#মেঘের_ছায়া (২)
আসফাক কপাল চেপে ধরে নিচে নামলো।সবাই আশফাকের কপালে রক্ত দেখে অস্থির হয়ে গেল।দাদু দেখে তো প্রায় কান্না করে দিলো। আসফাক সবার আদরের বড় নাতি বলে কথা।তার ক্ষতে সবার হৃদয় যেনো দগ্ধ।
সবার বিচলিত মুখ দেখে আশফাক মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ ও কিছু নয় ওয়াশরুমে হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিলো, পড়ে গিয়ে ব্যাথা লাগলো। আসফাক খুব ভালো করেই জানে সবাই এখন আগা গোড়া সব জানতে চাইবে।আসফাক আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না ফারাহদের বাসায়।
মা-বাবাকে নিয়ে গাড়ি নিয়ে ছোটলো নিজের গন্তব্যে। এলোমেলো মন নিয়ে বাসায় পৌঁছে নিজের রুমে হনহন করে চলে গেল। রুমে এসে খাটের উপর ওয়ালেটটা ছুড়ে মারল। বিস্ময় বিভ্রান্তি এবং মানসিকতার বৈকল্যতার দরুন বুক ফেটে যাচ্ছে আসফাকের, নিজের শক্ত অবয়ব টেনে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কপালটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো সে, কপালে রক্ত জমে শুকিয়ে গেছে ঠিক, কিন্তু হৃদয়ের ঘা’টা বিদ্যমান এখনো। চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে আসফাকের। আঘাত হানছে হৃদয়ের গভীরে। আশফাক একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।
ফারাহ তর তর করে এখনো কাঁপছে। চোখের কোণ ভর্তি জলের আবাস। বিষন্ন মনে ভাবছে কি করে দায়িত্ববান পুরুষটা তার সাথে এমনটা করল। সে তো কখনো দুঃস্বপ্নতেও ভাবেনি আসফাক তার সাথে এমন অ-সভ্যতামী করবে। থম ধরা জটিল নিশ্বাস ফেললো অনেকক্ষণ ধরে। হৃদয় যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ঘটে যাওয়া ঘটনাটি। ফারা কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। ওড়না দিয়ে মিথ্যা কল্পনার ভঙ্গিতে নিজের পুরো শরীর মুছতে লাগলো। পর পুরুষের স্পর্শ মুছতে সে গোসল করে নিল।
বিরহ মন নিয়ে ফারাহ নিচে নামলো যদিও তার ইচ্ছে করছিল না তবুও মায়ের ডাকাডাকিতে আসতেই হলো তাকে। ফারার এমন আনমনা ভাব দেখে মা জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে? ‘
কিছু না বলে মিথ্যে হাসির অভিনয় করল ফারাহ।
সৌরভ বোনকে টেনে সোফায় বসালো। উৎফুল্ল মনে আশফাকের দেওয়া খেলনাটা বোনকে দেখালো। খেলনাটা হাতে নিতে মা উপহারের একটা বাক্স ফারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ আসফাক তোর জন্য নিয়ে এসেছে।
ফারাহ ঘৃণিত মন নিয়ে নিতে না চাইলেও মায়ের সামনে নিতে হলো।
চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল দেখে মা জিজ্ঞেস করল, ‘ অসময়ে গোসল করেছিস কেন যদি জ্বর আসে?
ফারাহ মুখে মিথ্যা হাসির রেখা টেনে বলল, ‘ গরম লাগছিল মা, এই বলে সে কথাটা চেপে গেল।’
জোরপূর্বক কিছু খেয়ে নিজের রুমে গিয়ে উপহারের বাক্সটা বিছানায় ছুড়ে মারলো ফারাহ। যাকে সে আজ থেকে ঘৃণা করে, ওই ব্যক্তির দেওয়া সবকিছুই ঘৃণিত বস্তু ফারার কাছে।
ঘুম আসছে না ফারার। ফারাহ হঠাৎ বুকের ভেতর বিষাক্ত অনুভূতি টের পায় ভেতর থেকে ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে, ‘ যৌবন মানেই কি বন্ধু, আড্ডা, গান আর মাস্তি করা! মহান আল্লাহ ক্ষনিকের জন্য মানুষকে তার এই বিশেষ নেয়ামত দিয়ে পরীক্ষা করেন। যারা তাতে উত্তীর্ণ হবে তারাই সফল আর যারা তা অবহেলা করবে তারা চির ব্যর্থ।’
পবিত্র হাদীসে এরশাদ হয়েছে, ‘রাসূল (সাঃ) বলেনঃযেদিন আল্লাহর রহমতের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা নিজের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। যে যুবক বেড়ে উঠেছে মহান প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে। (বুখারি হাদিস ৬৬০)
ফারাহ গভীর নিঃশ্বাস ফেললো শুধু। মনে মনে চিন্তা করল, যুগে যুগে সব পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুবকরাই দাঁড়িয়েছে
কিন্তু বর্তমান বিচার করলে দেখা যায়, আমাদের যুবকেরা সারাক্ষণ অ-শ্লীল চিন্তাভাবনার মগ্ন থেকে অ-শ্লীল কাজকর্ম করে করে বেড়ায়।
যৌবন কখনো কখনো মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। যৌবনের তাড়নায় যুবকরা অনেক ধরনের পাপে লিপ্ত হয়ে যায়। এ কারণেই যুবকদের উদ্দেশ্যে রাসূল (সাঃ) বলেনঃ এই যুবকদের দল তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে এবং যে বিয়ের সামর্থ্য রাখেনা সে যেন সাওম পালন করে কেননা সাওম যৌ°ন ক্ষমতাকে দমন করে।( বুখারী হাদিস ৫০৬৫)
ফারাহ তাদের হেদায়েতের জন্য দোয়া করলো এবং আশফাক ভাইয়ের জন্য আফসোস করলো।গোপন বিষয়টি কাউকে জানাবে না বলে ঠিক করেছে সে। কেননা আশফাক ভাই সবার আদরের। ফুফু ফুফা শুনলে কষ্ট পাবেন।মনের সব যাতনা এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গেল ফারাহ।চাঁদনি রাতের মোহনীয় সৌন্দর্য তার মন প্রাণকে ভরিয়ে দিলো অনাবিল আনন্দে। আলো আঁধারের নির্দল স্নিগ্ধ মিতালীতে জন্ম হয়ে ওঠে চাঁদনী রাত। রাতের এরূপ প্রকৃতিতে এক অস্পষ্ট মায়া লোক রচনা করে প্রকৃতি পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে কোমল পরশে। রাতের নির্মেঘ আকাশে যেদিকেই তাকানো যায় সেদিকেই জোছনার আলোর খেলা চলে। ফারাহ চাঁদ দেখে তার জোছনা পান করে দুঃখ ভরা রাতটা এভাবেই কাটিয়ে দিল।
ফারাহ একেবারে ফজর পড়ে শুয়ে পড়লো। এক সপ্তাহ পর ফারাহ স্বাভাবিকভাবেই জীবন অতিবাহিত করতে প্রস্তুতি নিলো।
ফারাহ ভার্সিটি থেকে এসে দাদুর পাশে এসে বসলো। আজ কতদিন হল দাদুর সাথে মজা করে গল্প গুজব করা হয় না। কেমন একটা খাপছাড়া খাপছাড়া ভাব ফারাহকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিলো।
দাদু যত্ন করে ফারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ মাশাআল্লাহ আমার ফারাহ তো অনেক বড় হয়ে গেছে, এবার তো তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।
দাদু আবেগজনিত কণ্ঠে বললেন,’ মরার আগে তোর বিয়েটা দেখে যেতে চাই। যদি তোর কোন আপত্তি না থাকে এতে।’
দাদুর মুখে মৃত্যু শব্দটি শুনে ফারাহর বুকটা ধক করে উঠলো চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু সজল গড়িয়ে পড়ছে। ফারাহ আবেগে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা। দাদুর কাঁধে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ফেললো।
দাদু আদরের পরশ মাখিয়ে বলল,’ ছেলে আমার জানাশোনা, ভীষণ পছন্দ ওর চাইতে ভালো তোর জন্য আর কেউ হবে না এই ধরায়।’
দাদুর মন রাখতে দ্বিধাগ্রস্ত গলায় ফারাহ জবাবে বলল,’ দাদু তোমার যেহেতু পছন্দ তাহলে আমার আপত্তি নেই।’
ফারা চোখের জল মুছে দাদুর হাতে হাত রেখে ভরসা দিয়ে বলল,’ তোমার অনুরোধ কি আমি ফেলতে পারি!’
এই বলে সে থামলো।
দাদু নাতনির মুখে সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে ভীষণ খুশি হল এবং আনন্দে বাকবাকুম হয়ে বলল,
‘পাত্র তোর পরিচিত।’
এইকথা শুনে ফারাহ যেনো আকাশ থেকে পড়লো।
কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করল,’ কে সে?’
চিন্তায় ফারার বুকে কে যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে।
দাদু খুশি খুশি গলায় বলে উঠলেন,’ সে যে আমাদের আদরের আসফাক!’
চলবে
©আফরিন ইভা