মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-১৫

0
643

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৫

বৃহস্পতিবার-
দুই ভাইবোন আজ বাসা পরিস্কারের কাজে নেমেছিল। বেলা এ বাড়িতে আসার পর নিজেই সবকিছু করেছে এতদিনে। হঠাৎ কল আসায় ওয়াহাজ নিজের রুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর এসে এসে বেলার কাজ থামিয়ে দিয়ে বলে,” এখন এসব রাখো আর কিছু করতে হবে না। আমার সাথে তোমার বের হতে হবে।”

বেলা হাতের ঝাডু রেখে বলে,” কোথায় যেতে হবে?”
” পাসপোর্ট অফিসে।”
” আজই!”
” হ্যাঁ। আগামীকাল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আমার বন্ধু কল করেছিল, এখনই যেতে বলল।”
” ঠিক আছে। আমি তাহলে রেডি হয়ে নিই।”

বেলা ময়লাগুলো উঠিয়ে রেখে নিজের রুমের দিকে যাবে ঠিক তখনই ওয়াহাজ বেলাকে ডেকে বলে,” তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? পরে যেন না শুনি যে আমি জোর করে তোমাকে বাহিরের দেশে পড়তে পাঠিয়েছি। আর এখনই তো সব বলা যাচ্ছে না। আগামী সপ্তাহে জানতে পারবে সবকিছু। সব ব্যবস্থা আগে তাড়াতাড়ি করতে হবে। ”

বেলা কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবার বলে,” ভাইয়া, আমি নিজে থেকেই করছি সবকিছু। আমার একবার বিয়ে হয়েছিল, ডিভোর্স হয়েছে জন্য ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকব না৷ আমি কখনোই মনে করি না ডিভোর্স হওয়ায় আমার কোনো অন্যায় হয়েছে। আমি ওখানে আমার পড়াশোনা শেষ করে আবার দেশে ফিরব। ”
” আর ফারাজ!”

ওয়াহাজের কথায় চমকে যায় বেলা। ভ্রু বিস্তৃত করে তাকায় ওয়াহাজের দিকে। ফারাজের কথা তো ওয়াহাজের জানার কথা না। বেলা এ বাসায় আসার কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝেছিল ফারাজ তাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। যতটা সম্ভব হয়েছে সে ফারাজকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। ফারাজ যেদিন তাকে রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করতে বলেছিল সেদিনই বেলা আন্দাজ করেছিল যে ফারাজ হয়তো তাকে পছন্দ করে সেই কথাটাই জানাবে। বেলাও এটা ভেবেই রাজি হয়েছিল যে সে ‘না’ করে দেবে, ফারাজকে বোঝাবে সবকিছু সহজ হয় না।

বেলাকে চুপ থাকতে দেখে ওয়াহাজ বলে ওঠে,” আমি চাই না ফারাজের বাড়ির সবাই বলুক তুমি তাদের ছেলেকে ফাঁসিয়েছ। আর তার চেয়ে বড়ো কথা নুসরাতের কেসের ওই তিনজনের মধ্যে একজনকে বাড়ির সামনের বাজারে দেখেছি হয়তো তোমার খোঁজেই আসা যাওয়া করছে এদিকে। আমি কোনো রকম সমস্যায় তোমাকে জড়াতে চাই না। তোমার জীবন যে ঝামেলাবিহীন চলে তার ব্যবস্থা করছি আমি।”

বেলা মাথানিচু করে বলে,” উনাকে নিয়ে আমার তো কোনো চিন্তাভাবনা নেই ভাইয়া। উনি সেদিন…”

বেলাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ওয়াহাজ বলে উঠল,” আমি সবকিছু দেখে নেব। যাও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। অনেক কাজ বাকি আমার। ”

বেলা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে যায়। বেলা জানে তার ভাই একবার তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বললে সেটা তাড়াতাড়িই করতে হবে, দেরি হলে বারবার তাড়া দিতে থাকবে।
***
দুপুর আড়াইটা-
মৌ বেলাদের দরজার বাহিরে থেকে কলিংবেল বাজাচ্ছিল। দরজা না খোলায় চেক করে দেখে দরজা লক করা আছে। সকাল থেকে তার মন খারাপ। বেলাকে কল দিয়ে কোনোভাবেই পায়নি সে। ওয়াহাজকেও কল দিয়ে লাভ হয়নি।

ফিরে যাবে এমন সময় সিঁড়ি থেকেই বেলার গলা শুনতে পায় মৌ। তাকিয়ে দেখে বেলা আর ওয়াহাজ বাহিরে থেকে আসছে৷

মৌকে বাহিরে দেখে বেলা এগিয়ে গিয়ে বলে,” কী ব্যাপার আপু? বাহিরে কেন?”

ওয়াহাজের দিকে একবার দেখে আবার বেলার দিকে ফিরে বলে,” সকাল থেকে তোমাকে কল করছিলাম।”

বেলা মৃদু হেসে বলে,” ভুল করে ফোনটা বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। একটু তাড়াহুড়োয় বের হতে হয়েছিল তো!”
” কেন? কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?”
” পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলাম।”
” সত্যি সত্যিই তাহলে দেশ ছাড়ছো?”

বেলা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, ” হ্যাঁ ছাড়ছি। ছাড়তে হচ্ছে তো।”

মৌ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,” তুমি দেশ ছাড়ছো আর আমি বাড়ি ছাড়ছি, দারুণ না!”

বেলা একবার ভাইকে দেখে নিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দে মৌকে বলে,” তু তুমি বাড়ি ছাড়ছো মানে?”
” আমাকে আজ দেখতে আসবে, বেলা। একঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে। বাড়িতে আয়োজন চলছে।” কথাটা বলেই ওয়াহাজের দিকে তাকায় মৌ।

ওয়াহাজ কিছু না বলে দরজা আনলক করে ভেতরে চলে যায়। মৌ আর বেলা তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। মৌ নিজের ফ্ল্যাটের দিকে যেতে যেতে বলে,” তোমার ভাইয়া আমাকে একটুও বুঝতে পারল না! আমাকে নিয়ে একটু ভাবলে কী ক্ষতি হতো তার?”

বেলা পিছন থেকে মৌ-এর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে,” চলো, তুমি আজ ভাইয়ার সাথে কথা বলবে।”
” না, ওয়াজিহা। নিজে মুখ ফুঁটে এসব আর কীভাবে বলি? বললে তো এতদিনে বলতামই।”

ওয়াহাজ শার্টের বোতাম খুলছিল এমন সময় দরজায় নক করার শব্দ পেতেই খোলা বোতামটা আবার আটকে নেয় সে।

দরজা খুলে দেখে বাহিরে বেলা দাঁড়িয়ে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বেলা বলে ওঠে,” ভাইয়া, আর কত? মেয়েটা তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তোমার উচিৎ আঙ্কেলের সাথে কথা বলা। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে যেতে দিতে নেই ভাইয়া। সব মানুষ ছেড়েও যেতে চায় না। তোমার উচিৎ মৌ আপুকে, আপু থেকে আমার ভাবি করে দেওয়া। এটাই সঠিক সময়।”

” আমার এসবে জড়াতে একদম ভালো লাগছে না। সে যদি আমাকে পছন্দই করত তাহলে একবার বলতে তো পারতো তাই না? আমাকে সে পছন্দ করে এরকম কিছুই তো আমি কখনো দেখিনি বা শুনিনি তাছাড়া আমিও তাকে নিয়ে এরকম কিছু ভাবিনি।”
” এবার ভাবো। তুমি এখন আঙ্কেলকে বলবে ছেলেপক্ষ যেন রওয়ানা না দেয়।”
” পাগলামি করবে না, ওয়াজিহা।”
” আমাকে বাহিরে পাঠাতে চাইছো না? ধরো এটাই তার শর্ত।”
” আমি কোনো শর্তে তোমাকে বাহিরে পাঠাচ্ছি না। ”

বেলা ওয়াহাজের দুই বাহু ধরে আবদারের স্বরে বলে,” প্লিজ ভাইয়া।”

ওয়াহাজ আদরমাখা হাসিতে বেলার দিকে তাকায়। দুই গালে হাত রেখে বলে,” তুমি খুশি হবে?”
” খুউউব।”
” তোমার খুশির জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি।”
” আপাতত আঙ্কেলকে রাজি করো আর বিয়েটা করে নাও। আমি শান্তিতে দেশ ছাড়তে চাই। ”
**
বেলা ঠেলেঠুলে ওয়াহাজকে মৌদের বাসায় নিয়ে এসেছে। ফ্ল্যাটে ঢুকেই হাতের বামপাশে রান্নাঘর। মৌ-এর ফাহমিদা বেগম রান্নাঘরে রান্না করছিল। ওয়াহাজ আর বেলাকে দেখে তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন উনি। মৌকে ডেকে বসার ব্যবস্থা করতে বলে।

বেলা মৃদু হেসে বলে,” আন্টি এত ব্যস্ত হতে হবে না। আপনি তো রান্না করছিলেন হয়তো।”
” হ্যাঁ মা, আর বলো না। মৌকে আজ দেখতে আসবে। কিছুক্ষণ আগে কল করে বলল ওদের সাথে ছেলের বোনের আসার কথা। মেয়ের আসতে দেরি হচ্ছে। পাঁচটার দিকে আসবে হয়তো।”

ওয়াহাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,” তুমি এই বাসায় আসবে এটা তো ভাবাও বোকামি। আজ কী মনে করে আসলে তুমি? ফ্ল্যাট ভাড়া করে রেখেছ তিন বছর। মাঝে মাঝে এসে থেকেছ কিন্তু এখানে তো আসোইনি৷ ”

ওয়াহাজ কী বলবে বুঝতে পারছে না। এমন একটা দিনে নিজের বিয়ের কথা বলতে এসে নিজেও বিপদে পড়ে যাচ্ছে। অপমান করে বের করে দেয় নাকি সেটাও ভাববার বিষয়। আজকের দিনে এসব বললে অপমান করে বের করে দেওয়াও অসম্ভব কিছু না।

ওয়াহাজকে চুপ করে থাকতে দেখে বাম হাতের কনুই দিয়ে ধাক্কা দেয় বেলা। ওয়াহাজ সাথে সাথে বলে ওঠে,” আঙ্কেল কোথায়, আন্টি? ”

ফাহমিদা বেগম রুমটা দেখিয়ে দেয়। মৌ এতক্ষণে রুমের বাহিরে এসে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। বেলা তার দিকে তাকাতেই ইশারায় জানতে চায়- কী হচ্ছে এখানে?
বেলাও মৃদু হেসে ওয়াহাজকে নিয়ে মৌ-এর বাবার কাছে চলে যায়।

ওয়াহাজ দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলে বই থেকে মুখ তুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওয়াহাজকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়। বইটা পাশে রাখতে রাখতে বলে,” আরে ওয়াহাজ যে! তা বাবা, আজ কি পথ ভুল করে এসেছ নাকি? আসো আসো এখানে এসে বসো।”

ওয়াহাজ একবার বেলার দিকে তাকায়৷ ইশারায় তাকেও আসতে বলে মৌ-এর বাবার পাশে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চলতে থাকে।

দুজনের কথা চলছে, বেলা পাশে বসে বসে অপেক্ষা করছে ওয়াহাজ কখন আসল কথাটা বলবে। বেলা পাশে বসে থেকে ওয়াহাজকে বারবার ইশারায় কথাটা বলতে বলছে অথচ ওয়াহাজ সেটা কিছুতেই বলতে পারছে না।

বেলা আর অপেক্ষা করতে না পেরে নিজেই বলে ওঠে,” আঙ্কেল, মৌ আপুকে যারা দেখতে আসছে তাদের নিষেধ করে দেন। আমি আর ভাইয়া মৌ আপুর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। মৌ আপুকে আমি ভাবি বানাতে চাই। আমার ভাইয়াকে তো আপনারা চিনেনই৷ তার কোনো খারাপ অভ্যেস নেই। ওয়াহাজ ভাইয়া মৌ আপুর জন্য একদম পারফেক্ট। আমার ভাইয়ার মতো ছেলে আপনি সারা বাংলাদেশ তন্নতন্ন করে খুঁজলেও পাবেন না।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে বেলা। ওয়াহাজ আর সামনে বসা মৌ-এর বাবা এক পলকে বেলার দিকে তাকিয়ে আছে। বেলাও তাদের দুজনের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে যেন কী না কী বলে ফেলেছে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতে যেন বেলা হাফ ছেড়ে বাঁচে।

” আমার কল এসেছে, আমি আসছি। তোমরা কথা বলো।” বলে ফোনের দিকে তাকাতেই চমকে যায় বেলা। হঠাৎ এতদিন পর এই মানুষটা ফোন কোনোভাবেই আশা করেনি সে। বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ায় সে।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে