#মেহেরজান
#পর্ব-১৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
ব্যাগবোঁচকা সাথে নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছেন পদ্মাবতী। অর্ণব এলেই বের হবেন তারা। আম্রপালি অনেক্ষণ যাবৎ বুঝিয়ে অর্ণবকে যাওয়ার জন্য রাজি করিয়েছেন। শমিতকে সাথে যেতে হতে পারে এমনটা আন্দাজ করে তিনি অনেক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও উপায়ন্তর না পেয়ে অর্ণবকেই যেতে হচ্ছে পদ্মাবতীকে দিয়ে আসার জন্য। মোহিনী পদ্মাবতীর পাশেই বসে ছিলেন। পদ্মাবতী তার উদ্দেশ্যে বললেন,
“তুই আমার সাথে যাবি মোহিনী?”
“ধুর। আমি কী করে যাবো?”
“চল না। আমি ওখানে কাউকেই চিনি না। একা একা কী করে থাকবো? আর কোনোদিন তো তোদের ছাড়া একা গিয়ে কোথাও থাকিওনি। আমার একা ভয় করছে।”
“কিসের ভয়? ওরা বাঘ না ভাল্লুক যে তোকে খেয়ে ফেলবে?”
“তবুও তুই চল আমার সাথে।”
“আবোলতাবোল কথা বলিস না। অর্ণব এলে সাবধানে যাস ওর সাথে।”
“আচ্ছা, তুই অর্ণববাবুকে নাম ধরে ডাকিস কেন?”
“তো কী বলে ডাকবো?”
“শমিতদার মতো তাকেও তো অর্ণবদা বলতে পারিস।”
“কী! অর্ণবদা? আর কিছু পেলি না খুঁজে?”
মোহিনী উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। বললেন,
“তুইও তো তাকে অর্ণবদা বলিস না।”
“ওটা তো আসেই না মুখে। যাকে তাকে কি আর দাদা বানানো যায়?”
“এটাই হলো কথা।”
“তুই যা ইচ্ছে তাই বল। কিন্তু আমার কেন যেন নাম ধরে ডাকতে কেমন একটা লাগে। তাই অর্ণববাবু বলি।”
অর্ণব তৈরি হয়ে নিচে আসতেই সুন্দরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন তারা। মোহিনী দূর থেকে অর্ণবকে বিদায় জানালেন। তারা চলে গেলে সবাই আবার যে যার কাজে চলে গেলেন। মোহিনীর আর সেখানে মন টিকলো না। তিনি ফিরে এলেন তার বাড়িতে। নিজের আলোকসজ্জায় সজ্জিত ঘর দেখে কেন যেন অস্বস্তি বোধ করলেন মোহিনী। ঘরের জানালাগুলো খুব একটা খোলা হয় না। আজ এক এক করে সবগুলো জানালাই খুলে দিলেন তিনি। মখমলের বিছানায় গা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজতেই অর্ণবের মুখ ভেসে উঠলো। ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুঁটে উঠলো তার। আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে গিয়ে কপালে চিন্তার রেখে দেখা গেল। চোখ খুললেন তিনি। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে নিজের ঘুঙুর জোড়া পায়ে বেঁধে নিলেন। নৃত্যের অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ বাদে তারানা ঢুকলেন ঘরে। বললেন,
“নাচ নাচ। ভালো করে নাচ। আজ শহরের এক বাবু আসবে সন্ধ্যায় তোর নাচ দেখতে। একবার ভালো লাগলে টাকায় ভরিয়ে দিয়ে যাবে তোকে।”
মুহূর্তেই থেমে গেলেন মোহিনী। তারানার উদ্দেশ্যে বললেন,
“তারামা, আমি নাচি কেন?”
তারানা অবাক হলেন। বসতে বসতে বললেন,
“নাচবি না তো কী করবি? বাইজীবাড়িতে জন্মেছিস। নাচতে তো হবেই। নাচ ছাড়া আর আছে কী তোর জীবনে?”
মোহিনী ঘুঙুর খুলতে খুলতে জবাব দিলেন,
“আমার মা তো বাইজী ছিলেন না। আমি কেন হলাম?”
“তোর কপালে লেখা ছিল তাই। সবাই কী আর নিজে থেকে এই জগতে আসে না সবার মা এখানে ছিল? ভাগ্য তোদের নিয়ে এসেছে।”
“দোষটা তাহলে আমার মায়েরই। উনি আমাকে এখানে জন্ম না দিলে হয়তো আমাকে এভাবে নেচে পয়সা কামাতে হতো না।”
“নিজের জীবন নিয়ে আফসোস করছিস? আগে তো করতি না। তাহলে এখন কেন?”
“আচ্ছা তারামা, একটা কথা বলবে?”
“কী?”
“বড়মা আমাকে আর পদ্মাকে সমান ভালোবাসেন?”
“হঠাৎ এমন কথা বলছিস কেন? তুই নিজেও খুব ভালো করেই জানিস উনি তোকে কতটা ভালোবাসেন।”
“দুজনকে সমান?”
“কেন নয়?”
“তাহলে আমাকে নিয়ে যাওয়ার পরও আবার এখানে রেখে গেলেন কেন? চাইলেই তো উনি আমার ভাগ্যটা বদলে দিতে পারতেন। তখন আমার জীবন এমন হতো না। আমিও পদ্মার মতো হতাম।”
“ভাগ্য বদলানোর ক্ষমতা কারও হাতে নেই মেহের। তুই যদি জানতি আম্রপালি তখন কোন পরিস্থিতিতে ছিল তাহলে আজ এ কথা বলতি না।”
“জানি আমি। আরেকটা বাচ্চা পালা কী এতোই কঠিন ছিল?”
“ছিল না হয়তো। কিন্তু ওই শকুন্তলা মায়ের কথাতেই তো…”
মোহিনী উঠে দাঁড়ালেন। নিজের কথা শেষ করতে পারলেন না তারানা। তার আগেই মোহিনী বললেন,
“ওই বুড়িটা তাহলে ছোটবেলা থেকেই আমার পেছনে লেগে আছে?”
তারানা অট্টহাসি দিয়ে বললেন,
“এখন এসব চিন্তা বাদ দে। সন্ধ্যার জন্য তৈরি থাকিস। যত ভালো নাচবি, তত কামাবি। আর দু’হাতে ওড়াবি। একদম রানীর মতো থাকবি। নিজের জীবন নিয়ে আফসোস করিস না। হয়তো এর থেকেও খারাপ হতে পারতো।”
তারানা চলে গেলেন। মোহিনী নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বললেন,
“এই জীবনযাত্রাই যদি কখনো অর্ণব আর আমার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এর চেয়ে খারাপ আর কী হবে তারামা?”
.
.
.
গাড়ি থামতেই অর্ণব নেমে গেলেন। পদ্মাবতী হাই তুলতে তুলতে চোখ খুলে এদিক ওদিক দেখে বাইরে এলেন। চোখ ডলতে ডলতে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এসে গেছি আমরা? কোন বাড়ি?”
“এসে গেছি বললেই আসা যায় নাকি? আরও অনেক রাস্তা বাকি।”
“তাহলে গাড়ি এখানে থামালো কেন?”
“চোখে ছানি পড়েছে? দেখছো না সামনে নদী? নৌকা দিয়ে পার হতে হবে।”
“নৌকা?”
“চলো।”
অর্ণব সামনে এগিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী নিজের ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে আসছেন। অর্ণব পেছনে ফিরে বললেন,
“তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারো না?”
“হাঁটছি তো।”
“ব্যাগে কি পুরো সংসার নিয়ে এসেছো নাকি?”
পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। অর্ণবকে অতিক্রম করে গিয়ে নৌকায় উঠলেন। অর্ণব নৌকায় উঠে একটা সিগার ধরিয়ে বললেন,
“এবার জলে পরলে আর ওঠাবো না।”
“পরবোও না। ওটা ডিঙি নৌকা ছিল। আর এটা তো অনেক বড় নৌকা। এবার আর জলে পরছি না।”
অর্ণব স্মিত হাসলেন। নৌকা ছাড়লো। পদ্মাবতী বললেন,
“আচ্ছা, আপনি বাড়ি চেনেন কি করে? এসেছিলেন আগে?”
“চিনিও না, আসিও নি।”
“তাহলে যাচ্ছেন কিভাবে?”
“মা ঠিকানা বলে দিয়েছেন আমাকে।”
“আমাকে তো বললেন না।”
“কারণ তিনি জানেন তোমার ওই মোটা মাথায় ঢুকবে না।”
পদ্মাবতী মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। নৌকায় তাদের সাথে আরও কিছু লোকজন উঠেছে। পদ্মাবতী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখছেন। কালো রোগা একটা লোক বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পদ্মাবতী তাকে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলেন। অর্ণবের শার্ট ধরে হালকা টান দিলেন তিনি।
“কী হয়েছে?”
“সামনে ওই লোকটাকে দেখুন। চোখগুলো কেমন লাল হয়ে আছে। আমার সাথে কি ওর কোনো শত্রুতা আছে? দেখে মনে হচ্ছে পারলে এখনই আমাকে মেরে ফেলবে।”
অর্ণব দেখে বুঝতে পারলেন লোকটা পদ্মাবতীর গায়ের গয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো ছিঁচকে চোর টোর হবে হয়তো। পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“এতো গয়না পরে আসার কি খুব দরকার ছিল?”
“মানে? এতো গয়না কই পরলাম? হাতে দুটো চুড়ি, গলায় একটা মালা আর কানে দুটো কানেরদুল। এখানে এতো গয়না কই পেলেন আপনি? এগুলো তো আমি বাড়িতেই পরে থাকি সবসময়। আর এসবের সাথে ওই লোকের কী সম্পর্ক?”
“না, কোনো সম্পর্ক নেই। যখন চুরি করতে এসে তোমাকে মেরে ফেলবে তখন স্বর্গে বসে চিন্তা করো কী সম্পর্ক।”
“মানে?”
“এই তুমি সোজা কথা বুঝতে পারো না? দেখে বুঝতে পারছো না লোকটা একটা চোর।”
এতোক্ষণে যেন পদ্মাবতীর টনক নড়লো। নিজের গয়না শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঢেকে ফেললেন। মুহুর্তেই লোকটাও অন্যদিকে চোখ ঘোরালেন। নৌকা ঘাটে এসে থামলো। তারা উঠে দাঁড়ালেন। একে একে সবাই নেমে যাওয়ার পর তারা নামলেন। নৌকা থেকে নামতেই পদ্মাবতী বললেন,
“এখন কীভাবে যাবেন? গাড়ি তো আমাদের ওপারে রেখেই চলে গেল।”
“কেন? তুমি আছো কী করতে? এপাড় থেকে সাঁতরে গিয়ে গাড়িটা মাথায় করে নিয়ে আসো আবার।”
একটু দূর থেকে এক লোক বললেন,
“এখানে এই গরুর গাড়ি ছাড়া আর কিছু পাবেন না দাদা। এতে করেই যেতে হবে। কোথায় যাবেন আপনারা?”
“অমলেন্দু বসাকের বাড়ি চেনেন?”
“তিনি তো অনেক আগেই মারা গেছেন।”
“জ্বি। আমরা তার বাড়িতেই যাবো।”
“আপনারা ওনার কী হন?”
“দূরসম্পর্কের আত্মীয়।”
“ওহ। উঠে বসেন আমার গাড়িতে। আমি পৌঁছে দেবো আপনাদের।”
তারা গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো। পদ্মাবতী চারদিকে চোখ ঘোরাচ্ছেন। মোহিনী ঠিকই বলেছিলেন। গ্রামটা আসলেই অনেক সুন্দর। গাড়ির লোকটা বললেন,
“অমলবাবু অনেক ভালো একটা মানুষ ছিলেন। মারা গেছেন একুশ বছর হলো। তবুও গ্রামের প্রায় সব লোক তাকে এক নামেই চেনে। অনেক দয়ালু ছিলেন। দানও করেছেন অনেক।”
নিজের বাবার প্রসংশা শুনে বেশ খুশি হচ্ছেন পদ্মাবতী। অর্ণব লোকটির উদ্দেশ্যে বললেন,
“সামনে কোনো মিষ্টির দোকান থাকলে দাঁড়াবেন একটু।”
পদ্মাবতী বললেন,
“আপনি এখন মিষ্টি খাবেন?”
“না।”
“তাহলে কী করবেন?”
“খালি হাতে আত্মীয়ের বাড়ি যাবে?”
“বুঝেছি।”
একটা মিষ্টির দোকানের সামনে এসে গাড়ি থামলো। অর্ণব মিষ্টি কিনে এনে পদ্মাবতীর কাছে রাখলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলে লোকটা আবার বলতে শুরু করলেন।
“এতো ভালো মানুষ হয়েও বেশিদিন বাঁচলেন না। অল্প বয়সেই সংসার ত্যাগ করলেন। কিন্তু ওনার বউটা নাকি খুব একটা ভালো ছিলেন না।”
পদ্মাবতী সাথে সাথেই বলে উঠলেন,
“কেন?”
“তার মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই নাকি অন্য পুরুষের সাথে পালিয়েছেন।”
মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল পদ্মাবতীর। ইচ্ছে করছে এখনই ফিরে যেতে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“পরপুরুষের সাথে পালিয়েছেন এটা কে বলেছে?”
“কে আবার, অমলবাবুর বাড়ির লোকেরাই জানিয়েছেন। মানে তার মা বোন আরকি।”
“এখন কী অবস্থা ওনার মা বোনদের?”
“ওনার মা এখন বেশ অসুস্থ। বাঁচবেন বলে মনে হয় না। আর ওনার বোন এখানেই আছেন স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে।”
পদ্মাবতী বিড়বিড় করে বললেন,
“বেশ হয়েছে। বুড়িটা যেন এবার মরেই যায়।”
জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন পদ্মাবতী। অর্ণব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লোকটার উদ্দেশ্যে বললেন,
“তাদের খবর তো ভালোই রাখেন দেখছি।”
“এক গ্রামে থাকি আর খবর রাখবো না?”
“আপনার না রাখলেও চলবে। আপনি গাড়ি চালান ঠিকমতো তাহলেই হবে।”
গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। লোকটা বললেন,
“এসে গেছি।”
পদ্মাবতী নেমে বললেন,
“এই বাড়ি? আপনি না বললেন অমলেন্দু বসাক অনেক দানশীল ছিলেন। তাহলে তার বাড়ির এমন দশা কেন?”
“তখন তো তারা অনেক বড় পাকাবাড়িতেই থাকতেন। আর্থিক টানাপোড়েনে পড়ে পনেরো আগে তার মা আর বোন ওই বাড়ি বিক্রি করে এবাড়িতে এসে উঠেছেন।”
অর্ণব তার পয়সা মিটিয়ে দিলেন। পদ্মাবতী ভাঙা টিনের দরজায় ধাক্কা দিতেই তা বিকট শব্দ করে খুলে গেল। ভেতর থেকে এক মেয়ে কে কে বলে দৌঁড়ে এলেন। অর্ণব আর পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“আপনারা কারা?”
“আমি পদ্মাবতী। কুঞ্জনগর থেকে এসেছি।”
পেছন থেকে আওয়াজ এলো,
“কে এসেছেরে শিউলি?”
মেয়েটা চেঁচিয়ে বললেন,
“চিনি না মা। কুঞ্জনগর থেকে এসেছে বললো।”
ভেতর থেকে এবার এক মহিলা দৌঁড়ে এলেন। পদ্মাবতী তার উদ্দেশ্যে বললেন,
“নমস্কার। আমি পদ্মাবতী।”
মুহুর্তেই মহিলাটির মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। তিনি অর্ণব আর পদ্মাবতীকে নিয়ে ভেতরে বসতে দিলেন। পদ্মাবতী মিষ্টির থলেটা তার হাতে দিলেন।
“এসবের আবার কি দরকার ছিল বলো তো।”
“না না ঠিক আছে।”
“এই নাও। শরবত খাও। অনেকটা রাস্তা এসেছো। কান্ত হয়ে গেছো নিশ্চয়ই।”
মহিলাটি বেশ সুন্দর করে কথা বলেন। পদ্মাবতীর খুব ভালো লাগলো। মুখে হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি কে?”
“আমি শর্মিলা। আমি তোমার পিসি হই।”
পরক্ষণেই পদ্মাবতীর সব হাসি যেন মিলিয়ে গেল।
“ওহ।”
“পদ্মাবতী, ও কি তোমার বর? বিয়ে করেছো?”
তার প্রশ্ন শুনে অর্ণব, পদ্মাবতী দু’জনেই খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেন। অর্ণব বললেন,
“না, এমন কিছু নয়। আমি শুধু ওকে এখানে পৌঁছে দিতে এসেছি।”
“তোমাকে তো চিনলাম না বাবা।”
“আমি আদিত্য চৌধুরীর ছেলে।”
“ও তুমি আদিত্য আর আম্রপালির ছেলে। আগে বলবে তো। তা শুধু পৌঁছে দিতে এসেছো মানে? থাকবে না?”
“না, আমি এখনই চলে যাবো।”
“এখনই চলে যাবো মানে? কোত্থাও যেতে দিচ্ছি না এখন। গেলে যাবে কিন্তু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর। বিকেলে রোদটা কমলে যেও।”
শর্মিলা কাউকে রান্না বসানোর জন্য তাগাদা দিতে লাগলেন। অর্ণব বললেন,
“আপনি আমাদের জন্য এতো ব্যস্ত হবেন না। আমরা খেয়েই বের হয়েছি। নতুন করে কিছু রান্না করবেন না আমাদের জন্য। আর যা করার ধীরে সুস্থে করুন। কোনো তাড়া নেই।”
“আচ্ছা। তাই-ই করবো। তোমরা মায়ের সাথে দেখা করবে না?”
পদ্মাবতী হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালেন।
“চলো তাহলে। এখনই দেখা করে নাও।”
অর্ণব আর পদ্মাবতীকে নিয়ে ছোট্ট একটা ঘরে ঢুকলেন শর্মিলা। সেখানে ছোট্ট একটা খাট পাতা। তাতেই এক বৃদ্ধা শুয়ে আছেন। গায়ে যেন একবিন্দুও মাংস নেই। কুঁচকে যাওয়া চামড়া হাড়ের সাথে লেগে গেছে। চোখদুটো কোটরে চলে গেছে। মাথায় চুল নেই বললেই চলে। জীর্ণশীর্ণ শরীরে একটা মলিন কাপড় জড়ানো। পদ্মাবতী বুঝতে পারলেন ইনিই তার দিদা। এতোকিছুর পরও হঠাৎ করেই পদ্মাবতীর যেন তার প্রতি মায়া লাগতে শুরু করলো।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-১৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
কনক দেবীর মাথার কাছে এসে বসলেন পদ্মাবতী। ঘুমাচ্ছেন তিনি। শর্মিলা তাকে আস্তে করে ডাকলেন। পদ্মাবতী তাকে ডাকতে মানা করলেন।
“জাগাবেন না ওনাকে। এখন ঘুমাচ্ছেন, ঘুমাতে দিন।”
“তা কী করে হয়? উনি দেখতে চেয়েছেন বলেই তো তুমি এসেছো। কয়দিন বাঁচবেন ঠিক নেই। এখনই দেখে নিতে দাও তোমাকে।”
পদ্মাবতী মানা করার পরও শর্মিলা তাকে ডাকতে লাগলেন।
“মা, ও মা। উঠে দেখুন কে এসেছে।”
ধীরে ধীরে চোখ খুললেন কনক দেবী।
“দেখুন তো চিনতে পারেন নাকি।”
অস্পষ্ট স্বরে কনক দেবী বললেন,
“পদ্মাবতী।”
“ঠিক ধরেছেন একদম। আপনার পদ্মাবতী এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।”
অর্ণব তার পরিচয় দিয়ে কনক দেবীকে প্রণাম করে শর্মিলার সাথে বেরিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী একা সেখানেই বসে রইলেন কনক দেবীর সাথে।
“পদ্মাবতী, তুই যে আসবি আমি কল্পনাও করিনি। একদম তোর মায়ের মতো হয়েছিস। দেখতেও আর মন থেকেও।”
পদ্মাবতী কিছু বললেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। কনক দেবীর চোখ ভরে উঠলো। জল গড়িয়ে পড়তেই পদ্মাবতী মুছে দিলেন।
“ক্ষমা করে দিস আমাকে পদ্মাবতী। অনেক অবিচার করেছি তোর মায়ের ওপর। ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই এখন। তুই-ই ক্ষমা করে দে আমাদের।”
পদ্মাবতী তার মাথায় হাত রাখলেন। কনক দেবী আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন। পদ্মাবতীর হাত বুকে নিয়ে দু’হাতে চেপে ধরলেন তিনি।
.
.
অর্ণব মানা করার পরও খাবারের অনেকগুলো পদ সাজিয়ে টেবিলে রাখলেন শর্মিলা। শিউলি তাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। অর্ণব বললেন,
“আর দেবেন না দয়া করে। আমি এতো খেতে পারবো না।”
শর্মিলা বললেন,
“তা বললে কি হয়? আত্মীয়ের বাড়ি এসেছো। একটু বেশি না খেলে চলে নাকি? ও শিউলি, আরও দু’টুকরো মাংস দে ওকে।”
অর্ণব মানা করার আগেই শিউলি বাধ্য মেয়ের মতো অর্ণবের পাতে মাংস বেড়ে দিলেন। পদ্মাবতীর সামনে এসে বললেন,
“তোমাকে আরেকটু দেবো দিদি?”
শর্মিলা বললেন,
“জিজ্ঞেস করছিস কেন? দে দে। বেশি করে দে।”
পদ্মাবতী বললেন,
“না, আর দিস না শিউলি। খাবার বেশি হবে।”
শিউলি মেয়েটা খুব মিশুক হওয়ায় কিছু সময়ের মধ্যেই পদ্মাবতীর সাথে তার সম্পর্ক অনেক গভীর হয়েছে। শর্মিলা আবার বললেন,
“বেশি হবে কেন? তুমি কি ঠিকমতো খাও না? এতো শুকনো কেন? আমার কাছে কয়েকদিন থাকলেই দেখবে কেমন মোটাতাজা হয়ে গেছো।”
“আমি সত্যিই এতো খেতে পারবো না। পরেরবার এলে সাথে করে মোহিনীকে নিয়ে আসবো। ও একাই এর দ্বিগুণ খেয়ে ফেলতে পারবে।”
“মোহিনী কে?”
“আমার বান্ধবী।”
“এবার নিয়ে এলে না কেন সাথে করে?”
“বলেছিলাম তো। ওই তো এলো না।”
“পরের এলে নিয়ে আসবে কিন্তু।”
“আনবো।”
অর্ণবের দিকে তাকালেন শর্মিলা। বেচারা খুব কষ্ট করে আস্তে আস্তে খাচ্ছেন।
“খাচ্ছো না কেন অর্ণব? খাবার ভালো লাগেনি?”
“এমন কিছু না।”
“তাহলে তাড়াতাড়ি খাও। এরপর তো মিষ্টিও আছে।”
“একদম পারবো না মাসিমা। এটাই খুব কষ্ট করে খাচ্ছি।”
“তোমার সমান আমার একটা ছেলে আছে। তোমার থেকে কয়েক বছর বড় হতে পারে। খেতে খুব পছন্দ করতো। আর আমি খাওয়াতে।”
“এখন কোথায় সে?”
“তিন বছর আগে বিয়ে করেছে। এক বছরের একটা বাচ্চাও আছে। বউ বাচ্চা নিয়ে কলকাতায় থাকে। এখানে আসে মাঝেমধ্যে। ওই বছরের এক দুইবার।”
খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে নিলেন তারা। অর্ণবের জন্য শর্মিলা তার ছেলের ঘরটা খুলে দিয়েছেন। অর্ণব সেখানে চলে গেলেন বিশ্রাম নিতে। পদ্মাবতী শিউলির সাথে তার ঘরে গেলেন। শিউলি বিছানা গোছাতে গোছাতে বললেন,
“দিদি, তুমি কি থাকবে আমাদের সাথে ক’দিন?”
“হ্যাঁ, তুই কি এখন ঘুমাবি নাকি?”
“হ্যাঁ, ঘুমাবো। দুপুরে খাওয়ার পর একটা ভাতঘুম না দিলে চলে নাকি?”
“আমি কী করবো তাহলে?”
“তুমি ঘুমাবে না?”
“না, আমার অভ্যেস নেই এমন সময় ঘুমানোর।”
“ওহহ।”
“আমি বরং বাইরে একটু ঘুরতে যাই।”
“এই রোদে বাইরে যাবে ঘুরতে? এখন এখানেই থাকো। বিকেলে আমি নিয়ে যাবোনি গ্রাম ঘুরে দেখাতে। এখন তুমি একা গেলে মা আমাকে বকবে।”
“তাহলে কী করবো?”
“বই পড়বে? কিন্তু বই তো সব দাদার ঘরে।”
“কোন দাদা?”
“আমার দাদা। যার ঘরে এখন অর্ণবদা রয়েছেন।”
“ওহহ। তুই ঘুমা তাহলে। আমি গিয়ে বই নিয়ে আসি।”
“আচ্ছা।”
নিজেদের ঘর থেকে বের হয়ে অর্ণবের ঘরে এলেন পদ্মাবতী। দরজার কাছে আসতেই দেখলেন অর্ণব আগে থেকেই একটা বই পড়ছেন। বললেন,
“আসবো?”
“কী দরকার?”
“বই নিতে এসেছি।”
“কার জন্য?”
“কার জন্য আবার। নিজের জন্য।”
“তুমি বই পড়বে?”
“হ্যাঁ, তাতে কী?”
অর্ণব বিড়বিড় করে বললেন,
“ভূতের মুখে রাম নাম।”
“কিছু বললেন আপনি?”
“না, কিছু বলিনি। এসো। নিয়ে যাও যা লাগবে।”
পদ্মাবতী ভেতরে এসে বুকশেলফ থেকে খুঁজে খুঁজে শরৎচন্দ্রের একটা বই নিয়ে আবার চলে গেলেন। শিউলির ঘরে এসে দেখলেন তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। মেয়েটাকে পদ্মাবতীর খুব পছন্দ হয়েছে। খুব শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে। পদ্মাবতীর চেয়ে কিছুটা ছোট। পদ্মাবতী মানা করার পরও তিনি তাকে দিদি বলেই ডাকেন। এবাড়ির কাউকেই পদ্মাবতীর অপছন্দ হয়নি। অথচ তার ভাবতেই অবাক লাগে এরাই তার মায়ের সাথে এমন অবিচার করেছিলেন। সত্যিই, সময় মানুষকে কতটা পাল্টে দেয়। অনেক্ষণ যাবৎ পদ্মাবতী বই নিয়ে বসে আছেন। এখন তাতেও বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে। অভ্যেস না থাকলে যা হয় আরকি। শর্মিলা এসে দরজায় কড়া নাড়লেন। পদ্মাবতী দরজা খুলে দিলে তিনি বললেন,
“চলো। অর্ণব চলে যাচ্ছে।”
পেছনে শিউলিকে দেখে আবার বললেন,
“ও এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি? হায় ভগবান, এই মেয়েকে নিয়ে যে কি করি আমি।”
শর্মিলা ভেতরে গিয়ে শিউলিকে ডেকে তুললেন। পদ্মাবতী বাইরে এলেন। শিউলি আর শর্মিলা এলে অর্ণব কনক দেবীর সাথে দেখা করে তাকে আর শর্মিলাকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন।
.
.
.
সন্ধ্যা হয়েছে অনেক্ষণ আগেই। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। জোৎস্নার আলোয় চারদিকের অন্ধকার ঢাকা পড়ে গেছে। মোহিনী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে তাকে। সাথে এই বাড়িটাও আজ আলোকসজ্জায় সজ্জিত। দূরের রাস্তাটা দিয়ে একটা গাড়িকে চৌধুরী বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে দেখলেন। বুঝলেন অর্ণব ফিরে এসেছেন। রজনী এসে বললেন,
“নিচে চল মোহিনী। লোকজন চলে এসেছে সব। শহর থেকে অনেক বড় বড় লোক এসেছে। জলসা শুরু হবে এখন।”
“আমি না গেলে শুরু হবে কী করে?”
“এতো অহংকার ভালো না বুঝলি। নাচি তো আমরাও।”
“আসে তো ওরা আমার নাচই দেখতে।”
“তোর রূপের অবদান। অথচ কেউ আজ পর্যন্ত ছুয়েও দেখতে পারলো না।”
“জানো রজনীদি, আমার একটা সীমা আছে। যেটা আমি নিজেও লঙ্ঘন করি না। আর কাউকে করতেও দিই না। আর এজন্যই আমি তোমাদের থেকে আলাদা। এজন্যই ওরা আমাকে দেখতে আসে।”
“মধু থাকলে মৌমাছি তো আসবেই। তুই কি নিচে যাবি এখন?”
“তুমি যাও। আসছি আমি।”
রজনী চলে গেলেন। বাক্স থেকে বিভিন্ন অলংকার বের করে পরে নিলেন মোহিনী। সাথে পায়ে বেঁধে নিলেন নিজের ঘুঙুরজোড়া।
চলবে…