#মেহেরজান
#পর্ব-২০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
“তোমাকে আরেক টুকরো মাংস দেবো পদ্মাবতী?”
“না না। আর দেবেন না। আমি এতো খেতে পারবো না।”
“আচ্ছা। আমার মেয়েটার যে আজ কি করে এতো সুমতি হলো কে জানে। যাকে হাজারবার বলেও রান্নাঘরে ঢোকাতে পারতাম না। সে আজ নিজেই এতোকিছু রান্না করেছে।”
শিউলি বলে উঠলেন,
“তোমার মেয়ে আজও রান্নাঘরে ঢোকেনি মা।”
“তাহলে? এতোকিছু কে রান্না করলো?”
“যাকে এতো আদর আপ্যায়ন করে খাওয়াচ্ছো সে-ই রেঁধেছে।”
“মানে? আমি সকালে বাড়িতে ছিলাম না বলে তুই মেয়েটাকে দিয়ে এতো কাজ করালি?”
“আমার কী দোষ? আমি তো করতে নিষেধই করেছিলাম। দিদিই তো শুনলো না আমার কথা।”
পদ্মাবতী বললেন,
“ওর দোষ নেই। আমিই জোর করেছিলাম। এমনিতেও এখানে আমার কোনো কাজ নেই। ঘরে বসে থাকতে থাকতে কার এতো ভালো লাগে। তাই ভাবলাম দুপুরের রান্নাটা আমিই করি।”
“তবুও। এটা কিন্তু একদম ঠিক হয়নি পদ্মাবতী। তুমি শুধু শুধু এতো কষ্ট করলে।”
“আমার কোনো কষ্ট হয়নি। এগুলো তো আমার বা হাতের খেল।”
“শিউলিকে সেদিন বলেছিলাম তোমাকে গ্রামটা ঘুরে দেখাতে। কেমন লাগলো?”
“যতটা শুনেছিলাম তার চেয়েও বেশি সুন্দর।”
তাদের কথার মাঝে শিউলি বলে উঠলেন,
“তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি। জানো দিদি, আমরা যে মাঠে গিয়ে বসেছিলাম না? সেখানে অনেক বড় করে বৈশাখী মেলা হয়। তুমি এসো কিন্তু আবার নববর্ষে।”
“আসবো।”
“খাওয়া শেষ করে তুমি একবার আমার ঘরে এসো পদ্মাবতী। একটা কাজ আছে।”
“ঠিকাছে।”
পদ্মাবতী খাওয়া শেষ করে যথারীতি শর্মিলার সাথে তার ঘরে এলেন। শর্মিলা আলমারি থেকে কিছু একটা বের করে পদ্মাবতীর হাতে দিলেন।
“এটা কী?”
“খুলে দেখো।”
পদ্মাবতী খুলে দেখলেন একজোড়া বালা।
“এগুলো?”
“এগুলো তোমার মায়ের। এতো বছর আমার কাছেই ছিল। তাকে তো আর ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। তাই তোমাকেই দিলাম।”
“কিন্তু..”
নিজের কথা শেষ করতে পারলেন না পদ্মাবতী। তাকে থামিয়ে দিয়ে শর্মিলা বললেন,
“কোনো কিন্তু নয়। এগুলো এখন তোমার। তুমি সাথে করে নিয়ে যাবে।”
“ঠিকাছে। আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু যতদিন আমি এখানে আছি ততদিন আপনার কাছেই রাখুন। যাওয়ার সময় না হয় দিয়ে দেবেন।”
“আচ্ছা। তুমি যা বলবে।”
পদ্মাবতী শর্মিলার ঘর থেকে বের হয়ে শিউলির ঘরে ঢুকলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“মা কী বললো তোমাকে?”
“তেমন কিছু না।”
“আচ্ছা।”
শিউলি বিছানা ঠিক করতে লাগলেন। পদ্মাবতীর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তিনি এখন ঘুমাবেন।
.
.
.
রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসের ওপর বসে আছেন মোহিনী। সামনেই নদী। দুপুরের কড়া রোদে কতোগুলো বাচ্চা নদীতে নেমে ঝাঁপাঝাপি করছে। হঠাৎ পেছন থেকে কারও ডাক শুনতে পেলেন তিনি।
“কিরে? এসময় এখানে বসে আছিস যে?”
চকিতে পেছনে তাকালেন মোহিনী।
“শমিতদা। তুমি। তেমন কিছু না। এমনিই বসে ছিলাম। তুমি এখানে কী করতে?”
“তোকেই খুঁজতে এসেছিলাম।”
উঠে দাঁড়ালেন মোহিনী। শমিতের সামনে এসে বললেন,
“আমাকে? কেন?”
“আজ বাড়িতে এলি না কেন?”
“এমনিই যাইনি।”
“এমনিই বাড়িতে যাসনি। এমনিই এখানে বসে আছিস। কী হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি। তুমি কী বলতে এসেছো বলো।”
“অর্ণব খুঁজছিল তোকে। তাই বলতে এলাম।”
“উনি আমাকে কেন খুঁজবেন?”
“এমন ভাব করছিস যেন তোদের প্রেমকাহিনী সম্পর্কে আমি কিছু জানিই না। তুই আজ যাসনি বলে খুঁজছিল।”
“তুমি কী বললে?”
“বলেছি তুই ওর ওপর রেগে আছিস।”
“আমি কেন ওনার ওপর রেগে থাকবো? আমি তো রেগে নেই। তাহলে তুমি এমন কেন বললে?”
“এমনিই। তোদের মাঝে একটু ঝামেলা সৃষ্টি করার জন্য।”
“তারপর উনি কী বলেছেন?”
“জিজ্ঞেস করলো কেন রেগে আছিস। বললাম জানি না। তারপর ও বললো তোর সাথে রাতে দেখা করবে।”
“কখন? কোথায়?”
“সন্ধ্যার পর পরই। বাড়ির পেছনে বাগানে অপেক্ষা করিস।”
“ঠিকাছে।”
“শোন। আমি এখন যাই। তুই ঠিকমতো আসিস কিন্তু। নয়তো অর্ণব আবার আমাকে দোষ দেবে যে আমি তোকে বলিনি।”
“আচ্ছা। আমি আসবো।”
.
.
.
আম গাছতলায় দাঁড়িয়ে অর্ণবের জন্য অপেক্ষা করে করে চলেছেন মোহিনী। সূর্যাস্তের অনেক আগেই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। অনেক্ষণ যাবৎ পায়চারি করে চলেছেন। এখন সন্ধ্যার আলোটুকুও মিলিয়ে গেছে। পেছন থেকে নিজের খোলা চুলে কারও স্পর্শ পেতেই তৎক্ষনাৎ পেছনে ঘুরলেন তিনি।
“অর্ণব।”
“সোজা হয়ে দাঁড়ান।”
হাতে থাকা নাগচাঁপাটা মোহিনীর চুলে গুঁজে দিয়ে বললেন,
“এবার বলুন।”
সামান্য হাসলেন মোহিনী।
“এটা আমার অনেক পছন্দের ফুল।”
“জানি। এজন্যই এনেছি। অনেক খুঁজে।”
“মিথ্যে বললেন। খোঁজার কী দরকার? বাগানেই তো আছে।”
“প্রেমে একটু-আধটু মিথ্যে বললে কোনো ক্ষতি নেই। উল্টো ভালোবাসা বাড়ে।আমার ওপর নাকি রেগে আছেন? কেন?”
“একদম না। শমিতদা মিথ্যে কথা বলেছে।”
“আগেই বুঝেছি। আপনাকে ডেকেছি অন্য কারণে।”
“কী কারণ?”
“কাল আমি চলে যাচ্ছি। এটা জানাতেই।”
“চলে যাচ্ছেন মানে? কোথায় যাচ্ছেন?”
“কলকাতায়। কাকু নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। কারও সাহায্যের প্রয়োজন। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এজন্যই যাচ্ছি ওনাকে সব গুছিয়ে দিতে।”
“আপনার যাওয়ার কী প্রয়োজন? শমিতদাকেই তো পাঠাতে পারেন।”
“বলেছিলাম। কিন্তু পিসিমা রাজি হননি।”
“ফিরবেন কবে?”
“দেরি হবে অনেক।”
“কতদিন?”
“কয়েক মাস।”
“স্বরসতী পূজোর আগে ফিরবেন তো?”
অর্ণব মোহিনীর মুখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে তার গালে স্পর্শ করলেন।
“বলতে পারছি না। আরও দেরি হতে পারে। ভালো থাকবেন মেহেরজান।”
একটু দূর থেকে কারও চাপা কন্ঠ ভেসে এলো,
“চলে আয় অর্ণব। রামু কাকু আসছেন এদিকে।”
মোহিনী কৌতূহলী চোখে অর্ণবের দিকে তাকালেন। অর্ণব বললেন,
“শমিতকে সামনে রেখে এসেছি পাহারা দিতে।”
মোহিনী হেসে ফেললেন। অর্ণব শমিতের উদ্দেশ্যে বললেন,
“চলে যা তুই। আমি একটু পর আসছি।”
হাটু গেড়ে নিচে বসে পড়লেন অর্ণব। পকেট থেকে একজোড়া নুপুর বের করে মোহিনী পায়ে পরিয়ে দিলেন।
“আপনার পায়ে ঘুঙুর অপেক্ষা নুপুর বেশি শোভা পায় মেহের।”
কথাটা বলে মোহিনীকে নিয়ে পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। মোহিনী বললেন,
“এদিকে কোথায় যাবেন?”
“চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“আমি একা যেতে পারবো।”
অর্ণব গলার স্বর দৃঢ় করে বললেন,
“আমি বলেছি আমি পৌঁছে দেবো।”
“ঠিকাছে।”
রাস্তায় খুব একটা লোকজন নেই। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে বাইজীবাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলেন তারা। দোতলায় জানালা থেকে তাদের একসাথে আসতে দেখলেন তারানা। আবছা আলোয় তাদের চিনতে অসুবিধা হয়নি তার।
“এতোটুকু পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এবার আমি একাই যেতে পারবো। ভেতরে যাওয়াটা আপনার উচিত হবে না।”
“কেন?”
“এটা বাইজীবাড়ি। এখানে সচরাচর কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পৌঁছে দিতে আসে না। সবার আসার উদ্দেশ্য একটাই। তাই আপনার না আসাই উচিত। লোকে জানলে কুৎসা রটাবে।”
“আমার পূর্বপুরুষ আসতে পারলে আমি কেন পারবো না? পার্থক্য কোথায়?”
“সময়ের পার্থক্য।”
বাড়ির ধূলো জমা নাম ফলকটা রুমাল দিয়ে মুছে দিলেন অর্ণব। একটা নাম ভেসে উঠলো “রঙ মহল”। নামটা যে অনেক আগেই মুছে গেছে তা বলা বাহুল্য। অর্ণব মুচকি হেসে মোহিনীকে বিদায় জানালেন। অর্ণব চলে গেলে মোহিনীও বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরে ঢুকতেই তারানার সামনে পড়লেন তিনি।
“কী করছিস মেহের?”
“তারামা।”
“প্রমিতার মতো সেই একই পথে হাঁটছিস? এসব প্রেম ভালোবাসা যে তোদের জন্য না। প্রমিতার পরিণতি কী হয়েছিল ভুলে গেছিস?”
“শান্ত হও তারামা। কিচ্ছু ভুলিনি আমি। প্রমিতাদির সাথে যা হয়েছিল তা আমার সাথে কখনোই হবে না। আমি এতো দুর্বল নই।”
“কী করতে পারবি তুই? গ্রামের লোকেরা পাথর ছুড়ে ছুড়ে মেরেছে ওকে। ভুলে গেছিস?”
“কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না আমাকে তারামা। কারোর এতো সাহস হবে না। তুমি অযথা চিন্তা করা বন্ধ করো।”
মোহিনী নিজের ঘরে ফিরে এলেন। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। রাতের খাবার খেতেও গেলেন না। রাত যত গভীর হলো, তার গায়ের তাপমাত্রাও তত বাড়তে থাকলো। বারবার কাঁপুনি দিয়ে উঠছেন তিনি। পাশে থেকে কাঁথা টেনে নিজের গায়ে দিলেন। জ্বরের সাথে তীব্র মাথাব্যথা। দুর্বলতা তার শরীরকে গ্রাস করে নিচ্ছে অথচ তীব্র মাথাব্যথায় ঘুমাতেও পারছেন না। উঠে ঔষধ খাওয়ার শক্তিটুকুও যেন নেই তার। লম্বা একটা নির্ঘুম রাত কাটানোর পর যখন সূর্য উঁকি দিল, একটা নতুন দিনের সূচনা হলো, তখন চোখে ঘুম নেমে এলো তার। কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন, জানেন না তিনি। যখন চোখ খুললেন ততক্ষণে সূর্য মাথার ওপর। দরজায় কেউ বারবার কড়া নেড়ে যাচ্ছেন। সবকিছু বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো তার। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলেন তিনি। বাইরে রজনী দাঁড়িয়ে। মোহিনী দরজা খুলতেই তিনি ভেতরে ঢুকলেন। মোহিনী আবার আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলেন। শরীরের দুর্বলতা এখনো কাটেনি।
“কী হয়েছে তোর? এতো দুর্বল দেখাচ্ছে কেন?”
“রাতে জ্বর এসেছিল।”
“হঠাৎ জ্বর কেন এলো?”
“জানি না।”
“ওষুধ খেয়েছিস?”
“না। এখন জ্বর নেই। তুমি একটু আমাকে জল দাও না।”
রজনী মোহিনীকে জল এনে দিলেন। মুখে দিতেই তেঁতো স্বাদ অনুভূত হলো তার। চোখে মুখে জল দিয়ে রজনীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“এখন ক’টা বাজে রজনীদি?”
“বাজে তো অনেক। সাড়ে এগারোটা হবে হয়তো।”
মূহুর্তেই তার অর্ণবের কথা মনে পড়লো। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পেছন থেকে রজনী আওয়াজ দিলেন।
“এই শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“আমি এখুনি এসে পড়বো রজনীদি। তারামাকে বলো না।”
দৌঁড়ে অর্ণবদের বাড়িতে এলেন তিনি। অর্ণবকে কোথাও পেলেন না। শমিতকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“অর্ণব কই শমিতদা?”
“তুই এতোক্ষণে এলি? অর্ণব তো সেই কোন সকালেই চলে গেছে। তোর জন্য অনেক্ষণ অপেক্ষাও করেছে। কিন্তু তুই এলি না বলে শেষে চলেই গেল। তুই এলি না কেন?”
অনুরাধার ডাক শোনা গেল। শমিত আর মোহিনীর উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। সেদিকে চলে গেলেন। মোহিনী জ্বরে পড়ার জন্য বারবার নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন। বাড়ির বাইরে এসে সিড়িতে বসতেই দেখলেন পদ্মাবতী আসছেন। কাছে এসে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
“কত্তোদিন পর দেখলাম তোকে। অনেক মনে পড়েছে তোর কথা। তোদের সবার কথা। কেমন আছিস তুই?”
মোহিনী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“ভালো। তুই?”
“আমিও।”
“চলে এলি যে?”
“ভালো লাগছিল না তাই। কালও ভাবিনি আজ চলে আসবো। আজ সকালেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।”
“একা আসতে পারলি?”
“দেখছিস না? আর যাওয়ার সময় তো রাস্তা দেখেইছিলাম। আর পিসিমা নদী পার করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলেন।”
“তোর ঠাকুমা কেমন আছেন?”
“ভালো না। কোনোরকম বেঁচে আছেন আরকি।”
“ওহ।”
পদ্মাবতী বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তার চোখ যেন অন্য কাউকে খুঁজছে। মোহিনীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাড়ির সবাই কেমন আছে? বড়মা, ছোটমা, পিসিমা, চিত্রা, শমিতদা আর অর্ণববাবু?”
“সবাই ভালো আছে। আর অর্ণব বাড়িতে নেই।”
“কোথায় গেছেন?”
“কলকাতায়।”
“ফিরবেন কবে?”
“জানি না। অনেক দেরি হবে শুনলাম।”
“ওহ।”
পদ্মাবতীর মুখটা মলিন হয়ে উঠলো।
“তুই ভেতরে চল।”
“যাচ্ছি। তুই আমার ঘরে যা। আমি সবার সাথে দেখা করে আসছি। অনেক কথা জমে আছে তোকে বলার।”
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-২১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকা ঘাসে পা রাখলেন মোহিনী। গায়ে মোটা শাল জড়ানো। সূর্য অনেক আগে উঠলেও তার দেখা এখনো মেলেনি। গাছের ঝুলে থাকা পাতার ডগায় জমে থাকা শিশির কণাগুলো যেন এখুনি একত্রিত হয়ে টুপ করে নিচে পড়বে। আশেপাশে বসার মতো কোনো জায়গা পেলেন না মোহিনী। সবই ভেজা। তবে এভাবে খালি পায়ে হাঁটতে মন্দ লাগছে না। একটা দুটো করে শিউলি কুড়িয়ে নিজের শাড়ীর আঁচলে রাখছেন পদ্মাবতী। এমন সময় যেন তার ওপর বৃষ্টির বর্ষণ হলো। গাছ ধরে কেউ ঝাঁকাতেই এই কান্ড। ফুলগুলো ফেলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পেছনে ঘুরতেই দেখলেন মোহিনী দাঁড়িয়ে হাসছেন। মোহিনী এখানে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন, টেরই পাননি। একবার কেঁপে উঠে বললেন,
“এমনিতেই শীতে বাঁচি না। তার ওপর এভাবে আমার ওপর জল ঝরাতে পারলি?”
পদ্মাবতী আবার বসে শিউলিগুলো তুলতে লাগলেন। মোহিনী নিজের চাদরটা পদ্মাবতীর গায়ে দিয়ে তাকে ফুলগুলো তুলতে সাহায্য করলেন। ফুল কুড়িয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় মোহিনী বললেন,
“আমাকে একটু জল এনে দে। পা ধুতে হবে।”
“জুতো কী করেছিস?”
“বাগানে ঢোকার আগেই খুলে রেখে এসেছি।”
“দাঁড়া। আমি নিয়ে আসছি।”
পদ্মাবতী এক ঘটি জল এনে মোহিনীকে দিলেন। মোহিনী পা ধুয়ে পদ্মাবতীর সাথে তার ঘরে ঢুকলেন। পদ্মাবতী সূঁচ আর সুতা নিয়ে এসে বিছানায় বসলেন। এরপর ফুলগুলো দিয়ে মালা গাঁথতে শুরু করলেন। মোহিনী তার পাশেই বসে রইলেন। এমন সময় চিত্রা ঢুকলেন তাদের ঘরে। হাতে একটা থালা, যার মধ্যে তিনটা ক্ষীরের বাটি। মোহিনী দেখেই চট করে একটা তুলে নিলেন। বললেন,
“সকাল সকাল ক্ষীর?”
চিত্রা একটা বাটি পদ্মাবতীর হাতে দিয়ে বললেন,
“এই নে খা।”
“কিসের জন্য এটা?”
“আমার জন্মদিনের।”
জিভ কাটলেন পদ্মাবতী।
“একদম মনে ছিল না।”
চিত্রা নিজেও খেতে খেতে বললেন,
“তা মনে থাকবে কী করে? তোদের দুই বান্ধুবীর মাঝে আমি কে? আমার কথা কারও মনে রাখার দরকার আছে নাকি?”
“মনে নেই তো কী হয়েছে? তোর জন্য উপহার ঠিকই এনেছি।”
“কই?”
পদ্মাবতী হাতে থাকা ফুলের মালাটা চিত্রার গলায় পরিয়ে দিলেন। মোহিনী হেসে ফেললেন। চিত্রার উচ্ছ্বসিত মুখটা মুহূর্তেই চুপসে গেল।
“এটা আমার উপহার? এখন আছে, একটু পরেই নেই। এটা না দিয়ে নিজের গলারটাও তো দিতে পারতি।”
মোহিনী বলে উঠলেন,
“এতো লোভ করিস না। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ”
“তুই আর কিছু বলিস না তো। ইশশশ, দাদার কথা খুব মনে পড়ছে। দাদা থাকলে নিশ্চিত আমি যা চাইতাম তাই দিত।”
পদ্মাবতী বললেন,
“সত্যিই। সেই কবে গেলেন। কতমাস হয়ে গেল। পূজো শেষ করে দেখতে দেখতে দোলও চলে এলো। অথচ তিনি এখনো ফিরলেন না কেন?”
“মা তো বললেন দোলের দিন নাকি দাদা ফিরবেন।”
“তাই?”
“বললেন তো তাই। আমি জানি না।”
মোহিনী খাওয়া শেষ করে বললেন,
“আমার জন্য আরেকটু নিয়ে আয় তো। বড়মা বানিয়েছেন। অনেক মজা হয়েছে।”
“আমাদের কথা শেষ হলো না আর তোর খাওয়া শেষ?”
“খাওয়া বাদ দিয়ে এতো কথা বললে তো এমনই হবে। যা নিয়ে আয় আরেক বাটি।”
“আনছি।”
চিত্রা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মোহিনী আর পদ্মাবতী নিজেদের মতো গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
.
.
সকাল থেকেই আম্রপালি, শকুন্তলা, অনুরাধা তিনজনই রান্নাঘরে বসে আছেন। সাথে আরও দু’জন কাজের মেয়ে। বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত তারা। ভাপা, পাটিসাপটা, নকশি, পাক্কূণ, পুলিপিঠা, কী নেই সেখানে? সবই চিত্রার পছন্দের। সাথে ভালোমন্দ বিভিন্ন পদের রান্নাও রয়েছে। চিত্রার জন্মদিন উপলক্ষে আজ দুপুরে কিছু অনাথ শিশু আর গরীবদের খাওয়াবেন তারা। সেটারই প্রস্তুতি চলছে।
“আর পারছি না। সেই সকাল থেকে খেটে মরছি। এভাবে কী আর পারা যায়? দিদি, আমি বরং একটু ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিই। পরে আবার আসবো। তোমরা এদিকটা সামলে নিতে পারবে তো?”
আম্রপালি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। শকুন্তলা বেরিয়ে যেতেই অনুরাধা বললেন,
“পরে আসার কথা বললেও এদিকে আর ফিরে দেখবে না ও দেখো তুমি। খাটাখাটুনি করতে পারবে না তো এসব আয়োজন করার দরকারটা কী ছিল? আমাদের ছেলেমেয়ের বেলায় তো এতো রঙঢং করি না আমরা। তাহলে চিত্রার বেলায় হবে কেন?”
করতে দিন না দিদি। শখ যখন জেগেছে তাহলে সেটা একবার মিটিয়ে নিক।
“ওর মেয়ের জন্মদিন ও পালন করছে করুক। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের খাটিয়ে মারছে কেন বলো তো?”
আম্রপালি মুচকি হাসলেন। এমন সময় শান্তি দেবী ঢুকলেন রান্নাঘরে। নিজের লাঠিতে ভর দিয়ে, খুবই ধীরে ধীরে। সবকিছু একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ভাঙা গলায় বললেন,
“এগুলো কিসের জন্য?”
অনুরাধা বললেন,
“আপনার নাতনির জন্মদিনের জন্য। আপনার বউমা বাইরের কতগুলো লোককে এনে খাওয়াবে দুপুরে।”
“চিত্রার জন্মদিন? মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেল না? কয় বছরের হলো?”
“একুশ মনে হয়।”
“হবে হয়তো। ও তো আমার কাছে আসেই না। আমি জানবো কী করে কতটুকু হলো? পদ্মা ছাড়া তো আমার ঘরে ঢোকার সময়ই কারও হয় না।”
ফ্যাসফ্যাসে গলায় হাসলেন শান্তি দেবী। এরপর আবার নিজের লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেন। বেশ কষ্টে দোতলায় উঠলেন তিনি। এই বয়সে এমন শরীর নিয়ে এতোগুলা সিড়ি বাওয়া আসলেই কষ্টসাধ্য। পদ্মাবতীর ঘরে এলেন তিনি। নিজের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে বেশি প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা যাননা তিনি। বিগত দু’বছরে আজ তৃতীয়বারের মতো এই ঘরটায় এলেন তিনি। আসতেই দেখলেন ঘরে পদ্মাবতী ছাড়াও মোহিনীও আগে থেকে রয়েছেন। পদ্মাবতী শান্তি দেবীকে দেখা মাত্রই তাকে আসতে সাহায্য করলেন। শান্তি দেবী পদ্মাবতীকে ধরে ধরে এসে বিছানায় বসলেন। একদম মোহিনীর সামনে। মোহিনী বললেন,
“এখনো বেঁচে আছো বুড়ি? মরোনি?”
শান্তি দেবী ভেংচি কেটে বললেন,
“আমি ক্যান মরুমরে ছেমরি? তুই মর।”
মোহিনী হাসিতে ফেটে পড়লেন। মাঝেমাঝে শান্তি দেবীর মুখে এভাবে কথা বলা শুনতে ভালোই লাগে তার। রামু ছাড়া এভাবে কেউ কথা বলেন না। শান্তি দেবী বললেও খুব কম। মোহিনী হাসি থামিয়ে বললেন,
“বুড়ি হয়েছো তুমি আর মরবো আমি?”
“আমি বুড়ি হয়েছি তো কী হয়েছে? এখনই মরতে হবে নাকি? আমি মরলে মনে হয় তোরা বাঁচিস।”
“আমি বাঁচি বা না বাঁচি, পদ্মা তো বেঁচে যাবে। সারাদিন ওকে কতো খাটাও তুমি ভাবো একবার? সারাদিন শুধু ওকে এটা ওটা করার হুকুম দিয়েই যাও।”
“আমি হুকুম করবো না তো কী তুই করবি? জমিদার বাড়ির বউ আমি না তুই?”
“এখন তুমি। পরে নাহয় আমি হবো। তোমার বরের নাম যেন কী ছিল? দেখতে খুব সুদর্শন ছিলেন তাই না? বেঁচে থাকলে দেখতে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছেন আমার জন্য। আমার রুপের কাছে যে-কেউ হার মানতে বাধ্য।”
“কোথাকার কোন রুপের রানী এলেনরে আমার! তুই কী জানিস আমার রুপের কথা? যৌবনে তোদের থেকে কত বেশি সুন্দরী ছিলাম আমি ভাবতেও পারবি না। এমনি এমনি জমিদার বাড়ির বউ হইনি। প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে বিয়ে করে ওপাড় বাংলা থেকে এপাড়ে নিয়ে এসেছিলেন আমায়। আর তুই এসেছিস আমার মৃত স্বামীকে কেড়ে নিতে? হয়েছিস তো একদম কাঠির মতো। ফুঁ দিলেই উড়ে যাবি।”
শান্তি দেবী হাঁপিয়ে উঠলেন। মোহিনী ভ্রু নাচিয়ে পদ্মার উদ্দেশ্যে বললেন,
“বুড়ি খেপেছেরে পদ্মা।”
“উফফফ, কী শুরু করলে তোমরা? সবাই আমাকে বলো বাচ্চা অথচ এখন নিজেরাই বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছো। দিদা, তুমি কী বুঝো না ও তোমাকে রাগাতে চাইছে। তাই এসব বলছে। আর তুমিও ওর কথায় কান দিয়ে রাগছো।”
“আমাকে রাগাতে কী মজা পায় ও?”
“সেটা আমি কী জানি? ওকেই জিজ্ঞেস করো।”
শান্তি দেবী মোহিনীর দিকে তাকালেন। মোহিনী বললেন,
“শান্তি পাই শান্তি দেবী। শান্তি পাই।”
পদ্মাবতী শান্তি দেবীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“এবার বলো, কোনো দরকারে এসেছো?”
“কেন? এখানে কী দরকারেই আসতে হবে?”
“আমি তা বললাম কখন?”
“এমনিই এসেছি। গল্প করতে। ওরা তো সবাই রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমার সাথে কথা বলার সময় কোথায়? চিত্রা কই গেছেরে? শুনলাম আজ ওর জন্মদিন।”
“এসেছিল তো। এখন কই গেছে কে জানে।”
মোহিনী বললেন,
“ওকে পাঠিয়েছিলাম আমার জন্য আরেক বাটি ক্ষীর আনতে। সেই যে গেল আর ফেরার খবর নেই।”
“এতো খাস কীভাবে তুই? খাবার যায় কই বলতো? সেই তো দেখতে একেবারে শুকনো কাঠি।”
মোহিনী পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
“আমার পেট ছাড়া আর কই যাবে দিদা?”
“রান্নাঘরে দেখে এলাম। কতো রকমের রান্না হচ্ছে। আজ তো তোর জন্য উৎসব লেগে গেছে।”
“আগেই গন্ধ পেয়েছি আমি। এজন্যই তো সেই কখন থেকে এখানে বসে আসি।”
পদ্মাবতী বললেন,
“তুই যে তখন বললি তুই আমার জন্য বসে আছিস। আমার কাজ শেষ হলে আমাকে নিয়ে বাইরে যাবি।”
“সে তো যাবোই। কিন্তু দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে।”
“কোথায় যাবি?”
“সেটা খাওয়ার পরে ঠিক করবো।”
“তারমানে তুই খাওয়ার জন্যই বসে আছিস। আমার কোনো দাম নেই তোর কাছে।”
“আরে যার জন্যই থাকি, একই তো হলো।”
“না, এক হলো না।”
“একই হলো। চুপ কর তুই।”
মুহুর্তেই যেন পদ্মাবতী খেপে গেলেন। শান্তি দেবী বললেন,
“এইতো একটু আগেই দু’জন একদম ঠিক ছিলিস। এক মুহুর্তে এমন ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলি?”
“মোহিনীর জন্যই তো।”
“আমি কী করলাম? অযথা রাগ দেখাবি না একদম বলে দিলাম।”
“আমি অযথা রাগ দেখাই তাই না?”
“হ্যা, আমার সাথে কথা বলবি না একদম। তোর আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”
পদ্মাবতী কেঁদে ফেললেন। হঠাৎ এভাবে কেঁদে ফেলায় মোহিনী কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পদ্মাবতী নিজের কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“আমি অযথা রাগ দেখাই না। তুই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবি না একদম। তোর সাথে কথা না বলে কীভাবে থাকবো আমি?”
মোহিনী বুঝতে পারলেন না কী বলবেন। পদ্মাবতীর হৃদয় অনেক কোমল। একটুতেই কষ্ট পায় এটা জানেন মোহিনী। তাই বলে এই সামান্য একটা ব্যপারে এভাবে কেঁদে ফেলবে বুঝতে পারেননি। তবে এমন যে প্রথমবার হয়েছে তাও নয়। প্রায়ই তাদের ঝগড়া হলে পদ্মাবতী কেঁদে ফেলতেন। তা সে যত ছোটখাটোই হোক না কেন। মোহিনী পদ্মাবতীর মাথায় হাত রেখে বললেন,
“ঠিকাছে। কথা বলা বন্ধ করবো না তোর সাথে। তুই আসলেই একটা বাচ্চা।”
মোহিনীকে ছেড়ে দিলেন পদ্মাবতী। কান্না থামিয়ে কিছুটা শান্ত হলেন। নাক টানতে টানতে বললেন,
“আর কখনো আমার সাথে এভাবে কথা বলবি না।”
“ঠিকাছে বলবো না।”
পুরো ঘটনাটা চুপচাপ দেখে গেলেন শান্তি দেবী। এরপর মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
“তোদের ঢং দেখে আর বাঁচি না। তোদের বন্ধুত্বের কাছে দুই বোনও হার মানবে। দেখবোনি কতদিন টেকে এই বন্ধুত্ব। কারও নজর যেন না লাগে আবার।”
উঠে দাঁড়ালেন শান্তি দেবী। চশমাটা খুলে পাশে রেখেছিলেন তিনি। আবার চোখে দিয়ে বললেন,
“কিসের চশমা যে পরি আমি? চশমা পরার পরও সব সেই ঘোলাই দেখি।”
কথাটা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শান্তি দেবী। তার কথায় চোখ মুছতে মুছতে সামান্য হাসলেন পদ্মাবতী। বললেন,
“কারও নজর লাগবে না আমাদের।”
চলবে…