যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-২১+২২

0
770

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২১.

পড়ন্ত বিকেলে তরী ক্লান্ত চোখ মেলে তাকাতেই প্রচন্ড দূর্বল অনুভব করে। ব্যথা উপশমের জন্য ইঞ্জেকশন দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। সেই তীব্র ব্যথার প্রভাব এখন কিছুটা কম অনুভব হলেও তার রেশ কিছুটা রয়ে গিয়েছে এখনো। তরী ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখে পার্থ বেডের পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে। তরীকে চোখ মেলতে দেখেই সে বসা থেকে উঠে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ এখন কেমন লাগছে? “

তরী জবাব দেয় না। সে একহাতে ভর দিয়ে উঠে বসে। ক্লান্ত গলায় বলে,

“ পানি। “

পার্থ সাথে সাথে একটা পানির বোতল খুলে এগিয়ে দেয় তার দিকে। কিছুটা পানি মুখে দিতেই তরীর আচমকা মনে পড়ে আইয়াদের কথা। সে তো সার্জারি চলাকালীন অবস্থায় সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলো। তাহলে আইয়াদের পরে কি হয়েছে? তরী সাথে সাথে পানির বোতল রেখে বেড থেকে নামতে উদ্যত হয়। পার্থ মৃদু চিন্তিত গলায় বলে,

“ কোথায় যাচ্ছেন? ইউ নিড রেস্ট। “

তরী চিন্তিত দৃষ্টি মেলে পার্থর দিকে তাকিয়ে শুধায়,

“ আমার পেশেন্ট… আই নিড টু সি হিম। “

বলেই তরী কোনোমতে তাড়াতাড়ি বেড থেকে নামে। তখনই কেবিনে প্রবেশ করে হুমায়ুন রশীদ এবং ডক্টর আনিকা। তরী তাদের দেখে প্রশ্ন করে,

“ পাপা? আইয়াদ? সার্জারি কেমন হয়েছে? “

হুমায়ুন রশীদ জবাব দেয় না। তিনি নীরব ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ডক্টর আনিকা অগ্নিদৃষ্টি মেলে তরীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আপনি ড্রাগস নিয়ে সার্জারি করার সাহস কোথা থেকে পেলেন ডক্টর তরী? “

তরী বিস্মিত হয়। অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ ড্রাগস মানে? “

“ বিশ্বাস না হলে নিজে রিপোর্টস চেক করুন নিজের। “

তরী হুমায়ুন রশীদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ পাপা? কি বলছে এসব? “

ডক্টর আনিকা রাগী সুরে বলে উঠে,

“ আপনার শরীরে যেসব রিয়্যাকশন হচ্ছিলো সেসব ড্রাগস নেওয়ার ফলে হয়েছে। “

তরীর মাথার উপর যেন বজ্রপাত হয়। সে বলে,

“ আমি কোনো ড্রাগস নেই নি। আমি কেন ড্রাগস নিবো? “

“ আপনি কেন ড্রাগস নিবেন তা আমরা জানিনা ডক্টর তরী। কিন্তু আপনার ভুলের কারণে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ইউ কিলড এ চাইল্ড। অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত সকলে আপনার এই ভুলের সাক্ষী। “

তরী সাথে সাথে কেদে দেয়। সে কান্না জর্জরিত গলায় বলে,

“ আইয়াদ ইজ ডেড? “

ডক্টর আনিকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“ থ্যাংকস টু ইউ। “

তরী হুমায়ুন রশীদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে বলে,

“ পাপা ট্রাস্ট মি আমি ড্রাগস নেই নি। আমি কোনো ভুল করি নি। বিশ্বাস করো। “

ডক্টর আনিকা পাশ থেকে বলে উঠে,

“ স্যার? নিজের মেয়ে আর নিজের হসপিটাল দেখে কি এখন ডক্টর তরীকে ছাড় দিয়ে দিবেন? একটা পেশেন্টের লাইফের কি কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে? “

হুমায়ুন রশীদ হেরে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আই ট্রাস্ট ইউ। আমি জানি তুমি কখনোই ড্রাগস নিতে পারো না। কিন্তু যেই মুহুর্তে তোমার মনে হয়েছে যে ইউ আর ফিলিং নট গুড সেই মুহুর্তে তুমি সার্জারি অন্য কারো হাতে হ্যান্ডভার করো নি কেন? “

এতক্ষণের কথায় তরী যতটা না আঘাত পেয়েছে তার থেকে বেশি যন্ত্রণা এই মুহুর্তে অনুভব করছে সে। ডক্টর আনিকা বলে উঠে,

“ বোর্ড মিটিং ডাকা হয়েছে। ইউ হ্যাভ টু জয়েন আস ডক্টর তরী। “

তরী মূর্তির ন্যায় তার পাপার দিকে তাকিয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদ বলে,

“ চলো তরী। “

কথাটা বলেই উনি বেরিয়ে যায়। উনার পিছুপিছু ডক্টর আনিকাও বেরিয়ে যায়। তরী নিশ্চুপ ভঙ্গিতে মাথা নত করে বেরিয়ে যেতে নিলে পিছন থেকে হাতে টান অনুভব করে। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে পার্থ তার একহাত ধরে রেখেছে। পার্থ শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ আই ট্রাস্ট ইউ। নিজের মাথা নত করবেন না। “

তরী ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের হাত আলতো করে ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে।

__________

এক ঘন্টার থেকেও দীর্ঘ সময়ের বোর্ড মিটিংয়ে সকলেই তরীর বিপক্ষে নিজেদের স্টেটমেন্ট দেয়। সবার মতেই তরীর এই ভুল কোনো ভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। তরী নীরব দর্শকের ন্যায় মাথা নত করে সবার কথা শুনে। সর্বদা নিজের জন্য স্ট্যান্ড নেওয়া তরী এইবার নিজের সাফাইয়ে একটা বাক্যও উচ্চারণ করে না। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই তরীর সামনে একটা লিগ্যাল পেপার এনে রাখে একজন ডক্টর। তরীর অনুভূতি যেন ভোতা হয়ে গিয়েছে। সে চুপচাপ সেই পেপারের দিকে তাকিয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদ নিজের চোখের সামনে এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছে না। তবুও উনি নিজেকে শক্ত করে। নিজের ব্লেজারের পকেট হতে একটা কলম বের করে তা তরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ সব ভুলের ক্ষমা আছে, কিন্তু একজন ডক্টরের ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। ডক্টরস আর নট এলাউড টু ডু এনি মিস্টেক। ইউর মেডিক্যাল লাইসেন্স ইজ টার্মিনিটেড। ইউ আর নট এ ডক্টর এনিমোর। “

শেষের দিকে হুমায়ুন রশীদের গলা ধরে আসে। তিনি একটা ঢোক গিয়ে আবার বলে উঠে,

“ সাইন দ্যা পেপারস। “

তরী মাথা তুলে তাকায় না। সে নিঃশব্দে কলমটা নিয়ে পেপারের উপর মৃদু ঝুকে সাইন করার উদ্দেশ্যে। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে নিজের সম্পূর্ণ জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম। শত নির্ঘুম রাত জেগে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নিজের স্বপ্ন পূরণ করার পর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে যেরকম অনুভব হয়, তার সেরকম অনুভব হচ্ছে। তরীর নীরব অশ্রু টপটপ করে পড়ে কাগজ গুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে। আরেকজন বোর্ড মেম্বার কঠিন স্বরে বলে উঠে,

“ দ্রুত সাইন করুন। “

তরী কাঁপা হাতে নিজের এতদিনের পরিচয় নিঃশেষ হওয়ার পত্রে সিগনেচার করে। ডক্টর আনিকা কাঠকাঠ গলায় বলে,

“ যাওয়ার আগে পেশেন্টের ফ্যামিলি মেম্বারদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবেন। ইউ আর লাকি যে উনারা আপনার বিরুদ্ধে কোনো কেস ফাইল করে নি। “

তরী মাথা নত করেই বেরিয়ে যেতে নিলে ডক্টর আনিকা আবার বলে উঠে,

“ আপনার এপ্রোন এবং স্টেথোস্কোপটা রেখে যান। ইউ ডোন্ট নিড দ্যাট এনিমোর। “

তরী নিজের গায়ে থাকা এপ্রোনের একটা কোণা শক্ত হাতে চেপে ধরে। যেন কেউ তার গা থেকে এই এপ্রোন কেড়ে নিতে পারবে না। অন্য হাতে সে নিজের হাতে থাকা স্টেথোস্কোপটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রয়। ডক্টর সীমা এগিয়ে এসে তরীর হাত থেকে স্টেথোস্কোপটা নিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠে,

“ এই পোশাক আর এইসব সরঞ্জাম আমরা জীবন বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করি। আপনার কাছে এসব শোভা পাচ্ছে না। “

তরী দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না দমিয়ে রেখে গায়ের এপ্রোন খুলে এক দৌড়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। দৌড়াতে দৌড়াতে থার্ড ফ্লোরের শেষ মাথায় এসে সে পার্থর মুখোমুখি হয়। পার্থ কোনো প্রশ্ন করার আগেই তরী বলে,

“ বাসায় ফিরবো আমি। নিয়ে চলুন প্লিজ। “

__________

সন্ধ্যা বেলায় আজ চৌধুরী নিবাসে ছোট খাটো আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছেন সকলে। সাদিকা বেগমের আবদারে শোভন আজ মধুকে নিয়ে বাসায় এসেছে। আফজাল সাহেবও বাসায় উপস্থিত আছেন। সকলেই সন্ধ্যার নাস্তার পাশাপাশি খোশ গল্পে ব্যস্ত। আফজাল সাহেব ইতিমধ্যে তার হবু ছোট ছেলে বউয়ের গুণে মুগ্ধ। মেয়েটা বেশ হাসিখুশি এবং খোলা মনের। সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে। এই সন্ধ্যার নাস্তা গুলোও মেয়েটা নিজ হাতে বানিয়েছে, যার স্বাদ দুর্দান্ত।

সাদিকা বেগম মধুর সাথে গল্পের মাঝেই শোভনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ এই শোভন। তোর দাদা আর ভাবীকে ফোন দে। কখন ফিরবে জিজ্ঞেস কর। মেয়েটা আজকে এতো সকাল সকাল বেরিয়ে গেলো। এতো করে বললাম নাস্তাও করে যায় নি। সারাদিন খেয়েছে কিনা কে জানে। এতো বার ফোন দিলাম ফোন অফ আসছে। “

“ দিচ্ছি আম্মা। “

বলেই শোভন আগে নিজের ভাবীর নাম্বারে ডায়াল করে। কিন্তু ফোন সুইচড অফ আসছে। সে পার্থর নাম্বার ডায়াল করতে নিবে তখনই বাসার কলিংবেল বেজে উঠে। জমিলা খালা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তরী আর পার্থ ভিতরে প্রবেশ করতেই সাদিকা বেগম হেসে বলে উঠে,

“ আম্মু? সারাদিন তোমাকে ফোন দিচ্ছি নাম্বার বন্ধ আসছিলো কেন? “

তরী কারো দিকে ফিরে তাকায় না। এক মুহুর্ত দাঁড়ায়ও না। সে নীরব পায়ে হেঁটে উপরে চলে যায়। তার এহেন আচরণে সকলে বেশ অবাক হয়। আফজাল সাহেব পার্থকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,

“ ওর কি হয়েছে? “

পার্থ সিঁড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। তরীর মেডিক্যাল লাইসেন্স টার্মিনেশনের ব্যাপারটা তার অজানা নয়। সে জমিলা খালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ খালা ভাত আছে? “

“ না। “

“ তাহলে একটু ভাত বসান। আর তরকারি গরম করে একটু বেড়ে দিন। “

জমিলা খালা রান্নাঘরে চলে যায়। আফজাল সাহেব আবার প্রশ্ন করেন,

“ এবার বলো কি হয়েছে? “

__________

ভাতের প্লেট হাতে বেডরুমে প্রবেশ করতেই পার্থ দেখে চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। সে অন্ধকারেই হাতড়ে পরিচিত সুইচবোর্ড হতে সুইচ চেপে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। চারিদিকে চোখ বুলাতেই দেখতে পায় তরী রুমের এককোণে ফ্লোরে হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে। পার্থ এগিয়ে গিয়ে তরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। প্লেটটা একপাশে রেখে সে একহাত বাড়িয়ে স্ত্রীর মাথার উপর রেখে নরম সুরে ডাকে,

“ তরী? “

তরী উত্তর দেয় না। পার্থ আবারও ডেকে বলে,

“ সকালে নাস্তা করে যান নি। সারাদিন না খাওয়া। ভাত খেয়ে নিন। “

তরী মাথা তুলে তাকায়। পার্থ নিজের স্ত্রীর লাল টকটকে চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাষা হারায়। তরী থমথমে গলায় বলে,

“ খাবো না। চলে যান। “

পার্থ একদন্ড নিজের শুকনো গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলে উঠে,

“ প্লিজ তরী। “

তরী আচমকা একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়ে বসে। সে তার পাশে রাখে প্লেট তুলে দূরে ছুড়ে ফেলে বলে উঠে,

“ চলে যেতে বলেছি না? সমস্যা কি? যাচ্ছেন না কেন? “

কথাটা বলতে বলতে তরী আবার হাতের কাছের আরেকটা জিনিস তুলে নিতে নেয় আছাড় মারার জন্য। পার্থ সেই সুযোগ না দিয়ে তরীর দুই হাত শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে বলে উঠে,

“ নিজেকে সামলান। “

তরীর সারাদিনের চেপে রাখা কান্না তার সবথেকে অপছন্দের মানুষের সামনেই বাধ ভাঙলো। সে হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে দু’হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে বলে উঠলো,

“ আমি বাচ্চাটাকে মারি নি। আমি ড্রাগস নেই নি। “

অত:পর আরো কিছু বললো তরী যা পার্থর বোধগম্য হলো না। সে কেবল এগিয়ে একহাতে তরীকে আগলে ধরলো। আপন দুঃখে হয়তো এই মুহুর্তে তরীর মাথা কাজ করছে না। তাই তো কাঁদতে কাঁদতে সে তার সামনে বসে থাকা মানুষটার বুকে মাথা ঠেকায়। পার্থ নিজের দ্বিধা দন্ড কাটিয়ে এক হাত তরীর মাথায় রাখে। তরী এবার পার্থর পাঞ্জাবির বুকের অংশ খামচে ধরে অশ্রুসিক্ত স্বরে বলে উঠে,

“ আমার সম্পূর্ণ ক্যারিয়ার শেষ। আমার ১২ বছরের পরিশ্রম সব শেষ। আমি আর ডক্টর নই। কি করবো আমি? এই খুনের দায় নিয়ে কিভাবে বাঁচবো আমি? কিভাবে সবাইকে বিশ্বাস করাবো আমি খুনী নই? “

পার্থ নরম গলায় বলে,

“ আমি আছি তরী। আমি জানি আপনার কোনো দোষ নেই। “

তরী হঠাৎ হিংস্র হয়ে ফুসে উঠে। সে পার্থর থেকে সরে গিয়ে তার দুই হাত দ্বারা পার্থর বলিষ্ঠ বুকে ধাক্কা দেয়। পার্থ কিছুটা পিছনে সড়ে যেতেই তরী ফোস ফোস করে বলে উঠে,

“ এসব আপনি করেছেন তাই না? আমার কারণে আপনার নিজের ইলেকশন প্রত্যাহার করতে হয়েছে। সেটার প্রতিশোধ নিচ্ছেন? “

পার্থ অবিশ্বাস্যকর সুরে প্রশ্ন করে,

“ আমি কেন আপনার উপর প্রতিশোধ নিবো? “

“ কারণ আপনি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো কাল নেই। আপনি আমার জীবনের সবথেকে বড় কাল। এক ইলেকশনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আপনি আমার থেকে আমার অস্তিত্বের একটা অংশ কেড়ে নিয়েছেন। আমার কষ্ট করে উপার্জিত পরিচয় ছিনিয়ে নিয়ে কেমন অনুভব করছেন? “

পার্থ গরম চোখে তাকিয়ে বলে,

“ মুখে লাগাম টানুন। “

তরী রেগে পার্থর দিকে ঝুকে তার কলার টেনে বলে,

“ আপনি নিজের কর্মকান্ডে লাগাম টানুন। আর কতো মানুষের জীবন নষ্ট করবেন? “

পার্থর এইবার রাগ উঠে। সে তরীর দুই বাহু চেপে ধরে বলে উঠে,

“ আমি এক মুহুর্তের জন্যও আপনার কোনো ধরনের ক্ষতি করার কথা চিন্তা করি নি। “

“ আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করে আমার সবথেকে বড় ক্ষতি করেও বলছেন আমার ক্ষতি করার চিন্তা করেন নি? “

পার্থ এই পর্যায়ে এসে দমে যায়। তরী ভুল তো আর বলে নি। সত্যিই তো সে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছে। তরী ক্লান্ত ভঙ্গিতে আবারও দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। দুই হাঁটু ভাজ করে বুকের কাছে এনে তাতে মুখ গুজে রয়। পার্থ নীরবে তরীর পাশে এসে দেয়ালের সাথে মাথা হেলান দিয়ে বসে।

রাত গভীর হয়। পার্থ একই ভঙ্গিতে বসে রয়। আচমকা নিজের কাধে মৃদু ভার অনুভব করে। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে তরী তার কাধে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার তপ্ত নিঃশ্বাস এবার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু পার্থর পাঞ্জাবির কাপড় ভেদ করে তার চামড়া স্পর্শ করে। পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার দেয়ালে নিজের মাথা ঠেকায়। ক্লান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ আপনাকে কোনো অবস্থাতেই আমি ডিভোর্স দিবো না তরী। কিন্তু আপনার এলোমেলো জীবন সাজিয়ে দেওয়ার কথা দিচ্ছি। কথার বরখেলাপ হলে নিজেকে আপনার হাতে তুলে দিবো। ব্যর্থ আসামীকে নাহয় তখন সাজা শুনিয়েন। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২২.

হুমায়ুন রশীদের মুখ হতে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে তূর্যর রাগে শরীর কাঁপতে থাকে। সে ক্ষিপ্ত সুরে বলে,

“ তুমি আপির সাথে এরকম কি করে হতে দিলে পাপা? আপিকে ফাঁসানো হচ্ছে। আপি ড্রাগস কেন নিতে যাবে? “

তূর্যর রাগান্বিত রূপ দেখে পৃথা আর কিছু বলার সাহস পায় না। সে নীরব ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মনে মনে তারও বিশ্বাস বড় ভাবীকে কোনো ভাবে ফাঁসানো হচ্ছে। হুমায়ুন রশীদ বলে,

“ তরী নিজ থেকে ড্রাগস নিবে না কখনো সেটা আমিও জানি। কিন্তু এখানে তরী ইচ্ছাকৃতভাবে ড্রাগস নিয়েছে কিনা সেটা মূখ্য নয়। মূখ্য হলো তরীর দায়িত্বে থাকা একজন পেশেন্ট মারা গিয়েছে। তরী চাইলেই নিজের সার্জারি অন্যের হাতে হ্যান্ডভার করতে পারতো। হসপিটালে আরও কার্ডিওলজিস্ট এভেইলেবেল ছিলো। “

তূর্য অবিশ্বাস্যকর সুরে বলে,

“ তুমি এই কথা বলছো পাপা? তোমার মনে হয় আপি ইচ্ছে করে সার্জারি অন্য কাউকে হ্যান্ডভার করে নি? আপি কি এতো বোকা যে নিজের ক্যারিয়ার রিস্কে ফেলে এরকম এক বোকামি করবে? “

হুমায়ুন রশীদের প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে। তিনি সামান্য কপাল কুচকে বলে উঠেন,

“ আমি শুধু তরীর পাপা নই। তরীর জায়গায় অন্য যেকোনো ডক্টর হলেও আমি একিই ডিসিশন নিতাম। নিজের মেয়ে দেখে ওর প্রতি নরম হলে সম্পূর্ণ বোর্ড কমিটি আমার উপর প্রশ্ন তুলতো। “

পৃথা নীরবে লিভিং রুম ছেড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। হুমায়ুন রশীদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ বাচ্চাটা সাদ এবং আয়রার ছেলে ছিলো। “

তূর্য চোখ বড় বড় করে তাকায় হুমায়ুন রশীদের দিকে। বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ সিরিয়াসলি? “

“ তাহলে তোমার কি মনে হয় আমি এই মুহুর্তে মজা করছি? “

তূর্য আর কিছু বলবে তার আগেই পৃথা এক কাপ কফি হাতে লিভিং রুমে প্রবেশ করে। পৃথাকে দেখে তূর্য চুপ হয়ে যায়। পৃথা এগিয়ে হুমায়ুন রশীদের দিকে কফির মগটা দিয়ে বলে,

“ পাপা আপনার জন্য। মাথা কম ভার লাগবে এটা খেলে। “

হুমায়ুন রশীদের মন ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। মেয়েটা দু’দিন হয়েছে না ঘরে বউ হয়ে এসেছে, অথচ কি সুন্দর সব সামলে নিয়েছে একহাতে। তার নিজের ছেলে মেয়েও সবসময় পড়াশোনা এবং চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। কেবল রাতের খাবারটুকু খাওয়ার সময় তারা একত্রে বসতো। কিন্তু এই মেয়েটা তার নিজের মেয়ে না হয়েও আলাদা করে হুমায়ুন রশীদকে সময় দেয়। হুমায়ুন সাহেব মলিন হেসে কফির মগটা নিয়ে বলে,

“ থ্যাঙ্কিউ আম্মু। “

পৃথা জবাবে সামান্য হাসে কেবল। তূর্য উঠে নিজের রুমে চলে আসে। নিজের ফোন বের করে তরীর নাম্বারে ম্যাসেজ দেয়,

“ সব ঠিক হয়ে যাবে আপি। আল্লাহ ভরসা। ভেঙে পরিস না। “

__________

সকাল সকাল ফোনের তীক্ষ্ণ এলার্মের শব্দে তরীর ঘুম ভেঙে যায়। সে হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে এলার্ম বন্ধ করে। চোখ ডলতে ডলতে আচমকা তার মনে পড়ে রাতে সে ফ্লোরে বসে ছিলো। তাহলে বিছানায় কিভাবে পৌঁছালো সে? পার্থ কি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গিয়েছে? কথাটা মাথায় আসতেই তরীর রাগ হয়। এই লোকের সাহায্য এবং সিমপ্যাথি দুটোই তার কাছে অপছন্দের।

তরী বিছানা ছেড়ে নামতে নিলেই তার মনে পড়ে যায় এইসময় প্রতিদিন সে হসপিটাল যাওয়ার জন্য রেডি হতো। কিন্তু আজ? আজ কি করবে সে? মুহুর্তেই তার চেহারায় মলিনতা ফুটে উঠে। পার্থ সেই মুহুর্তে বেডরুমে প্রবেশ করে। দুজনে দৃষ্টি মিলন হতেই পার্থ নিঃশব্দে ওয়াশরুমে চলে যায়। তরী একই ভঙ্গিতে বসে রয়। মনে মনে ভাবছে নিচে কিভাবে যাবে সে? গতকাল কেমন বেয়াদবের মতো কারো কথার জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে উপরে চলে এসেছিলো সে। পার্থর সাথে তার বিয়ের মাধ্যমে এই ঘর এবং এই ঘরের মানুষগুলোর সাথেও সে একটা সম্পর্কে বাঁধা পড়েছে। এই পর্যন্ত তরী এই বাড়ির বড় বউ হওয়া সত্ত্বেও ঘরের কোনো কাজে হাত দেয় নি। তা নিয়ে ঘরের কারো কোনো অভিযোগ নেই। উল্টো তার শাশুড়ি বেশ আদরের সাথেই সব পরিস্থিতিতে তাকে আগলে রেখেছে। নিজের দুঃখ কষ্টে নিমজ্জিত হয়ে এই মানুষ গুলোকে অবহেলা করা মোটেও সমীচীন নয়।

__________

নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত জমিলা খালা। সাদিকা বেগম পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করে যাচ্ছেন। সেই মুহুর্তে রান্নাঘরে তরীর আগমন ঘটে। সে শান্ত স্বরে জমিলা খালাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ খালা, আমি বাকিটা দেখে নিবো। আপনি টেবিলে প্লেট গুলো সাজিয়ে ফেলুন। “

জমিলা বেগম কিছু বলতে নিলেই সাদিকা বেগম ইশারা করে তরী যা বলছে তা করতে। জমিলা খালা তাই চুপচাপ পরিষ্কার প্লেট গুলো নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সাদিকা বেগম মমতা নিয়ে পুত্রবধূকে দেখছে। মেয়েটা কষ্টে আছে তা উনি জানেন। কিন্তু কষ্টটা কতটুকু গভীর সেই সম্পর্কে উনার ধারণা নেই। হয়তো ঘরের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে সেই কষ্টটা ভুলে থাকতে চাইছে তরী। তাই সাদিকা বেগমও আর বাঁধা দেন না।

নাস্তার টেবিলে বসে আছেন চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা। পার্থ এখনো নিচে নামে নি। তরী গরম গরম রুটির প্লেট হাতে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করে সকলকে খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টেবিলে বসে থাকা আফজাল সাহেব, সাদিকা বেগম এবং শোভন নীরব দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। পার্থও তখনো নিচে নেমে আসে। আফজাল সাহেবের পাশে নিজের চেয়ারটা টেনে বসতে নিলেই আফজাল সাহেব বলে উঠে,

“ তুমি অন্য চেয়ারে বসো। “

পার্থসহ সকলে ভ্রু কুচকে তাকায়। পার্থ বলে,

“ আমি তো সবসময় এখানেই বসি। “

“ আজ থেকে বসবে না। “

বলেই আফজাল সাহেব তরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ তরী মা। তুমি এসে বসো এখানে। দাঁড়িয়ে আছো কেন? “

তরী হকচকিয়ে যায়। নিজেকে সামলে বলে,

“ আপনারা নাস্তা করুন আব্বা। আমি পরে বসছি। “

আফজাল সাহেব এবার আরেকটু আদর মিশিয়ে বলে,

“ মেয়ে না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে বাপের গলা দিয়ে খাবার নামবে কখনো? “

শোভন পাশ থেকে বলে উঠে,

“ বসে পড়ুন ভাবী। কাল রাতে আপনি খান নি দেখে আব্বাও আর খায় নি। আব্বা খায় নি দেখে আম্মাও খায় নি। দাদাও রাতের খাবার খায় নি। আর সবাই যেখানে খায় নি সেখানে আমি আর কিভাবে রাজাকারের মতো খাই বলুন? “

তরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। পার্থ তরীকে এক পলক দেখে নিয়ে নীরবে নিজের চেয়ারটা ছেড়ে দেয়। তার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। তরী মাথা নিচু করে গিয়ে নিজের শশুড়ের পাশে বসে। শোভন উঠে তরীর প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে উদ্যত হয়। হাস্যজ্বল মুখে বলে,

“ ভাবী আজ আপনার দেবর আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবে। কি কি দিবো বলুন? “

সাদিকা বেগম বলে উঠে,

“ তরী সকাল সকাল এসব খায় না। ওকে রুটি সবজি এসব দিস না। “

শোভন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ হ্যাঁ? ভাবী তাহলে কি খায়? “

সাদিকা বেগম জমিলাকে ডাকতেই জমিলা খালা একটা প্লেট আর মগ হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্লেট আর মগ তরীর সামনে রাখতেই তরী দেখে সেখানে ফ্রেঞ্চ টোস্ট, অমলেট আর কফি। তরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সকাল সকাল তরী সবসময় এসব খেয়েই অভ্যস্ত। আম্মা এসবও লক্ষ্য করেছে?

এতো আদর আর যত্ন দেখে তরী কিশোরীদের ন্যায় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। চোখ উপচে তার জল গড়িয়ে পড়ে। জমিলা খালা আঁতকে বলে উঠেন,

“ কি গো বড় বউ? কান্দতাসো ক্যান তুমি? “

আফজাল সাহেব নরম সুরে প্রশ্ন করে,

“ খাবার পছন্দ হয় নি মা? “

আবেগে বর্শভূত তরী আফজাল সাহেবকে একপাশ হতে জড়িয়ে ধরে। ছোটবেলা থেকেই কান্না পেলে সে সবসময় নিজের পাপাকে জড়িয়ে ধরে কাদতো। সেই অভ্যাস থেকেই সে আফজাল সাহেবকে পিতা রূপে জড়িয়ে ধরে। আফজাল সাহেবসহ সকলেই অবাক হয়।

আফজাল সাহেব আগে কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পড়েন নি। উনার নিজের ছেলে মেয়েদের সাথে সম্পর্কটাও উনার সেই পর্যায়ে কখনো ছিলো না যে চাইলেই তারা নিরদ্বিধায় উনাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে। নিজের মনের দ্বিধাকে সরিয়ে উনি স্নেহ নিয়ে তরীর মাথায় হাত রেখে বলে,

“ আরে আরে বোকা মেয়ে। কাদে না। “

তরী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার মাঝে বলে উঠে,

“ আমাকে মাফ করবেন আব্বা। আমার কারণে আপনাদের সম্মান নষ্ট হচ্ছে। “

আফজাল সাহেব নরম গলায় বলে,

“ আমি জানি তুমি কখনো আমাদের সম্মান নষ্ট হওয়ার মতো কিছু করবে না। আমি যতদিন তোমার মাথার উপর আছি তুমি কিছু নিয়ে চিন্তা করো না মা। আল্লাহ আছেন উপরে। উনি ইনসাফ করবেন অবশ্যই। তুমি হাসিখুশি থাকো শুধু। “

পার্থ নীরবে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখে। অত:পর সবার চোখের আড়ালেই সে সামান্য হাসে। তার আব্বা ছেলেদের সাথে যতটা কঠোর থাকেন মেয়েদের বেলায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত। যাক! এই পরিস্থিতিতেও তরীকে নিয়ে তার মোটেও চিন্তা হচ্ছে না। তার দ্বারা চব্বিশ ঘণ্টা তরীর পাশে থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবার ঠিকই তরীর কোনো অযত্ন করবে না তা নিয়ে সে নিশ্চিত।

__________

পার্টির কিছু সিনিয়র নেতার সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত পার্থ। তখনই তার সাইলেন্ট করা ফোনটা ভাইব্রেট করে বেজে উঠে। পার্থর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় টেবিলের উপর থাকা নিজের ফোনের স্ক্রিনে। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের মাঝে অন্য কেউ কল করলে পার্থ কখনোই রিসিভ করতো না। কিন্তু জহিরের নাম দেখে সে এক মুহুর্ত দেরি না করে ফোনটা রিসিভ করে।

“ জহির? কি হয়েছে? “

“ ভাই, ভাবী বাসা থেকে বের হইসে। একা একা গাড়ি ড্রাইভ করতেসে। আমি উনার পিছনেই গাড়িতে আছি। ফলো করতেসি। “

“ কোথায় যাচ্ছে ও? “

“ সেইটা তো জানিনা ভাই। মনে হইতেসে মিরপুরের দিকে যাইতেসে। “

“ আচ্ছা তুই ফলো কর। পৌঁছালে আমাকে এক্সাক্ট এড্রেস টেক্সট করে পাঠা। “

“ আচ্ছা ভাই। “

__________

মিরপুর ২ এ কাঙ্ক্ষিত বাসাটার সামনে এসে গাড়ি থামায় তরী। সাত তলা এই বিল্ডিংটায় এর আগেও বেশ কয়েকদিন এসেছিলো সে। কিন্তু তখন আর আজকের মধ্যে বিস্তার ফারাক। তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নেমে বাসার ভেতর প্রবেশ করে। দ্বিতীয় তলার ডান পাশের এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়াতেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তবুও সাহস সঞ্চয় করে সে কলিংবেল বাজায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মধ্য বয়স্ক নারী দরজা খুলে। তরীকে দেখতেই উনি চমকে যায়। শব্দ করে কাউকে ডাকতে ডাকতে ভিতরে চলে যায় উনি। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই সাদ এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। চেহারা তার বিধ্বস্ত হয়ে আছে। তরীকে দেখতেই সে বলে,

“ তুমি এখানে? “

“ ক্ষমা চাইতে এসেছি। “

সাদ কিছু বলবে তার আগেই আয়রা এসে দরজার সামনে উপস্থিত হয়। তরীকে দেখতেই সে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় তরীর দিকে তেড়ে যেতে নেয়। কিন্তু সাদ তাকে আটকে ফেলে। আয়রা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ কেন এসেছিস? এখন খুশি তুই? তোর প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। সাত বছর আগে আমি তোর থেকে তোর বাগদত্তা কেড়ে নিয়েছি, তাই তুইও সুযোগ বুঝে আমার থেকে আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছিস। খুনী তুই। “

আয়রার উচ্চ শব্দের দাপটে আশেপাশের এপার্টমেন্ট থেকে আরো মানুষ বেরিয়ে আসে। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তরী নরম গলায় বলে,

“ ট্রাস্ট মি আয়রা আমি ইচ্ছে করে কিছু করি নি। তুই তো ছোটবেলা থেকে আমাকে চিনিস। আমি কখনো কোনো বাচ্চার ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারি না। “

আয়রা সাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তরীর দিকে এগিয়ে যায়। তরী আয়রাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। আয়রা ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে তরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ তুই পারিস। তুই করে দেখিয়েছিস। এসব কিছু তুই হিংসা থেকে করেছিস। আমার বাচ্চাকে দেখে তোর হিংসা হয়েছে। তুই কিভাবে বুঝবি একটা বাচ্চার মর্ম? যে নিজে জীবনে বাচ্চার মুখ দেখতে পারবে না সে কিভাবে বাচ্চার মর্ম বুঝবে? তুই ইচ্ছে করে আমার ছেলেকে মেরেছিস। “

কথাটুকু বলেই আয়রা তরীকে ধাক্কা দেয়। সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় ধাক্কা খেয়ে সামলাতে না পেরে তরী সিড়ি থেকে পড়ে যায়। মুহুর্তেই পরিস্থিতি উত্তেজনামূলক রূপ ধারণ করে। পার্থ তখন কেবল একতোলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলো। এই দৃশ্য দেখে সে সাথে সাথে দৌড়ে সিড়ির নিচে পড়ে থাকা তরীর কাছে এগিয়ে যায়। সাদও ততক্ষণে এগিয়ে এসে আয়রাকে ধরে বাসার ভেতর নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

পার্থ তরীর কাছে আসতেই দেখে তরী নিজেই একা একা উঠে বসছে। পার্থ উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে,

“ ব্যথা পেয়েছেন? “

প্রশ্নটা করেই পার্থ ক্ষিপ্ত দৃষ্টি মেলে উপরে তাকায়। গর্জে উঠে,

“ কার বুকে এতো বড় পাঠা হয়ে গিয়েছে যে আমার বউয়ের গায়ে হাত দেয়? “

বলেই পার্থ সাদের এপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। কিন্তু তরী তার একহাত ধরে বাঁধা দেয়। চোখের ইশারায় মানা করে কোনো ঝামেলা করতে। পার্থর রাগ ঠান্ডা হয় না। কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে সবার আগ্রহী দৃষ্টি দেখে এই মুহুর্তে এখান থেকে প্রস্থান করাই উত্তম মনে করে সে। তরীর দিকে নিজের একহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

“ চলুন। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে