যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৭.
নিঃশ্বাসের উঠানামার গতি ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসছে। আতংকিত চোখ জোড়াও এখন বেশ ক্লান্ত। মনের ভীতি বেশ ভালো করেই কাবু করে ফেলেছে তরীকে। তার প্রভাব তার শারীরিক অবস্থায়ও পরছে। এতক্ষণ যথাসাধ্য নিজের মানসিক অবস্থা শক্ত রাখার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু এখন আর কোনো বল পাচ্ছে না সে। দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা অসাড় চিত্ত ধীরে ধীরে ভর ছেড়ে হেলে পড়ে ফ্লোরের দিকে। মনে মনে তরী স্থির করে সে আর জেগে থাকবে না। এতো ভীতি নিয়ে জেগে থাকাটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। তার থেকে উত্তম ঘুমিয়ে পড়া। অন্তত এই আতংকিত অনুভূতি থেকে ক্ষণিকের মুক্তি তো মিলবে তার।
তরীর ক্লান্ত চোখ জোড়া যখন প্রায় বুজে আসছে তখনই অন্ধকার রুমের দরজা শব্দ করে খুলে যায়। এক গুচ্ছ আলোক রশ্মি রুমের ভেতর প্রবেশ করে। বাহিরে তখন তুমুল বর্ষণ এবং ভয়ংকর বজ্রপাত। সেই আলোক রশ্মি চিড়ে একটা লম্বা চওড়া অবয়ব রুমে প্রবেশ করে। ভেজা শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হয় না তরীর। কিন্তু আপাতত কিছু বলার মতো শক্তি নেই তার গলায়। সে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে সামনের মানুষটার বিধ্বস্ত চোখ দুটির দিকে চেয়ে রয়।
পার্থর নিঃশ্বাস যেন গলার মধ্যে আটকে গেছে। ফ্লোরে অর্ধ চেতনায় পড়ে থাকা নিজের অর্ধাঙ্গিনীর এহেন অবস্থা দেখে মনে মনে রুবেলকে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। যত এক পা এক পা করে এগোচ্ছে, তত নিজের নিঃশ্বাসের প্রখরতার বুকের পিষ্টনে আঘাত হানা অনুভব করছে সে। তরীর কাছাকাছি এসে সে হাঁটু গেড়ে বসে তার সামনে। তরী এক দন্ড পার্থকে দেখে নিয়ে নিজের এক কম্পিত হাত বাড়িয়ে পার্থর হাত ধরে। পার্থর যেনো এতক্ষণে হুশ ফিরে। সে অশান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“ আপনি ঠিক আছেন। “
এতক্ষণে নিজেকে সামলে নেওয়া তরীর সাহসের দূর্গ ভেঙে যায় এই প্রশ্ন। তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে। পার্থ একবার তরীর মুখশ্রী দেখে নিয়ে পুরো রুমের দিকে নিজের দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। এক পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের পুরনো স্টোর রুম এটা। রুমের চারিদিকে বেশ অপ্রয়োজনীয় পুরনো জিনিসপত্র, মাকড়সার জাল এবং ইদুর, ছাড়পোকা দিয়ে ঠাসা। এই দৃশ্য দেখে পার্থ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে তরীকে তুলে নেয়। এই জায়গায় সে আর এক মুহুর্ত তরীকে রাখতে চায় না। দরজার বাহিরেই তার দলের ছেলে পেলেরা অপেক্ষা করছিলো। পার্থ দরজা দিয়ে বের হয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,
“ যে যার বাসায় ফিরে যা। “
ছোট্ট বাক্যটা যেন আদেশ সরূপ মেনে নিলো। পার্থ নিজের মতো হেঁটে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গেলো। গাড়ি কিছুটা দূরে পার্ক করায় এতটুকু রাস্তা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অতিক্রম করতে হয় তার। তরী নির্বিকার ভঙ্গিতে পুরোটা সময় পার্থকে দেখছিলো। পার্থর ঘন চুল এবং দাঁড়ি বেয়ে পড়া পানি দেখতে দেখতে আচমকা সে উপলব্ধি করলো এই মুহুর্তে তার আর ভয় অনুভব হচ্ছে না। উল্টো বেশ আয়েশী ভাবে চোখ বুজে আসছে। নিজের মনকে সে বুঝ দেয় এইরাত কেবল দুঃস্বপ্ন। আগামীকাল সকালে ঘুম ভাঙতেই সে দেখবে সব আগের মতো আছে।
__________
চৌধুরী নিবাসের বয়জৈষ্ঠ দুই সদস্যের চোখে এখনো ঘুম নেই। ঘড়ির কাঁটা রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই। ঘরের বড় পুত্রবধূ বিয়ের প্রথম দিনই নিখোঁজ। তাকে খুঁজতে গিয়ে বাড়ির দুই ছেলেও লাপাত্তা। সাদিকা বেগম তজবি হাতে চিন্তিত মুখে বসে আছেন। আফজাল সাহেবের চোখে মুখেও চিন্তার ছাপ। উনি হতাশ গলায় বলে উঠেন,
“ মন দিয়ে দোয়া করো পার্থর আম্মা। মেয়েটা ঘরের বউ হয়ে এলো চব্বিশ ঘণ্টা হয় নি তার মধ্যেই এতো বড় এক বিপদ নেমে আসলো। বেয়াই যে খবরটা শুনলে কি করবে তাই ভাবছি। উনার বাসায় আমার মেয়ের ঠিকই কোনো অযত্ন হচ্ছে না, অথচ উনার মেয়ের নিরাপত্তাটুকুও আমরা ঠিকঠাক নিশ্চিত করতে পারলাম না। “
সাদিকা বেগম স্বামীর কথা শুনে আরো চিন্তায় ডুব দেয়। তার ছেলের তো শত্রুর অভাব নেই। এতদিন চব্বিশ ঘণ্টা নিজের ছেলের চিন্তা তাকে কুড়ে খেতো। এখন ছেলের বউয়ের চিন্তাও সাথে যোগ হলো। উনার চিন্তার মাঝেই বাসার বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে আসে। লিভিং রুমের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো জমিলা খালা। হর্ণের শব্দ শুনতে পেয়েই উনি দৌঁড়ে দরজা খুলতে চলে যায়। সাদিকা বেগম এবং আফজাল সাহেবও চিন্তিত ভঙ্গিতে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই পার্থর কোলে অবচেতন তরীকে দেখে জমিলা খালা আর্তনাদ করে উঠে,
“ ও আল্লাহ গো! বড় বউর কি হইসে? “
পার্থ এবং তরী দুজনেই ভিজে জবজবে অবস্থায় আছে। সাদিকা বেগম কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই পার্থ সিড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে উঠে,
“ আম্মা আমার সাথে চলো। “
সাদিকা বেগম আর প্রশ্ন করে না। উনি ছেলের পিছু পিছু উপরের দিকে দৌড় লাগায়। আফজাল সাহেবও আপাতত আর কিছু ঘাটে না। পার্থ যে মেয়েটাকে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে এটার জন্যই মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় তিনি। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় ছোট ছেলেকে ফোন করে খবরটা জানাতে। জমিলা খালাও রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে এগিয়ে যায়। বৃষ্টির পানিতে ভেজা পার্থর কথা চিন্তা করে চুলোয় চায়ের জন্য পানি বসায়।
__________
বিছানার এককোণে কম্বল মুড়ি দিয়ে জোড়োসড় হয়ে শুয়ে আছে তরী। তার মাথার কাছেই শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে পার্থ। সাদিকা বেগম এসে তখন তরীর গায়ের শাড়ি বদলে একটা থ্রি পিস পড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তরীর মাথার চুল ভেজা ছিলো। সেই চুল শুকানোর জন্যই হেয়ার ড্রায়ার হাতে তার মাথার কাছে বসে আছে পার্থ। মোটামুটি চুল শুকিয়ে আসতেই সে হেয়ার ড্রায়ারটা রেখে দেয়৷ মৃদু আলোকিত রুমটার বারান্দা হতে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ভেসে আসছে। পার্থ বিছানার হেড সাইটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে।
কিছুক্ষণ পরই নিজের রুমের দরজায় মৃদু কষাঘাতের শব্দ শুনতে পেয়ে সে চোখ মেলে তাকায়। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে জমিলা খালা দাঁড়িয়ে আছে। জমিলা খালা বেশ বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে উঠেন,
“ খালাম্মা খালু আপনারে নিচে ডাকসে। “
পার্থ চোখ বুজে একহাতে সামান্য ঘাড় ম্যাসাজ করে ফের জমিলা খালার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
“ আপনি আমি ফেরার আগ পর্যন্ত তরীর কাছে থাকুন। “
জমিলা খালা বিনাবাক্য ব্যয়ে পার্থর কথা মেনে নেয়। পার্থ নিচে নেমে যায় তার পরিবারের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে। শোভনও ইতিমধ্যে আফজাল সাহেবের কল পেয়ে বাসায় ফিরে এসেছে।
লিভিং রুমে উপস্থিত তিনটা মানুষের দৃষ্টিই আপাতত পার্থর উপর স্থির। আফজাল সাহেব সর্ব প্রথম প্রশ্ন করে,
“ সম্পূর্ণ ঘটনা কি? “
পার্থ কোনো ভনিতা ছাড়া জবাব দেয়,
“ আমার সাথে শত্রুতার জের ধরে রুবেল হোসাইন তরীকে হসপিটাল থেকে বাসায় ফেরার পথে কিডন্যাপ করেছিলো। “
সাদিকা বেগম সাথে সাথে আঁতকে উঠেন। আফজাল সাহেব বিচক্ষণ মানুষ। উনি বিচলিত হলেন না। বরং ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,
“ তুমি কিভাবে তরীকে খুঁজে পেলে? “
“ রুবেল নিজেই আমাকে এড্রেস দিয়েছে। “
আফজাল সাহেব ভ্রু কুচকে রইলেন। অত:পর সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
“ তরীর বিনিময়ে সে নিশ্চয়ই তোমার থেকে কিছু চেয়েছে? “
পার্থ এক দন্ড সময় নেয়। অত:পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,
“ নির্বাচন প্রত্যাহার ঘোষণা করেছি আমি। আগামীকাল আমার প্রত্যাহার পত্র জমা দিতে যাবো। “
শোভন এবং সাদিকা বেগম দুজনেই চমকে তাকায় পার্থর দিকে। যেন এই কথাটা তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। আফজাল সাহেব হতাশ গলায় বলে,
“ নির্বাচনের আগেই তবে হেরে গেলে। “
পার্থ এবার বেশ দৃঢ় গলায় বলে উঠে,
“ নির্বাচন আসবে যাবে। কিন্তু যদি আজকে তরীর কোনো ক্ষতি হতো তাহলে সেটা আমার হার হতো। সেই হারের বোঝা আমার জন্য বয়ে বেড়ানো বেশি কষ্টের হতো। “
কথাটা বলেই পার্থ আর অপেক্ষা না করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। শোভন অবাক হয়ে চেয়ে রয়। দু’দিন আগ পর্যন্তও তার দাদার জীবনে রাজনীতি ফার্স্ট প্রায়োরিটি ছিলো। আর সেই একই মানুষ কিনা আজ নিজের স্ত্রীর জন্য নির্বাচন প্রত্যাহার করার আগেও একবার ভাবলো না? তার দাদা এতটা কবে বদলে গেলো?
__________
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে তূর্য। গায়ে মেনস পারফিউমটা লাগাতে লাগাতে আড়চোখে আয়না দিয়ে বুকশেলফের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে দেখছে সে। পৃথা বুকশেলফের সামনে পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শেলফের সবথেকে উঁচু তাক থেকে একটা বই নেওয়ার প্রচেষ্টায় বিভোর সে। বইটার নাগাল পেতেই সে আনাড়ি হাতে বইটা টেনে ধরে। সাথে সাথে সেই বইয়ের উপর স্তুপ আকারে রাখা বাকি বই গুলোও পৃথার উপর হেলে পড়ে। পৃথা ভয়ে চোখ খিচে মাথা নিচের দিকে ঝুকিয়ে ফেলে। বইগুলো শব্দ করে ফ্লোরে পড়ে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটাও বই পৃথার মাথা স্পর্শ করে না। চোখে ভয় নিয়েই পৃথা তাকিয়ে দেখে তার সামনে লম্বা দেহী তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। নিজের লম্বা চওড়া দেহ দিয়ে সে পৃথাকে আড়াল করে রেখেছে। ফলে বইগুলো সব তার পিঠে বাড়ি খেয়ে নিচে পড়েছে। পৃথা চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,
“ ব্যথা পেয়েছেন? “
তূর্য সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,
“ সারাদিন বাসায় একা একা কি এসব অকাজই করে বেড়াও তুমি? “
“ আমি আবার কি করলাম? “
“ এভাবে কেউ বই পাড়ে? ভাগ্যিস শুধু বই পড়েছে। তুমি যেভাবে একহাতে বুকশেলফের উপর ব্যালেন্স রেখে বইয়ের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছিলে সেভাবে বুকশেলফও উল্টে তোমার উপর পড়তে পারতো। “
“ সারাদিন বাসায় বসে টেক্সট বুক পড়ে আর টিভি দেখে আমি বোর হয়ে যাই। করার মতো কিছু পাই না। আপনি আর পাপা আমাকে ঘরের কাজও করার পারমিশন দিচ্ছেন না। আমার দোষটা কোথায় বলুন? “
তূর্য চোখ পাকিয়ে বলে,
“ মানে এখন সব দোষ আমার আর পাপার? “
পৃথা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“ অবশ্যই আপনাদের দোষ। আপনারা আমাকে এই বাসায় মেহমানের মতো ট্রিট করেন। “
তূর্য অবাক হয়ে বলে,
“ এরকম কেন মনে হচ্ছে তোমার? “
“ কারণ আমি যদি এই বাসার বউ হতাম তবে আপনারা নির্দ্বিধায় আমার উপর সম্পূর্ণ ঘরের দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন। “
তূর্য ভ্রু কুচকে পৃথার দিকে তাকিয়ে রয়। পৃথা এক কদম এগিয়ে এসে তূর্যের হাত ধরে বলে উঠে,
“ আমি জানি আমি অনেক কিছুই পারি না৷ কিন্তু প্লিজ ট্রাস্ট মি। সংসারটা যেহেতু আমার তাহলে সেটার দায়িত্বও আমাকে তুলতে দিন। প্রথম প্রথম সব সামলাতে হয়তো আমি হিমশিম খাবো, কিন্তু ধীরে ধীরে সব সামলে নিবো। আই প্রমিজ এসবের মাঝে আমি আমার পড়াশোনাও ঠিকঠাক চালাবো। কিন্তু এভাবে আনপ্রোডাক্টিভ হয়ে দিন পাড় করাটা আমার দ্বারা আর সম্ভব নয়। “
পৃথার স্পষ্ট আবদার তূর্য মেনে নিলো কিনা বুঝা গেলো না। পৃথা জবাবের অপেক্ষায় চেয়ে রইলো। তূর্য নিজের হাতঘড়িটা পড়ে নিতে নিতে বলে উঠে,
“ তোমার আবদার ফেলার সাধ্যি কার? “
পৃথার মুখে সাথে সাথে হাসি ফুটে উঠে। সে এগিয়ে গিয়ে তূর্যকে জড়িয়ে ধরে উৎফুল্ল সুরে বলে উঠে,
“ আই লাভ ইউ সো মাচ! “
__________
জ্বরতপ্ত একটি হাত পার্থর পাঞ্জাবির কোণা আঁকড়ে ধরতেই পার্থ চোখ মেলে তাকায়। সবে মাত্র তার চোখ লেগে এসেছিলো। কিন্তু চিন্তায় সেই তন্দ্রা ভাবটা আর গাঢ় হওয়ার সুযোগ পায় নি। গত রাতেই তরীর গা কাপিয়ে জ্বর এসেছে। সারারাত পার্থ তরীর পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিয়েছে। কিন্তু শরীরের জ্বর তেমন একটা কমেছে বলে মনে হচ্ছে না।
পার্থ তরীর ঘুমন্ত শুকনো মুখখানা দেখে নিয়ে পাশে রাখা থার্মোমিটার দিয়ে আরেকবার টেম্পারেচার চেক করে নেয়। প্রায় ১০৪° ছুঁই ছুঁই। পার্থ ক্লান্ত ভঙ্গিতে আবার বেডের হেড সাইটে নিজের পিঠ হেলান দেয়। তরীর এতো জ্বর আসার পিছনে কারণ কি? বৃষ্টিতে ভেজা? নাকি ভয়? দ্বিতীয় কারণটা পার্থর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। যেই মেয়ের কপালে রিভলবার ঠেকালেও সে ভয়ে চোখের পলক ফেলে না সে এতো দূর্বল হতে পারে না।
পার্থর ভাবনার মাঝেই তরী তার দিকে ফিরে নিজের উত্তপ্ত মাথাটা তার হাঁটুর উপর তুলে দেয়। পার্থর অনুভব হলো তার কোলে যেন এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা এনে কেউ ছেড়ে দিয়েছে। তবুও সে চুপচাপ সেই উত্তাপ সহ্য করে নেয়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে ক্ষমতার জোরে প্রতিনিয়ত অপকর্ম চালিয়ে যাওয়া রুবেলের চেহারাটা। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো পার্থর এই মুহুর্তে রুবেলের বদলে নিজের প্রতি ধিক্কার এবং আক্ষেপ অনুভব হচ্ছে। এতদিন সে একা ছিলো। নিজের জীবনের প্রতি ভয় কাজ করতো না কখনো। কিন্তু এখন তরীও তার জীবনের অংশ। আর তার সবথেকে বড় প্রতিপক্ষ ইতিমধ্যে তরীর দিকে নিজের দৃষ্টিপাত করে ফেলেছে। যদিও পার্থ নির্বাচন প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু এই যুদ্ধ এখানে শেষ হবে না। যতদিন না পার্থ জয় নিজের নামে লিখে নিচ্ছে ততদিন এই যুদ্ধ চলবে। তার শুধু এখন একটাই চিন্তা। তার এই যুদ্ধের মাঝে যেনো তরী তুরুপের তাস না হয়।
পার্থ নিজের বাধ্য হাতটা বাড়িয়ে তরীর চুলের ভাজে তা ডুবিয়ে দেয়। অন্যহাতে কম্বলটা টেনে তরীর গা ঢেকে দিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠে,
“ নিশ্চিন্তে থাকুন তরী। মনের সম্পর্ক না থাকুক কিন্তু কোনো ধরনের অবহেলা হবে না আপনার প্রতি। পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর নিজের স্ত্রীর প্রতি ওয়াদা রইলো। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৮.
তরীর যখন জ্ঞান ফিরে তখন প্রায় দুপুর। শরীরের তাপমাত্রা সামান্য কমেছে এখন। কিছুটা ভয় ও জড়তার সাথে চোখ মেলে তাকায় তরী। কিন্তু যার মুখশ্রী দেখে নিশ্চিন্তে ঝড়ো রাতে নিজের চোখ বুজেছিলো সে তার সামনে নেই। বরং জমিলা খালা তার মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছেন। তরীকে চোখ মেলতে দেখেই উনি বলে উঠেন,
“ বড় বউ গো! তোমার হুশ ফিরসে? যাক আলহামদুলিল্লাহ। “
তরী গায়ে অসহন জ্বর অনুভব করছে। সে ক্লান্ত গলায় বলে উঠে,
“ পানি খাবো। “
জমিলা খালা অপেক্ষা করে না। সাথে সাথে বেডসাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে তরীকে উঠে বসতে সাহায্য করে। তার পিঠের পিছে দুটো বালিশ দিয়ে গ্লাসটা এগিয়ে ধরে। তরী দূর্বল হাতে গ্লাস নিয়ে কিছুটা পানি খেয়ে নেয়। নিজের গায়ের পরিবর্তিত জামার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে,
“ আমার শাড়ি কে বদলেছে? “
“ তোমার শাশুড়ি বদলায় দিসে। তোমার লাইগ্যা যে তার কি মোহব্বত! কপাল কইরা একখান শাশুড়ি পাইসো বড় বউ। আমারে তোমার কাছে পাঠায় দিয়া নিজ হাতে তোমার লাইগ্যা রানতাসে। “
তরী জমিলা খালার কথার জবাব দেয় না। সে একহাত নিজের চুলের ভেতর দিয়ে নিয়ে ঘাড় স্পর্শ করতেই টের পায় সেখানে ব্যান্ডেজ করা। এই জায়গাটাতেই কালকে তাকে পিছন থেকে আঘাত করা হয়েছিলো। তরী এক মুহুর্ত প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে দূর্বল গলায় প্রশ্ন করে,
“ পার্থ কোথায়? “
জমিলা খালা মুখ কালো করে বলে,
“ নির্বাচনের প্রত্যাহার পত্র জমা দিতে গেসে। তাড়াতাড়ি আইসা পড়বো বলসে। “
তরীর ক্লান্ত মস্তিষ্ক যেন হঠাৎ সজাগ হয়। সে চোখ মৃদু সরু করে প্রশ্ন করে,
“ নির্বাচনের প্রত্যাহার পত্র কেন জমা দিচ্ছে? “
“ আর বইলো না। বিপরীত দলের লোকেরা তোমারে তুইল্যা নিয়া গেসিলো। তোমারে মুক্ত করার বিনিময়ে পার্থরে নির্বাচন প্রত্যাহার করতে কইসে। পার্থ বাপজানে তোমারে এতো মোহাব্বত করে যে লগে লগে নির্বাচন প্রত্যাহার ঘোষণা কইরা তোমারে উদ্ধার কইরা আনসে। সারাডা রাইত তোমার মাথায় জলপট্টি দিসে। ডাক্তারও ডাকসিলো। “
তরী শুকনো মুখে জমিলা খালার কথা শুনছে। জমিলা খালা নিজেই আবার বলে উঠে,
“ একটা কথা কইতাছি বড় বউ। পার্থ বাপজান তোমারে জোর কইরা তুইল্যা বিয়া করসে দেইখ্যা তুমি হের উপর গুস্সা এইডা আমি জানি। কিন্তু যেহেতু বিয়াডা হইয়াই গেসে তাই এইডা মাইন্না নেওয়ার চেষ্টা করো। এই বাসার সবাই কিন্তু তোমারে মন থেইক্যা আপন কইরা নিসে। “
“ আমার ফোনটা একটু এনে দিবেন খালা? পাপার সাথে কথা বলবো। “
জমিলা খালা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। তরী যে পার্থর ব্যাপারে কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছে না তা স্পষ্ট। উনি চুপচাপ তরীর ফোনটা এনে দিয়ে নিজে রুমের বাহিরে চলে যায়। তরী নিজের কল লিস্ট থেকে তার পাপার নাম্বারে ডায়াল করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন রিসিভ হয়। অপরপাশ থেকে হুমায়ুন রশীদ বলে উঠে,
“ প্রিন্সেস? আজ হসপিটাল এলে না যে! কাউকে ইনফর্মও করো নি। “
তরী দূর্বল গলায় ডাকে,
“ পাপা। “
মেয়ের কণ্ঠ শুনেই মেয়ে যে ঠিক নেই তা বুঝতে পারে হুমায়ুন রশীদ। উনি সাথে সাথে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,
“ কি হয়েছে প্রিন্সেস? তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? “
“ বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে পাপা। “
হুমায়ুন রশীদ ভ্রু কুচকে বলে,
“ তোমাদের দুই ভাই বোনেরই দেখি গায়ে নতুন হাওয়া লেগেছে। আগে তো কখনো তোমরা বৃষ্টিতে ভিজতে না! জ্বর কেমন এখন? কমেছে? “
তরী মৃদু গলায় জবাব দেয়,
“ হ্যাঁ। “
দুই বাপ মেয়েই এখন কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে। হুমায়ুন রশীদ হঠাৎ সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,
“ ওই বাড়িতে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো মা? পার্থ তোমার খেয়াল রাখছে তো? আর বাকি সবাই? “
তরীর গলা ধরে আসছে। সে বলে,
“ হ্যাঁ পাপা। সবাই ভালো। কিন্তু আ’ম মিসিং ইউ। “
হুমায়ুন রশীদের বেশ মন খারাপ হয়। তার সর্বদা শক্ত খোলসে আবৃত মেয়ে একমাত্র তার কাছেই আহ্লাদ করতো সবসময়। তার মেয়েকে কি পার্থ তার মতো আগলে রাখতে পারবে সবসময়?
__________
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি পলাশীর মোড়ের চিরচেনা চায়ের দোকানে বসে গরম কাচের কাপে চুমুক দিচ্ছে মধুমিতা। অপেক্ষা তার চিরচেনা প্রেমিকের। যে আপাতত ঢাকার জ্যামে ফেসে আছে হয়তোবা।
মধুমিতার অপেক্ষা দীর্ঘ হয় না। সিভিল ড্রেসে নিজের প্রেমিককে দেখে সে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ আজকে কি ডিউটি নেই বুঝি জনাব? “
“ আজ সিভিল ড্রেসে ডিউটি করছি। “
কথাটা বলেই শোভন মধুমিতার হাত থেকে তার আধা খাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে সেটাতে চুমুক বসায়। অত:পর চোখ বুজে বলে উঠে,
“ চায়ে আজকাল চিনির বদলে মধু দেন নাকি চাচা? “
টংয়ের ভেতর বসে থাকা দোকানদার দাঁত বের করে বলে,
“ চায়ে তো সবসময়ের মতো দু চামচ চিনিই দিয়েছি। “
“ তাহলে মধুর টেস্ট কিভাবে পাচ্ছি আমি? “
শোভনের মশকরা দেখে মধু তার বাহুতে একটা চাপড় দিয়ে বলে,
“ একদম ঢং করবে না। “
শোভন মধুর কথার জবাব দেয় না। সে চা খেতে খেতে বলে উঠে,
“ দাদা নির্বাচন প্রত্যাহার করে দিয়েছে। “
মধু বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,
“ কি? “
শোভন গতকালের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মধুকে খুলে বলতেই মধু বিস্ময় নিয়ে বলে উঠে,
“ কিন্তু এরকম ঘটনা হলে তো ওই রুবেল টুবেলকে জেলে পাঠানো উচিত। “
“ কেউ তো ওর বিপক্ষে থানায় মামলা করে নি। তাহলে গ্রেফতার কিভাবে করবো? “
মধু খানিকটা ভাবুক ভঙ্গিতে বসে রয়। অত:পর বলে,
“ একদিক দিয়ে ঠিকই আছে। রুবেল ক্ষমতাশালী লোক। তাকে জেলে পাঠালেও দু’দিন পর ক্ষমতার দাপটে বেরিয়ে আসবে। পরে দাদার সাথে শত্রুতা আরো গভীর হবে। এর থেকে ঝামেলা না করাই ভালো। “
শোভন বিরক্ত মিশ্রিত সুরে বলে,
“ একদম দাদার সুরে কথা বলবে না মধু। “
“ আমি দাদার সুরে নয় বরং সত্যি কথা বলছি। তুমি একজন কর্তব্যপরায়ণ অফিসার হিসেবে বিষয়টা ভাবছো তাই তোমার মনে হচ্ছে রুবেলকে জেলে পাঠালেই প্রবলেম সলভড। কিন্তু বস্তুত পক্ষে এতে আরো ঝামেলা বাড়বে। আর আই এম শিওর দাদা ভাবীর লাইফ নিয়ে রিস্ক নিবে না। “
__________
রাত তখন দশটা প্রায়। বাহিরে তুমুল বর্ষণ। যদিও পার্থ বলেছিলো বিকালের মধ্যে ফিরে আসবে কিন্তু ফ্যাক্টরিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যাওয়ায় তার বাসায় ফিরতে এতো দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু টাইম টু টাইম সে জমিলা খালার থেকে তরীর আপডেট নিতে ভুলে নি। তার অনুপস্থিতিতে তরীর যে মোটেও অযত্ন হয়নি তা সে ভালো করেই জানে।
পার্থ ঘরে ফিরে লিভিং রুমে বসতেই সাদিকা বেগম এক গ্লাস পানি হাতে ছেলের দিকে এগিয়ে আসে। পার্থ পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে,
“ আব্বা কোথায়? “
“ তোর আব্বা খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়েছে। উনার প্রেশারটা বেড়েছে আবার। “
আফজাল সাহেবের আচমকা এরকম প্রেশার বাড়ার পিছনের কারণটা পার্থর অজানা নয়। তার আব্বার তার প্রতি খুব আশা ছিলো যে এবারের ইলেকশনটা পার্থই জিতবে। কিন্তু ছেলের ইলেকশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে উনার সেই আশায় গুড়ে বালি হওয়ায় বিষয়টা মানতে উনার সময় লাগছে। পার্থ পানিটুকু মুখের কাছে নিয়েই থেমে যায়। সাদিকা বেগমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ তরী খেয়েছে? “
“ হ্যাঁ। মাত্র খাইয়ে ওষুধ দিয়ে আসলাম। সন্ধ্যার পর থেকে জ্বরটা আবার বেড়েছে মনে হচ্ছে। “
পার্থ পানি খেয়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায়। সিটিং এরিয়াটা পাড় করে বেড রুমে প্রবেশ করতেই তরীর মুখোমুখি হয়।
তরী সবে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। রুমে একা ছিলো বিধায় ওড়না বিছানার এককোণে রেখে গিয়েছিল সে। তার মুখ জুড়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। সেগুলো চোখ, নাক, ঠোঁট বেয়ে তার উন্মুক্ত গলায় গড়িয়ে যাচ্ছে। পার্থ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রূপালী রঙের হাতঘড়ি খুলতে থাকে। তখনই পিছন থেকে তরীর দূর্বল গলা শোনা যায়,
“ সবার সামনে নিজের পারফেক্ট হাজবেন্ডের ইমেজ ক্রিয়েট করে কেমন অনুভব করছেন? “
পার্থ ভ্রু কুচকে তরীর দিকে ফিরে তাকায়। তরী ছোট ছোট কদম ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। জ্বরের আবেশের শুকনো মুখটা হঠাৎ কেমন দৃঢ়ভাব ধারণ করেছে। পার্থ প্রশ্ন করে,
“ কি বলছেন? “
“ এই রুমে এখন আপনি আমি ব্যতীত আর কেউ নেই। তাই নিজের ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকার চেষ্টা করবেন না আর। নির্বাচন প্রত্যাহার করে কি প্রমাণ করতে চাইছেন? যে আপনি খুব ভালো স্বামী? আমাকে খুব ভালোবাসেন? আপনার আসল রূপ আমি খুব ভালো করে চিনি পার্থ মুন্তাসির। সবাইকে ধোকা দিলেও আপনি আমাকে কখনো ধোকা দিতে পারবেন না। “
কথা বলতে বলতে তরী পার্থর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। পার্থ চুপচাপ নিজের একহাত বাড়িয়ে তরীর কপাল ছুঁয়ে দেখতে নেয় শরীরের তাপমাত্রা কেমন। কিন্তু তার আগেই তরী ঝাড়া মেরে তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
“ আমার উপর স্বামীগিরি ফলাতে আসবেন না। একদম হাত ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দিবো মনে রাখবেন। “
কথাটা বলে ঘুরে তরী বিছানার দিকে যেতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে নিজের বাম হাতে হ্যাঁচকা টান অনুভব করে। পার্থ তরীর একহাত ধরে টেনে তাকে নিজের কাছে এনে তার সেই হাত কোমরের পিছনে নিয়ে শক্ত করে ধরে গভীর স্বরে বলে উঠে,
“ আপনার সম্মান আমার কাছে যেকোনো
ইলেকশনের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। “
কথাটুকু বলতে বলতে সে আরেক হাত দিয়ে তরীর ডান হাত নিজের দখলে নিয়ে নেয়। আঙ্গুলের প্রতিটা ফাঁকে ফাঁকে নিজের আঙ্গুল গুজে দিয়ে নরম সুরে বলে,
“ আর যেটাকে আপনি স্বামীগিরি বলছেন সেটা আমার অধিকার। সম্পূর্ণ দেনমোহর পরিশোধ করেছি। আপনার কাধের ছোট্ট তিল তূল্য বিন্দু হতে শুরু করে আপনার সম্পূর্ণ চিত্তের উপর আমার অধিকার রয়েছে। আপনার শরীরের তাপমাত্রা বুঝার জন্য আমি চাইলেই থার্মোমিটারের বদলে নিজে ছুঁয়ে দেখতে পারি। “
তরীর অত্যাধিক দূর্বল ক্ষিপ্ত দৃষ্টি আচমকা শিথিল হয়ে আসে। নিজের উষ্ণ শরীরের ভার সে ছেড়ে দেয় পার্থর বুকে। পার্থ প্রথমে থমকায়। ঘটনা বুঝতে পেয়েই সে নিচু গলায় ডাকে,
“ তরী? এই তরী? ঠিক আছেন? পুড়ে যাচ্ছেন আপনি। “
তরী সাড়াশব্দ করে না। পার্থ তাকে বিছানায় তুলে শুইয়ে দেয়। বিছানার সাইড কেবিনেট হতে ডিজিটাল থার্মোমিটার নিয়ে সেটা তরীর দু ঠোঁটের মাঝে গুজে দেয়। দিনে একশোর ঘরে নামা তাপমাত্রাটা এখন হু হু করে আবার একশো চার ডিগ্রী ছুঁই ছুঁই পর্যায়ে চলে গিয়েছে। গায়ের চামড়া দগ্ধ অনলে পুড়ে যাচ্ছে। পার্থ কম্বল টেনে তরীকে ঢেকে দেয়। অত:পর আবার ডাকে,
“ তরী? আম্মা যে ওষুধ দিয়ে গিয়েছিলো খেয়েছেন? “
তরী এবার মৃদু চোখ মেলে হালকা মাথা নাড়ায়। পার্থ নিশ্চিত হয় যে জ্ঞান হারায় নি। কেবল দূর্বল শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছিলো না সে। তখনই পার্থর ফোন বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে হুমায়ুন রশীদের নাম্বার দেখে পার্থ অবাক হয়। এই রাতের বেলায় পার্থকে কেন কল করছে উনি? সব ঠিক আছে তো?
পার্থ দেরি না করে ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই হুমায়ুন রশীদ বলে উঠে,
“ তরীর সাথে দুপুরের দিকে আমার কথা হয়েছিলো। ওর নাকি জ্বর এসেছে? এখন জ্বর আবার বেড়েছে? “
পার্থ বলে,
“ হ্যাঁ। মাত্রই টেম্পারেচার চেক করলাম। এভাবে জ্বর বাড়তে থাকাটা তো চিন্তার বিষয়। হসপিটালে নিয়ে আসবো? “
“ না। তার প্রয়োজন হবে না। আমি তোমাকে যেই মেডিসিনের নাম ম্যাসেজ করে দিবো সেটা এনে খাইয়ে দেও। আর মাথায় পানি দাও। তাহলেই হবে। “
পার্থ চিন্তিত সুরে বলে,
“ আপনার মেয়ে যদি মাথায় পানি দিতে রাজি না হয়? “
“ আমার মেয়ের জ্বর আসলে ও কখনোই মাথায় পানি দিতে রাজি হতো না। জোর করে ধমকে দিয়ে দিতে হতো। এখন তোমার স্ত্রীর কেসে তুমি তাকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবে সেটা তোমার বিষয়। খালি এতটুকু মাথায় রাখো যে আমার আগামী পরশু একটা সার্জারি আছে। এন্ড আই নিড ডক্টর তরী টু এসিস্ট মি দ্যাট ডে। “
কথাটুকু বলে হুমায়ুন রশীদ ফোন রেখে দেয়। পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তরীকে বলে উঠে,
“ চলুন। মাথায় পানি ঢালতে হবে। “
পানির কথা শুনতেই তরী কম্বল আরো শক্ত করে চেপে ধরে মাথা নেড়ে না বলে। পার্থ একটানে কম্বল সরিয়ে বলে উঠে,
“ সুন্দর করে বলছি চুপচাপ চলুন। রাগাবেন না আমাকে। তুলে নিয়ে যেতে বাধ্য হবো। “
এই কথাতেও তরীর মধ্যে তেমন একটা হেলদোল দেখা দিলো না। সে শক্ত করে বালিশ আঁকড়ে দূরে সড়ে যায়। পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে নিজের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে বলে উঠে,
“ বুঝতে পেরেছি। কোলে উঠতে চাইছেন সেটা আগে বললেই পারতেন। “
কথাটা বলেই পার্থ তরীকে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে বাথটাবের সামনে বসিয়ে দেয়। অত:পর নিজেও তার পাশে বসে তরীর চুল এবং মাথা বাথটাবের ভিতর দিকে রেখে শাওয়ারের পানি ছেড়ে দেয়। ঠান্ডা পানির পশলা তরীর মাথা স্পর্শ করতেই সে ঠান্ডায় কুকড়ে উঠলো। পানির নিচ থেকে নিজের মাথা সরানোর জন্য সে জোর খাটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়না। উল্টো তার অতিরিক্ত নড়াচড়ার ফলে পানি আরো ছিটে পার্থর বুকে লাগে। পার্থ অধৈর্য্য হয়না। বরং শান্ত গলায় বলে,
“ তরী গান শুনবেন? “
তরী পার্থর কথায় নিজের ছোটছোট চোখ আরো ছোট করে তাকায়। পার্থ তা দেখে মৃদু হেসে বলে,
“ কিন্তু শর্ত আছে। চুপচাপ বসে থাকতে হবে। “
কথাটুকু বলে পার্থ তরীর শিক্ত আদ্র চুল নিজের একহাতের মুঠোয় নিয়ে পানির নিচে স্থির ভঙ্গিতে তা ধরে রাখে। পানির ছলছল ধ্বনির সাথে তাল মিলিয়ে পার্থ নরম সুরে গেয়ে উঠলো,
“ আমি তোমার কাছেই রাখবো
আজ মনের কথা হাজার,
দিয়ে তোমার কাজল আঁকবো
আজ সারা দিনটা আমার,
তুমি বৃষ্টি হয়ে নামলে
তুমি বৃষ্টি হয়ে নামলে
আর কমলো চিন্তা আমার। “
তরীর মনযোগ ইতিমধ্যে ঠান্ডা পানি থেকে পার্থর গানের দিকে স্থির হয়েছে। জ্বরের কারণে তপ্ত ভার হয়ে থাকা মাথাটা সে আর সোজা করে রাখতে পারছে না। মাথাটা বা দিকে হেলে দিতেই তা পার্থর বুকে গিয়ে ঠেকে। মুহুর্তেই পার্থর প্রসস্থ বুক আদ্র সংস্পর্শ অনুভব করলো। পার্থ তবুও গান থামায় না।
“ হালকা হাওয়ার মতন
চাইছি এসো এখন,
করছে তোমায় দেখে
অল্প বেইমানী মন,
বাঁধবো তোমার সাথে
আমি আমার জীবন। “
চোখ বুজে গান শুনতে শুনতে আচমকা তরীর চোখের সামনে গানের দৃশ্যগুলো ভেসে উঠে। সাথে সাথে সে অস্ফুটে বলে উঠে,
“ নির্লজ্জ লোকের নির্লজ্জ গান। “
তরীর কথা পার্থর কর্ণগোচর হয় না। সে মৃদু হাসে। মনে মনে চিন্তা করে তাকে যেই তকমা দেওয়া হয়েছে সেরকম একটা কাজ করে দেখালে কেমন হয়? ডাক্তার এখন রেগে গেলেও তাকে আঘাত করতে পারবে না। যেরকম ভাবনা সেরকম কাজ। সাথে সাথে পার্থ একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলে। তরীর ডান কাধের উন্মুক্ত ছোট্ট তিলটায় নিজের শীতল ঠোঁট ছোঁয়ায়। সেই অবস্থায়ই ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ আমার নির্লজ্জতার ছোট একটা ডেমো। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]