যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১০.
পৃথার জ্ঞান নেই বুঝতে পেরেই তূর্য তাদের এলাকার পরিচিত একজন ডাক্তারকে ডাকেন। উনার নাম রইস রহমান। উনি এসে পৃথাকে দেখে সর্ব প্রথম প্রশ্ন করে,
“ এই মেয়েকে তো আগে তোমাদের বাসায় কখনো দেখিনি। কে? “
তূর্য বিনা দ্বিধায় জবাব দেয়,
“ শি ইজ মাই ওয়াইফ আংকেল। “
রইস সাহেব বেশ অবাক হয়। এইতো দু’দিন আগেও তার তরীর সাথে দেখা হলো। কই তরী তো একবারও এই ব্যাপারে কিছু বললো না। দু’দিনের মাঝে কি তূর্যর জীবনে আকাশ থেকে বউ নেমে আসলো? তার উপর হুমায়ুনও এখন দেশের বাহিরে। আসল ব্যাপারটা কি?
রইস সাহেব নিজের কৌতূহলকে ক্ষণিকের জন্য সাইডে রেখে পৃথার চেকাপ শুরু করে। অত:পর আতংকিত গলায় বলে,
“ ওহ মাই গড! তোমার ওয়াইফের দেখছি ডায়েবেটিস আছে। তার উপর হাইপোগ্লাইসেমিয়া কেস। বয়স কত ওর? “
তূর্য চিন্তিত সুরে বলে,
“ ১৮। “
রইস সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়। মেয়েটাকে দেখে তার বেশ ছোটই মনে হচ্ছিলো। এতো কম বয়সের একটা মেয়েকে তূর্যর মতো শিক্ষিত ছেলে কিভাবে বিয়ে করলো? রইস সাহেব এক ডোজ ইনসুলিন দিতে দিতে বলে উঠেন,
“ ব্লাডে সুগার লেভেল লো হয়ে যাওয়ার ফলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। হাসব্যান্ড যেহেতু হয়েছো সেহেতু একটু খেয়াল রেখো ওর ডায়েটের প্রতি। এতো কম বয়সে ডায়েবেটিস থাকলে খাবার দাবারের প্রতি একটু সতর্ক থাকা উচিত। “
রইস সাহেব চলে যাওয়ার পর পরই তূর্য রুমে এসে বসে। তার বাসার কাজের আন্টিও তিনদিনের ছুটিতে আছে। ঘরের অবস্থা কি বিচ্ছিরি! পৃথার জ্ঞান ফেরার আগে তাকে খাবার কিংবা ওষুধ কিছু দেওয়াও যাবে না। তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত তুলে সে। অত:পর শক্ত হাতে পৃথাকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে তাকে পাশের রুমে শুইয়ে দিয়ে আসে।
সবার আগে সে নিজের সব ফাইলস আর বই গুছিয়ে বুকশেলফ এবং টেবিলে রাখে। তারপর সম্পূর্ণ নতুন একটা বেডশিট বিছিয়ে বিছানা গুছিয়ে নেয়। দু’দিনে মিররেও প্রচুর ময়লা জমেছে। তূর্য ক্লিনসার দিয়ে সম্পূর্ণ মিরর ভালো করে মুছে কেবিনটটাও গুছিয়ে নেয়। এসব দিকে তার তেমন একটা লক্ষ্য করা হয়নি কখনো। সে, আপি আর তার পাপা প্রায় সবসময়ই কাজের কারণে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাহিরেই থাকে। বাসায় ফিরে দু মুঠো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়াই তার নিত্যদিনের অভ্যাস। সেখানে এতো কিছু নোটিশ করার সময় কোথায়?
একঘন্টার ব্যবধানেই তূর্যের ঘর গুছানো সম্পন্ন হয়ে যায়। সাথে সাথে সে দেরি না করে পাঁচ মিনিটের ভেতর ইন্সট্যান্ট শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে। গায়ের ফর্মাল আউটফিট চেঞ্জ করে একটা আকাশি রঙের টি শার্ট পড়েছে এখন। পাশের রুম থেকে পৃথাকে নিয়ে আসার সময় পৃথা নড়ে উঠে। অত:পর পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তূর্য তা দেখে। নীরবে পৃথাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে উঠে,
“ তোমার তো মারাত্মক অবস্থা! এতো কম বয়সে ডায়েবেটিস কেন? “
পৃথা উত্তর দেয় না। সে আড়চোখে সম্পূর্ণ রুম দেখতে ব্যস্ত। এতো পরিবর্তন? আলাদিনের জ্বিনের কারসাজি নাকি? তূর্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ব্রাশ করতে করতে পৃথার চারিদিকে বোলানো বিস্মিত দৃষ্টি লক্ষ্য করে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে উঠে,
“ খাবার রেডি আছে। আমি গরম করে নিয়ে আসছি। ওয়েট ফর মি। “
পৃথা একপাশে ফিরে পাশের মাথার বালিশটাকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। তার আম্মা আব্বা কোথায়? উনারা কি জানতে পেরেছেন তাদের মেয়ে কত বড় এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে? জানতে পেরেও একবারও কথা বলতে চায় নি উনারা? পৃথার প্রতি খুব রাগ বুঝি তাদের?
__________
সন্ধ্যার ফ্লাইটেই সিলেট থেকে ঢাকা ফিরে এসেছে আফজাল সাহেবরা। দুপুরে জমিলার কল পেয়ে জানা ঘটনা শুনে আর এক মুহুর্ত স্থির থাকতে পারে নি তারা? তার দুই ছেলে মেয়ে বিয়ে করে নিয়েছে মানে কি? বিয়ে কোনো মগের মুল্লুক নাকি?
দরজায় জোরে জোরে হওয়া করাঘাতের কর্কষ শব্দে তরী ভ্রু কুচকে মাথা তুলে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে বুঝতে পারে এখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। তরী উঠে বসে নিজের চোখ কচলে নেয় কিছুক্ষণ। অত:পর ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে দিতেই সামনে আতংকিত জমিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
“ ওগো বড় বউ। তোমার শশুর, শাশুড়ি, দেবর আইস্যা পড়সে। নিচে তুফান শুরু হইসে। পার্থ বাপও তো হেই সকালে বাইর হইসে এখনো ফিরে নাই। তুমি নিচে চলো। “
তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সবে তো মাত্র শুরু। এখন এই ফ্যামিলি, তারপর নিজের পাপা, তারপর পরিচিত সকলকেই তার এখন হ্যান্ডেল করতে হবে। ওই স্ক্রাউন্ডেলটা ঠিকই নিজে ঝামেলা বাঁধিয়ে এখন কুরক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়েছে। তরী বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“ ভীতুর বাচ্চা কোথাকার। “
নিচে নামতেই সে সর্বপ্রথম দেখতে পায় নিজের শাশুড়িকে। ভদ্র মহিলা সোফায় বসে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে এবং বিলাপ পারছে,
“ আমার ছেলে মেয়ে দুইটা কই গেলো? এই শোভন! তোর দাদা আর বোনরে ফোন দে। ওদের আমার কাছে আসতে বল। “
মহিলার থেকে কয়েক হাত দূরে ফোন কানে ব্যস্ত পায়ে হাঁটা ব্যক্তিটা তার দেবর তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তরীর। এই সকল কিছুর মাঝে শান্ত চুপচাপ বসে থাকা আফজাল সাহেবও তরীর দৃষ্টিগোচর হয় না। তরী একটা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। অত:পর লিভিং রুমে প্রবেশ করে বলে উঠে,
“ আসসালামু আলাইকুম এভ্রিওয়ান। আমি আপনাদের বড় ছেলের বউ তরী। যদিও এই ইন্ট্রোডাকশনটা আপনাদের ছেলের করানোর কথা ছিলো। কিন্তু আনফরচুনেটলি হি ইজ এ ম্যানারলেস। এজন্যই জোর করে একটা মেয়েকে তার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে পেরেছে। “
আফজাল সাহেব, সাদিকা বেগম এবং শোভন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে দেখছে তাদের ঘরের নব বিবাহিত বড় বউকে। আফজাল সাহেব প্রশ্ন করে,
“ ওহ! তুমিই সেই মেয়ে! সবার প্রথমে তুমি আমার এই কথার জবাব দাও আমার ছেলের তোমাকে জোর করে বিয়ে করার পিছনে কারণ কি? “
তরী বুকের কাছে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বলে,
“ তা আপনি নিজের ছেলের থেকেই জেনে নিয়েন। আর বাকি রইলো আপনাদের ঘরের মেয়ের কথা তাহলে সে এই মুহুর্তে আমার বাবার বাসায় আছে। ওর বিয়েটা আমার ভাইয়ের সাথে হয়েছে। “
সাদিকা বেগম আবার কান্না জুড়ে বসে। শোভন বিরক্তিকর গলায় বলে,
“ আম্মা প্লিজ একটু থামো আপাতত। পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার হতে দাও। “
সাদিকা বেগমের কান্নার শব্দ এখন কিছুটা কমে আসে। শোভন তরীর দিকে দু কদম এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
“ আপনার আর ভাইয়ার ব্যাপার পরে ক্লিয়ার হওয়া যাবে। আগে বলুন আমার বোন আর আপনার ভাইয়ের বিয়েটা কিভাবে হলো? “
“ ওরা খুব সম্ভবত আগে থেকেই পরিচিত ছিলো। পৃথার মুখে শুনলাম ও আমার ভাইকে ভালোবেসে স্ব ইচ্ছায়ই বিয়ে করেছে। যদিও এই ঘটনায় আমার ভাইয়েরও কিছুটা দোষ আছে। ও এই বাসায় আমাকে সিকিউরিটি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তোমার বোনকে বিয়ে করেছে। ইউ ক্যান সে কাইন্ড অফ ক্রস কানেকশন। “
শোভনসহ ঘরের সবাই হতভম্ব। সাদিকা বেগম চিন্তিত সুরে বলে,
“ আমি আমার মেয়ের কাছে যাবো। “
তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ আমার সাথে চলুন আপনারা। “
__________
জ্ঞান ফেরার পর থেকে পৃথা এখনো নিজ থেকে তূর্যের সাথে একটা কথাও বলে নি। কেবল চুপচাপ খাবার এবং ওষুধ খেয়ে বিছানার এককোণে বসে আছে। এর মাঝে তূর্য ল্যাপটপে নিজের একটা আর্টিকেলে কাজ শেষ করে নিয়েছে। আজকের জন্য সে ফ্রি আপাতত। হাতে আর কোনো কাজ নেই।
তাই সে পৃথার সামনে এসে বসে প্রশ্ন করে,
“ এখন শরীর কেমন লাগছে? “
পৃথা উত্তর দেয় না। অষ্টাদশীর অভিমান চরম শিখরে। বিশ্বাস ভাঙায় সে নীরব অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে তূর্যর বিরুদ্ধে। তূর্য অধৈর্য্য হয় না। বরং প্রশ্ন করে,
“ সংসারের কোনো দায়িত্ব তোমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। এতদিন তোমার লাইফ যেভাবে লিড করছিলে এখনো সেভাবেই করবে। পড়াশোনার বয়স তোমার। সো নিজের ফোকাস নিজের লাইফের উপর দেওয়াটাই ভালো। বাই দ্যা ওয়ে, ভার্সিটি নিয়ে প্ল্যান কি তোমার? হাতে তো এখনো তিনমাস সময় আছে। এডমিশনের প্রিপারেশন নিবে নাকি প্রাইভেটে পড়ার ইচ্ছে তোমার? “
পৃথা জবাব না দিয়ে ফট করে তূর্যর সামনে থেকে উঠে চলে যেতে নেয়। তূর্য পৃথার একহাত খপ করে ধরে তাকে টেনে আবার নিজের সামনে বসায়। কঠিন স্বরে বলে,
“ ডোন্ট টার্ন ইউর ব্যাক অন মি। যা ফিল হচ্ছে আমাকে বলো। আমার উপর রাগ থাকলে সেটা প্রকাশ করো। অভিযোগ থাকলে আমাকে জানাও। আমি শুনছি। “
সারাদিনের জমে থাকা পৃথার রাগ এখন মুক্তোর দানার মতো গাল গড়িয়ে টুপটুপ করে পড়তে শুরু করে। তূর্য শান্তস্বরে বলে,
“ যা করে শান্তি পাও আপাতত তা-ই করো। কেঁদে শান্তি পেলে মন খুলে কাঁদো। আমাকে ঘৃণা করে শান্তি পেলে সেটাই করো। “
পৃথার ভরাট সুশ্রী রূপ ইতিমধ্যে কান্নার ফলে লাল রঙ ধারণ করেছে। সে নাক টানতে টানতে বলে উঠে,
“ আমি বোকা। আমি আপনাকে ঘৃণা করতে না পারায় নিজের প্রতি চরম বিরক্ত। আমি কখনো ঘৃণা করতে শিখি নি। কিভাবে করবো? “
তূর্য কণ্ঠস্বর গভীর খাদে নামিয়ে বলে উঠে,
“ তাহলে ভালোবাসো। নিজের জীবন ও নিজেকে আপাতত আমার হাতে ছেড়ে দাও। যতটুকু যা এলোমেলো করেছি সব নিজ হাতে গুছিয়ে দিবো আই প্রমিস। “
পৃথা ফোলা ফোলা চোখ মেলে প্রশ্ন করে,
“ এই রুমের মতো? “
তূর্য এই পর্যায়ে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে উঠে,
“ হ্যাঁ। এই রুমের মতো। “
তূর্যের হাসি দেখে পৃথা অবাক হয়। এইখানে সে হাসার মতো কি এমন বলেছে? তূর্য হাসতে হাসতেই লক্ষ্য করে অষ্টাদশীর দৃষ্টি। এই বয়সের মেয়েদের আবেগ হলো বরফের ন্যায়। আগুনের ফুলকির কাছে এতেই গলে পানি হয়ে যায়।
কলিংবেলের শব্দ ভেসে আসতেই তূর্য নিচে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে সে কিছু বলার আগেই তার গালে সজোরে একটা চড় পড়ে।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]