মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-০৩

0
664

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০৩

” আমার স্বামী আমার জন্য সতীন নিয়ে আসছে জানো? আমি আমার পুরুষটাকেও মায়ায় বাঁধতে পারলাম না। আমি আর কত হারাবো বলতে পারো?” কল রিসিভ হতেই বেলা সাথে সাথে বলে ওঠে।

ওপাশের ব্যক্তি তখনও নিরব। তিনি হয়তো বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না। এ সময় যে মেয়েটার সংসার ভাঙনের পথে সে মেয়েটাকে কী বলে সান্ত্বনা দেয়া উচিৎ সেটা ওপাশের ব্যক্তির জানা নেই।

বেলা আবার বলে ওঠে,” আমি সতীনের সাথে সংসার করব না ভাইয়া। তুমি আমাকে এখান থেকে প্লিজ নিয়ে যাও। ওরা ভাবছে আমার যাওয়ার জায়গা নেই, আমার সৎভাই ছাড়া কেউ নেই তাই ওরা আমার সাথে এরকম করতে পারছে। ভাইয়া আমি আর একটা মুহূর্তও এখানে থাকতে পারছি না। এদের মাঝে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে জানো? আমি এখানে পাঁচটা বছর গাধার খাটুনি খেটেছি শুধুমাত্র একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কিন্তু সেটাও পেলাম না। ”

ওপাশ থেকে ভারী গলায় পুরুষটি বলে ওঠে,” আমি দেশে এসেছি গতকাল। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামীকাল দেখা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু এভাবে দেখা করতে হবে ভাবিনি। তুমি কি নিজের জীবন নিয়ে যা করতে চাইছো সেটাই করবে? আমি তোমাকে কোনকিছুতে বাধা দেব না। আমার মনে হয় তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ। পৃথিবীতে ভালোবাসার চেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে সম্মান। ”

বেলা ভাইয়ের সাথে আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারে না। বারবার ভেঙে পড়ার পথে এগুচ্ছে সে। সে ফুঁপিয়ে উঠলেই ওপাশ থেকে কঠিন ব্যক্তিত্বের পুরুষটি আবার বলে ওঠে,” ওয়াজিহা, কাঁদবে না একদম কাঁদবে না। এরকম শিক্ষা আমি তোমাকে দেইনি। আমি তোমার বড় ভাই, তোমার পাশে আছি। আমি এক্ষুণি বাসা থেকে বের হচ্ছি। তুমি শুধু তোমার বাসার লোকেশন আমাকে দিতে থাকবে।”

বেলা নিজেকে শান্ত করে বলে ওঠে,” কিন্তু ভাইয়া, তুমি এখানে আসলে যদি কিছু হয়।”
” তোমার কি মনে হয় আমি কোনরকম ব্যবস্থা না করেই দেশে এসেছি! তোমার ভাই কাঁচা খেলোয়াড় নয়, ওয়াজিহা।”

হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ পেয়ে বেলা বলে ওঠে,” ভাইয়া, কেউ দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।”

আদেশ করার ভঙ্গিতে ওপাশ থেকে জবাব আসে,” তোমার মূল্য তুমি বুঝতে পেরেছ? একটা পুরুষ তার প্রথম স্ত্রীকে কখন না জানিয়ে বিয়ে করে? প্রথম স্ত্রীর মর্যাদা তার কাছে কতটুকু হলে এমন করতে পারে মাথায় রেখ। তোমাকে হয়তো কেউ অনেক কিছু বোঝাতে আসবে কিন্তু বাস্তবতা তোমাকে মাথায় রাখতে হবে। সিদ্ধান্ত থেকে নড়া যাবে না।”
” আমি তোমার বোন। কিচ্ছু ভুলব না আমি, তুমি প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।”
” আমি আসছি ওয়াজিহা, জাস্ট আড়াই ঘণ্টা।”
” অপেক্ষা করছি ভাইয়া।”

ফোন কেটে বেলা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে তার শাশুড়ী আর ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে। দুজনকে একসাথে দেখে বেলা বেশ বুঝতে পারে এবার তাকে অনেককিছুই হয়তো বোঝাতে হবে। বেলা নিজেকে শক্তপোক্তভাবে তৈরি করে নেয়। হিসেব করে নেয় বারো লাখ যোগ সাত লাখ সমান ঊনিশ লাখ টাকা। এতগুলো টাকা দিতে না চেয়ে অনেককিছুই হয়তো তাকে বোঝানো হবে এখন।

দরজার ওপাশের দুজনই বেলার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছে। তারা ভেবেছিল বেলাকে কান্নায় চোখ ফুলিয়ে ফেলা অবস্থায় দেখবে। বেলাকে এই অবস্থায় দেখবে সেটা কেউই কল্পনা করেনি। জাহিদা বেগম এবং ধ্রুব দুজন দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার বেলার দিকে তাকায়৷

জাহিদা বেগম নরমস্বরে বলেন, ” তুমি ঘরের খিল এঁটে এসব করতেছিলা? আমি ভাবছিলাম…”

বেলা চকিতে বলে ওঠে, ” কী ভাবছিলেন? কান্না করে করে ম*রে যাচ্ছি? আপনার ছেলে ওরকমও কেউ না আম্মা। ”

বেলার কথায় ধুবর মুখটা চুপসে যায়। আপাদমস্তক একবার দেখে নেয় বেলাকে। আমতা আমতা করে বলে,” আমাকে কি ক্ষমা করে দেয়া যায়, বেলা? আমি ভুল করে ফেলেছি সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু এখন তো কিছু করার নেই। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না। তুমি প্লিজ একটাবার আমাকে সুযোগ দাও। লিলির থেকে তুমিই বেশি প্রায়োরিটি পাবে কথা দিলাম।”

জাহিদা বেগম ধ্রুবর হাত ধরে টেনে নিয়ে রুমে ঢুকে পড়েছে এতক্ষণে। তিনিও বলে ওঠেন,” বলতে গেলে এ বাড়ি তোমার হাতে গড়ে উঠেছে। তুমি কেন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আগেও যেমন ছিলে এখনও তেমনই থাকবে। তোমার গুরুত্ব একচুলও কমবে না। সবকিছু প্রয়োজনে তোমার কথামতো চলবে। তুমি ডিভোর্সের কথা মাথায় এনো না, মা।”

বেলা সবকিছু বুঝতে পারে। তার ভাবনা তাহলে সত্যি। মা-ছেলে মিলে গিয়েছে এতক্ষণে। পৃথিবীর কোন মা-ই অবিশ্বাস্য কিছু করে উঠতে পারল না। নাড়িতে ঠিকই টান পড়ল, ছেলে বলে কথা! তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে বেলা।

বেলাকে চুপ থাকতে দেখে জাহিদা বেগম ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে ইশারায় কিছু বলেন৷ বেলা ঠিক বুঝতে পারে এখানে এখন মেলোড্রামা চলতে শুরু করেছে।

ধ্রুব বেলার দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরবে ঠিক তখনই সে তড়িৎগতিতে পা থেকে স্লিপারটা খুলে হাতে নিয়ে দাঁত শক্ত করে বলে ওঠে,” তোকে তো ইচ্ছে করছে এটা দিয়ে মা*রতে মা*রতে জাস্ট এটাই ছিড়ে ফেলি। তুই যদি আর একপা আমার দিকে বাড়িয়েছিস, তোর পা আমি কে*টে রেখে দেব। আমাকে এখনো চিনে উঠতে পারিসনি তোরা। যা রুম থেকে বেরিয়ে যা এক্ষুণি। তোর এই ইবলিশমার্কা চেহারা দেখলে আমার বমি আসছে। ”

ধ্রুব করুণস্বরে বলে ওঠে,” বেলা প্লিজ একটাবারের জন্য আমাকে মাফ করে দাও।”
জাহিদা বেগমও বলে ওঠেন,” বউমা, একটাবার বাবুকে সুযোগ দিয়েই দেখো। আমি বলছি, ও আর ভুল করবে না।”

বেলা তার শাশুড়ির কথা শুনে বলে,” জানেন আম্মা, আমি আপনার কথা শুনে মোটেও অবাক হচ্ছি না। আপনি তো মা, ছেলের পক্ষ অবশ্যই নিবেন। তবে আম্মা, আপনার ছেলে কোন ভুল করেনি যা করেছে সেটা অন্যা*য়। অ*ন্যায়ের শা*স্তি ওকে পেতেই হবে। আমাকে পাওয়া তো দূরের কথা আমার দিকে তাকানোর অধিকারটুকুও আমি কেড়ে নেব আপনার ছেলের থেকে। ”

বেলা এবার ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বলে,” তোর কি মনে হয় তুই আমার যোগ্য? হাহ! আমি আমার ভাইয়ের কথা রাখতে তোকে বিয়ে করেছিলাম। সাধারণ একটা মেয়ের মতো এখানে পাঁচটা বছর ছিলাম। শুধু এখানে কেন, সৎভাইয়ের বাড়ি লা*ঠিঝেঁ*টা খেয়েও বুদ্ধির পর আট বছর ছিলাম। আমাকে যতটা সাধারণ, দূর্বল তোরা ভেবেছিস ততটা আমি নই৷ ধারের টাকা আর কাবিনের টাকা দিতে বুকে ব্যথা করছে তাই তো এখানে এসেছিস। আমাকে নির্বোধ ভেবে এরকম ভুল আর করবি না। ঊনিশ লাখ টাকা উপার্জন করতে তোর পাঁচ বছর লেগেছে। একসাথে হয়তো আজই দেখবি, এর আগে তো মুরদ হয়নি বাপের জন্মে৷ তুই আমাকে ডিজার্ভই করিস না।”

জাহিদা বেগম আর ধ্রুবর মুখে আর কোন কথা নেই তবে ধ্রুব তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রাগে ফুসছে। সে মোটেও বেলার সামনে আসতে চায়নি৷ সে আন্দাজ করেছিল এরকম কিছুই হবে, বেলা খুব জেদি মেয়ে সেটা ধ্রুব আগে থেকেই জানে। মায়ের জোরাজোরিতেই এখানে আসতে হয়েছিল তার। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে তার কাছে।

বেলা দুজনকে চুপ থাকতে দেখে বলে ওঠে,” এখন আপনারা যেতে পারেন৷ টাকার ব্যবস্থা করুন সাথে তালাকেরও৷ যখন সম্মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, ভালোবাসা আর সম্মানের তুলনা আসে তখন আমি ভালোবাসাকেও মূল্য দেব না। আমি যদি আমাকে সম্মান না করি, পৃথিবীর কেউ আমাকে দু’পয়সার মূল্যও দেবে না, সম্মান তো দূরের কথা। সুতরাং একজন নারী যার আত্মসম্মান ব্যাপক, তার কাছে অন্তত এরকম ইউজলেস ওয়ার্ড ইউজ করবেন না। ভালোবাসা আপনারা ডিজার্ভ করেন না।”

কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে বেলা আবার বলে ওঠে,” আপনারা যদি মনে করেন, আমি অন্যান্য মেয়েদের মতো ন্যাকা সাজতে গিয়ে বলব যে সব টাকা মাফ করে দেব তাহলে ভুল ভাবছেন। একটা পয়সাও আমি ছাড়ব না। আমার টাকা আমি প্রতিটা পয়সা বুঝে নেব আর আমার কাবিনের টাকা আমার অধিকার। সেটাও মাফ করব না আমি। শান্তিতে থাকতে চাইলে ঊনিশ লাখ টাকা আজই আমাকে দিতে হবে। নাহলে অবশ্যই এখানে থানা-পুলিশ হবে। ”
বেলা তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,” আর হ্যাঁ আম্মা, আমার গহনাগুলো আমাকে বুঝিয়ে দেন৷ চার ভরী গহনা আছে আমার। প্রয়োজনে ওজন দিয়ে নেব আমি। আমি যদি খুব একটা ভুল না করি তাহলে আপনি হয়তো ভেবেছিলেন আমার গহনার কিছু গহনা মেয়েকে দিয়ে তাকে বিদেয় করবেন৷ সেটা আর হচ্ছে না। গহনা নিয়ে আপনি এখানে আসবেন নাকি আমি আসব আপনার সাথে?”

” পাঠিয়ে দিচ্ছি।” সংক্ষেপে বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যান জাহিদা বেগম।
ধ্রুবও যেতে যেতে বলে,” লোভী মেয়ে একটা।”

” প্রতা*রক একটা।” ধ্রুব রুম থেকে চলে যাওয়ার সময় বেলার এই কথাটা শুনতে পায়৷ পিছন ফিরে বেলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
***
বেলা নিজের রুমেই ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিল। যা যা প্রয়োজন সেসব নিজের সাথে নিয়ে যাবে সে। এখানে ফেলে যাওয়ার কোন মানে না। নিজের পছন্দের শাড়ি, জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় সবকিছু ব্যাগে নিচ্ছে সে।

রিমি এসে দরজায় দাঁড়াতেই দেখতে পায় বেলা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। সে যেন এবার শান্তি পাচ্ছে। মায়ের দেয়া গহনাগুলো দিতে এসেছে বেলাকে। এখানে এসে চক্ষুশীতল করা জিনিস দেখবে সেটা সে ভাবতেই পারেনি।

গহনাগুলো নিয়ে বেলার কাছে আসতে আসতে বলে,” নাও, নাও ব্যাগ গুছিয়ে নাও। এ বাড়িতে তোমার আয়ু তো বেশি সময়ের না। দেখো বাহিরে গিয়ে আমার ভাইয়ের মতো কেউ কপালে জোটে কি না।”

রিমির ঠেস দিয়ে কথা বলার অভ্যাস সেটা বেলা জানে। রিমির হাতে থেকে গহনাগুলো নিয়ে বিছানায় ছড়িয়ে সেগুলো দেখতে থাকে।

গহনাগুলো দেখিয়ে বলে,” আমার চিন্তা তোমার করতে হবে না। তোমার ভাইয়ের মতো দুশ্চরিত্র পুরুষ মানুষ চাইও না। দেখো এখানের কোন গহনা পছন্দ হয় কি না। নিজের বিয়েতে তো মনে হয় না তোমার নতুন ভাবি কিছু দেবে। এখান থেকে দুই একটা নাও, আমি আবার এতটাও কার্পণ্য করব না। ”

রিমি মুখ বাঁকিয়ে বলে,” তুমি যে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছেন তুমি কোথায় যাবে। আমার ভাইয়ের অবর্তমানে কোন নাগর জুটিয়েছ নাকি?”
” তোমার ভাইয়ের মতো আমার চরিত্র খারাপ না। তোমার ভাইয়ের মতো আমি কাউকে ঠকাচ্ছিও না। ”
” আমাদের চোখের আড়ালে কী কী করেছ সেটা তো তুমিই জানো৷ খুটিয়ে দেখলে হয়তো কেঁচো খুড়তে কেউটে বেরিয়ে আসবে। দেখা যাবে নাগর ঠিকই জুটিয়েছ।”

বেলা রিমির গালে আবারও থাপ্পড় দেয়ার ভয়ে দেখিয়ে বলে,” আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকে দেখো। তোমার ভাই বউ রেখে আরেকটা বিয়ে করেছে সেদিকে দেখো, যেখানে কিছু নেই সেখানেই দ্বিতীয়বার কাদা ছুড়াছুঁড়ি করবে না। চলে যাওয়ার আগে পি*টিয়ে সোজা করে দিয়ে যাব বলে দিলাম। যাও রুম থেকে বেরোও। নোংরা মস্তিষ্ক নিয়ে একদম আমার সামনে আসবে না। আমার ব্যাপারে যদি মানুষের সামনে আবার নাক গলিয়েছ নাকের বদলে গলা কে**টে রেখ দেব। আমাকে তুমি এখনো চেনোনি। নতুন ভাবির খাতির যাত্ন কর যাও। যাও, বেরোও। ”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে