#যুগলবন্দী_পায়রা
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-৩
চোখ পিটপিট করে তাকালো মহুয়া। মাথার উপর ভনভন করে পাখা ঘুরছে। ঘরটিতে মৃদুমন্দ আলো। দূর কোথা থেকে ভেসে আসচ্ছে কাঠগোলাপের তীব্র গন্ধ। মহুয়া আশে পাশে চোখ বুলালো। কটা বাজে?জানা দরকার? খোলা জানালা দিয়ে রাতের মেঘলা আকাশ ভাসচ্ছে আর ফরফর করে আসা বাতাসে উড়ে চলছে শুভ্র আর লাল পর্দা। ঘরটিতে সব রুচিশীল আসবাপত্র-ও শুভ্র আর লাল। মাথায় অসহনীয় ব্যথা নিয়ে উঠে বসতে চাইলো মহুয়া।কিন্তু উঠতে ব্যর্থ সারা শরীরে ব্যথায় জর্জরিত। মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলো বেন্ডেজ করা। মনে পড়ে গেলো এক্সিডেন্টের কথা। মহুয়া ধরফড় করে উঠে বসলো। কোথায় সে? গায়ের কাথা সরিয়ে উঠতেই আরেক ধাক্কা খেলো। তার শরীরে কোনো পুরুষের শার্ট ছাড়া কিচ্ছুটি নেই?গলা শুকিয়ে এলো মহুয়ার। অচেনা, অজানা ভয় ঝেঁকে বসলো তাকে। বার বার পেটে মোচড় দিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে কোনো বাজে ঘটনা ঘটে গেছে কি এই এক পশলা বৃষ্টির রাতে? ধীরে ধীরে সব কথা মনে হতে লাগলো। পা জোরার মালিককে দেখেই জ্ঞান হারিয়েছে মহুয়া! লোকটি তার সাথে বাজে কিছু করে নি তো? কিন্তু মহুয়ার মন সায় দিলো না। লোকটির গভীর কালো কুচকুচে চোখে শুধু শুদ্ধতাই দেখতে পেয়েছিলো মহুয়া। তবে মস্তিষ্ক এর আগের লোক গুলোর কথা ভেবে চাপা ভয়ে জানান দিচ্ছে, ” পুরুষ মানুষ সব এক রকম। একা মেয়ে পেলে ছেড়ে দিবে না কখনোই” কিন্তু মন বলছে মিথ্যা, অহেতুক ভাবনা।
মন আর মস্তিষ্কের সাথে মহুয়া লড়াইয়ের মাঝেই দরজা ঠেলে কেউ ভিতরে পা বাড়ালো। মহুয়া চোখ মেলে তাকাতেই ভেসে উঠলো লোমহীন উদাম বুকের অত্যন্ত সুপুরুষ। মহুয়ার চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠলো। মস্তিষ্কে খেলে গেলো নানান প্রশ্ন। মুহূর্তই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ফোঁটা ফোঁটা জল। মহুয়ার ফ্যাকাসে মুখ দেখে ভ্রু কুচকে গেলো ইয়ামিনের। মহুয়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অাতঙ্কিত কন্ঠে বলল,,
“আপনি ঠিক আছেন কাঁদচ্ছেন কেনো? ব্যথা বেশি করছে কি? ডাক্তার ডাকবো?”
মহুয়া হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইয়ামিনের দিকে। গৌরবর্ণের দীর্ঘ দেহী পুরুষ। শক্তপোক্ত ব্যয়ামপুষ্ঠ শরীর। ভ্রু জোড়ার নিচে কালো কুচকুচে মনির গভীর চোখ জোড়া। উদম লোমহীন বুক। শুধু পরনে আছে একটি কালো টাউজার। যা নাভির নিচে নেমে আছে। মহুয়া মনে আতঙ্ক আরো ভর করলো। ইয়ামিন আরো কাছে আসতেই ঝাপিয়ে পড়ে কন্ঠ নালি চেপে ধরলো।মহুয়ার বড় বড় নখ দেবে রক্ত বেড়িয়ে আসে ইয়ামিনের গলা থেকে।ইয়ামিন বিস্ময়ে হতভম্ব। মহুয়ার চিৎকারে তার সম্বিৎ ফিরে পেলো।
” কেন করলের এমন বলুন? কেন করলেন?”
ইয়ামিন মহুয়ার হাতটি তার কন্ঠনালি থেকে শরীয়ে মহুয়ার পিঠের দিক নিয়ে ঠেসে ধরল। মহুয়া ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো। ইয়ামিন মহুয়ার মুখের তাকিয়ে বুঝতে চাইলো। হচ্ছেটা কি? মেয়েটা বলছেটা কি? খানিকটা বাদে ধাতস্থ হয়ে ভয়ানক গমগম কন্ঠে বলল,,
“কি যাতা বলছেন? কি করেছি আপনার সাথে?আমি আপনাকে হেল্প করেছি কই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন? না করে আমার গায়ে দাগ বসাচ্ছেন? ”
মহুয়া ছাড়া পাবার চেষ্টা করছে লোকটি তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। মহুয়া নিজেকে ছাড়াবার জন্য ইয়ামিনের বুকে হাত রাখতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি শিরশির করে উঠলো দেহে।কিন্তু কেন? ভয় লাগলো এবার মহুয়ার তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে এক হাতে ধাক্কা দিতে লাগলো। শক্তপোক্ত বিশাল দেহী লোকের সাথে কখনোই পারবে না তার জানা।রাগে কাঁপতে কাঁপতে মহুয়া ত্রুদ্ধ স্বরে বলল,,
“আপনার শরীরে হালকা দাগ পড়েছে। আর আপনি আমার সারাজীবনে দাগ বসিয়ে দিয়েছেন। ছাড়বো না আমি আপনাকে। কেস ঠুকবো আপনার নামে!ছাড়ুন!”
বলেই মহুয়া কামুড় বসালো ইয়ামিনের বুকে। ইয়ামিন স্তব্ধ হয়ে গেলো। রাগে গজগজ করতে করতে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো মহুয়াকে। মহুয়া উঠতে নিবে তার আগেই তার উপর ঝুঁকে পড়ে ইয়ামিন। গাল চেপে মহুয়াকে ধরে রক্তলাল চোখে তাকিয়ে বলল,
“ইয়ামিনের এক ইশারায় হাজার টা মেয়ে বেড পাটনার হতে রাজি। তোমার মতো বেহেঞ্জি সেখানেই নিতান্তই তুচ্ছ। আমার এতও রুচি খারাপনা যে তোমার সাথে শুতে হবে!”
কঁপালে উঠে গেলো চোখ মহুয়ার। অকপটে বলা ভয়ংকর কথা গুলো কানে বাজতে লাগলো তার। মনের মাঝে এক রাশ বেদনার ছাপ উঠে উঠলো। মনে মনে বলল তার পত্রপ্রেমিকের সে যোগ্য তো? যদি ফিরিয়ে দেয়।বিষন্ন হয়ে গেলো তার মন। চোখের জল টপ টপ করতে লাগলো ।তবুও নিজেকে সামলে বলে উঠলো,,
“এতোই যখন অপছন্দ তাহলে আমার গায়ে হাত কেন দিয়েছেন?”
ইয়ামিন স্বভাবসুলভ ভ্রু কুচকায়। গম্ভীর থমথমে কন্ঠে বলে উঠে,,
” আমি আপনাকে টাচ করিনি!”
“তাহলে আমার কাপড়!”
“মিস নিরু পালটে দিয়েছেন আপনার কাপড়। ”
সরে এলো ইয়ামিন। মহুয়া পড়েই রইলো বিছানা। ইয়ামিনের চোখের সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেয়ে গেলো সে। এক গাদা আড়ষ্টতা ভর করলো।নিজের কাজে নিজেই লজ্জা পেয়েছে সে। লোকটি তাকে সহায়তা না করলে সত্যি সত্যি কোনো পশুর শিকার হতো সে। মুহূর্তে কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আসতে চাওয়ার আগেই টুপ করে গিলে নিলো মহুয়া। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,,
” আমি দুঃখীত। আপনাকে আমি ভুল বুঝেছি! ”
ইয়ামিন আবার তাকালো। মেয়েটি উঠে বসে আছে।তখন রাগের মাথায় বেহেঞ্জি বললেও মেয়েটি সুন্দর। ছোট একটি পুতুলের মতো। চুল গুলো এলো মেলো হয়ে আছে। মুখটা দেখতে নিতান্তই বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে। গায়ের রঙ হলদে ফর্সা। ইয়ামিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো মহুয়াকে।তার চোখ মাথার চুল থেকে মুখ, গলায় আসতেই নজর সরিয়ে নেয়। ধস্তাধস্তির সময় মহুয়া শার্টের বোতাম ছিড়ে গেছে দুটি। ইয়ামিনের নজর এভাবে ফিরিয়ে নিতেই ভ্রু কুচকে যায় মহুয়ার। নিজের দিক তাকিয়ে দেখতেই আত্মকে উঠলো মহুয়া। বিছানার চাদর টেনে গায়ে জড়িয়ে বসে পড়লো। ইয়ামিন গলা পরিস্কার করে বলল,,
“রেস্ট করুন। সকালে কথা হবে!”
ইয়ামিনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো মহুয়া। প্রশস্ত পিঠে ছোট ছোট লাল তিল। আর ঠিক মাঝামাঝিতে রক্ত জমাটবাধার মতো জম্মদাগ ভাস্যমান।মহুয়া চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিজেকে লুচু লুচু মনে হলো। লোকটিই বা কেমন? একটি মেয়ে মানুষের সামনে উদোম বদোম ঘুরছে?মহুয়া বিছানা গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিকে কাজ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে পাওয়া চিঠির কথা গুলো মনে করতে করতে ঘুম জগতে পাড়ি জমালো মহুয়া।
——
তিন দিনের মাথায় চিঠি নিয়ে হাজির হয়েছিলো পায়রাটি। মহুয়া সেদিন ভিষণ অবাক।বুকের ধড়ফড়ানী বৃদ্ধি পেয়েছিলো কয়েকশ গুন।মনে হচ্ছিল সিনেমার মতো তার চারপাশে গান বাজতেছে, স্ব স্ব শব্দে হাওয়া বইছে। নিজেকে নব্বই দশকের প্রেমিকা প্রেমিকা লাগচ্ছে। যদিও সে মনে মনে চাইতো লোকটির কাছ থেকে আসুক, ফিরে আসুক তার উত্তর। কিন্তু এত জলদি ভেবেই পেলো না সে! চটপট চিঠি খুলতেই ভেসে উঠলো চেনা পরিচিত গোটা গোটা অক্ষরের গুটি কয়েক লিখা। এতেই যেন মহুয়া সন্তুষ্ট। বার কয়েক বার পড়ে নিলো সে। যতবার পরে বুকে ভিতর ডিপ ডিপ করে ওয়াজ শোনা বেড়ে যায়! এমন কেন হচ্ছে?মহুয়া আবার পড়লো,,
” আমার চিঠি কখনোই সঠিক ঠিকানায় যাবে না মিস মরিচীকা। আমার প্রিয়তমা তার শহর আমার জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। চাইলে-ও সে আমাকে ধরা দিবে না। কখনোই আমার কাছে ধরা দিবেনা। তবুও অবাক হয়েছি। ১৬ কোটি মানুষের ভীরে এত বছরে কেউ চিঠির উত্তর তো দিলো! কিন্তু সেই অপরিচিত চিঠি মিতার নামটি বেমান হয়ে গেলো না? সত্যি বলতে এই রহস্য জানতেই আমার এ পত্র লিখা।
ইতি,
আপনার নাম দিয়া পাগলাটে নিশ্চুপ প্রেমিক।
এক নিমিষেই আরেকবার পরে উত্তেজনায় থর থর করে কেঁপে উঠেছিলো সে। ইশ কি অনুভূতি, কত আবেগে সেদিন চোখের জল টুপ করে পড়ে গেছিলো। সেদিনের অনুভূতি যেন আজও পুরোনো নয়। দিন, গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর তার পরেও অনুভূতি বাড়চ্ছে। বাড়চ্ছে অপেক্ষা করা মিষ্টি অনুভূতি। গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো মহুয়া। সত্যি কি এই অনুভূতিতে জর্জরিত হয়ে থাকা এক বুক ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে?
চলবে,