মোহনেশা পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
992

#মোহনেশা (অন্তিম পর্ব)
কেটে গেছে কয়েকটা মাস। রমজান মাসও প্রায় শেষের দিকে। এর মাঝে খবর এসেছে সারা আর মেহনাজের বিয়ের অনুষ্ঠানটি ঈদের পরের দিনই সম্পন্ন হবে। ইরফানের অফিস আর মিতুলের কলেজও ছুটি। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামীকালই তারা বাড়িতে ফিরবে।
সন্ধ্যায় দুজনে মিলে মার্কেটে চলে যায় নিজেদের জন্য ও পরিবারের সবার জন্য টুকটাক কেনাকাটা করার জন্য। একটা লেডিস শপে ঢুকে দুজনে বাড়ির সবার জন্য জামা-কাপড় দেখা শুরু করে। নানীর জন্য একটা শাড়ি বেছে নিয়ে ইরফান শপে কর্মরত একজন মহিলা কর্মীকে ডাক দেয়।
-এক্সকিউজ মি আপু? (ইরফান)
-জ্বী স্যার বলুন।
মহিলা কর্মীকে দেখে ইরফান রীতিমত থমকে গেছে।
-নিসা তুমি এখানে? (ইরফান)
মাথা নামিয়ে নেয় নিসা।
-জ্বী স্যার ব… বলুন আপনার কোনটা পছন্দ হয়েছে? আমি প্রাইস দেখে দিচ্ছি। (নিসা)



বর্তমানে একটা কফিশপে ইরফান ও মিতুলের মুখোমুখি বসে আছে নিসা।
-তোমার ওয়াইফ? (নিসা)
মিতুলের কাধে হাত রেখে ইরফান বলে ওঠে,
-হুম আমার ওয়াইফ মিতুল।
ইরফানের কান্ডে মুচকি হাসে মিতুল।
-বাহ খুব মিষ্টি তো। দেখেছো তুমি জিতেছো কিন্তু। এত কিউট একটা বউ পেয়েছো। বাই দ্যা ওয়ে কংগ্র্যাচুলেশন বোথ অফ ইউ। (নিসা)
-থ্যাংকিউ নিসা। তা তোমার এই হাল কেন? শুনেছিলাম তোমার নাকি তোমার প্রেমিকের সাথেই বিয়ে হয়ে গেছে? তা সে কোথায়? (ইরফান)
নিসার মুখখানা মলিন হয়ে যায়।
-ডিভোর্স হয়ে গেছে। বিয়ের আগে আমি ব্যতীত অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক ছিল তা আমি জানতাম না। বিয়ের পরে এসে বুঝতে পারি সে একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্কে রয়েছে। আমার কোনো ফল্ট খুজে পাচ্ছিলো না সে যে কারণবসত আমাকে ডিভোর্স দেবে। যখন জানতে পারে আমি কখনো মা হতে পারব না সেদিনই আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আর পরে ডিভোর্সলেটার ও পাঠিয়ে দেয়। বড় ভাইয়ের বউও আমাকে সহ্য করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে এসেছি। এখন কোনো মতে নিজের খরচ চালাচ্ছি। ভালো একটা চাকরীর জন্যও চেষ্টা করছি দেখি কি হয়। (নিসা)
নিসার বলা কথায় ইরফান আর মিতুল দুজনেই চরমভাবে অবাক হয়ে যায়। কি বলবে দুজনের কেউই ভেবে পাচ্ছেনা। মিতল তো সেই প্রথম থেকেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
-আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও ইরফান। মিতুল ইরফানের খেয়াল রেখো। তুমি অনেক লাকি। (নিসা)
-ও লাকি না নিসা। লাকি তো আমি যে ওর মতো একজন লাইফপার্টনার পেয়েছি। ধন্যবাদ তোমাকে নিসা। (ইরফান)
অপলক ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে মিতুল। নিসা দুজনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কফিশপ থেকে বের হয়ে যায়। ক্ষানিক বাদে ইরফান আর মিতুলও বের হয়ে যায়।

কতগুলো মাস পরে দুজনে আজ বাড়ি ফিরেছে। মিতুল তো তার মাকে সেই দশ মিনিট যাবৎ জাপটে ধরে আছে। আজ কতদিন পরে মনের তৃষ্ণা মিটেছে তার। পরিবার থেকে দূরে কি মানুষ থাকতে পারে? কতটা কষ্ট হয় তা একমাত্র যে থাকে সেই জানে।
ঈদের দিনে সকাল সকাল গোসল করে সবাই নতুন জামা-কাপড় পড়ে নেয়। বাড়িতে হই-হুল্লোড় লেগে গেছে। ছেলেরা সকলে জোট বেধে গেছে ঈদের নামাজ আদায় করতে। নামাজ পড়ে এসে সকলে এক সাথে সেমাই,নুডলস,মিষ্টি,পায়েস খেয়েছে। বড়রা সকলকে ঈদের সালামি দিয়েছে। মিতুলের দাদী তার সব নাতী আর পুতনিদের ডেকে নিয়ে তাদের জন্য গড়িয়ে রাখা স্বর্ণের চেন পরিয়ে দিয়েছেন। সকলে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিকালের মেহনাজ ও সারার গায়ে হলুদের আয়োজন করতে।
হলুদে বর ও কনেকে ম্যাচিং বোটল গ্রিন কালারের পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরানো হয়। আর বাকি ছেলে ও মেয়েরা কচিপাতা কালারের পাঞ্জাবি ও শাড়ি পড়ে। চারদিকে শুধু রঙ-বেরঙের মরিচবাতি জ্বলছে। রাত পার হতেই খুব ভোরেই বিয়ের আয়োজন করতে সকলে কাজে লেগে পড়ে। কারোই আজ ঘুম পোরেনি। বিয়ে বাড়িতে আবার ঘুম? পুরোই অসম্ভব একটা ব্যাপার। বেশ সুন্দর ভাবেই মেহনাজ ও সারার বিয়ে সম্পন্ন হয়।
রাতে সকলে এখন বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন।
-মিতুল আমার রুমের বারান্দায় যা তো। আমি আসছি। বেশ গম্ভির সুরেই বলে ওঠে ইরফান।
সবেমাত্র লেহেঙ্গা বদলে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল মিতুল। ইরফানের কথায় সোজা ইরফানের রুমের সাথের বারান্দায় চলে যায়। ইরফান দুটো কাপে গরম গরম ধোয়া উড়ানো চা নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করে।
-আই এম এক্সট্রেমলি সরি মিতুল। জানি তুই অনেক ক্লান্ত। কিন্তু আমার মনটা যে বড্ড অশান্ত হয়ে আছে। ভাবলাম তোর সাথে একটু সময় কাটালে হয়তো ভালো লাগবে। বলেই মিতুলের দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে মিতুলের পাশের টুলে বসে পড়ে ইরফান।
-ব্যাপার না। আমারো ঘুম আসছিল না। কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? (মিতুল)
-না শরীর খারাপ না। তোর সাথে একটু গল্প করার জন্য মন চাইছিল। মনের ভেতর অশান্ত হয়েছিল এতক্ষণ। এখন থেমেছে। কি জাদু করেছিস মিতুল? (ইরফান)
ইরফানের কথায় রিনঝিনে কন্ঠে হেসে ওঠে মিতুল। হাতের কাপটা টুলের ওপর রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে মিতুল। এগিয়ে গিয়ে বারান্দার র‍্যালিং ধরে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ইরফান উঠে গিয়ে মিতুলকে পেছন থেকে জাপটে ধরে।
-আমায় একটু ভালোবাসবি মিতুল? কেন জানিনা তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মন সারাক্ষণ আশান্ত হয়ে থাকে। চারপাশের কিছুই ভাল্লাগেনা। বল না একটু ভালোবাসবি আমায়? (ইরফান)
পেছনে ঘুরে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরে মিতুল।
-আমিযে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসি তাকি চোখে বাধেনা? কি শুরু করেছেন, “একটু ভালোবাসবি আমায়?” আমি যে আপনাকে নিজের চেয়েও ভালোবাসি। আর একটু না অনেকখানি ভালোবাসি। যার পরিমাণ আপনি সারাজীবন বসেও হিসাব করতে পারবেন না মিঃ সাইক্লোন। (মিতুল)
মিতুলকে দুবাহুতে আগলে নিয়ে ইরফান বলে ওঠে,
-প্রথমবার ভালোবেসে যখন ঠকে গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল দ্বিতীয়বার আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব না। কিন্তু তুই ঝরের গতিতে এসে আমার লাইফটাকেই চেঞ্জ করে দিলি। আমার সিগারেটের নেশার মতো তুই আমার মোহনেশায় পরিণত হয়ে গেলি মিতুল। কি জাদু জানিসরে?
ইরফানের কানের কাছে মুখ নেয় মিতুল।
-ভালোবাসার জাদু মিঃ সাইক্লোন। ভালোবাসার জাদু। ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলে আবার রিনঝিনে কন্ঠে হেসে ওঠে মিতুল।

-আরাফ নাকি অনেক অসুস্থ। তার বাবা এসে নাকি অনেক মাফ চেয়েছে মামাদের কাছে এসে। আরাফও নাকি মাফ চেয়েছে জেলে বসে। তোর কাছে বার্তাটা পৌছে দেওয়ার অনেক অনুরোধ করেছে নাকি। ক্ষমা করে দিস ওকে। ক্ষমা করা কিন্তু মহৎ গুণ। (ইরফান)
-ক্ষমা তো করেই দিয়েছি। কি হয়েছে তার? (মিতুল)
-কি এক মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। নামটাও ঠিক করে জানতে পারলাম না। দোয়া করতে বলেছে। হয়তো বেশিদিন বাচবেনা। কাল তোকে নিয়ে যাব একটাবার দেখে আসব। ঠিক আছে? (ইরফান)
-আচ্ছা ঠিক আছে। (মিতুল)

ইরফান টুলে গিয়ে বসতেই মিতুল একটা সিগারেট এগিয়ে দেয় ইরফানের দিকে।
-কই পেলি? (ইরফান)
-সেদিন ফেলে দেইনি। রেখে দিয়েছিলাম। এই নিন শেষবারের মতো এই একটাই নিতে পারবেন। আর কখনোই কোনোদিনই পারবেন না খেতে। (মিতুল)
-শেষবারের জন্যও দরকার নেই। ফেলে দে। (ইরফান)
ইরফানের কোলে বসে পড়ে মিতুল সিগারেটটা ধরিয়ে নিজে একটা টান দেয়। ধোয়ার বেগ সইতে না পেরে খুকখুক করে কাশতে শুরু করে। ইরফান মিতুলের হাত থেকে সিগারেটটা টেনে নিয়ে নিভিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়।
-যেটার অভ্যাস নেই সেইটা ট্রাই করিস কেন? (ইরফান)
-না দেখলাম আপনি কিভাবে খান এটা। কি জ/ঘ/ন্য জিনিস এটা! আপনি এটা খেতেন কিভাবে? ইশশ! (মিতুল)
মিতুলের কথায় হোহো করে হেসে ওঠে ইরফান।
-দ্বিতীয়বার আর এটার ট্রাই করিস না। দেখা গেল আমাকে রেখে তুই সিগারেটের নেশাতেই আটকে গেলি। (ইরফান)
-ইশ! জ/ঘ/ন্য কথাবার্তা। আর দিতীয়বার হাতে নিলে তো? আর আপনাকে কখনো এটা ছুতে দেখেছি তো হাত ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে দেব একদম। (মিতুল)
-নির্দিষ্ট একজনের মোহনেশায় আটকে গেলে দ্বিতীয় কোনোকিছুতেই মানুষ আর আটকায় না। তুই আমার সেই মোহনেশা মিতুল। (ইরফান)
চোখ বুজে মিতুল ইরফানের কথা শুনতে থাকে। সেই মুহূর্তেই ইরফান মিতুলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
-একটা কথা বলি?
-হুম বলুন? (মিতুল)
-আই নিড ইউ জরিনার আম্মা। ক্যান আই…
ইরফানকে কথাটি শেষ না করতেই দিয়েই মিতুল ঘপ করে কোল থেকে সোজা হয়ে ওঠে দাঁড়ায়। চোখ-মুখ কুচকে ইরফানের দিকে তাকায়।
-কি বললেন? (মিতুল)
-কই কি বললাম? ঠোট টিপে হেসে বলে ওঠে ইরফান।
-না না আবার বলুন আপনি তখন কি বলছিলেন? (মিতুল)
টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মিতুলের দিকে হালকা হেলে পড়ে ইরফান।
-সত্যিই বলব? (ইরফান)
-না থাক আমি শুনব না।
বলেই দৌড়ে বারান্দা হতে বের হতে নিতেই ইরফান মিতুলের হাত টান দিয়ে নিজের দিকে নিয়ে আসে।
-কেন শুনবানা জরিনার আম্মা? ও জরিনার আম্মা চোখ বুজলা কেন? (ইরফান)
-আপনি এত ফা/জি/ল কেন হ্যা? (মিতুল)
-আমি যদি ফাজিল হয়ে থাকি তবে তুমি কি হুম? (ইরফান)
-কেন! জরিনার আব্বার বিয়া করা একমাত্র বউ। বলেই দৌড়ে বারান্দা হতে বের হয়ে যায় মিতুল। মৃদু হেসে মিতুলের পেছনে দৌড়ে যায় ইরফান।
আর সেই সুন্দর রাতের সাক্ষী হয়ে থাকে স্নিগ্ধ রাতের আকাশের সেই অপূর্ব সুন্দর চাঁদ,যা আজ পর্যন্ত লক্ষ-কোটি ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে এসেছে।

~সমাপ্ত

আফিয়া অন্ত্রীশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে