মেঘময় চাঁদ পর্ব-০২

0
836

#মেঘময়_চাঁদ
#পর্ব_২
#লেখনীতে_সাবীহা_সুলতানা_মহিমা

আজ ভার্সিটির প্রথম দিন তাই সকাল সকাল রেডি হয়ে বের হয়ে ছিলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। যদিও কথা ছিলো বাবাই সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাবাই যেহেতু একজন রাজনৈতিক দলের লোক তাই সকাল বেলাই কোথায় যেনো চলে গিয়েছিলো, তাই তো আমি রেডি হয়ে আমার স্কুল ফেন্ড মিলির সাথে ভার্সিটিতে চলে যাই।
যেহেতু আমি রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে তাই আমার সেফটির কথা চিন্তা করেই নিজের জেলার ভার্সিটিতে এডমিশন করানো হয়েছে আমাকে, এতে আমি টু শব্দটিও করতে পারিনি। আর তাছারা এডমিশন টেষ্টে মেধাতালিকায় আমার চান্স আমাদের শহরের ভার্সিটিতেই এসেছে। তাই ইচ্ছা থাকলেও অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি।
আর পরিবারের ছোট মেয়ে কম কথা বলা মেয়ে হওয়ায় নিজের ইচ্ছের কথা মা ছারা তো কাউকে বলতে পারিনা, বড্ড ভয় পাই যে।
চাইলেই আর আট দশটা মেয়ের মতো যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারি না।। খোলা আকাশের নিচে প্রান খুলে অনুভব করতে পারি না। সব সময় কাচ ঢাকা গাড়ি, লিফ্ট বডিগার্ড দিয়ে বেষ্টিত থাকে আমার চারপাশ।
ছোট বেলায় নাকি আমি অনেক চঞ্চল ছিলাম, কিন্তু বড় হয়ে ঘর কুনো হয়ে গেছি, এটা শুভ্র ভাইয়ের কথা। শুধু শুভ্র ভাইনা বাড়ির বড়রাও বলে আমি অনেক ঘর কুনো হয়ে গেছি।
কিন্তু তাদের বলতে পারিনা আমার এই নিয়মের ভিতরে গড়া জীবন আমার ভালো লাগে না।
মিলিকে সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে পা রাখার আগে ভেবে নিয়েছি এখানে আমি আমার নিজের ইচ্ছে মতো চলবো।
সাধারন মেয়েদের মতো কান্টিনের খাবার খাবো, বন্ধু বানাবো। কাউকে বলবোনা যে আমি ইমতিয়াজ শিকদারের মেয়ে, ইশতিয়াক শিকদারের আদরের ভাতিজি।
এসব ভাবতে ভাবতেই ক্যাম্পাসে ডুকে যাই।
ক্যাম্পাসে ডুকতেই দেখতে পাই, কতো গুলো ছেলের সাথে শুভ্র ভাই হেসে হেসে কথা বলছেন।
তার পরনে কালো টিশার্ট। চোখে কালো সানগ্লাস, হাতে দামি ব্যান্ডের সোনালি রংএর ঘড়ি, কালো জিন্সের পেন্ট আর পায়ে কালোশো।
আমি বুঝিনা এতো ফর্মাল স্টাইলে সে সারক্ষন কিভাবে কাটান।
ওনাকে দেখেই আমার মুখে আধার নেমে আসে।
এখানেও বুঝি আমার ইচ্ছে মতো চলা হবে না। হায় আফসোস।
মিলি শুভ্র ভাই কে দেখে খুশি হয়ে বলে দেখ তরী শুভ্র ভাইয়া।
হুম সে এখানে পড়ে। আমি তো ভুলেই গিয়ে ছিলাম।
শুভ্র ভাইয়া এবার ফাইনাল ইয়ারে টপ বয়। সাথে ছাত্র দলের নেতা।
শিক্ষকদের অতি আদরের ছাত্র। মেয়েদের ক্রাশ।
কিন্তু এই মানুষটাকে আমি সব চাইতে বেশি ভয় পাই।
কিন্তু আজকে ওনাকে দেখে আমার কেনো যেনো ভয় লাগছে না, থাক সে তার মতো, আমি আমার মতো চলবো। ক্যাম্পাসের বাইরে বডিগার্ড থাকলেও ভিতরে তো আর আসতে পারবে না।
মিলি আমাকে আবার হাত ধরে ঝাকি দিলো এই চলনা শুভ্র ভাইয়ার কাছে যাই, কিন্তু আমি তো যাবো না।
আমার থেকে বেশি দুরে নয় শুভ্র ভাই। কিন্তু সে আমাদের দেখেও যেনো দেখলো না।
তাতে আমার কি। আমিও দেখিনি।
এখন না মিলি, চল আজকে প্রথম দিন লেট করে যাওয়া ঠিক হবে না।
মিলি আমার কথায় সায় জানিয়ে বলরো হ্যা তাহলে চল, এমনিতেই আমরা নতুন। কোথায় আমাদের ক্লাস তাই তো জানিনা।
চল চল।
মিলি আমাকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে চললো।
ওর তারা হুরোয় আমরা সোজা গিয়ে ধাক্কা খাই একটা ছেলের সাথে।
আমি যেহেতু কথা কম বলি আর ছেলেদের সাথে কথা বলতে ভয় পাই তাই মিলিই দাড়িয়ে গিয়ে ছেলিটিকে ছরি বলে দেয়।
চারশো এগারো নম্বর হল হচ্ছে ফাস্ট ইয়ারদের রুম, আমি আর মিলি দুজনে এক সাথে রুম খুজে বের করে হলে ডুকে পড়ি।
হলে ডুকে কোথায় বসবো সব ছিটিই ফুল, আর এটা ভার্সিটি এখানে সব ছেলে মেয়ে এক সাথে বসে।আমি মিলির দিকে অসহায়ের মতো তাকাই, কারন আমাদের দুজনের কারোরি অভ্যাস নেই ছেলেদের সাথে বসার। কিন্তু একানে তো এই নিয়ম চলবে না।
তোমরা দুজন আমাদের সাথে বসতে পারো, আমাদের পাশে জায়গা আছে।
সামনে তাকিয়ে দেখি তখন যে ছেলেটার সাথে ধাক্কা লেগে ছিলো সেই ছেলেটাই আমাদের কে তার পাশে বসার জন্য বলছে। আমি আর মিলি সারা ক্লাসে তাকিয়ে দেখি আসলেও ওদের সিট ছারা আর কোনো ছিট ফাকা নেই, তাই বাধ্য হয়েই ওদের পাশে বসতে হলো।
আমরা সিটে বসতেই ছেলেটি হেসে বললো,
হায় আমি সৌমিক, তখন তোমাদের দুজনের সাথে আমার ধাক্কা লেগেছিলো।
মিলি হেসে উত্তর দেয় হুম, আমি তো ভেবেছিলাম সিনিয়র ভাইয়া আপনি।
আরে ধুর কি বলো। আর আপনি আপনি করছো কেন, আমরা তো সেম ইয়ার।
সৌমিকের পাশেই বসা একটা মেয়ে সে এইবার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো
আমি জুই, তুমি?
আমি সৌজন্য হেসে জবাব দিলাম তরী।
আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
মিলি আমার অসস্থি হচ্ছে বুঝতে পেরে বলে উঠলো আরে কেন নয়!
আজকে তোমরা দুজন না থাকলে তো এতো সময় হয়তো দাড়িয়ে থাকতে হতো, আর এখানে আমরা সবাই নতুন। আমরা যদি একে অপরের বন্ধু না হই তাহলে একা একা কিভাবে চলবে বলো।
এরপর আমাদের আর কথা হয়নি স্যার চলে আসায়।
ক্লাসের পুরোটা সময় আমি চুপ ছিলাম। মিলি ওদের দুজনের সাথে বকবক করছিলো৷ আমি চাইলেও পারছিলামনা ওদের সাথে মিশে উঠতে খুব অসস্থি বোধ করছিলাম। কিন্তু আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি নিজের মনের মধ্যে থাকা সংকট দুরকরতে হবে, এবাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চলা যাবেনা শুভ্র ভাই সিকদার বাড়ির ছেলে হয়ে বাহিরে যে ভাবে চলে আমিও সেই ভাবেই চলবো। আমিও সিকদার বাড়ির মেয়ে, পার্থক্য থাকবে এখানে সে তার পাওয়ার নিয়ে চলবে আর আমি সাধারন মেয়ের মতো বাকিদের সাথে।
পুরো ক্লাস টাইম চুপ ছিলাম এটা মিলি আর সৌমিক দুজনেই খেয়াল করেছে। মিলি আমার মনোভাব বুঝলেও সৌমিক বুঝেনি।
তাই যখন ব্রেক টাইম দিলো তখন আমরা চারজন মিলে ক্যান্টিনের দিকে যাওয়ার সময় সৌমিক আমাকে প্রশ্ন করেই বসে, আর ইউ অলরাইট তরী, তোমাকে কেমন আপসেট লাগলে। ক্লাসেও দেখলাম তুমি তেমন কথা বললে না। তোমার কি আমার সাথে মিশতে খারাপ লাগছে?
ওর করা প্রশ্নে নিজেকে স্বাভাবিক করার মতো করে বলি আসলে আমি প্রথম কোনো ছেলের সাথে কথা বলছি, একচুয়ালি ছোট বেলা থেকেই আমি গার্ল স্কুল কলেজে পড়েছিতো তাই একটু আন কমফর্টটেবল ফিল হচ্ছে তাই চুপ আছি, এছারা কিছু না। দু একদিন বাদেই ঠিক হয়ে যাবে।
সৌমিক আমার কথায় যেনো স্বস্থির শ্বাস নিলো।
ওহ্ বাচালে আমি আরো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আরেনা তেমন কিছু না।
আরো টুকটাক কথা বলতে বলতে আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে খাবার মেনু দেখে নুডলস আর চিকেন নিয়ে নেই৷
ভার্সিটি ক্যান্টিনে খাবার অর্ডারের জন্য মেনু কার্ড দেখে আমি প্রথমে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। কিন্তু আমার এতো কিছু ভাবার সময় নেই। তারাতাড়ি খেয়ে এখান থেকে যেতে পারলে ভালো লাগবে।
শুনেছি ভার্সিটিতে নাকি রেগিং হয়।
বাইচান্স যদি আমার সাথেও এমনটা হয়। আমি যদিও ক্ষমতা দিয়ে এসব সামলাতে পারবো কিন্তু, আমি সাধারনদের মতো লাইফটা ইনজয় করতে চাই।
এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কই থেকে কয়েকটা মেয়ে এসে আমার নুডলুসের মধ্যে চিলি সস ঢেলে দেয়।
আমি বেশ অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখি পাঁচটা মেয়ে আর তিনটা ছেলে আমাদের টেবিলের চার পাশটা ঘিরে রেখেছে।
আমি অবাক হলেও ভয়ে মিলির হাত চেপে ধরি, আমার বোঝা শেষ আমরা রেগিং হবো একটু পর। মিলি আমার হয়ে কিছু বলতে নিবে এমন সময় আমি ওকে থামিয়ে দেই যদিও ভয় হচ্ছিলো। কিন্তু আমিও দেখতে চাই এরা ঠিক কি করতে চায়।
আমার নুডলুস নষ্ট হওয়ায় সৌমিক জুই আর মিলি দাড়িয়ে গেলেও আমি চুপচাপ বসেই আছি।
আমাকে বসে থাকতে দেখে ওই মেয়েদের একজন বলে ওঠে,
এই মেয়ে এখনো বসে আছো জানোনা যে সিনিয়রদের দেখলে দাড়াতে হয়।
এবার আমি ধীরে ধীরে উঠে দাড়াই।
তোমাকে তো শাস্তি পেতেই হয়, যেহেতু তুমি বেয়াদবি করেছো,
কি শাস্তি দেয়া যায়!
আমার অবস্থা দেখে মিলি হয়তো শুভ্র ভাইকে কল দিতে চাচ্ছিলো ঠিক তখনি সুইটি নামের একটা মেয়ে আমার হাতে একটা কাগজ গুজে দিয়ে বলে, যাও এই কাগজটা নিয়ে ওইযে মাছে কালো টিশার্ট পড়ে যেই ছেলেটা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে ওকে গিয়ে দিবে। আর প্রপোজ করবে।।
আমরা কেউ তোমার সাথে যাবোনা।
তার ইশারা করা দিকে তাকিয়ে আমার চোখ কপালে, এতো আর কেউ নয়, শুভ্র ভাই। এই কাজ আমি কখনই করতে পারবো না। অসম্ভব।

প্লিজ আপু এই কাজটা করতে বলবেন না। আমি এটা পারবো না।
তোমাকে তো পারতেই হবে, বলেই আমার হাত ধরে এক প্রকার টেনেই বের করে আনে আর শুভ্র ভাইয়ের দিকে যাওয়ার জন্য ঠেলে দেয়।
আমি তো মহা বিপদে পড়ে যাবো একেতো জমের মতো ভয় পাই, যার সামনে কথা বলতেও আমার হাতপা কাপে তাকে কিভাবে,,
কি হলো যাও, তুমি না পারলে কিন্তু এর চাইতেও কঠিন শাস্তি দিবো তোমাকে।
আমি মিলির দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে শুভ্র ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাড়াই।
ভাইয়া আমাকে দেখে বেশ অবাই হয়েছে। কারন যে আমি কখনো বাড়িতেও তার আশেপাশে যাইনা আর ভরা ভার্সিটিতে তার সামনে।
শুভ্র ভাই ভেবেচে হয়তো কোনো দরকারে গিয়েছি।
তাই তিনি দাড়িয়ে যখনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তরী কি হয়েছে তখনি আমি ওনার হাতে কাগজটা দিয়ে দেই।
কাগজ দিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে আছি।
শুভ্র ভাই একবার আমার দিকে তাকািয়ে হাতে থাকা কাগজটা খুলতেই ওনার চোখ লাল হয়ে যায়, এদিকে শুভর সামনে আমাকে দেখে সব ছাত্র ছাত্রী ভির করেছে। আমি এসব দেখে ভয় পেয়ে যাই। আমি কখনো এতো মানুষ দেখিনি।
শুভ ভাই আমাকে কিছু বলতে নিয়ার জন্য মুখ খুলতেই দেখেন, আমি ঢলে পড়ে যাচ্ছি,,।
চোখ বন্ধ করার আগে আমি শুভ্র ভাইকে আমার দিকে ঝুকে আমার নাম ধরে ডাকতে শুনেছি। এর পরে আমার আর কিছু মনে নেই।
রাতে যখন জ্ঞান ফিরে তখন আধো চোখে কোনো পুরুষ অবয়ন দেখেছিলাম। আবার জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
কিরে তরী খাচ্ছিস না কেন। খাবার নারাচারা করছিস। ভালো লাগছেনা খেতে?
মামনীর কথায় চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে দেখি শুভ্র ভাইয়া আমার পাশের চেযারে বসেছে৷ এটা দেখে আমার চোখ চরক গাছ। সে
তো জানে আমি ভয় পাই তাহলে আমার পাশে বসছে কেন?
আসলে মামনী কালকে জ্বরের কারনে মুখ তিতকুটে হয়ে আছে।
হ্যা আজ তোকে ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই, আজ ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো তোকে।
ওকে ডক্টরের কাছে নিতে হবে না মা,এমনিতেই ভালো হবে কত সাহসি মেয়ে আমাদের তরী, এই টুকু জ্বরে তার তো কিছুই হবেনা।
আমার কানের কাছে এসে বলে ঠিক বলেছিনা তরী রানি, কালকের চিঠির কথা বাসায় বলবো?
কি ব্যাপার বাবু তুই তরীকে কি বলছিস?
উত্তরে শুভ্র বাই যা বললেন তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আসলে মা,,,,,,,

চলবে,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে