মোহনেশা পর্ব-০২

0
815

#মোহনেশা (২)
-আপনি সিগারেট খান ইরফান ভাই!

সিগারেটে সর্বশেষ টানটা দিয়ে অবশিষ্টটুকু মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে পিষে আগুন নিভিয়ে দেয় ইরফান। নাক-মুখ থেকে অঝোরে তীব্র গন্ধুযুক্ত সিগারেটের ধোয়া বেরিয়ে আসছে । বেশ শান্ত স্বাভাবিকভাবেই মিতুলের কথার জবাবে বলে ওঠে,
-হ্যা এই মাঝেমাঝেই দুই একটা চলে আরকি। মাকে বলিস না কষ্ট পাবে। মা জানে বহুত আগেই ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু কি বলত একবার যেটার প্রতি নেশা জন্মে যায় তা থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে পারেনা। সবার সামনে নিজেকে ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নিয়ে চললেও মাঝে মাঝে কেমন যেন নিজেকে পাগল পাগল লাগে। মন বড্ড অশান্ত হয়ে পড়ে। তখন এই একটা সিগারেটের ধোয়া গিয়ে মন মাথা সব ঠান্ডা করে দেয় মিতুল।

ইরফানের কথার আগামাথা কিছুই মিতুলের মাথায় ঢোকেনা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই ইরফানের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে সে।
-তা আপনি জানেন না যে সিগারেট খাওয়া একদম উচিত না? আপনিতো বেশ আমাকে পান খাওয়া নিয়ে বকাঝকা করেন। তবে নিজে কেন এটা খান? (মিতুল)

-আমি যা করি করি। হই আমি বড্ড খারাপ। তোরাও কি তাহলে আমার মতো হবি? (ইরফান)
-তাও আপনি ছাড়বেনা না এটা? কিঞ্চিত রেগে বলে ওঠে মিতুল।
-তোর ইরফান ভাইয়ের যন্ত্রণা কমায় এই সিগারেট। তোর ইরফান ভাই যে বড্ড একা হয়ে গেছে মিতুল। (ইরফান)

ইরফানের কথায় মিতুলের বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে ওঠে। টলটলে চোখে ইরফানের উদ্দেশ্যে বলে,
-কি হয়েছে আপনার ইরফান ভাই? কি এমন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আপনি? বলুন না? (মিতুল)
আচমকা ইরফানের খেয়াল আসে এসব সে কি বলছে মিতুলকে? নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ভ্রু বাকিয়ে ইরফান বলে ওঠে।
-কিরে তোর না ফ্রেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা? টেস্টও তো নভেম্বরেই। লেখাপড়া কি করার দরকার পড়েনা? এই সন্ধ্যায় পড়া বাদ দিয়ে ছাদে কি তোর? প্রিটেস্টে ম্যাথে আর হায়ার ম্যাথে কত পেয়েছিলি মিতুল?

ইরফানের কথায় টনক নড়ে ওঠে মিতুলের। আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
-ইয়ে মানে…
-কি ইয়ে মানে? বল কত পেয়েছিলি? (ইরফান)
-আমি যাচ্ছি আমার অনেক পড়া আছে ইরফান ভাই। আপনি ছাদ থেকে নামার আগে আমার গাছগুলোতে একটু পানি দিয়ে দিয়েন। যাই। বলেই এক ছুটে নিজের রুমে চলে আসে মিতুল।

-কিরে মিতুলরাণী হাপাচ্ছিস কেন? কোথা থেকে কি চুরি করে এসেছিস হুম? (সারা,মিতুলের চাচাতো বোন))
-আরে সারা আপু তুমি কখন এলে? (মিতুল)
-এসেছি তো একটু আগে। ইরফান ভাই ঢাকা থেকে আসার আগেই আমাদের বলে দিয়েছিল সে বাড়ি আসছে আমরাও যেন চলে আসি। তাই সবাই চলে এসেছি। (সারা)
-সবাই মানে? (মিতুল)
-সবাই মানে আমি,ইরা আপা,ইরা আপার স্বামী,আমাদের ছোট মোহিনী, রাতুল ভাইয়া,আতিফা আপু,আকিব ভাইয়া সবাই এসেছে। সবাই দাদীর রুমে গেছে। আমি ফ্রেশ হতে তোর রুমের বাথরুমে এলাম একটু আগে। (সারা)

খুশিতে এক লাফ দিয়ে সারার গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদি সুরে মিতুল বলে ওঠে,
-ওরে আপুরে আমার যে কি খুশি লাগতেছে কি বলব। অনেক মিস করি তোমাদের জানো? তুমি ঢাকায় চলে যাওয়াতে আমাকে এখন আর কেউ এ্যাটেনশনই দেয়না।
-এইত্ত চলে এসেছি আমি। এবার আমি একা না সবাই মিলে তোকে এ্যাটেনশন দেব যাহ। বলেই হোহো করে হেসে ওঠে সারা।


মেহনাজের রুমে মিতুলরা সব কাজিনরা মিলে বসেছে আড্ডা দিতে। আজ কত মাস পরে সবাই আবার একসাথে হয়েছে। সকলের মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায় মাঝে মাঝে কেন যে তারা সকলে বড় হয়ে যাচ্ছে!
বিছানার মাঝে বড় একটা ট্রেতে সবার জন্য চা আর আরেকটা ট্রেতে বিস্কুট,চানাচুর আর গরম গরম পাকোড়া দিয়ে গেছেন ইয়াসমিন খানম।

-আচ্ছা তোরা কি কেউ জানিস আমাদের মিতুল লুকিয়ে লুকিয়ে ফেসবুক ইউজ করে? তোরা কি কেউ মিতুলের মতো থাকতে ফেসবুক ইউজ করতি? (ইরফান)

সকলে এক তালে বলে ওঠে, “না না একদম না।“
-কি ভাই আমাকে এই এ্যাটেনশন দেয়ার জন্যই কি তোমরা আজকে এই আড্ডা বসিয়েছো হ্যা? ইরফান ভাই আমার সম্মানকে সুজির হালুয়া বানাতে কি আপনার অনেক ভাল্লাগে? (মিতুল)
-তোর সম্মানকে আবার আমি সুজির হালুয়া বানালাম কখন? আর সম্মানকে সুজির হালুয়া বানায় ও বা কিভাবে মিতুল? এই তোরা কেউ জানিস কিভাবে বানায়? (ইরফান)
-ইরফান ভাই! থামবেন আপনি? আমাকে ফেসবুক একাউন্ট মেহনাজ ভাইয়া খুলে দিয়েছে। (মিতুল)
-কি মেহনাজ তুই খুলে দিয়েছিস? (ইরফান)
-হুম আমিই খুলে দিয়েছি একাউন্ট। ম্যাসেঞ্জারে স্কুল গ্রুপ আর ব্যাচের গ্রুপে কানেক্ট থাকার জন্য। সমস্যা নেই আমি প্রতিদিন আম্মুর ফোনে চেক করি ও কি করে ফেসবুকে। (মেহনাজ)
-কাজটা ঠিক করলিনা। এখন তোদের দুই ভাই-বোনকেই রুলস ব্রেক করার জন্য পানিশমেন্ট দেওয়া হবে। সবাই মিলে ডিসাইড কর তো কি পানিশমেন্ট দেয়া যায়। (ইরফান)

-বাহিরে যেহেতু বৃষ্টি পড়ছে তাহলে আজকে ভুনা খিচুড়ি খাওয়া যায় কি বলিস? ওদের দুইজনকে দিয়ে রান্না করাবো খিচুড়ি। (রাতুল, মিতুলের ছোট চাচার ছেলে)
-গ্রেট আইডিয়া! যা তোরা রান্নাঘরে দৌড় দে। (ইরফান)
-কি ভাই আমাকে কেন এর মধ্যে ফাসাচ্ছিস? নাক মুখ কুচকে বলে ওঠে মেহনাজ।
-চুপচাপ চলে যাও তোমরা দুজন মেহনাজ ভাই। (সারা)

-কারো যেতে হবেনা। তোমাদের দুলাভাই থাকতে আমার শা/লা-শা/লি কেন কষ্ট করতে যাবে? আমি যাচ্ছি। এই ইরা মেয়েকে ধরো তো আমি যাই খিচুড়ি রান্না করে নিয়ে আসি।

সকলে খুশিতে হাতে তালি দিয়ে ওঠে।


ঘড়িতে এখন রাত দেড়টার মতো বাজে। সারাবাড়িতে পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। বেড সাইড টেবিলের ওপর থেকে মায়ের ফোনটা নিয়ে ফেসবুকে ঢোকে মিতুল। সার্চ লিস্টে ইরফান আহমেদ দিয়ে সার্চ দিতেই ইরফানের হাস্যজ্জ্বল মুখের প্রোফাইল পিকচার দেয়া আইডিটা সামনে চলে আসে। আইডিতে ঢুকতেই প্রায় ৭ঘন্টা আগের একটা পোস্ট দেখে চোখ আটকে যায় তার। সাধারণত এই ধরনের কোনো পোস্ট আগে কখনো ইরফানকে করতে দেখে দেখেনি মিতুল।
“কথা ছিল একফালি চাঁদকে সাক্ষী রেখে একসাথে প্রতিটা সন্ধ্যারাত কাটাবো।“
পোস্টটি পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে মিতুলের। ইরফান ভাই কাকে উদ্দেশ্য করে দিয়েছে এই পোস্ট? কে তাকে এতো যন্ত্রণা দিয়েছে? চোখের কোণ হতে টুপ করে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মিতুলের। ইরফান ভাই অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে পোস্ট দিয়েছে তাতে তার কেন কষ্ট হচ্ছে ? এই এক পোস্টই যেন কিশোরির রাতের ঘুম কেড়ে নিল। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দেয় একটা শ্বাসরুদ্ধকর দীর্ঘ রাত।
সকালে লম্বা চুলগুলো হাত খোপা করতে করতে রান্নাঘরের দিকে যায় মিতুল
-ছোট চাচী আমাকে এক কাপ চা করে দেবে? (মিতুল)
মিতুলের ছোট চাচী মিতুলের সদ্য বলা কথাটি শুনে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করে,
-মা তুই চা খাবি এখন? কই কখনো তো সকালে খালি পেটে চা খাস না তুই।
-মাথাটা ভিষণ ব্যথা করছে। এখন যদি ব্যথা না কমে তবে স্কুল বা ব্যাচ কোনোটাতেই যেতে পারব না চাচী। (মিতুল)
-চোখ মুখের এই অবস্থা কেন তোর? সারারাত ঘুমাসনি বোঝা যাচ্ছে। কি হয়েছে মা কিছু নিয়ে কি মন খারাপ? (মিতুলের ছোট চাচী)
-না চাচী গরমে খুব অসহ্য লাগছিল। কই তুমি চা দিলে দাও আমি যাই ফ্রেশ হয়ে আসি। (মিতুল)
মাথা ব্যথার জন্য আর স্কুল এবং ব্যাচে যেতে পারেনি মিতুল সারাদিন শুয়েই কাটিয়েছে সে।


সন্ধ্যাবেলা,
এখন অনেকটাই হালকা লাগছে মাথা। একটা ম্যাথ কিছুতেই মিতুলের মাথায় ঢুকছিল না। বই আর খাতাটা নিয়ে ইরফানের রুমের দিকে রওনা হয়। ইরফানের রুমে ঢুকতে নিতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মিতুল। বিছানার ওপর উপুড় হয়ে কারো সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে ইরফান। ফোনের স্ক্রিনের উপরের কোণার দিকে ছোট একটু জায়গায় একটা মেয়েকে হাসতে দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তের মাঝে থমকে যায় মিতুল।

দরজার সামনে মিতুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরফান ফোনটা বিছানার ওপরে রেখে বলে ওঠে,}
-ওখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস কেন মিতুল? ভেতরে আয়। কি হয়েছে বল।
অস্পষ্ট সুরে মিতুল বলে ওঠে,
-না মানে একটা ম্যাথ বুঝতেছিলাম না। তাই বলতে চাইছিলাম যে যদি আপনি একটু বুঝিয়ে দিতেন? (মিতুল)
-এটা কোনো কথা মিতুল? আয় বস এখানে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আর শোন মেহনাজ তো মনে হয় ব্যস্ততার জন্য তোকে নিয়ে বসতে পারেনা। তাই এখন থেকে রোজ সন্ধ্যায় একঘন্টা করে আমার কাছে পড়তে বসবি মানে যতদিন আমি আছি আরকি। টেস্ট এক্সামের বেশিদিন বাকি নেই। তাই সকলের সাথে আড্ডা কম দিয়ে একটু পড়বি বেশি। আড্ডা দিতে মানা করছিনা কিন্তু টাইম মেইনটেইন করে চলবি। দে কোনটা বুঝছিস না দেখা। (ইরফান)

ইরফান ম্যাথ বুঝিয়ে যাচ্ছে একাধারে আর মিতুল নিশ্চুপ হয়ে টলমল চোখে খাতার দিকে চেয়ে আছে। চোখের পলক ফেললেই যেন অশ্রুর ঢেউ উপচে পড়বে চোখের কোণ হতে।
-কিরে কাদছিস কেন তুই? শরীর খারাপ লাগছে?

চলবে…

আফিয়া অন্ত্রীশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে