মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-০১

0
1075

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০১

স্বামী বিদেশ থেকে আসবে বলে দুইদিন আগে থেকে বাড়ি পরিষ্কার করার কাজে হাত দিয়েছে বেলা। শাশুড়ির রুম পরিস্কার করার সময় শাশুড়ির গলা শুনে কাজ থামিয়ে কথা শোনার চেষ্টা করে।

” ধ্রুব নাকি গতকাল আইছে বিদেশ থেইকা। ওয় এহনো বাড়িত আইলো না, বাড়িত কয়-ও নাই। সুমু কইল কাইল নাকি বাবুরে দেখছে কোন এক মাইয়ার লগে। কইল যে দেইখা নাকি মনে হইছে জামাই-বউ। এইডা কোন কথা হইল ক’? ওই ছ্যাড়া কারে লইয়া শহর ঘুরতাছে ক’ তো?”

জাহিদা বেগম তার মেয়ে রিমিকে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। শাশুড়ির কথা শুনে বেলার মুহূর্তের মধ্যে দমে গেল। আনন্দের সাথে কাজ করা যেন থেমে গেল তার। শাশুড়ির ঘর মুছে দিচ্ছিল সে। শাশুড়ির মুখে স্বামীকে নিয়ে ওরকম কথা শুনে হাতে যেন আর কোনভাবেই শক্তি পাচ্ছিল না সে।

রিমি সহাস্য বলে ওঠে,” আম্মা, ভাই বিদেশী মাইয়া বিয়া কইরা আনছে? দেখতে ক্যামন, কিছু কইছে সুমু? নিশ্চয়ই ধলা কোন বিদেশিনীরে ভাই নিয়া আইছে। আমার তো শুনেই নতুন ভাবিরে দেখতে মন চাইতেছে আম্মা।”

জাহিদা বেগম মেয়ের দিকে কটমট করে তাকান। চোখ দেখেই বোঝা যায় তিনি মেয়ের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। মেয়ের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে ওঠেন,” কী কইতাছস খেয়াল আছে? মা*গি সোয়ামির ভাত খাওয়া লাগত না চিন্তাভাবনা এমন দূষিত হইলে। ভাই একটা অকাজ কইরা বইয়া আছে, সেই ভাই আর নতুন কোন বে*শ্যা আইতাছে তারে নিয়া আবার তোর মনে লাড্ডু ফুটতাছে, না? ”

রিমি মায়ের কাছে থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় এসে বসে। বিলম্ব না করে বলে ওঠে,” তোমার ছেলের বউরে দেখছ? খেয়াল করছ চেহারা কেমন হয়ে গেছে? আর আমার ভাই! কী তার গায়ের রঙ, কী তার হাইট, চেহারা! তোমার কি মনে হয় আমার ভাই এই মহিলার সাথে থাকবে? জীবনেও না। সুমুর দেখা যদি সত্যি হয় তাইলে আমি হেব্বি খুশি। বিদেশি ভাবি আইবো, পাড়া-মহল্লার লোকজন দেখতে আইবো, আহা, আহা!”

বেলা আর বসে থাকতে পারল না। উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,” আমার চেহারা এমনিতে নষ্ট হয় নাই রিমি। তিনবেলা মাটির চুলায় রান্না করা, বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা, বাড়িতে ছেলেমানুষ না থাকায় বাজারটাও করতে হয়, আম্মার শাড়ি,জামাকাপড় প্রতি এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর আমার ধুয়ে দিতে হয়, কোনো কোনদিন তো তোমারটাও ধুইতে হয়, সকালে শুধু নামাজটা পড়ি তারপর তো দম ফেলার সময়টাও পাই না, গরুর দেখাশোনা করতে হয়, তোমাদের জন্য এই সংসারের জন্য আমি আমার পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারিনি, হাত লাগাও কোন কাজে? সারাদিন তো ফোনটা নিয়েই পড়ে থাকো। ”

বেলার কথা শুনে পিছনে ঘুরে তাকায় রিমি। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। জাহিদা বেগম অসহায় চোখে বেলাকে দেখছে। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন মেয়েটা সব কথা শুনেছে কিন্তু সে যে রুমে ছিল এটা তিনি বুঝতে পারেননি।

বেলা আবার বলে ওঠে,” তোমার ভাইয়া যদি সত্যিই বিয়ে করে না? আমি এ বাড়ি আজই ছাড়ব। ত্যাগ করব তোমার ভাইকে।”

রিমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সহাস্যমুখে বলে,” কোথায় যাবেন শুনি? সৎভাইয়ের সংসারে? আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা বসে আছে দেখুন গিয়ে। ”

জাহিদা বেগম মেয়ের দিকে তেড়ে আসেন। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে উনার।

রিমির কথায় রীতিমতো তীর*বিদ্ধ হয় বেলা। মুহূর্ত কয়েক স্থির-চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। রিমি আগে থেকেই কটুভাষী সেটা সবারই জানা।

বেলা টলমল চোখে শাশুড়ীকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আম্মা আপনি যা বললেন তা কি সত্যি।”

জাহিদা বেগম বেলাকে সাহস দিয়ে বললেন,” তুমি একদম চিন্তা কইরো না তো বেলা। সুমু এহন দূর থেইকা কী দেখছে না দেখছে! ধ্রুব আইলে তো বাড়িত জানাতোই।”

বেলা শুধু মুখ গম্ভীর করে বলল,” আম্মা, দোয়া করেন সুমুর দেখা যেন ভুল হয়। ও যদি সঠিক দেখে তাহলে আপনারা খুব পস্তাবেন। আমি একা মেয়ে, আমার বাচ্চা হয়নি, আমি যেখানে সেখানে চলে যেতে পারব। আপনার ছেলে সত্যি বিয়ে করলে বা কাউকে নিয়ে এমন কিছু করলে আমি সত্যিই এখানে থাকব না। বাড়ি থেকে আজকের মধ্যে চলে যাব। আপনার মেয়ে যদি ভাবে আমার যাওয়ার কোন জায়গা নাকি তাহলে আপনার মেয়ে ভুল ভাবছে। ”

রিমি তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,” পুরুষ মানুষ রাগ করে বাড়ি থেকে বের হইলে হয় রাজা আর মেয়েমানুষ রাগ করে বাড়ি থেকে বের হইলে হয় বে*শ্যা। আপনের কপালেও ওটা আছে।”

বেলা আর সহ্য করতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে রিমির গালে সজোরে চড় বসিয়ে দেয়৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” আমার যাওয়ার জায়গা আছে৷ পতি*তাপল্লীতে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। নিজের ব্যবহার আচরণ ভালো করো, মস্তিষ্কের অসুখ সারাও নইলে তোমার আরও অনেক জায়গা যেতে হতে পারে।”

জাহিদা বেগম মেয়েকে শাসন করতে থাকেন৷ বেলা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মিনিট দশেকে কিসের থেকে কী হয়ে গেল, সবকিছু অচেনা লাগছে বেলার কাছে।

**
বিকেল চারটা-

বেলা তার রুমটা ফুলের দোকান থেকে কিনে আনা ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই সে গোসল দিয়ে নামাজটা শেষ করে খাবার টেবিল থেকে খাবার নিয়ে রুমে এসেছে। মাথায় তখনও তোয়ালে জড়ানো৷ চুলটা ভালোভাবে মুছে খেতে বসে সে। দুই-তিনবার খাবার মুখে নিতেই রিমি এসে হাজির হয়।

রুমের এপাশ থেকে ওপাশ চোখ বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,” সতীনের জন্য বাসর সাজালেন নাকি বড়ভাবি?”

বেলা সাগ্রহে বলে,” হ্যাঁ, সতীন আসছে তার জন্য বাসর সাজাব না? ননদ হয়ে তো কোন কাজের কাজই করলা না। সব আমারই করতে হলো। তবে তোমার ভাই যদি নতুন বউ নিয়ে না আসে তাহলে এখানে আমারই থাকতে হবে আর সত্যিই যদি নিয়ে আসে তাহলে সে-ই থাকবে। তোমার হয়তো এরকম কিছু ভাগ্যে জুটবে না, যেই মস্তিস্ক নিয়ে চল, তোমার কপালে সংসার আছেই কি না সেটা আল্লাহ জানেন।”

রিমি যেন তেলেবেগুনে জ্ব*লে ওঠে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,” তোমার এই বেশি বেশি তর্কের জন্য সব হারাবে। আমিও মনেপ্রাণে চাই তুমি এই বাড়ি থেকে বিদেয় হও।”

বেলা মুচকি হেসে বলে,” যদি বাড়ি থেকে চলে যেতেই হয় তাহলে তোমাদেরই একদিন মনেপ্রাণে আমাকে চাইতে হবে, চাইতেই হবে দেখে নিও।”
” এত খারাপ দিন আসবে না। ”
” অপেক্ষায় থাকো।”

দুজনের কথাবার্তার মাঝে কলিংবেল বেজে ওঠে। দুজনের কানেই শব্দ পৌঁছায়। রিমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে চারটা পনেরো। রিমি মুচকি হাসে।

” এবার তোমার কপাল পুড়*লো।” বলেই আনন্দের সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

বেলা খাবারের প্লেটটা নিয়ে বাহিরে এসে খাবার টেবিলে সেটা রেখে হাতটা ধুয়ে তাড়াতাড়ি বাহিরের দরজার দিকে যেতে থাকে।

দরজার কাছাকাছি যেতেই দেখে বাহিরের উঠোনে ভিড় জমেছে। বেলার বুক যেন ভার হতে থাকে। বাহিরে কথাবার্তা আবছা আবছা কানে আসছে। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে শাশুড়ীর কথাটা মিথ্যে নয়। বেলা একপা দু’পা করে এগুতে থাকে৷ তাকে দেখে সবাই তার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছে। বেলা এদিক ওদিক সবাইকে তাকিয়ে দেখে তাদের উপেক্ষা করে ধ্রুবর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ধ্রুবর পাশে লালশাড়ি পরিহিতা এক রমনী দাঁড়িয়ে। গায়ের রঙ যেন ধবধবে সাদা। বেলার চোখ টলমল করছে। শেষমেশ তার ভয়টাই সত্যি হলো!

বরের পাশে লালশাড়িতে নতুন বউকে দেখে ভাঙা ভাঙা গলায় বেলা বলে ওঠে,” আমার জামাই আমার জন্য বিদেশ থেকে সতীন নিয়ে আসছে!

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে