মৌনতা পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

1
1173

#মৌনতা
#পর্ব_৭ (অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
মেহরাব আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“কেঁদো না পুষ্প। ফুলের চোখে পানি মানায় না।”

আমি ছিটকে দূরে সরে গেলাম। তার একটুখানি আহ্লাদে তো আর আমার এতদিনের কষ্ট, রাগ-অভিমান সব মুছে যেতে পারে না। আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,

“ফুলের চোখে পানি মানায় না?”

“না।”

“তাহলে কেন কাঁদান?”

“আ’ম সরি।”

“সরি?”

“হ্যাঁ।”

“কীসের জন্য?”

“তোমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য।”

“কষ্ট তো আপনি আমাকে কম দেননি। কোন কষ্টের জন্য সরি বলছেন?”

“সব।”

আমি থম মেরে রইলাম। এত শত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও যেন কিছুই বলতে পারছিলাম না। সে আমার হাত টেনে ফের জড়িয়ে ধরল। আমি এবার গলে গেলাম না। কঠিনস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,

“এসব আহ্লাদ কেন দেখাচ্ছেন হঠাৎ?”

“তুমি এমন কঠিন করে কেন প্রশ্ন করো?”

“কারণ আপনি আমাকে এমন বানিয়েছেন।”

মেহরাব চুপ করে রইল। আমি বললাম,

“আমি জানি, আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আমাদের সম্পর্কটা অনেকটাই পরগাছার মতো আপনার কাছে। গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছি তো? কোনো সমস্যা নেই। কথা দিচ্ছি, আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাব। তার আগে আমার শুধু কিছু প্রশ্ন আছে আপনার কাছে। সেগুলোর উত্তর চাই আমি। এরপর সময়মতো মুক্তি পেয়ে যাবেন।”

“যদি মুক্তি না চাই?”

“চাইবেন না কেন? বিয়ের দিন থেকে মুক্তিই চেয়ে আসছেন। শুধু মুখে বলতে পারেননি এতদিন। আজ যা দেখলাম তা তো আর মুখে বলে দিতে হবে না।”

“আমাদের দেখার আড়ালেও অনেক সত্য লুকিয়ে থাকে পুষ্প।”

“ঠিক কোন সত্যটা আমার দেখার আড়ালে রয়েছে আমাকে বলতে পারবেন?”

“রূপা আমার পূর্ব পরিচিত ছিল। আমার এক বন্ধুর খালাতো বোন। ওর ফোনেই আমি প্রথম রূপার ছবি দেখেছিলাম। ভালো লেগে গেছিল দেখে। প্রেম-ট্রেম করার বয়স, সময় কোনোটাই এখন আমার নেই। আর না আছে তেমন কোনো ইচ্ছে। তাই পরিবারের মাধ্যমেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। ওর সাথে আলাদা কথাও হয়েছিল আমার। তখন বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে কিনা। কিন্তু ও স্বীকার করেনি। কেন করেনি সেটাও জানিনা। নিজের ইচ্ছেতেই বিয়েতে মত দিয়েছিল। পছন্দের মানুষটাকে পাব তাই এক্সাইটেড ছিলাম। কিন্তু বিয়ের দিন যে আমার জন্য এমন কিছু অপেক্ষা করছিল আমি সেটা মোটেও আশা করিনি। রূপার পালিয়ে যাওয়া শুধু ওর পরিবারের জন্যই লজ্জাজনক ছিল না; আমার এবং আমার পরিবারের জন্যও অপমানজনক ছিল। ও যদি আমাকে একটাবারও বলত যে, ওর অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে তাহলে আমি কখনোই বিয়ের ব্যাপারে আগাতাম না। কিন্তু ও সেটা না করে অপমান করে গেল। এই বিষয়টা একদম ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে। যখন ওর ছোটো বোনকে বিয়ের ব্যাপারে আমার মতামত জিজ্ঞেস করা হলো তখন আমি না-ই বলতে গেছিলাম। ঐ সময়ে তুমি বললে তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি অবাক হইনি। কেন জানো? আমার প্রতি তোমার রাগ, জেলাস এসব দেখে অনেক আগেই আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে তোমার মনে আমার জায়গাটা অন্যরকম। কিন্তু আমি বুঝেও না বোঝার ভান করতাম। এর অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে আমার এজ ডিভারেন্স। আমার কেমন আনইজি লাগত। যখন আব্বু তোমাকে বিয়ে করতে বলল তখন আমি এমন একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম যে কিছু বলতেও পারিনি।”

এইটুকু বলে সে থামল। আমি চুপচাপ তার কথা শুনে যাচ্ছি। সে দম নিয়ে ফের বলা শুরু করল,

“বিয়ে করে বাড়ি ফেরার পর মনে হলো তোমাকে বিয়ে করা আমার উচিত হয়নি। একদিকে রূপার এভাবে অপমান করে পালিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে তোমাকে বিয়ে করা; সবকিছু নিয়ে আমার মন খুব বিক্ষিপ্ত ছিল। বারবার মনে হতো, তোমাকে বিয়ে করে তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি। নিজেকে অনেক ছোটো লাগত। অস্বস্তি হতো তোমার সামনে। আগের সেই সহজ-স্বাভাবিক ব্যবহারও করতে পারছিলাম না। তুমি শুধু দেখেছ, আমি তোমাকে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু তুমি এটা দেখোনি যে আমি কতবার তোমার সাথে কথা বলতে গিয়েছি। তুমি একবুক অভিমান নিয়ে রাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যেতে। আর আমি গভীর রাতে তোমায় বুকে জড়িয়ে মাফ চাইতাম। অভিমানে তুমি নিজের বাড়িতে চলে গিয়ে ভাবলে হয়তো এখন আমি সুখেই আছি। কিন্তু তুমি দেখোনি যে প্রতিটা রাতে আমি কেমন ছটফট করেছি। তুমি দেখেছ, আমি তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি এটা দেখোনি যে তোমার প্রতিটা পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই আমি কলেজে গিয়ে দূরে অপেক্ষা করেছি। এতকিছুর পরও কখনো সরাসরি বলতে পারিনি আমার নিজের লুকায়িত কথাগুলো। নিজেকে অনেক বেশি অপরাধী মনে হতো তাই।”

কথাগুলো অবিশ্বাস্য শোনালেও তার চোখ-মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছে না মিথ্যে বলছে। মিথ্যা বলার কথাও তো নয়। সে আমাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে আমার দু’হাত ধরে বলল,

“আজ যেই মেয়েটাকে আমার সাথে দেখেছ ওর নাম লিজা। আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড। ওর হাজবেন্ড সিয়ামও আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড। আমরা ব্যাচমেট ছিলাম তিনজন। ওরা রিলেশন করে গত দুই বছর হবে বিয়ে করেছে। কিন্তু ইদানীং ওদের বনিবনা হচ্ছে না। সিয়াম চাকরির সুবাদে চট্টগ্রাম থাকত লিজাকে নিয়ে। ঝগড়া করে এক সপ্তাহ্ হবে লিজা ঢাকায় চলে এসেছে। আমি বিয়ে করেছি এটা ওরা জানতো। কিন্তু তোমাকে তো দেখেনি। তাই চিনতে পারেনি। আজ দেখা করেছি সিয়ামকে নিয়েই কথা বলতে। আমরা ওখান থেকে বের হওয়ার পর অবশ্য বলে দিয়েছিলাম, তুমি আমার বিয়ে করা বউ। ও তখনই তোমার সাথে আবার কথা বলতে চেয়েছিল। তোমার ভুল ভাঙাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি দেইনি। কেন জানো?”

আমি মুখে কিছু না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। সে মৃদু হেসে বলল,

“কারণ আমি জানতাম, এই বিষয়ে কথা বলার জন্য হলেও তুমি আমার কাছে আসবে। হয়তো আমার ইগো বেশি। এজন্য হয়তো আমি যেচে তোমার কাছে যেতে পারিনি। নিজেকে তোমার সামনে প্রকাশ করতে পারিনি। তাই এই সুযোগটাও আমি হাতছাড়া করতে চাইনি। তাই সব কাজ রেখে এই সময়ে আমি বাসায় বসে আছি। শুধু তোমার অপেক্ষায়।”

আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। সে আবার দু’হাতের পিঠে চুমু খেয়ে আমার দু’গালে হাত রেখে বলল,

“আমি তোমাকে হারাতে চাই না পুষ্প। ভালোবাসি তোমাকে আমার প্রিয় ফুল।”

নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা আর সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিকই কেঁদে ফেললাম এবার। সে আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল,

“তোমার প্রতি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি আমি। সেজন্য আমি অনুতপ্ত। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও ফুল।”

আমি কাঁদতে কাঁদতেই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,

“আপনি খুব খারাপ খুব। আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করব না। কখনোই না।”

সে হেসে বলল,

“তাই? ঠিক আছে। ক্ষমা করতে হবে না। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার অপরাধে তুমি না হয় আমার সাথে সারাজীবন থেকে শাস্তি দিয়ে যেও। আমি সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব। তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না।”

“কেন যাব না? আপনি তো চাইতেন আমি যেন চলে যাই।”

“না,আমি এমনটা কখনোই চাইতাম না। তবে এটাও ভাবিনি যে, এভাবে তুমি আমার মনে জায়গা করে নেবে। তোমাকে দেওয়া কষ্টগুলোই যে ভালোবাসা হয়ে আমার মনে জন্ম নেবে এটা কে ভেবেছিল বলো?”

“আপনি একটা খারাপ লোক। আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

“ভালোবাসো না তাতেই যেভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছ! ভালোবাসলে না জানি কী করতে!”

এ কথা শুনে আমি তাকে ছেড়ে দিলেও সে আমাকে ছাড়ল না। আমি রাগ দেখিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,

“ছেড়ে দিন আমাকে।”

“এখন তো আর সেটা সম্ভব নয়। একবার যখন এবার হাত ধরেছি তখন মৃ’ত্যু’র আগে আর ছাড়ছি না।”

আমাকে এরপর আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গভীর চুমু এঁকে দিল আমার ওষ্ঠদ্বয়ে। আমি গুটিয়ে গেলাম। শান্ত হয়ে গেল আমার রাগী, অভিমানি মন। মিশে গেলাম তার বুকে। খুশিতে, আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

“আপনাকে ছেড়ে আমি কী করে থাকব? ভালোবাসি তো আমি।”

“ভালো তো আমিও বাসি। মৌনতা কাটিয়ে এবার পূর্ণতা দেই চলো সম্পর্কটাকে?”

আমি তার কথা না বুঝে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলল,

“বোঝোনি?”

“উঁহু!”

“এজন্যই বাচ্চা মেয়েদের বিয়ে করতে নেই। সব একদম হাতে-কলমে শেখাতে হয়। ভালোবাসি, ভালোবাসি শুধু মুখে বললেই হবে? এতদিন মৌনতা পালন করে দুজন যে সম্পর্কটাকে অপূর্ণ রাখলাম সেটাকে পূর্ণতা দান করতে হবে না? এখনো বোঝোনি?”

আমি দু’দিকে মাথা নাড়ালাম। আসলেই বুঝতে পারিনি আমি। এবার সে ধৈর্যহারা হয়ে বলল,

“উফ! আর মুখে কিছু বলতে পারব না।”

এরপর আমাকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে যখন জানালা লাগিয়ে দিচ্ছিল তখন বুঝলাম মৌনতার বদলে পূর্ণতার মানে। এত লজ্জা আর ভয় লাগছিল! সেই সাথে অদ্ভুত একটা অনুভূতি আর আনন্দও লাগছিল। আনন্দ তো হবেই। অবশেষে মানুষটা যে আমাকে ভালোবাসলো। আজ তো পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি। তার ভালোবাসার প্রতিটা ছোঁয়ায়, স্পর্শে এতদিনের জমায়িত মৌনতা একটু একটু করে ভাঙতে লাগল। সব ভালোবাসার মানুষগুলোর ভালোবাসা এভাবেই পূর্ণতা পাক। মৌনতা না আসুক কারও জীবনে।

(সমাপ্ত)

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে