মেঘের আড়ালে রোদ পর্ব-২০+২১

0
527

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#পর্ব_২০
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

একটা অন্ধকার রুমে চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে আছে পলাশ।

অন্ধকার রুমের দরজা ঠেলে একজন লোক প্রবেশ করলো। অন্ধকার রুমটা সেকেন্ডে আলো জ্বলে উঠলো। যত্ন সহকারে একটা চেয়ার পলাশের মুখোমুখি রেখে বলে উঠলো, ‘ মেডাম আসেন। ‘

দরজা দিয়ে ফরমাল ড্রেসআপে প্রবেশ করলো একটা নারী। খুব সুন্দর করে হেঁটে এসে চেয়ার টেনে পলাশের মুখোমুখি বসল। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে বললো,’ ফাহিম ওর মুখে পানি ঢেলে দাও।’

__________

আহনাফ বসে আছে রনির সামনে।
এতোক্ষন প্রচুর মেরেছে রনিকে। কিন্তু এই ছেলে ভয় পাওয়ার বদলে কেমন বিশ্রী হাসছে।

~ ভাই শা*লা পাগল হয়ে যায় নাই তো.?
রনি~ ওই তোর কাছে আমার বইন বিয়া দিছি.? শা*লা কছ কোন সম্পর্কে.?

ছেলেটা আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ খুব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রনির দিকে। ঝড় আশার আগে যেমন প্রকৃতি শীতল থাকে এখন ঠিক তেমনই আছে।

রনি ঘারটা বাঁকা করে এক হাত দিয়ে ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা রক্তটা মুছে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ দুলাভাই একগ্লাস পানি দে.. বইন তো নাই তাও তোরে দুলাভাই বানায় নিলাম। এই খুশিতে একটা সিগারেট দে।’

ছেলেটা ভয়ে ভয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ এখনো চুপচাপ রনিকে দেখছে।
রনির সে দিকে খেয়াল নেই। দেখেও না দেখার মতো একে ওকে এটা আনতে ওটা আনতে বলছে৷ আর হুঁ হুঁ করে হাসছে।

আহনাফ হঠাৎ বলে উঠলো, ‘ সাদ ওই রুম থেকে আগুনে দিয়ে রাখা রডটা নিয়ে আয়।’
রনি থামলো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আহনাফ দিকে তাকালো। হাত জোর করে বলে উঠলো ” ভাই ভাই আমাকে মারবেন না ভাই মারবেন না, আমি সব বলছি।’

আহনাফ ঠিক আগের মতোই।

রনি আহনাফের দিকে তাকিয়ে বিশ্রী ভাবে হাসতে হাসতে বলে উঠলো, ‘ তোর কি মনে হয় আমি আমার জীবন ভিক্ষা এভাবে তোর কাছে চাইব.?? এই রনি কারো কাছে মাথা নত করে না সবাই রনির পায়ে ধরে জীবন ভিক্ষা চায়। তুইও চাইবি শুধু একবার এখান থেকে বের হই তোর জীবন আমি জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়ব।

আহনাফঃ আগে বের হয়ে দেখা। জীবন নিয়ে বের হতে পারবি তো.?
এর মধ্যে সাদ ছেলেটা গরম রড এনে আহনাফের সামনে রাখল। রড লাল হয়ে আগুনের লাভার মতো হয়ে আছে।

রনি উপর দিয়ে এইসব বললেও ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে।

আহনাফ রনির অবস্থা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠলো, ‘ তোকে দুইটা অপশন দিচ্ছি যে কোনো একটা বেছে নে.’
রনি ভয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। রডের দিকে একবার তাকালো আরেকবার আহনাফের দিকে।
আহনাফঃ প্রথম, তুই প্রথম থেকে মহুয়ার সব কিছু বলবি। তাহলে খুব সহজ মৃত্যু দেওয়া হবে।
দ্বিতীয়, এই সব কিছুর পেছনে কে.? আর না বললে , বলেই রডটা হাতে নিয়ে রনির হাতে চেপে ধরলো।

রনি চিৎকার দেওয়ার আগেই সাদ ছেলেটা রনির মুখ টেপ মেরে ছিলো।

রনি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ইশারা করলো সে সব বলবে।
বিজয়ী হাসি ফুটে উঠলো আহনাফের চোখে মুখে।

____________

পলাশ চোখ পিটপিট করে আশেপাশে তাকালো। সে এখানে কেন? ওতো হসপিটাল ছিলো”!

পলাশঃ আমি এখানে কেন? আর আপনি.?
মেয়েটা অবাক হলো না। জেনো সে জানতো ছেলেটা ওকে চিনে ফেলবে।

মেয়েটা পকেট থেকে রিভলবার বের করে ওর আর ছেলেটার মাঝ খানে ছোট টেবিলের উপর রাখলো।
ভয়ে চুপসে গেলো পলাশ।

~ তাহলে আগে পরিচিত হয়ে নেই।
পলাশ ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল।
~ আমি CID মেঘলা ইসলাম মেঘ।

CID শুনেই কপাল বেয়ে ঘাম পড়তে শুরু করলো পলাশের।

মেঘলা চঞ্চল চোখে পলাশকে ভালো করে দেখে নিলো তারপর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আচ্ছা ফাহিম আমাকে দেখতে কি ডাইনীদের মতো লাগছে.??

ফাহিম নিজেও মেঘলাকে ভয় পায়। মেঘলাকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারন আছে। এই যে সামনে বসে থাকা মেয়েটা এখন কি মিষ্টি করে হাসছে, কিছু জিজ্ঞেস করছে এখন যদি সঠিক উত্তর না পায় সাথে সাথে সে ডাইনী রুপ দারন করতে এক মুহূর্ত দেরি করবে না। CID সব চেয়ে সাহসী আর রাগী অফিসার হলো মেঘলা। যার তাকানোতেই সবাই ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।

ফাহিমঃ না মেডাম আপনাকে দেখতে খুবই মিষ্টি লাগছে।
মেঘলা খুশি হলো উত্তর শুনে। সাদা সার্ট,চুল গুলো উপরে করে জুটি বাঁধা, দেখতে আসলেই মিষ্টি একটা মেয়ে লাগছে।

মেঘলা পলাশের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন.? কাঁপছেন কেন.? ‘
পলাশ কিছু না বলে রিভলবারের দিকে তাকিয়ে পানি খেতে চাইল।
মেঘলা ফাহিমকে ইশারায় পানি নিয়ে আসতে বললো।
ফাহিম পানি নিয়ে আসতেই মেঘলা পলাশকে দেখিয়ে সবটা পানি একটু একটু করে খেয়ে নিল।।
মেঘলাঃ পানি কেন সাথে বিরিয়ানি ও পাবেন আগে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
পলাশঃ জ…জ্বি।
মেঘলাঃ ভয় পাবেন না উত্তর ঠিকঠাক হলে আপনার কিছু হবে না আর ভুল হলে বলেই পাশ থেকে একটা ছুরি হাতে নিয়ে পলাশের হাতের চারপাশ ঘুরিয়ে বলে উঠলো, ‘ একটা আঙ্গুল ও থাকবে না।’

পলাশ CID শুনার পর থেকেই ভীষণ ভয়ে আছে। আজ হয়তো তার জীবনের শেষ দিন। আজ কি তাহলে জীবনের সব পাপের ধুলো পড়া পৃষ্ঠা নাড়া খাবে!!??.

মেঘলা এবার সিরিয়াস হয়ে পলাশের মুখোমুখি বসল। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ মহুয়ার জীবনের প্রথম থেকে সবটা শুনতে চাই।’
পলাশের ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।
পলাশঃ কে মহুয়া.? আ…আমি কিছু জানিনা।

মেঘলা ছুরি হাতে নিয়ে ফাহিম কে বলে উঠলো, ‘ সুপারি কাঁটার যন্ত্রটা নিয়ে আয়। আমার চোখের সামনে একটা একটা করে ওর আঙ্গুল গুলো কাঁট যতোক্ষন না সত্যি কথা বলে।

পলাশের ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো, ‘ বলছি বলছি..’
মেঘলা মুচকি হেঁসে তাকালো।

___________

অতীত,

মহুয়ার বাবা মা ওর জন্মের পরপর মা-রা যায়।
মহুয়া বড় হয় ওর মামা মামির কাছে। মামার ছিল দুই ছেলে এক মেয়ে।

মুর্শেদ তালুকদার ছিল মহুয়ার মামা। একমাত্র মুর্শেদ আর ওর দুই ছেলে ছাড়া আর কেউ তেমন মহুয়াকে পছন্দ করত না। রাস্তা দিয়ে বের হলে পাড়াপ্রতিবেশিরা বুঝিয়ে দেয় ওর বাবা মা বোনের মৃত্যুর জন্য একমাত্র ও দায়ী। মহুয়া অলক্ষী যার জন্য ওর জন্মের প্রথম দিন ওর বাবা বোন আর দ্বিতীয় দিন মা পৃথিবী ছাড়েন।

নিজের মামিও কোনোদিন ছাড় দেয় না প্রতিদিন নিয়ম করে মনে কড়িয়ে দেয় মহুয়া অপয়াঅলক্ষী।

রুমের পাতলা পর্দা টেনে নিলো মহুয়া। সূর্য মামা আজকে একটু বেশি জ্বালাতন করছে। আজ নিশ্চয়ই সূর্য মামা মামির সাথে ঝগড়া করে এসেছে,সেই জন্যই এতো সকাল সকাল মামির সব রাগ আমার মতো নিরীহ বাচ্চার উপর ঝারছে।

বালিশে মুখ গুঁজে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতেই নিচে চেচামেচি, ভাঙচুরের শব্দ শুনতে পেল। এটা নতুন কিছু না প্রতিদিন হয়ে আসছে।

রায়মা বেগম রেগে ভাঙচুর করছেন আর মহুয়াকে ইচ্ছে মতো গালাগালি করছেন।

মহুয়া বিছানা থেকে উঠে রুমের দরজা জানালা ভালো করে লাগিয়ে আবার এসে শুয়ে পড়লো দশটার দশ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠবে। এর আগে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও সে নিচে যাবে না।

আর এই দিকে রাইমা বেগম বলেই চলেছেন,’ জমিদারের মাইয়া সারাদিন ঘুমাইব আর আমি এই বাড়ির কাজের লোক। সারাদিন রান্না ঘরে পড়ে থাকি রুপ দিয়ে কি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাইব আপদ আল্লাহ আপদ চোখের সামনে থেকে দূরও করে না। এতো মানুষ ম’রে তোরে দেখে না। আজ থেকে মেপে মেপে খানা দেওয়া হইব। খানা কি রাস্তায় পইরা থাহে।সারাদিন ঘুম, বন্ধুদের সাথে আড্ডা ঘরে কোনো কাম নাই। আরও হাজারো কথা বলছেন আর হাঁড়ি পাতিলের উপর রাগ ঝাড়ছেন।

মহুয়া এইসব শুনতে শুনতে অভস্ত্য।
ফ্রেশ হয়ে দশটার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে বের হলো বাড়ি থেকে। আজ সকালের খাবার যে পাবেনা আগে থেকেই জানত। ব্যাগে দেখে নিল কতো টাকা আছে। ৫০ টাকা পেলো।

এই দুতলা বাড়িটি মহুয়ার বাবার। ওর বাবার মৃত্যুর পর পর যখন ওর মা ও মা-রা যায় তারপর ওর দায়িত্ব নেয় মুর্শেদ তালুকদার। সম্পর্কে ওর দূর সম্পর্কের মামা হয়। তারপর থেকে তারা এই বাড়িতেই থাকে মহুয়ার আব্বুর সব কিছু দেখাশোনা করে। মহুয়া কখনো দাদা বাড়ি ঠিকানা বা নানা বাড়ির ঠিকানা পায়নি। না কখনো কোনো আত্মীয় স্বজনরা এসেছে। সে একমাত্র তাদের ছাড়া আর কাউকে চিনে না। মা বাবার, বোন তাদের ছবিও কোনোদিন দেখেনি। পাড়াপ্রতিবেশিদের মুখ থেকে শুনে ওর মা বাবা ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। ওর বাবা খুব ভালো মনের মানুষ ছিলো। ওর বাবা ছিল পুলিশ আর মা উকিল। মহুয়া এইসবের সত্যি কতোটুকু তাও জানেনা। মামা মামি কখনো ওর মা বাবার কথা তুলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলেও ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। সে নাকি বড় হয়নি সে এখনো ছোটো।

মহুয়া পাঁচ মিনিট হাঁটতেই স্কুলে চলে আসলো। সে এবার দশম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলে আসতেই বেস্টুর সাথে দেখা হয়ে গেল। দুইজন কথা বলতে বলতে গেইট দিয়ে ঢুকার সময় লক্ষ করলো একটা বোকাসোকা, চশমা পড়া ছেলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

মহুয়া বেস্টু মাইশা দুষ্টু হেঁসে বলে উঠলো, ‘ তোর আশিক।’
মহুয়া রেগে মাইশার দিকে তাকালো।
মাইশাঃ ওফ্ফ তোর রাগী তাকানো তে আমিই প্রেমে পড়ে গেলাম বেচারা আশিক তো আছাড় খেয়ে পড়বে।

মহুয়াও মাইশার কথা শুনে হেঁসে ফেললো। আজ একটা বছর এই ছেলেটাকে দেখে আসছে। মহুয়া বাড়ি থেকে বের হলেই ছেলেটাকে দেখবে রাস্তার পাশে টং দোকানে, কখনো স্কুলের গেইটের পাশে, আবার কখনো ওদের বাড়ির রাস্তায়। মোট কথা মহুয়া যেখানে এই ছেলেও সেখানে। মহুয়া বুঝে পায় না এই ছেলে কি জাদু জানে.? না হলে মহুয়া কোথায় আছে এই ছেলে কিভাবে জানতে পারে.?? দেখতে বোকাসোকা, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, গায়ের রং ফর্সা, চুল গুলো এক পাশে লেপ্টে রাখা যেন তেল দিয়ে রেখেছে। শার্টের সব গুলোই বোতাম লাগানো, গলার কাছের বোতাম টাও যার জন্য একটু বেশিই বোকা টাইপের লাগছে।

বোকাসোকা চোখে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার দিকে। এই এক বছরে কখনো মহুয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলেনি। শুধু পাঁচটা চিঠি দিয়ে ছিলো তাও বিশেষ দিনে, চিঠির ভাষায় যে কোনো নারী এই বোকাসোকা ছেলের প্রেমে পড়তে দ্বিতীয় বার ভাববে না। মহুয়া মাঝে মাঝে ভাবে এই ছেলে কি কোনো লেখকের লেখা চিঠি চুরি করে আমাকে দিল.?? এতো সুন্দর কিভাবে হয় একটা মানুষ চিন্তা ভাবনা!!..?

মহুয়া ক্লাস শেষে স্কুল থেকে বের হতেই রাস্তার পাশে তাকালো। ছেলেটা কে না দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। আশেপাশে খুঁজতে শুরু করলো। না কোথাও নেই, ছেলেটাকি চলে গেল.??

মন খারাপ হলো মহুয়ার। মাইশা এসে মহুয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে বললো,’ চল বাড়িতে যাওয়া যাক।’
মহুয়াঃ হুম।
মাইশাঃ এই মেহু তোর মুখ এতো শুখনা কেন.? সকালে খেয়েছিস.?
মহুয়ার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভীষণ খিদে পেয়েছে ক্লাসে পড়ার চাপে ভুলে ছিলো আর এখন সেই নোকাবোকা লোকটা খুজতে গিয়ে।

মহুয়াঃ চল মাইশা দুইটা সিঙ্গারা কিনে নিয়ে আসি।
মাইশাঃ তোর বাড়ি, তোর সব কিছু আর ওই ডাইনী মহিলা তোর উপর এতো অত্যাচার করে! কিভাবে সহ্য করিস তুই.? আমি হলে তো ডাইনীর ঘার মটকে দিতাম।
মহুয়াঃ তোর ঘার মটকানো শেষ? এবার চল. আমার প্রচুর খিদে পেয়েছে।
মাইশাঃ তুই এমন কেন.?
মহুয়াঃ উনি যেমনি হোক মাইশা, উনারা আমাকে লালন পালন করে বড় করেছে। আজ আমি কোথায় থাকতাম যদি উনারা আমাকে আগলে না নিত.? আমার উনারা ছাড়া কেউ নেই। মামি আমাকে আপন নাই ভাবুক আমার উনাকে আমার মামি নয় মা মনে করি। ছোটো থেকে মা ঢেকেছি বলে কতো মার খেয়েছি তাও আমি মা ডাকি, মামি বলতে চাইলেও মুখ দিয়ে মা চলে আসে। আমি ভালোবাসি উনাদের। একদিন তারাও বাসবে।

মাইশা আর কিছু বললো না চুপচাপ একটা হোটেল থেকে সিঙ্গারা আনতে গেল।মহুয়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

হুট করে সেই বোকাসোকা টাইপের ছেলেটা মহুয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। বেশ অবাক হলো, থাকে বুক ধুকপুক করা শুরু করলো। কেমন লজ্জা লাগতে শুরু করলো।

ছেলেটার হাতে একটা প্যাকেট, প্যাকেট টা মহুয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
মহুয়া কি বলবে..? কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারছে না। হুট করে সামনে আশায় সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এতোদিন তো কতো কিছু ভেবে রেখে ছিলো। কত শব্দ সাজিয়ে রেখে দিলো।

ছেলেটা এই প্রথম মহুয়ার সাথে কথা বললো,’ নেন দরুন.’
মহুয়াঃ এটা কি.?
~ বাসায় গিয়ে খুলে দেখবেন।
মহুয়া হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিল।
ছেলেটা হাসলো। কি চমৎকার সেই হাসি। সদ্য কিশোরী মেয়ে মহুয়া মুগ্ধ হলো। এখন বুঝি মুগ্ধ হওয়ার বয়স? হুটহাট প্রেমে পড়ার বয়স.? মিথ্যা মায়াজালে আঁটকে পড়ার বয়স.? ! এই যে মহুয়া ছেলেটার হাসি দেখেই মুগ্ধ হলো। পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর হাসির অধিকারী হিসেবে সামনে দাঁড়ানো বোকা ছেলেটাকে ঘোষণা করল।

মহুয়ার ভাবনার মধ্যেই খেয়াল করলো ছেলেটা চলে যাচ্ছে। মহুয়া এক ভয়াবহ কাজ করে বসলো। হঠাৎ পেছন থেকে ছেলেটা কে ডেকে বলে উঠলো, ‘ আপনার নাম কি..?’

ছেলেটা পেছন ফিরে মুচকি হেঁসে বললো, ‘ পলাশ’

ব্যাস এই মুচকি হাসি তীরের মতো মহুয়ার কিশোরী মনে এসে বিঁধল। কি বিঁধল!? কাঁটা নাকি গোলাপ.? এটা কাঁটা যুক্ত গোলাপ।

________

বাড়িতে এসেও মহুয়া শুধু সেই বোকাসোকা ছেলের কথাই ভাবছে। চাইলেও মাথা থেকে নামাতে পারছে না। হুট করে সব কিছু রঙিন মনে হচ্ছে। ফুল দেখে কানে গুজতে ইচ্ছে করছে, শাড়ি পড়ে ছেলেটার সামনে যেতে ইচ্ছে করছে কি আজব! মহুয়া কি প্রেমে পড়েছে.? তাও এক বোকাসোকা ছেলের.?

পাঁচটা চিঠি হাতে নিয়ে বসে আছে। ঠিক জানা নেই এই এক বছরে এই চিঠি গুলো কতোশবার পড়েছে। ফ্রী হলেই চিঠি গুলো পড়তে শুরু করে মিটিমিটি হাসে, আবার মন খারাপ করে। কেন ছেলেটা সাহস করে সামনে এসে কথা বলে না। দূর থেকে শুধু তাকিয়ে দেখে। ছেলেটার কি একটু দু চারটা কথা বলতে ইচ্ছে হয় না.?? মহুয়ার তো হয়, অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয়।

রাতে বাড়িতে সাইফ আসল। সাইফ, সবুজ জমজ ভাই। সবুজ বিদেশ থাকে আর সাইফ নতুন চাকরি নিয়েছে।

সাইফ খেতে বসতেই মিম দৌড়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, ‘ আমার চকলেট কোথায় ভাই.?’
সাইফ চকলেট বের করতেই মিম দুইটা চকলেট নিতে চাইল। সাইফ একটা মিমের হাতে দিয়ে মহুয়াকে ডাকল। মহুয়া রুম থেকে বের হয়ে আসলে। সাইফ মহুয়ার হাতে আরেকটা চকলেট দিল।

মিম রেগে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,’ বাহিরের লোকের জন্য আমি আমার ভাইদের ভালোবাসাও ঠিক মতো পাচ্ছি না। এখানে ভাগ বসাতে চলে আসে। অলক্ষী আমার জীবন থেকে কবে যাবে!!..??

সাইফ মিম কে ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ‘ মিম এইসব কেমন ব্যাবহার! দিন দিন তুই বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস! মহুয়া আমাদের আরেক বোন। রক্তের সম্পর্ক সব নয় আত্মার সম্পর্কই সব। মহুয়ার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক নেই তবে আত্মার সম্পর্ক আছে।

মিম বিরক্ত হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কেটে নিজের রুমে চলে গেল।

সাইফ মহুয়ার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে প্লেটে খাবার বেরে বড় মাছের মাথাটা মহুয়াকে দিল। মহুয়ার মাছের মাথা পছন্দ।

রেনু বেগম রান্না ঘর থেকে ছেলের জন্য তরকারি বাটি এনে টেবিলে রেখে মহুয়ার প্লেটের দিয়ে তৃক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।

এই মাছটা উনি সাইফের জন্য রেখে ছিলেন। মিম কতো বার বলেছে মাথাটা আমাকে দাও তাও দেননি। আর এখন কিনা নবাব জাদি বসে বসে খাচ্ছে। রাগ হলো ভীষণ তাও ছেলের সামনে কিছু বলা যাবে না। দুই ছেলে কে কি জাদু করেছে এই কালনাগিনী আল্লাহ ভালো জানে। কারো কাছেই ওর নামে কিছু বলা যায় না৷

রাত গিয়ে দিন আসছে। সময় নিজের মতো চলে যাচ্ছে।
এই এক সপ্তাহে পলাশ বেশ কয়েকবার মহুয়াকে এটা সেটা দিয়েছে তবে আগের মতো অন্য কাউকে দিয়ে নয়। নিজ হাতে চোখে চোখ রেখে দিয়েছে।

একদিন সাহস করে পলাশ বলে উঠলো, ‘ আপনি কি আমার বন্ধু হবেন মহুয়া ? আমার জন্য অপেক্ষা করবেন.?’

মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো অবাক হয়ে ছিলো মহুয়া। তবে সেদিন কিছু বলেনি, চুপচাপ চলে গিয়ে ছিলো।

তারপর থেকে মহুয়া স্কুলে আসলেই রাস্তার আশপাশে তাকাতে শুরু করত । কিন্তু কোথাও পলাশ কে দেখা যেত না। দুইদিন হয়ে গেল কিন্তু পলাশ কে একবারও দেখা যায়নি।
মহুয়া মন খারাপ হলো। বুকের ভেতর কিছু একটা নেই, শূন্যতা অনুভব হলো।যেখানেই যেত আশেপাশে তাকাত। এই বুঝি পলাশকে একটু দেখা গেল।

এর মধ্যে স্কুল থেকে অনেক মেয়ে গায়েব হয়ে গেছে। স্কুলে এসে ছিলো কিন্তু তারা আর বাড়ি ফিরে যায়নি। ১-২ জন নয় ২৫জন ছাত্রী নিখুঁজ। সবার মা বাবা মেয়েদের চিন্তায় পাগল প্রায়। সবাই স্কুলের কর্তৃপক্ষের উপর দোষ দিচ্ছে। পুলিশরাও আজ দুইদিন মেয়েদের কোনো খুঁজ বের করতে পারছে না।খুব নিখুঁত পরিকল্পনায় ওদের কিডন্যাপ করা হয়েছে। ভুলেও এক ফোটা খুঁত রেখে যায়নি কিডন্যাপার।

তিনদিনের দিন দেখা মিললো পলাশের। চোখে চশমা ঠেলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে এই দিকে। কাউকে এক মুহূর্ত দেখার তৃষ্ণায় যেন সে বেআকুল হয়ে আছে।

মহুয়া পলাশকে দেখে থমকে গেলো। চোখে পানি চিকচিক করে উঠলো। মন তাকে জানিয়ে দিল তুমি ভীষণ বাজে ভাবে এই বোকা ছেলের প্রেমে পড়ে গেছ।

চলবে….
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#পর্ব_২১
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

দিন গিয়ে রাত নামছে,রাতের পর সকাল। দেখতে দেখতে এক মাস চলে গেছে।
একটা মেয়ের ও সন্ধান পাওয়া যায়নি। আস্তে আস্তে চাপা পড়ে গেল সেই ঘটনা আর মেয়ে গুলো।
মহুয়া খেয়াল করল হুট করে মেয়েগুলোর মা বাবা আত্মীয় স্বজনরা স্কুলে এসে ভাংচুর, চিৎকার চেচামেচি করা বন্ধ করে দিলো। স্কুলের আশেপাশেও দেখা যায় না তাদের।

পলাশের সাথে মহুয়ার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মহুয়া, মাইশা আর পলাশ এক সাথে ফুচকা খাওয়া,ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যাওয়া শুরু করলো।

দিন দিন মহুয়া ভীষণ ভাবে দূর্বল হয়ে পরল পলাশের প্রতি।

একদিন মহুয়া কে মাইশা ফোন দিয়ে বললো জলদি সুন্দর করে রেডি হয়ে স্কুলের পেছনে পুকুর পাড়ে চলে আয়।
মহুয়াঃ কেন.?
মাইশাঃ আল্লাহ মহু তুই জানিস না! আজ তো পলাশ ভাইয়ার জন্মদিন।

নিমিষেই মনটা খাারাপ হয়ে গেল মহুয়ার। আজ পলাশের জন্মদিন আর মহুয়া এটা জানে না৷ পলাশ একবার ওকে বললোও না! মন খারাপ করে স্কুল ড্রেস পড়ে নিল।

স্কুলে আসতেই কিছুটা অবাক হলো মহুয়া। রাস্তায় আশার সময় খেয়াল করল কিছু ছেলে মিটিমিটি হাসছে। কেউ বা ভাবি বলে সালাম দিচ্ছে।
মহুয়া ভয়ে মাথা নিচু করে রাখল।
আজ বুঝলো মাইশা ভুল বলে না মহুয়া আসলেই ভীষণ ভীতু। এমনিতেই কয়েকদিন আগে এতোগুলা মেয়ের কিডন্যাপ হয়ে যাওয়া তারপর আজ অচেনা ছেলেদের এমন আচরণে ভয়ে হাত পা কাঁপছে। দ্রুত পা চলাতে গিয়েও মনে হচ্ছে পা চলছে না।

স্কুলে এসে মাইশা কে দেখে হাত চেপে ধরলো।
মাইশাঃ কি হয়েছে মহু.? এতো ভয় পেয়ে আছিস কেন.?
মহুয়াঃ পানি দে..
মাইশা বোতল বের করে পানি দিল।
মহুয়া পানি খেয়ে ক্লাসের দিকে যেতেই মাইশা ওর হাত শক্ত করে ধরে বললো,’ ভয় কেন পেয়ে আছিস.? মামি কিছু করেছে.? মিম কিছু বলেছে..? শুধু বল আজ আমি একটা কেও ছাড়বও না কি পেয়েছে ওরা।
মহুয়াঃ তেমন কিছু না। ক্লাসে চল..

মাইশা মহুয়াকে জোর করে স্কুলের পেছনে নিয়ে গেলো। কিছু ছেলে মেয়ে ঘিরে আছে। মাইশা মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো সামনে যা।

মহুয়া কিছুই বুঝতে পারছে না এখানে হচ্ছেটা কি..??

মহুয়া সামনে যেতেই একটা কেক দেখলো। চারপাশে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। মহুয়া সামনে যেতেই গাছ থেকে আরও গোলাপের পাপড়ি পড়তে শুরু করলো ওর মাথার উপর।

মহুয়া কিছু বুঝে উঠার আগেই চশমা পড়া বোকাসোকা পলাশ ওর সামনে এক গুচ্ছ গোলাপ থেকে একটা গোলাপ নিয়ে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।
মহুয়ার মনে হলো সব স্বপ্ন!! আসলেই কি স্বপ্ন..? নিজের হাতে চিমটি কাটলো। না সবটা সত্যি..

সেদিন পলাশের সেই প্রপোজে লজ্জায় মিইয়ে পড়া মহুয়া সম্মতি দেয়। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।

তাদের ভালোবাসা চলতে থাকে, সম্পর্ক আস্তে আস্তে ভীষণ গভীর হয়। কিন্তু পলাশ কখনো মহুয়ার গায়ে বাজে ভাবে হাত দেয়নি। শুধু ভালোবেসে কখনো হাতে ফুলের মালা পড়িয়ে দিয়েছে আবার কখনো শক্ত করে হাতটা ধরে রাস্তা পাড় হয়েছে, কখনো বা যত্ন করে হাতে চকলেট গুঁজে দিয়েছে।

মহুয়া পলাশের এই আচরণে ভীষণ মুগ্ধ।

চারমাস পেড়িয়ে গেছে ওদের সম্পর্কের।

আজকাল মামির সাথে হাঁটতে বসতে ঝগড়া হচ্ছে, মিম কখনো সখনো মহুয়া গায়ে হাত তুলছে। আজ তো সকাল, দুপুর দুই বেলাই খাবার পায়নি। রাতে সাইফ মহুয়াকে সব সময় নিজের সাথে খেতে বসায়। দিনে অফিসে থাকে বাড়ির খবর সে কিছুই জানতে পারে না।

রেনু বেগম আজ মুরশেদ তালুকদার বাড়িতে আসতেই মহুয়াকে নিয়ে নালিশ দিতে শুরু করলো।
মুরশেদ তালুকদার বউয়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে মহুয়াকে ডাকলেন৷
রেনু ভাবলো হয়তো মহুয়াকে বকবে বলে ডেকেছে। মনে মনে অনেক খুশি হলো৷ কিন্তু উনার খুশি বেশি সময় টিকল না মুরশেদ তালুকদার মহুয়াকে পড়াশোনার বিষয়, এটা সেটা জিজ্ঞেস করে ভালো করে পড়তে বললো।

রেনু শুধু অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মহুয়ার দিকে। মহুয়া দেখে ঘা জ্বালানো হাসি দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
রেনু অবাক হয়, যেই মেয়ে চোখ তুলে তাকাত না আজ সে মুখে মুখে তর্ক করছে, উনাকে টেক্কা দিয়ে চলছে। তাহলে কি সময়ের সাথে মানুষ পরিবর্তন হয়.?? ধৈর্য ধরতে ধরতে এক সময় তা ভয়ংকর রুপ নেয়.?? আজকাল মহুয়াকে দেখে চিন্তেই পারে না।

মুরশেদ তালুকদার সাইফকে ডেকে মহুয়ার দিকে নজর রাখতে বললো। এতোদিন টেনশন না হলেও এখন মহুয়া বড় হয়েছে। দেখতে পরীর মতো যে কোনো ছেলে এক দেখায় প্রেমে পড়বে। এমন মেয়েদের নিয়ে অবিভাবকের একটু টেনশন বেশিই থাকে। উনি সব সময় দোয়া করেন কোনো কাল নজর যেন মহুয়ার উপর না পড়ে। মেয়েটা দেখতে ওর মায়ের মতো সুন্দরী হয়েছে।

একদিন সন্ধ্যার কথা হুট করে সাইফ সন্ধ্যায় বাসায় চলে আসলো। খুব চিন্তিত হয়ে মিম আর মহুয়ার কথা রেনুকে জিজ্ঞেস করলো।

পড়ের দিন সাইফ ওদের স্কুলে দিয়ে আসল। আর মিম কে কলেজে।
মহুয়া স্কুলে গিয়ে শুনতে পেল গ্রাম থেকে দশজন মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে সেদিন ভীষণ ভয় পেয়ে ছিলো৷

পলাশ ওকে বুঝালো ভয় পাওয়ার কোনো কারন নেই ওর পাশে সব সময় পলাশ আছে। ওর কিছু হবে না।
মহুয়া সেদিন পলাশের হাত শক্ত করে ধরে রেখে ছিলো।

ঠিক এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর মাইশাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । মহুয়া ভীষণ কান্না শুরু করলো। মাইশা একমাত্র ওর বান্ধবী ছিল, শুধু বান্ধবী নয় বোন ছিল। পুলিশ এসে মহুয়াকে মাইশার বিষয় অনেক জিজ্ঞাসা বাদ করল। মহুয়া শুধু পাথরের মতো বসে ছিলো। কি হচ্ছে এই গ্রামে..? কে করছে এই কিডন্যাপ.? কে এই কিডন্যাপার.? পুলিশ এতো চেষ্টা করেও কেন খুঁজে বের করতে পারছে না.?

পলাশ সারারাত ফোনে ওকে বুঝালো। মাইশা ফিরে আসবে মিথ্যা আশা দিল। এভাবে কেটে গেল একমাস। গ্রামের মানুষ এখন ভীষণ সচেতন। তারা নিজেদের মেয়েদের একা ঘর থেকে বের হতে দেয় না। কারন কিডন্যাপার শুধু কিশোরী মেয়েদের কিডন্যাপ করছে।

এর মধ্যে মহুয়া শুনতে পায় ওর বিয়ে ঠিক করেছে মুরশেদ তালুকদার।
মহুয়া আকাশ থেকে পড়ে। বলা নেই কওয়া নেই কিসের বিয়ে!.? সেই দিন অনেক কেঁদে ছিল মহুয়া। ওর সাহস নেই যে মুরশেদ তালুকদারকে নিষেধ করবে বা পলাশের কথা বলবে।

রাতে পলাশকে সবটা বলতে পলাশ হঠাৎ বললো, ” চলো আমরা এই গ্রাম ছেড়ে বহুদূরে পালিয়ে যাই!”
মহুয়াঃ পালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি মামাকে তোমার কথা বলি।
পলাশ ভয় পেয়ে যায়, ভয়ে বলে উঠে,’ মহুয়া তুমি আমাকে ভালোবাস না!! আমি তো গরিব একটা ছেলে আমার কাছে তোমাকে দেওয়ার মতো ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নেই তোমার মামা আমাদের সম্পর্ক কখনো মেনে নিবে না। আরও ইনিয়েবিনিয়ে হাজার কথা বলতে শুরু করলো। বোকা মহুয়া তাই বিশ্বাস করে নিল৷

