যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৩.
রেস্টুরেন্ট হতে বের হতেই তরী পার্থর হাত ছেড়ে দেয় এক ঝাটকা মেরে। পার্থ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে উঠে,
“ আপনি নিজে আমার হাত ধরেছেন। এখন আবার হাত ঝাড়া মারছেন কেনো? “
“ এক্সকিউজ মি। দুই মিনিটের জন্য হাত ধরেছি দেখে এটা ভেবে বসবেন না যে আমার সাথে আপনার কোনো চান্স আছে। “
পার্থ মুখ শক্ত করে তরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। নারী জাতির এই এক সমস্যা! এরা কখন কি চায় নিজেরাও জানে না। আজব এক প্রজাতি!
তরী চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসতেই পার্থ এসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তরী বসে বসে নিজের ফোন চালাতে ব্যস্ত। পার্থও আপন মনে ড্রাইভিং করছে। হঠাৎ সে প্রশ্ন করে,
“ বিয়ে যেহেতু অফিসিয়ালি হয়েই যাচ্ছে তো বিয়ের পরের প্ল্যান কি আপনার? “
তরী ফোন চালাতে চালাতেই জবাব দেয়,
“ আপনার জীবন বরবাদ করার প্ল্যান। “
পার্থ হাসে মৃদু। অত:পর বলে,
“ আপনার অনেস্টি আমার ভালো লেগেছে। “
তরী পার্থর কথায় আর পাত্তা দেয় না। এই লোক কি সেধে তার সাথে কথা বলে তাদের মধ্যের সম্পর্ক নরমাল করার চেষ্টা করছে? উহু। এরকম কখনো হবে না। তরী হতেই দিবে না। এরকম একটা স্ক্রাউন্ডেল দ্বারা ইম্প্রেস হওয়ার চেয়ে কচু গাছে কোমর দড়ি বেঁধে মরে যাওয়া ভালো।
__________
আকাশে আজ সূর্যের দেখা নেই। ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে আজ আকাশ। তূর্য এবং পৃথার কাবিনের এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। এই এক সপ্তাহে পৃথা বাড়ির সকলের সাথেই অনেকটা ফ্রি হয়ে গিয়েছে। বড় দা’র প্রতি রাগ টাও প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। উল্টো কাল তার বড় দা এবং বড় ভাবীর হলুদের জন্য বেশ এক্সাইটেড সে।
তরী, হুমায়ুন রশীদ, তূর্য কেউই বাসায় নেই। কাজের মহিলাও সকাল ১০ টার মধ্যে সব কাজ সেড়ে চলে গিয়েছে। তারপর থেকে পৃথা পড়ার টেবিলে বসে অলস সময় পাড় করছে। তূর্যর সাথে কথা বলে সে ডিসাইড করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবে। সে জন্যই সারাদিন বইয়ে ডুবে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু আজকের এই গুমোট আবহাওয়া দেখে অষ্টাদশীর আর পড়ার টেবিলে মন বসছে না।
অবশেষে সে বই রেখে উঠে রুমের সকল দরজা জানালা লাগিয়ে দেয়। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। পৃথা ক্লসেট থেকে একটা সবুজ তাতের শাড়ি বের করে পড়ে নেয়। ভাগ্যিস আম্মা তাকে শাড়ি পড়াটা শিখিয়েছিল। নাহয় এখন শাড়ি পড়তে গিয়ে বিপাকে পড়তে হতো তাকে। শাড়ি পড়া শেষ হতেই পৃথা নিচে নেমে রান্নাঘরে চলে যায়। আজ সে ইচ্ছে করেই আন্টিকে বলেছিলো রান্না করতে হবে না।
ফোনে ইউটিউব হতে সে গরু মাংস দিয়ে ভুনা খিচুড়ি রান্না করার রেসিপি দেখে নিজেও অপরিপক্ক হাতে রান্না করা শুরু করে। মনে মনে ভেবে রেখেছে চমৎকার রান্না করে তূর্যকে চমকে দিলে কেমন হয়? আম্মার কাছে সে শুনেছিলো পুরুষের মনের রাস্তা পেট হয়ে যায়। সুতরাং পৃথার মজার রান্নার উপর ডিপেন্ড করছে তূর্যর মনে তার প্রতি ভালোবাসা জাগবে কিনা তা!
রান্নার মাঝেই তূর্যর কল আসে। পৃথা কোনো মতে একটা টিস্যু নিয়ে একহাত মুছে কল রিসিভ করতেই ফোনের অপর পাশ থেকে তূর্য বলে উঠে,
‘’ হ্যালো মি এ বি সি। কি করছো? “
“ আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছিলাম। আপনি তার মাঝে কল করে বিরক্ত করছেন। “
“ আমার কলের থেকেও কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো তোমার জন্য? “
“ আপনাকে কেনো বলবো? “
“ আমি বুঝতে পারছি। বিয়ের আগে তো খুব স্বামী মেনে চলতে। বিয়ের পর আর এখন আমাকে ভাল্লাগছে না, তাই না? এক সপ্তাহেই ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো? “
পৃথা তূর্যের কথা শুনে মুখ টিপে হাসে। অত:পর খুব ব্যস্ত আছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠে,
“ বিরক্ত করবেন না তো। রাখছি। “
তূর্য বেক্কলের ন্যায় ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি হলো? অন্য সময় তো পৃথা নিজে এটা ওটার ছুঁতোয় তাকে কল দিতো একটু পর পর। আর আজ তূর্যকে পাত্তাই দিচ্ছে না?
__________
“ আরেব্বাস। ইলেকশনের আগ মুহুর্তে পার্থ মুন্তাসির বিয়ে করতে চলেছে। তা পাত্রী কে? “
রুবেলের প্রশ্ন শুনতেই সুজন হাতের একটা ছবি এগিয়ে দেয় তার দিকে। ছবির দিকে তাকিয়ে থেকেই রুবেল ভ্রু কুচকে বলে উঠে,
“ এই মেয়েকে আগেও কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। “
“ হসপিটালে দেখসেন ভাই। ওই সিয়ামের ডাক্তার আসিলো উনি। “
রুবেল হেসে বলে,
“ ভালো মাল খুঁজসে তো পার্থ। রাজনীতি করতে গেলে আহত হইলেও সমস্যা নাই। বাসায় বউ সেবা যত্ন করবো। “
কথাটা বলেই রুবেল হাসতে থাকে। তখনই তার পার্টি অফিস রুমের দরজাটা সুরসুর করে খুলে গেলো। দরজা দিয়ে প্রবেশ করা মানুষটাকে দেখে রুবেল অবাক হয়। অত:পর নিজের বিস্ময় লুকিয়ে বলে,
“ আরেএ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। আসেন আসেন। আপনাকে নিয়েই কথা বলছিলাম। শুনলাম নাকি বিয়ে করছেন। তা দাওয়াত দিতে আসলেন নাকি? “
পার্থ রুবেলের বরাবর টেবিলের অপর পাশে থাকা চেয়ারটায় পায়ের উপর পা তুলে বসে। মুখে তার হাসি লেপ্টে আছে। তার সাথে আসা দলের কয়েকজন ছেলেপুলে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। পার্থ মুখের হাসি বজায় রেখে বলে,
“ নির্বাচনের প্রস্তুতি কতদূর গড়ালো? শুনলাম নাকি নিজের নামের বড় বড় ব্যানার এবং পোস্টার ছাপানোর অর্ডার দিয়েছেন। “
রুবেল নিজের হাতে থাকা তরীর ছবিটা উল্টো করে টেবিলে রাখে। এতে করে পার্থ আর সেই ছবিটা দেখতে পারে না। রুবেল বলে উঠে,
“ হঠাৎ আজ আমার খোঁজ খবর নিচ্ছেন খুব। সব ঠিকঠাক আছে তো? “
“ আপনার এতো প্রস্তুতি দেখে খারাপ লাগছে। দিনশেষে নির্বাচন প্রত্যাহার করতে হবে আপনাকে। বেশ লস হয়ে গেলো। “
রুবেল ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
“ নির্বাচন প্রত্যাহার করতে হবে মানে? “
পার্থ আসিফের হাত থেকে একটা ফোন নিয়ে তা রুবেলের দিকে এগিয়ে দেয়। রুবেল ফোনটা হাতে নিয়েই দেখে একটা ভিডিও ওপেন হয়ে আছে। রুবেলের কপালের ভাজ আরেকটু গভীর হয় যখন সে দেখতে পায় ভিডিওটিতে তার দলের সেই তিন ছেলে নিজেদের জবানবন্দী দিচ্ছে যে রুবেলের আদেশেই তারা পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর পার্টির ছেলে সিয়ামকে কুপিয়েছে।
রুবেল সাথে সাথে ব্যস্ত হাতে ভিডিওটা ডিলিট করে দেয়। তা দেখে পার্থ হেসে বলে,
“ রাজনীতি করেন অথচ কোনো বুদ্ধি নেই মাথায়। এই ভিডিওর আরো অনেক কপি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। ভাবুন নির্বাচনের আগে এমন একটা ভিডিও যদি আমি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেই তাহলে আপনার ইমেজের উপর এর কেমন প্রভাব পড়বে? “
রুবেল চোয়াল শক্ত করে বলে,
“ ভুল করছো পার্থ। “
পার্থ রুবেলের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজের দু হাত পিঠের পিছে ভাজ করে সে গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
“ হাতে ৩ দিন সময় আছে। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিন যে নির্বাচন প্রত্যাহার করবেন নাকি গণমাধ্যমে ভাইরাল হবেন। “
কথাটা বলে পার্থ উল্টো দিকে ফিরে হাঁটা ধরতেই রুবেল বলে উঠে,
“ মুরগী কিন্তু খাঁচার বাইরে গেলে শিয়ালের থাবায় পড়ার ঝুঁকি থাকে। ভাবি কিন্তু দেখতে বেশ হেব্বি। সামলে রেখেন। “
পার্থ ভয়ংকর আশ্চর্যজনক চাহনিতে পিছনে ফিরে তাকায়। রুবেল কুটিল হেসে নিজের টেবিলের উপর থাকা তরীর ছবিটা উল্টে সেটার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ মালটা কিন্তু সেই। “
পার্থ ধীর কদমে এগিয়ে এসে টেবিলের উপর থেকে তরীর ছবিটা তুলে নিজের পকেটে গুজে নেয়। অত:পর রুবেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ চোখ আর জিভের হেফাজত করে চল। নাইলে দেখার জন্য চোখ আর কমেন্টস করার জন্য জিভ খুঁজে পাবি না। “
কথাটা বলেই পার্থ বেরিয়ে যায়। রুবেলের চেহারায় আবার চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। রাগ সামলাতে না পেরে সে পার্থকে উদ্দেশ্য করে একটা বিশ্রী গালি দেয়।
__________
সন্ধ্যা করে তূর্য বাড়িতে ফিরতেই পৃথা মুখ ফুলিয়ে দরজা খুলে। তূর্য অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
“ মুখ ফুলিয়ে আছো কেনো? “
পৃথা জবাব না দিয়ে ঘরের ভেতর চলে যায়। তূর্য পিছু পিছু ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগায়। পৃথা লিভিং রুমে সোফায় বসে ছিলো। তূর্য তার সামনের সোফায় গিয়ে বসে। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে বুঝে যায় তার পাপা এবং আপি এখনো বাসায় ফিরে নি। অত:পর সে আবার পৃথার দিকে তাকায়। এতক্ষণে সে লক্ষ্য করে পৃথা আজকে শাড়ি পড়েছে। তূর্য মজার ছলে বলে উঠে,
“ মন খারাপ উপলক্ষে আজ শাড়ি পড়েছো নাকি? “
পৃথার মন আরো খারাপ হয়ে যায়। সে উঠে উপরে নিজের রুমে চলে যায়। দুপুরে যেই খিচুড়ি রান্না করেছিলো সে তা জঘন্য হয়েছে একেবারে। তার উপর বাসায় অন্য কিছু রান্নাও করা নেই যে সে তূর্যকে এখন খেতে দিবে। কি বিশ্রী একটা বিষয়! নিজেকে বেশ অকর্মা মনে হচ্ছে পৃথার। তার এই অকর্মা স্বভাবের জন্য তূর্যর তাকে ভালোবাসার চান্স প্রায় নেই ই বলতে গেলে।
পৃথা মন খারাপ করে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর তূর্য বারান্দায় আসে। নীরবে পৃথার পাশে বসে। অত:পর বলে,
“ মন খারাপ কেন পৃথা? “
“ খিচুড়ি রান্না করেছিলাম দুপুরে। জঘন্য হয়েছে। রাতের জন্য আর কোনো রান্নাও নেই। “
তূর্য ভ্রু কুচকে বলে,
“ এইটুকু বিষয়ের জন্য মন খারাপ? “
পৃথা মাথা নত করে বলে,
“ আ’ম সরি। আমি কোনো কাজের না। “
“ তোমাকে কাজ করতে বলেছে কে? “
“ কেউ না। “
তূর্য বুঝতে পারে অষ্টাদশীর মন একটু বেশিই খারাপ আজ। একদম আজকের আবহাওয়ার মতো। তূর্য একহাত বাড়িয়ে পৃথার হাত ধরে। অত:পর বলে উঠে,
“ কেউ হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেক্ট হয়না পৃথা। এজন্যই দুটো ইম্পার্ফেক্ট পার্সন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যেনো নিজেদের মিসিং পিস গুলো ফিলাপ করতে পারে। আমি তোমাকে রান্না শিখিয়ে দিবো। তুমি নাহয় আমাকে ভালোবাসাটা শিখিয়ে দিয়ো। “
পৃথা চোখ বড় করে তূর্যর দিকে তাকায়। তূর্য মৃদু হেসে আচমকা পৃথার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। পৃথা লজ্জায় জমে যায়। তূর্য নিচু স্বরে বলে,
“ গান জানো পৃথা? “
“ আপনি কিভাবে বুঝলেন? “
“ তোমার কণ্ঠ শুনে বুঝা যায়। গান শুনাও তো একটা। “
পৃথা লজ্জা পায়। সে টুকটাক গান জানে। কিন্তু বড় দা আর ছোট দা ছাড়া আর কারো সামনে কখনো গায় নি। তূর্য পৃথার লজ্জাটুকু বুঝতে পেরে পৃথার একহাত নিজের চোখের উপর রেখে বলে,
“ নাও চোখ বন্ধ করে রাখছি। আর লজ্জা পেতে হবে না। “
পৃথা সামান্য হেসে গান শুরু করে,
“ এসে গেছে দিন, কতনা রঙিন,
নামে তোর, এ শহর,
দেব লিখে সব আমার।
তুই এলি তাই, মন হলো ঠিক,
কাছে তোর, ঘুম ঘোর,
নেব চেয়ে যা চাওয়ার।
চেনা তোর ইশারায়
ফেলেছে কি জ্বালায়,
এসেছে এ কি ঝড় অবেলায়। “
চলবে…
যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৪.
দমকা বাতাসের চোটে তরীর শাড়ির আচল এবং চুল উড়ছে। কাল বৈশাখীর আবহাওয়া। এই কাল বৈশাখী যেমন গ্রীষ্মের উগ্রতা কমিয়ে এনেছে তেমন প্রকৃতিতে এক নতুন তান্ডব শুরু করেছে। তান্ডব তো তরীর জীবনেও কম হয়নি। এই যেমন কিছুক্ষণ আগেই তার জীবন এক নতুন ঝড়ের সাথে বাঁধা পড়েছে। সেই ঝড়ের নাম পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী।
সেই ভয়ংকর রাতে যখন পার্থ তাকে জোর করে বিয়ে করে সেদিন ওর গায়ে শোক রঙা কাপড় ছিলো, যা পরিস্থিতি অনুযায়ী একেবারে মানানসই ছিলো। কিন্তু আজ তার গায়ে কালোর বদলে লাল রঙ শোভা পাচ্ছে। এই লাল রঙ আসলে কিসের প্রতীক? ভালোবাসার নাকি ঘৃণার?
রুমে প্রবেশ করতেই পার্থ দূর হতে তরীকে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আচমকাই তার মনে পড়ে যায় রুবেলের বলা সেদিনের কথাটি। মনে জায়গা না পাক, কিন্তু সকলের সামনে তিন বার কবুল বলে পার্থর জীবনে তো তরীর জায়গা হয়েছে। তা পার্থ কখনোই অস্বীকার করবে না। সেই সম্পর্কের ভিত্তি হতেই এই নারীর নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন থেকে তার। কেউ যদি ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করে তাহলে তাকে পিচঢালা পথে পিষে দিবে পার্থ।
তরী আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে দরজার কাছে পার্থকে বিয়ের শেরওয়ানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তরী ভ্রু কুচকে সাথে সাথে বলে উঠে,
“ এই ফুল টুল দিয়ে রুম সাজানোর আইডিয়া কার ছিলো? “
পার্থ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আপনমনে পাঞ্জাবির উপর হতে শেরওয়ানি খুলতে খুলতে বলে উঠে,
“ আপনার দেবর, ননদের আইডিয়া। “
তরী সাথে সাথে চিল্লিয়ে উঠে,
“ এই! করছেন কি আপনি? “
পার্থ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তরীর আচমকা চিৎকারে। অত:পর বিরক্ত মিশ্রিত সুরে বলে,
“ ছাগলের মতো চিল্লাচ্ছেন কেন? “
তরী দুই পা এগিয়ে এসে বলে,
“ শেরওয়ানি খুলছেন কেন? “
পার্থ অবাক হয়। কি অদ্ভুত প্রশ্ন! ডাক্তার সাহেবার এসব আজগুবি প্রশ্ন শুনলে মাঝে মাঝে তার মনে হয় তরী বুঝি চিটিং করে সব এক্সাম পাশ করে ডাক্তার হয়েছে। নাহয় আইকিউ লেভেল এরকম কেন হবে? পার্থ বিরক্তি নিয়েই বলে,
“ আপনি নিজের সকল গয়না খুলে আর আটা ময়দা তুলে বসে আছেন কেন? যাতে একটু আরামে ঘুমোতে পারেন। আমিও সেজন্যই শেরওয়ানি খুলছি। “
তরী নিজের দুই হাত বুকের উপর ভাজ করে বলে,
“ আমাকে আপনার বোকা মনে হয়? আমি খুব ভালো করে বুঝি আপনাদের মতো পুরুষদের ইনটেনশন কি। প্রথমে শেরওয়ানি খুলবেন, তারপর পাঞ্জাবি। আর তারপর নিজেদের জিম করা বডি দেখিয়ে মেয়ে মানুষকে সিডিউস করার ট্রাই করবেন। কিন্তু আমি এসব দ্বারা মোটেও ইম্প্রেসড হবো না। “
পার্থ তাজ্জব বনে যায়। সে তো এতো ডিপ চিন্তাভাবনা করেও নি। অথচ এই ডাক্তার একটা ছোট বিষয়ের কতো গভীরে চলে গেলো। পার্থ ফুস করে উঠে নিজের গায়ের পাঞ্জাবিটাও খুলে ফেলে। তরী সাথে সাথে রাগে লাল হয়ে যায়। কি নির্লজ্জ বেহায়া পুরুষ মানুষ! শরম হায়া নামে কোনো জিনিস এই লোকের ভেতরে নেই।
পার্থ এক পা করে তরীর দিকে এগিয়ে আসে। তরী এক বিন্দুও নড়ে না। সে হাতে শক্ত করে মুষ্টি করে রেখেছে। আজকে সে এই বেহায়া পুরুষের মুখের নকশা বদলেই ছাড়বে। পার্থ তরীর কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই তরী নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরে আঘাত করার উদ্দেশ্য। কিন্তু সেই হাত পার্থকে ছোঁয়ার আগেই পার্থ একহাতে তা শক্ত করে ধরে ফেলে। তরী আবার আরেক হাত তুলে। এবারও পার্থ তা ধরে ফেলে। অত:পর তরীর দুই হাত কোমরের পিছনে নিয়ে শক্ত করে আটকে ধরে তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ আপনাকে ইম্প্রেস করার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। উল্টো আমার তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে সিডিউস করার প্ল্যান করেছেন। শাড়ির আঁচল সড়ে যে আপনার কোমরের বাক দৃশ্যমান সেই খেয়াল কি আছে? “
তরী হতভম্ব হয়ে যায়। দুই হাত আবদ্ধ থাকায় পার্থকে লাথি মারার উদ্দেশ্যে ঠিক করা পা বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। এই নির্লজ্জ লোকের কথায় রাগে তার কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। পার্থ তরীর হাত সামান্য আলগা করে একই সুরে আবার বলে উঠে,
“ স্টিল আই হ্যাভ কন্ট্রোল অভার মাইসেল্ফ। একইভাবে আপনিও নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে শিখুন তরী। “
কথাটা বলেই পার্থ তরীকে ছেড়ে পাশ কেটে চলে যেতে নেয়। যাওয়ার সময় সে আরেকটা কাজ করে। তরীর কাধে তুলে রাখা শাড়ির আচলটা ছেড়ে দেয়। সাথে সাথেই তরীর এতক্ষণের দৃশ্যমান কমোরের বাক ঢেকে যায়। তরী হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। পার্থ আলমারি হতে নিজের টি শার্ট এবং বিছানা হতে একটা বালিশ নিয়ে বাহিরের সোফার রুমে চলে যায়।
তরী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা লক করে গায়ের শাড়ি পরিবর্তন করে নেয়। আর জীবনে এই নির্লজ্জের সামনে শাড়ি পড়তে যাবে না সে।
__________
দীর্ঘ রাত। সারাদিন মানুষে গিজগিজ করা বিয়ে বাড়িটা এখন বেশ শান্ত। আকাশটা থেমে থেমেই গর্জন করে উঠছে আপন ছন্দে। যেকোনো সময়ই মেঘগুলো বৃষ্টির বিন্দু হয়ে ঝড়ে পড়তে শুরু করবে। পৃথা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার ঘুরেফিরে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত। তার বড় দা আর বড় ভাবীর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ কয়েক ঘন্টা হয়ে গেলো। অথচ সে এখনো নিজের পরিহিত লেহেঙ্গা বদলাচ্ছে না। নিজেকে দেখতে নিজের কাছেই বেশ সুন্দর লাগছে তার। এই লেভেন্ডার রঙের লেহেঙ্গাটা তূর্য তার জন্য পছন্দ করে এনেছিলো।
তূর্য নিজেও আজকে লেভেন্ডার রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। সে চুপচাপ বিছানায় বসে আড়চোখে পৃথাকে দেখতে ব্যস্ত। এইযে এই অষ্টাদশী সারাদিন তার বউ রূপে তার সামনে এই রুমময় পায়চারি করে বেড়ায় বিষয়টা তূর্যর কাছে বেশ উপভোগ্য। তার অবচেতন মন ক্ষণে ক্ষণে পৃথামোহে ডুব দিয়েছে তার অজান্তেই। কিন্তু ঠিক করে রেখেছিলো সেই কথা পৃথাকে এখন জানতে দিবে না। নাহয় পড়াশোনা চাঙ্গে তুলে এই মেয়ে গভীর প্রেমে ডুব দিবে। কিন্তু তূর্যর মন এখন তাকে শাসিয়ে বলছে,
“ পড়াশোনা গাঙ্গে ভাসুক, তুই তোর মনের কথা জানিয়ে দে। নিজের বউকেই তো ভালোবেসেছিস। এটা নিয়েও এতো ভাবাভাবির কি আছে? “
তূর্য মনকে সায় দেয়। ফোন রেখে উঠে গিয়ে সে পৃথার পিছনে দাঁড়ায়। পৃথা তাকে দেখেই চোখ ছোট করে বলে,
“ আপনার ঘুম পেলে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার এসব মেকাপ তুলতে টাইম লাগবে। “
তূর্য একবার বারান্দার থাই গ্লাস দিয়ে বাহিরে তাকায়। অত:পর প্রশ্ন করে,
“ ছাদে যাবে? “
পৃথা চোখ ছোট করে বলে,
“ এখন? বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। “
“ ভিজতে সমস্যা আছে? “
পৃথার ছোট ছোট চোখ মুহুর্তেই প্রফুল্ল হয়ে উঠে। সে হাসি দিয়ে বলে,
“ আপনিও কি বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করেন? ওহ মাই গড! আই মিন থ্যাংক গড! জানেন আম্মা কখনোই আমাকে পারমিশন দিতো না। “
তূর্য পৃথার হাত ধরে বলে,
“ এখন চলো। “
নিশ্চুপ অন্ধকারে তলিয়ে আছে সম্পূর্ণ ঘর। তূর্য আর পৃথা সাবধানে রুম থেকে বের হয়। ছাদের সিঁড়ি পেরিয়ে দরজা খুলে ছাদে প্রবেশ করতেই পৃথা বলে উঠে,
“ থ্যাংক গড পাপা ঘুমোচ্ছে। পাপার সামনে ধরা খেলে লজ্জায় পড়তে হতো। “
কথাটা বলতে বলতেই সিঁড়ির কাছ থেকে হুমায়ুন রশীদের গলা ভেসে আসে,
“ ছাদে কে রে? “
সাথে সাথে পৃথার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। তূর্য নিচু গলায় শিট বলে পৃথার হাত ধরে ছাদের পিছনের দিকে দৌড় লাগায়। পৃথার একহাত তূর্যর হাতের মুঠোয় ও অন্য হাত তার লেহেঙ্গা সামলাতে ব্যস্ত। ছাদের রেলিঙের কাছাকাছি যেতেই তূর্য পৃথাকে কোলে তুলে পাশের ছাদে নামিয়ে দেয়। পরপর নিজেও লাফ মেরে পাশের ছাদে নেমে আবার পৃথার হাত ধরে দৌঁড়ে সেই ছাদের একটা পিলারের আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
এত কম সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখের পলকে ঘটে যাওয়ায় পৃথার বোধগম্য হয় না। যখন বোধগম্য হয় ততক্ষণে সে তূর্যের দু হাতের সীমানার ভেতর আবদ্ধ। মাথা তুলে তাকাতেই দেখে তূর্য পিলারের আড়াল হতে উঁকি দিয়ে তাদের বাসার ছাদের দিকে দেখছে। পৃথা কিছু বলতে নিলেই তূর্য তার ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
“ পাপা ছাদে। শব্দ করো না। “
পৃথা নিচু স্বরে প্রশ্ন করে,
“ কিন্তু আমরা এভাবে পালাচ্ছি কেন? ইলিগ্যাল কিছু করছি না তো আমরা। “
তূর্য মৃদু স্বরে হুশ বলে পৃথাকে থামিয়ে দেয়। হুমায়ুন রশীদ চলে যেতেই তূর্য পৃথার দিকে ফিরে তাকায়। সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকে উঠে। বিদ্যুতের আলোয় পৃথার মুখের দিকে তাকিয়েই বলে দেয়,
“ আই লাভ ইউ। “
পৃথার চঞ্চল দৃষ্টি স্থির হয়। কিন্তু আবহাওয়া আর স্থির থাকে না। ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামে ধরণীর বুকে। পৃথা লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলে। কঠোর চেতনার তূর্যর মনে আচমকা পৃথাকে ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনা জাগে। সেই বাসনাকে সে অগ্রাহ্য করে না। নিবিড়ভাবে একহাত বাড়িয়ে সে পৃথার গালে রাখে আর অন্য হাত তার কমোরে। ধরে আসা গলায় বলে,
“ আগ্রহ নয় ভালোবাসা থেকে ছুঁইছি। “
পৃথা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বলতে নেয়,
“ তূর্য আপনি… “
কথা শেষ করার আগেই অষ্টাদশীর ওষ্ঠ যুগল তূর্যর দখলে চলে যায়। বৃষ্টির পানিতে পৃথার ভেজা চুলগুলো তূর্যর হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে আবদ্ধ। কিছু সময়ের ব্যবধানেই তূর্য পৃথার কানের কাছে মুখ নিয়ে তাকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“ বলো তো মেয়ে, তুমি প্রেমিকা নাকি স্ত্রী? “
পৃথা জবাব দেয় না। নিজের রুদ্ধশ্বাস গুণতে ব্যস্ত সে। তার রক্তিম আবিরে রাঙা চেহারা দেখে তূর্য মৃদু হেসে আবার বলে,
“ দেনমোহর তো বিয়ের দিনই পরিশোধ করে দিয়েছিলাম। এখন কি তাহলে নিজের হক বুঝে নিবো? “
পৃথা তূর্যর বুকে দু’হাতের সাহায্যে আলতো ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দৌড়ে ছাদের রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সাথে সাথে সে বুঝতে পারে এই ছাদের রেলিঙ একা টপকানোর সাধ্যি তার নেই। অর্থাৎ তূর্যর থেকে পালানোর কোনো রাস্তাও নেই। পৃথা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। তূর্য এখনো বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি পৃথাতেই নিবদ্ধ। পৃথাকে তাকাতে দেখেই সে নিজের দু’হাত মেলে দিয়ে বলে,
“ ক্যান আই হ্যাভ ইউ ইন মাই আর্মস রাইট নাও? “
পৃথা আকুল চোখে তাকিয়ে রয়। এতোদিন তো সে এটাই চাচ্ছিলো। তূর্যকে সে পেয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু তূর্যর হৃদয় পাওয়া তার বাকি ছিলো। আজ তূর্য আর তার হৃদয় দুটোই পৃথার হয়ে গিয়েছে। তাহলে এতো সংশয় কেন?
অষ্টাদশী আর অপেক্ষা করে না। ভারী বর্ষণ চিড়ে সে দৌড়ে তূর্যর কাছে এসে এক লাফে তার গলা জড়িয়ে ধরে। তূর্যও পৃথার কোমর নিজের পেশল বাহুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পৃথার পা এখন আর মাটি ছুঁইছে না। পৃথাকে আগলে রেখেই তূর্য বলে উঠে,
“ ভাগ্যিস সে রাতে তুমি কল করেছিলে। “
পৃথা নিজের ছোট্ট মুখটুকু তূর্যের ঘাড়ে লুকিয়ে উত্তপ্ত নিঃশব্দ ছেড়ে বলে উঠে,
“ ভাগ্যিস সেদিন আপনি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন। “
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]