু বলার মতো পেলোনা হয়তো! আমি বুঝতেই পারছিনা কি হচ্ছে আমার সাথে, কি চায় ওরা? মুক্তি না শাস্তি!
মা – বাবা আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাই ভাবিকে নিয়ে অন্য ঘরে গেল। কিন্তু রাহাত কেন যেন বসেই আছে, কে থাকতে বলেছে আমার কাছে, আমার চাইনা কাউকে….!
– কি সুন্দর জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছ!
– তাতে তোমার কি?
– বা রে, আমার বউ জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছে আর আমার কিচ্ছু না!
– সাহসটা খুব বেড়েছে, তাইনা? বউ!.. ঠং…
– ঠং কি? তুমি তো আমার বউই।
– যাবে তুমি এখান থেকে।
– তুমিও মায়ের মতোই হবে, তাইনা? আমার ছেলের বউকে জ্বালিয়ে মারবে!
– চুপ করবে তুমি?
– হু..
বউয়ের কথা তো শুনতেই হবে।
– আচ্ছা রাহাত, তুমি আমাকে মিস করেছো?
– না…
– না মানে?
– যে বুকের খুব গভীরে, প্রতিটা স্পন্দনের সাথে জড়িয়ে থাকে তাকে কি আবার নতুন করে মিস করতে হয়!
– হয়েছে, ভালোই শিখেছ।
– কি শিখেছি?
– কিছুনা।
ভাবি দরজায় এসে চোখ টিপে বললো,
– কি গো, তোমাদের কথা শেষ হলো?
– কেন শেষ হবে না ভাবি? ওর সাথে আমার কোন কথাই নেই।
শাশুড়ি’মা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
– তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হও, যেতে হবে তো নাকি!
– কোথায় যাবো মা?
– শ্বশুরবাড়ি, আর কোথায়! জ্বর আমাদের ওখানে গেলে এমনিই সেড়ে যাবে!
– কি বলছেন মা?
– হুম, আমার এরকম ঝগড়ুটে বউই চাই আর সংসার আগলে রাখার মতো মন। আগেরবার তো রাহাত তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আগলে রাখতে পারেনি। এবার আমি নিয়ে যাবো, দেখো ঠিক আগলে রাখবো.. যাবে না আমার সাথে? মায়েরা তো মেয়ের কাছে অনেক ভুল করে তাই বলে কি মেয়েরা ক্ষমা করেনা? আমি না হয় তোমার মা নই শাশুড়ি, কিন্তু তুমি তো আমার মেয়ে!
– আপনাকে আমি মা করেই রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু…
– ভুলে যাওয়া যায়না সেই কয়েকটা দিন। তুমিই না আমাকে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে বললে তাহলে তুমি কেন মনে রেখেছো মা ভুলে যাও, মুছে ফেল সেই কয়েকটা দিন স্মৃতি থেকে। ক্ষমা করো তোমার শাশুড়ি’টাকে।
আমি কি বলবো ভেবেই পেলাম না, সত্যি আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এভাবে আবার রাহাত আমার জীবনে ফিরতে পারে কিংবা ফিরে পাবো রাহাত সহ ওর পরিবার। আমার যত্নে লালন করা স্বপ্নগুলো সত্যি হবে ভাবতেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে, তবে এটাই সত্যি। জ্বর গায়ে নিয়েই প্রস্তুত হতে হলো, মা – বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কিন্তু এবার আমার মধ্যে সংশয় নেই, ভয় নেই, আছে শুধু বিশ্বাস আর ভালোবাসা।
শাশুড়ি’মা হেসে বললেন,
– কেমন দিলাম বলোতো বৌমা?
– আমি তো ভেবেছিলাম রাহাতের সাথে আমার আর দেখা হবে না, আপনাদের কাউকেও আর দেখতে পাবোনা। সংসারের স্বপ্ন সত্যিকার ভাবে মানুষ একবারই দেখে তাই আমিও দেখেছিলাম কিন্তু যখন স্বপ্নটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল তখন সংসার স্বপ্নটাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। সবার কপালে সংসার থাকে না, স্বামী – শ্বশুরবাড়ি ও সবার কপালে থাকে না আমি নিয়তি মনে করে সেটাই মেনে নিয়েছিলাম।
– এই কথাগুলো বাদ দিলে হয়না? আমি কিন্তু উত্তর পেলাম না। সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম?
– খুব খারাপ না! এই না হলে আমার শাশুড়ি’মা!
রাহাত অভিমানের সুরে বলল,
– আমি যে প্রথমে ওকে এনেছিলাম তার কোন দাম নেই!
……
আমি, রাহাত আর শাশুড়ি’মা পাশাপাশি বসে আছি।সবার মুখেই হাসির রেখা স্পষ্ট। কথায় বলে না,
” সব ভালো তার,
শেষ ভালো যার।”
রাহাত কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আই লাভ ইউ ”
” সবার চাপে আবার আমাকে ভুলে যেওনা কিন্তু ”
#কামরুন নাহার স্মৃতি