মহুয়ার বিয়েতে সাইফ কোনো কিছুর বাদ রাখল না। যদিও এই বিয়ের বিরুদ্ধে সাইফ৷ পাত্রের আগেও একটা বউ ছিল। বয়স ৪০ হবে। বাবা কোন আক্কেলে এমন লোকের সাথে মহুয়ার বিয়ে ঠিক করলো..? কিছুই বুঝতে পারল না! অনেক ঝগড়াও হয়ে গেছে এই নিয়ে মুরশেদ তালুকদারের সাথে কিন্তু উনি উনার সিদ্ধান্ত অনর। মহুয়াও কিভাবে রাজি হলো! সাইফ অনেক বার মহুয়াকে জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু এই মেয়ে প্রতিবার খুশি মনে রাজি বলেছে। সাইফের মনে প্রশ্ন জাগে মুরশেদ তালুকদারও কি রেনুর মতো মহুয়াকে কখনো দেখতে পারত না!?? শুধু মুখে আদর,ভালোবাসা দেখাত.? কিন্তু কেন.? এর পেছনে কিসের রহস্য.? আর এতো পাত্র থাকতে এই লোকের সাথেই কেন বিয়ে ঠিক করলো.? মহুয়া যথেষ্ট সুন্দরী, শুধু যথেষ্ট নয় আগুন সুন্দরী। ওর জন্য পাত্রের অভাব পড়ত না!

এই সকল প্রশ্ন মাথায় নিয়ে সাইফ বিয়ের আয়োজন করে আর অন্য দিকে নিজের বন্ধুদের কল দিয়ে বলে। এই বুইড়া বেডা যখন বিয়ে করতে লোকজন নিয়ে আসবে রাস্তায় গাড়ি ভেঙে ওর মাথা ফাটিয়ে হসপিটাল ভর্তি করবি। তারপর আমি মুরশেদ তালুকদারের মুখোমুখি দাঁড়াবো। মহুয়াকে আমি সব সময় নিজের বোনের মতো দেখেছি। পুরনো সব স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সব সময় মহুয়ার রাগ, অভিমান, কষ্ট সাইদ বুঝত কিন্তু সাইদ বিদেশ চলে যাওয়ার পর থেকে সাইদের জায়গাটা সাইফ নিয়ে নিল। মহুয়াকে নিয়ে ফুচকা খেতে যাওয়া প্রতি সপ্তাহ, প্রতিদিন নিয়ম করে চকলেট, আইসক্রিম নিয়ে আশা।মহুয়া কি লাগবে সব ইচ্ছে পূরণ করা একজন বড় ভাই হিসেবে সব সময় চেষ্টা করেছে। আর এখন বড় ভাইয়ের কর্তব্য পালনও করবে।

বিয়ের দিন চলে আসলো৷ মহুয়াকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে গেল পার্লারের মেয়েরা। মিম এসে ঘা জ্বালানো কিছু কথা বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো। রেনু বেগম ভীষণ খুশি আপদ চোখের সামনে থেকে দূর হচ্ছে। সাথে টাকাও লাগছে না আরও পাচ্ছে। ওই লোক পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে মুরশেদ তালুকদারের হাতে বিয়ের পর বলেছে আরও দিবে। আর এই বাড়ি ঘর জায়গা সম্পত্তি সব এখন উনাদের।

সাইফ এসে একবার দেখে গেল। মহুয়ার মাথায় হাত রেখে বললো” বড় ভাই এখনো তোমার পাশে আছি, এমন কিছু হতে দিব না যা তোমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।”

খুব সাবধানে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল মহুয়া। লেহেঙ্গা শক্ত করে ধরে দৌড় লাগালো। পায়ের জুতা হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে বউ বেসে কি অপূর্ব সুন্দরী এক নারী। আজ মহুয়ার কী ভাগ্য রাস্তায় তেমন মানুষও নেই। সুনশান রাস্তা পেয়ে মহুয়ার দৌড় আরও বেড়ে গেল। নিশ্চয়ই এতোক্ষনে বিয়ে বাড়িতে মহুয়ার অনুপস্থিতি সবাই বুঝে ফেলেছে। ওকে খুঁজতে সবাই বের হয়ে গেছে৷ কিন্তু বেচারি কি জানে ওর না হওয়া বর এখন হসপিটালে ICU তে।

এরি মধ্যে সামনে এসে দাঁড়ালো একটা বাইক। মহুয়া ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়ে ছিলো। আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো সামনে পলাশকে দেখে অবাক হয়ে তাকালো। আজ পলাশ কে চিনা যাচ্ছে না। সেই বোকাসোকা ছেলে লাগছে না। কালো পাঞ্জাবি সাথে চুলগুলো কি সুন্দর সিল্ক কপালে এসে পড়ে আছে।হাতে দামী ঘড়ি,সাথে বাইক মহুয়ার কাছে স্বপ্নের রাজপুত্র লাগছে।
পলাশঃ জলদি উঠ মহুয়া সুন্দরী।
ধ্যান ভাঙলো মহুয়া।

পেছনে তাকিয়ে দেখলো সাইফ আসছে।
মহুয়া ভয়ে কিছু বলার আগেই এক হাত ধরে বাইকে বসিয়ে দিল পলাশ। হাওয়ার বেগে বাইক নিয়ে সাইফের চোখের আড়াল হয়ে গেল।

বাইক থেকে ট্রেন, ট্রেন থেকে বাস তারপর টেক্সি করে আসলো একটা জায়গায়। মহুয়া অসুস্থ হয়ে গেছে এতো বড় জার্নিং করে। ৯ ঘন্টার পথ।

পলাশ মহুয়ার হাত শক্ত করে ধরে প্রবেশ করলো এক নিষিদ্ধ জায়গায়। ইসস বোকা মহুয়া বুঝতেই পারলো না ওর সাথে কি হতে যাচ্ছে!!।
পলাশ এখানে এসেছে ওর খালার থেকে দোয়া আর পারমিশন নিতে। সেই ছোটো থেকে বড় হয়েছে খালার কাছে। আজ জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত নিবে খালার দোয়া তো অবশ্যই লাগবে।

মহুয়া চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’ পলাশ ভাই জায়গাটা এমন কেন.? সবাই এভাবে তাকিয়ে আছে কেন.? মেয়েদের জামা কাপড় এমন কেন.?
পলাশঃ মাথা নিচু করে রাখ মহুয়া। একদম মুখ থেকে কাপড় সরাবে না।
মহুয়াঃ সবাই আপনার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন.?
পলাশ মুচকি হাসলো। এখানে আসলে সব মেয়েরা পলাশের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। বিভিন্ন ভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। আজ হয়তো সাথে এক নতুন মেয়ে দেখে অবাক হয়েছে তাই এভাবে তাকিয়ে আছে।

পলাশ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। এক মধ্যে বয়সী মহিলা লাল শাড়ি পড়ে বসে আছে। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক মুখে ভাড়ি মেকআপ, মুখে ভেতর পান। পলাশকে দেখেই ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে বলে উঠলো, ‘ আমার বাঘের বাচ্চা হঠাৎ না বলে আসলি যে..? .’
পলাশ ইশারায় মহুয়াকে দেখাল। তারপর বললো,’ দেখ তো খালা তোমার বাঘের বাচ্চার চয়েস কেমন.?’
মহিলাটা দুষ্টু হাসি দিয়ে হেলতে দোলতে মহুয়ার সামনে এসে এক টানে মহুয়ার মুখের কাপড় সরিয়ে ফেললো। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘ মাশাল্লাহ এই যে পরী নিয়া আইছস, কই পাইলি এই হুরপরী!!??’
পলাশ মুচকি হেঁসে বললো ” আমরা আজ বিয়ে করছি খালা তোমার থেকে দোয়া নিতে আসলাম।
মহুয়া মহিলাটিকে সালাম করতে গেলে পলাশ আঁটকে বলে উঠলো ” মুখে সালাম করো ”
মহুয়া তাই করলো। মহিলাটি মুগ্ধ হয়ে বললো,’ এই যে কোকিলের কন্ঠ। ‘
পলাশ আবারও হাসলো যাক খালার পছন্দ হয়েছে।
~ আমি ফুলবানু এই মহল্লার সরদারনী। তুমি আমাকে ফুলবানু খালা বলে ডাকতে পারো।
মহুয়া শুধু আড়চোখে চারপাশে তাকাচ্ছে। মেয়েদের আকার ভঙ্গি কেমন অদ্ভুত লাগছে।এইগুলো কি পড়ছে.? সব দেখা যাচ্ছে!! চকচকে লিপস্টিক দিয়ে, মুখে মেক-আপ করে, চোখে গাড় কাজল কি উদ্ভুত লাগছে চারপাশের মেয়েদের। মহুয়া পলাশের হাত শক্ত করে ধরতেই ফুলবানু তা দেখে হাসলো৷ যত যাই হোক এই টকটকে আপেল উনি কিছুতেই হাত ছাড়া করবেন না। এই একটা মেয়েই পারবে এই পল্লী মহলকে আরও উপরে নিয়ে যেতে৷ অনেক দামে এই মেয়েকে পেতে চাইবে লোকজন। কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না এতো সুন্দরী কে। এর রুপে যেন চারপাশ আলোয় ঝলমলে করে উঠেছে।

ফুলবানু পান চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,’ কতো দূর থাইকা আইছস যা ফ্রেস হইয়া ল। আর এই মাইয়ারে একটু বিশ্রাম নিতে দে।
পলাশঃ না খালা আমাদের এখনি যেতে হবে। আমি থাকার জন্য জায়গা আর কাজি কে বলে রেখেছি।
~ যাবি ত এতো তারা কিসের । আগে কিছু খাইয়াল। আমার মহল্লায় গার্লফ্রেন্ড লইয়া আইছস খালি মুখে যাবি.? কিছু খাইয়া তারপর যাবি। এখন বাদ একটু পর বউ হইব। নাকি আমারে আপন মনে করস না.?

ফুলবানুর জোরাজুরিতে রাজি হয়ে গেল পলাশ। মহুয়াকে একটা মেয়ে নিয়ে যেতে চাইলে পলাশ নিজে একটা রুমে নিয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে বলে নিজে অন্য রুমে গেল।

খাবার সাজিয়ে শয়তানি হাসলো ফুলবানু। পলাশ আর মহুয়া আসলো। মহুয়ার ভয় লাগছে সব অচেনা মানুষ, জায়গা সব। শুধু পলাশ একমাত্র পরিচিত । পলাশ মহুয়ার হাত শক্ত করে ধরে আছে যেন ভয় না পায়। পলাশের নিজেরও ভালো লাগছে না মহুয়াকে এখানে বেশিক্ষন রাখতে।এই জায়গা সম্পর্কে ওর থেকে ভালো কে জানে.??

পলাশ ফুলবানুকে বললো,’ তুমিও বস না খালা’
~ না তোরা খা আমি নিজ হাতে বেরে দেই। নতুন বউ বলে কথা আমি নিজ হাতে খাওয়াব।
নতুন বউ শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো মহুয়া এখনো তো বিয়ে হয়নি।
পলাশ খাবার খাওয়ার মাঝে অনুভব করলো মাথা ঘুড়াচ্ছে সাথে মহুয়ারও। এক পর্যায়ে দুইজন জ্ঞান হারায়।

ওদের দিকে তাকিয়ে ফুলবানু হেঁসে বলে সরি আমার বাঘের বাচ্চা। এতো সুন্দর পবিত্র ফুল নিয়ে এখানে আশা তোর উচিত হয়নাই। এই ফুলের খুশবুয়ে আমার মহল্লা এখন থেকে জমজমাট থাকব।

একজনকে ইশারা করলো পলাশকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য।

” এক রুমে আঁটকে রাখবি কয়েকদিন। খেয়াল রাখবি যেন বের না হতে পারে। এই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি, কিছুই জানিনা। আমি যতোদিন না ছাড়তে বলব ছাড়বি না। নিয়ে যা…”

চলবে……
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে