মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-০৯

0
682

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৯(নতুন করে শুরু)

ওয়াহাজ রাতে বোনকে নিয়ে বাসায় ফিরে নিজেই খাবার গরম করে বোনকে খাইয়েছে। ওয়াজিহা খেতে না চাইলেও একপ্রকার জোর করে খাবার খাইয়েছে সে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে রাত দেড়টা বেজে গিয়েছিল। ওয়াহাজ ওয়াজিহাকে তার রুম দেখিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। সকাল সকাল উঠতে হবে বলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে সে।

রাত তিনটা, ওয়াজিহার চোখে তখনও ঘুম নেই। প্রিয়জন হারানোর কষ্ট তেমন না থাকলেও ঠকে যাওয়াটা তাকে ভীষণ পো*ড়াচ্ছে। সারারাত কেউ নির্ঘুম কাটাচ্ছে এটা শুনলে সে আগে ভীষণ অবাক হতো কিন্তু আজ যেন কোনকিছুই অস্বাভাবিক লাগছে না। নির্ঘুম রাতটা যেন বিশাল থেকে বিশালাকার ধারণ করছে।
ওয়াজিহা জানালার পাশে বসে বসে রাতের খোলা আকাশ দেখছিল সে। বাড়ির পিছনের দিকটায় তার রুমটা। বাড়ির পিছনে বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
ঘড়ির কাটায় এক এক করে মিনিট বাড়ছে। ওয়াজিহা আর বসে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়ায়। রুমে লাইট জ্বালিয়ে ওরনাটা নিয়ে ড্রয়িংরুমের বেসিনে চলে যায়। হাত ধোয়া থেকে শুরু করে মাথা মাসেহ করে রুমে এসে আবার দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমে গিয়ে পা ধুয়ে চলে আসে। হাত-মুখ মুছে ব্যাগ থেকে জায়নামাজ বের করে সে। শেষ কবে তাহাজ্জুদ পড়া হয়েছে সেটা তার মনে নেই। সংসারের চাপে, কাজের চাপে তাহাজ্জুদ তো দূর মাঝেমাঝে ফরজ নামাজটাও ছুটে যেত। এখন হয়তো আর সেটা হবে না। ওয়াজিহা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় এই জীবনটা এবার মানুষকে নয় রবকে খুশি করার জন্য উৎসর্গ করবে সে।

ব্যাগ থেকে জায়নামাজটা বের করে নামাজে দাঁড়িয়ে যায় সে। চারদিকে প্রগাঢ় নিরবতা। কোথাও কোন শব্দ নেই তেমন। মাঝেমাঝে গাড়ির শব্দ আর কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।

ওয়াজিহা তাহাজ্জুদ শেষ করে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে চারটা দশ বেজেছে। সাড়ে চারটায় ফজরের আজান দেবে। ততক্ষণে সে নিজের কুরআন শরীফ বের করে পড়া শুরু করে। কতদিন পর সব যেন নিয়ম মাফিক হচ্ছে। নামাজ, কুরআন পড়লেই কেমন নিশ্চিন্ত লাগে নিজেকে।

ওয়াজিহা ফজরের নামাজ শেষ করে রুমের বাহিরে বের হয়। রান্নাঘরে লাইট জ্বল*ছে দেখে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে ওয়াহাজ রান্নাঘরে কিছু একটা করছে। রান্নাঘরের বাহিরে থেকেই ওয়াজিহা বলে ওঠে,” এত সকালে কী করছ ভাইয়া?”

ওয়াহাজ পিছনে ফিরে বোনকে দেখে মৃদু হেসে বলে,” পানি গরম দিলাম। এত সকালে উঠেছ? রাতে ঘুম হয়েছে?”
” নতুন জায়গা তো তাই হয়তো ঘুম হয়নি। পানি গরম করে কী করবে? চা খাবে?”
” না, আমি সকালে চা খাই না। এই যে পানি গরম হয়ে গেছে এখন একটু মধু মিশিয়ে খেয়ে নেব। তোমাকেও দিচ্ছি।”

ওয়াজিহা নাক সিটকে বলে,” আমি এসব খাই না।”
” কোনো ব্যাপার না, এখন থেকে খাবে।”

ওয়াহাজ দুইটা মগ দুজনের জন্য রেডি করে ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসে। ওয়াজিহাও পাশে এসে বসে। একটা মগ ওয়াজিহার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ওয়াজিহা সেটা হাতে নিয়ে বসে ভাইয়ের কাজ দেখছে।

ওয়াহাজ ছোটো একটা কৌটা থেকে কয়েকটা কিসমিস বের করে নিজে কিছু নিয়ে বাকিটা বোনকে দিয়ে বলে,” এগুলো খেয়ে নাও। খেয়ে রুমে চলে যাবে, তোমার ঘুম প্রয়োজন।”
” তুমি কী করবে?”
” আমি ফজরের নামাজ শেষ করে প্রতিদিন হাটতে বের হই। সপ্তাহখানেক যাক তারপর তোমাকেও নিয়ে যাব। তুমি চাইলে বাসার ছাদে যেতে পারো এখনকার আবহাওয়া সুন্দর। ”

ওয়াহাজ বেরিয়ে যেতেই ওয়াজিহা দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দেয়। একপা দু’পা করে রুমে যেতে শুরু করে তারপর কিছু একটা ভেবে রুমে না গিয়ে দরজা খুলে সোজা ছাদে চলে আসে।

মাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সূর্য ওঠা এখনো দেরি৷ চারপাশটা একরকম অদ্ভুত সুন্দর। ওয়াজিহা ছাদের একপাশ থেকে অন্যপাশে হাটতে শুরু করে। নিচের দিকে তাকিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে। হঠাৎ চিলেকোঠার একপাশে চোখ যেতেই দেখতে পায় সেখানে কেউ গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ওয়াজিহা সেদিকে এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারে এখানে কেউ জায়নামাজ বিছিয়ে শুয়ে আছে।

ওয়াজিহা লোকটার সামনের দিকে যেতেই দেখে তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। লোকটার বয়স হয়তো পঞ্চাশের ওপরে। ওয়াজিহা সেখানে আর বেশিক্ষণ দেরি না করে নিজের রুমে চলে আসে। দরজা আটকে বিছানায় গিয়ে বসে। রুমের একপাশে বুকশেলফ দেখে সেখান থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে।
**
সাতটা পর ওয়াহাজ বাসায় ফিরে এসে দেখে ওয়াজিহা রুমের দরজা আটকে রুমেই আছে। ওয়াহাজ রান্নাঘরের দিকে গিয়ে ফ্রিজ চেক করে দেখে খাবার রান্না করতে যায়। দরজায় কলিংবেলের শব্দ পেয়ে ওয়াহাজ গিয়ে দরজা খুলে দেখে ওপাশে পিছন ঘুরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াহাজ দেখেই বুঝতে পারে সেটা মৌ।

ওয়াহাজ ডেকে বলে,” তুমি এখন এখানে কেন? এত সকালে?”

মৌ ওয়াহাজের দিকে ফিরে বলে,” ফারাজ বলল, আপনার ফ্ল্যাটে নাকি কে আসছে?”
” আমার বোন। ”
” বোন! আগে তো বলেননি কখনো যে আপনার বোন আছে?”
” বলেছি মনে করে দেখো।”
” ভেতরে আসতে বলবেন না? আগে তো বাসায় আসলে ভেতরে আসতে দিতেন না, এখন তো দিবেন তাই না?”
” হ্যাঁ, এসো।”

মৌ ভেতরে এসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে। কাউকে না দেখে ওয়াহাজকে জিজ্ঞেস করে,” কোথায় আপনার বোন? দেখছি না তো?”

ওয়াহাজ ওয়াজিহার রুম দেখিয়ে বলে,” ওয়াজিহা রুমে আছে।”
” আপনার বোন নাম ওয়াজিহা? ওয়াহাজ আর ওয়াজিহা। বাহ সুন্দর! আমি তার রুমে যাব? সে আমার বড়ো নাকি ছোটো?”
” তোমার ছোটো হবে। ওর বয়স তেইশ বছর।”
” আচ্ছা। আমি যাব ওর রুমে?”
” হ্যাঁ যাও।”

মৌ ওয়াজিহার রুমের দরজায় গিয়ে নক করতেই ওয়াজিহা ভেতর থেকে এসে দরজা খুলে দেয়। বাহিরে একটা মেয়েকে দেখে পিছনে দাঁড়ানো ভাইয়ের দিকে তাকায়।

ওয়াহাজ পিছন থেকে বলে ওঠে,” উনি আমাদের বাসাওয়ালা আঙ্কেলের মেয়ে। রাতে যে বেরিয়ে চাবি দিল তার বোন। তোমার সাথে পরিচিত হতে এসেছে। ”
ওয়াজিহা মৃদু হেসে মৌ-কে ভেতরে আসতে বলে। মৌ ভেতরে গিয়ে পাশে রাখা মোড়া টেনে বসে। ওয়াজিহা গিয়ে বিছানায় বসে।

মৌ পরিচিত হতে বলে,” আমার নাম মৌ। সামনের ফ্ল্যাটটায় আমরা থাকি। তুমি চাইলে যখন ইচ্ছে আমার বাসায় আসতে পারো। তুমি আমার ছোটো তাই তুমি করেই বললাম।”

ওয়াজিহা পূর্বের ন্যায় মৃদু হেসে বলে,” আমি ওয়াজিহা।”
” তোমার ভাইয়া এখানে বাসা নিয়েছে অনেকদিন কিন্তু আজ দুদিন ধরে তিনি একেবারে দেশে আসছে। উনি মাঝেমাঝে কয়েকবার এসেছিল দেশে। গতকাল উনি বের হওয়ার সময় বললেন যে স্পেশাল কাউকে নাকি বাসায় আনতে যাচ্ছেন। আমার প্রথম শুনে খুব মন খারাপ হয়েছিল জানো? আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো বিয়ে করে বাসায় বউ নিয়ে আসবেন। বোনও যে কারো এত স্পেশাল কেউ হতে পারে! যাক আমি এখন খুশি।”
” আগে কেন খুশি হননি?”

মৌ ওয়াজিহাকে ইশারায় কাছে ডেকে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,” তোমাকে বিশ্বাস করে বলছি। তোমার ভাইয়াকে বোলো না প্লিজ।”

ওয়াজিহা বুঝতে পারে মৌ কী বলবে তবুও সে বলে,” বলব না ভাইয়াকে। ”
” আমি না তোমার ভাইয়াকে পছন্দ করি কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারি না। বললে হয়তো উনি আমাদের বাসা ছেড়ে চলে যাবেন।”
” আমি বলব?”
” তুমি আমাকে সাহায্য করবে?”
” হ্যাঁ, করতেই পারি। দুজনকে একসাথে করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে। এখন তো দুনিয়ার মানুষ শুধু দুজন মানুষকে আলাদা করায় ব্যস্ত।”

ওয়াজিহা আর মৌ গল্প করছে এমন সময় ওয়াহাজ দুই কাপ চা নিয়ে রুমে আসে। ওয়াজিহা আর মৌকে চা দিয়ে আবার বেরিয়ে যায়। ওয়াহাজ বেরিয়ের যেতেই আবার কলিংবেলের শব্দ শুনতে পায় ওয়াজিহা। বিছানা ছেড়ে উঠবে তখনই মৌ বলে ওঠে,” তুমি বোসো আমি দেখছি।”

মৌ চায়ের কাপটা রেখে বাহিরে চলে আসে। বাহিরে এসে দেখে ওয়াহাজ নিজের ঘরের দরজা লক করে দিয়েছে। সে হয়তো কাজে বের হবে জন্য রেডি হচ্ছে তাই মৌ আর তাকে না ডেকে নিজেই গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দেয়।

বাহিরে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠে,” এখানে কি? তুই এখন এখানে কেন? আমার পিছে পিছে নজর রাখতে চলে এসেছিস?”

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে