#মেঘবদল
লেখক – এ রহমান
পর্ব ১৫
গোধূলি বেলায় হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। তীব্র শব্দে কেপে উঠছে ধরণী। ঠাণ্ডা হাওয়ায় কুকড়ে গেছে প্রকৃতি। রান্না ঘরে চা বানাচ্ছিল ফারিয়া। বৃষ্টির এমন অঘোষিত আগমনে বিচলিত হয়ে উঠলো। চুলা বন্ধ করে ঘরে গেলো। জানালা খোলা। পানি ঘরে ঢুকে পড়বে। তড়িঘড়ি করে জানালা বন্ধ করে বারান্দার দরজা বন্ধ করতে গেলো। কিন্তু হুট করেই আনমনা হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। কি ভেবে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দুই হাত বের করে দিলো। বৃষ্টির ঠাণ্ডা পানি হতে পড়তেই কেপে উঠলো সে। কিন্তু হাত সরিয়ে নিলো না। মুখটাও অনেক টা কাছে নিয়ে গেলো। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির পানি উড়ে এসে গায়ে পড়ছে। ভিজিয়ে দিয়ে গেলো ফারিয়াকে। সে চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছে বৈরী আবহাওয়া। কলিং বেলের তীব্র শব্দে বিরক্ত হলো সে। চোখ খুলে চলে গেলো দরজা খুলতে। খুলেই দেখে জারিফ হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো ঝাড়ছে। পানি এসে ফারিয়ার মুখে পড়লো। চোখ খিচে বন্ধ করে বলল
— কি করছো?
জারিফ তাকাল। বলল
— ওহ সরি। বুঝতে পারিনি।
কথা শেষ করেই ভেতরে ঢুকে ব্যাগটা রাখলো। ফারিয়া কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে বলল
— তুমি তো পুরোটাই ভিজে গেছ। এতো বৃষ্টির মাঝে আসার কি দরকার ছিল। একটু অপেক্ষা করা যেতনা?
ফারিয়া কথাটা বলে থেমে যেতেই জারিফ চোখ তুলে তাকাল। কিছুক্ষণ শান্তভাবে তাকিয়ে থেকে বলল
— আমি যখন অফিস থেকে বের হয়েছিলাম তখন বৃষ্টি ছিলো না। মাঝ রাস্তায় এসে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তখন ভেজা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
জারিফের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও ফারিয়া মেনে নিতে পারলো না। কঠিন গলায় বলল
— বৃষ্টিতে ভিজলেই তুমি যে অসুস্থ হয়ে পড় সেটা কি ভুলে গেছো? এখন যদি অসুস্থ হয়ে যাও তাহলে কি হবে?
ভেজা কাপড়ে জারিফের ঠাণ্ডা লাগছে। অথচ ফারিয়ার সেটা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। এসব কথা তো পরেও বলতে পারে। জারিফ বিরক্তিকর সরে বলল
— ভেজা কাপড়ে এভাবে একটার পর একটা তোমার কথার উত্তর দিতে গেলে অসুস্থ তো হবই। চেঞ্জ করার সময়টাও কি দেবেনা?
ফারিয়া কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বলল
— আশ্চর্য! আমি কি তোমাকে আটকে রেখেছি নাকি? তুমি চেঞ্জ করে ফেলো। আমি তো নিষেধ করিনি। আমি বলছিলাম কারণ অসুস্থ হলে তো তোমার তেমন কিছু হবে না।
জারিফ ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
— আমি অসুস্থ হলে আমার কিছু হবে না তো কার হবে শুনি?
ফারিয়া শান্ত কণ্ঠে বলল
— অসুস্থ হলে তো আমাকেই সেবা করতে হবে। তোমার আর কি হবে। বিরক্ত তো আমাকেই করবে।
জারিফ অবাক হলো। ঠোঁট চেপে হেসে বলল
— তুমি আমার সেবা করবে? নিজের খেয়ালটাই তো এখনো ঠিক মত রাখতে শেখনি।
জারিফ যে তাকে অপমান করলো সেটা বুঝেই ফারিয়া ভীষন রাগ করলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কোমরে হাত রেখে ঝাঁঝালো গলায় বলল
— নিজের খেয়াল রাখতে শিখেছি কিনা সেটা পরের কথা। তোমার খেয়াল তো ঠিকই রাখতে হয়। তোমার জন্য রান্না করতে হয়। তোমার সব জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখতে হয়। তোমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কখন আসবে অফিস থেকে। এক বেলা কিছু খেলে পরের বেলায় কি খাবে। সেসব তো তোমার চোখে পড়বেনা কারণ তুমি তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সেসব দেখার কি সময় আছে?
ফারিয়া মুখ ভেংচিয়ে ঘরে চলে গেলো। জারিফ চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে ফারিয়ার বলা কথা গুলো ভাবছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে সেও চলে গেলো ঘরে। ফারিয়া তার জন্য অপেক্ষা করে কখন আসবে। মুচকি হাসলো জারিফ। ফারিয়া আবারও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জারিফ পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। খেয়াল করলো ফারিয়া পুরো ভিজে গেছে। হাত টেনে সামনে এনে ঝাঁঝালো গলায় বলল
— এভাবে ভিজছো কেনো?
ফারিয়া উত্তর দিলো না। তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকিয়ে আবার বাইরে তাকাল। বৃষ্টি দেখতেই ব্যস্ত সে। জারিফ ফারিয়ার আচরণ খেয়াল করলো। যে কোন কারনেই হোক আজ ফারিয়াকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। আগের মতো সাভাবিক ভাবেই কথা বলছে। মৃদু হেসে জারিফ নরম কণ্ঠে বলল
— বৃষ্টিতে ভিজবে?
ফারিয়া জারিফের দিকে তাকাল। রাগ অভিমানে ভরা উদাসীন মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। জারিফ মৌন সম্মতি বুঝতে পেরেই হেসে তাকে নিয়ে ছাদে গেলো বৃষ্টি বিলাস করতে।
—————
অন্ধকার ঘরে মৃদু আওয়াজে একটা ইংরেজি গান চলছে। নাহিদ চোখ বন্ধ করে মৃন্ময়ীর কথা ভাবছে। অনেকদিন হয়ে গেলো মেয়েটার কোন খবর নেই। সেদিন হাসপাতালে তার আত্মীয় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে দিয়ে নাহিদ বাসায় চলে এসেছিলো। আসার সময় মেয়েটা নীরবে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। কোন কথা বলেনি। হয়তো অতো মানুষের সামনে জড়তা কাজ করছিলো। কিন্তু নাহিদের মনে হয়েছিল মেয়েটা তাকে কিছু বলতে চায়। সেও আর আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায় নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে। অন্তত ফোন নাম্বারটা যদি নিত তাহলে একবার খবরটা তো জানতে পারত মেয়েটা কেমন আছে। তার ভাবনার মাঝেই সায়রা দরজা ঠেলে ঢুকলো। অন্ধকার দেখে ভাবলো নাহিদ ঘুমিয়ে আছে। তাই বের হতে নিলেই নাহিদ উঠে বসলো। বলল
— মা চলে যাচ্ছ কেনো? ভেতরে আসো।
সায়রা ভেতরে ঢুকে লাইট জ্বালালেন। বিছানায় বসতে বসতে বললেন
— ভাবলাম তুই ঘুমাচ্ছিস। তাই আর বিরক্ত করতে চাইলাম না।
নাহিদ মৃদু হেসে বলল
— না না। এমনি শুয়ে ছিলাম।
সায়রা কপালে হাত রেখে বললেন
— তোর কি শরীর খারাপ? আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসলি যে?
নাহিদ মৃদু সরে বলল
— আজ কাজের চাপ একটু কম তাই তাড়াতাড়ি চলে আসলাম।
বেশ কিছুক্ষণ নিরব পরিবেশ বিরাজ করলো ঘরে। নাহিদ বুঝতে পারলো সায়রা কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না। তাই নিজেই বলে ফেললো
— কিছু বলবে মা?
সায়রা যেনো সাহস ফিরে পেলো। আমতা আমতা করে বলল
— আসলে ঐ মেয়েটার খালা ফোন করেছিল।
— কোন মেয়েটা?
নাহিদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করতেই সায়রা বলল
— মৃন্ময়ী।
নামটা শুনেই নাহিদের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো। নিজের খুশিটা গোপন রেখেই সাভাবিক ভাবে বলল ‘ওহ ‘। সায়রা আবারও বলল
— ওরা আসলে মেয়ের বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি দিতে চায়। তাই জানতে চেয়েছে আমাদের পছন্দ হয়েছে কিনা। আর যদি পছন্দ না হয় তাহলে ওরা অন্য জায়গায় কথা বলে দেখবে।
নাহিদ নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
— তুমি কি বললে?
সায়রা নাহিদের দিকে তাকাল। বলল
— আমি এখনো কিছু বলিনি। তোর পছন্দ হলেই আমার পছন্দ। তবে মেয়েটা কিন্তু ভালই। এখন তোর কেমন লেগেছে জানিনা।
মায়ের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে নাহিদ হাসলো। বলল
— তোমার পছন্দ হয়েছে তাই না?
সায়রা মৃদু হাসলো কোন কথা বলল না। নাহিদ নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
— তোমার ভালো লাগলে হ্যা বলে দাও।
সায়রার চোখে মুখে উচ্ছাস। হাসি মুখে বলল
— তোর ভালো লেগেছে মেয়েটাকে? হ্যা বলবো।
নাহিদ হেসে ফেললো। উঠে দাড়িয়ে বলল
— বলো।
সায়রা খুশি হয় চলে গেলো। আর অপেক্ষা করল না। তার অবস্থা এমন যেনো ছেলেকে এখনি বিয়ে দিতে পারলেই শান্তি পায় সে। নাহিদ হেসে ফেলল মায়ের অবস্থা দেখে। সে উঠে রেডি হলো বাইরে যাবে। আকাশে মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে। চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। এখন রাস্তায় হাঁটতে বেশ লাগবে। ফোনটা পকেটে নিয়ে বের হলো ঘর থেকে। বাইরে এসে দেখে সায়রা হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে। গলা তুলে বলল
— মা আমি বাইরে যাচ্ছি।
সায়রা শুনলো কিনা নাহিদ বুঝতে পারলো না। সে অপেক্ষা করলো না মায়ের উত্তরের। বের হয়ে গেলো। সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নেমেই দেখে ইভান দাড়িয়ে আছে। নাহিদ পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘাড়ে হাত রাখতেই সে চমকে তাকাল। বলল
— ওহ। তুমি?
নাহিদ ভ্রু নাচিয়ে বলল
— এতো গভির ভাবে কি ভাবছিস?
ইভান মৃদু স্বরে বলল
— কিছু না।
নাহিদের কাছে ইভানের কথার ধরন অস্বাভাবিক মনে হলো। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো
— কি হয়েছে তোর? কোন সমস্যা?
ইভান ঠোঁট ভাঁজ করে বলল
— কোন সমস্যা নেই। তুমি কোথায় যাচ্ছো?
— তেমন কোথাও না। এমনিতেই হাঁটছিলাম।
নাহিদের কথা শেষ হতেই ইভান বলল
— চলো সামনে থেকে হেঁটে আসি।
দুজনেই রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো। কেউ কোন কথা বলছে না। কিছু দূর হাঁটার পর নাহিদ জিজ্ঞেস করলো
— তুই নাকি বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিস? সব কিছু কি রেডি হয়েছে?
ইভান শব্দ করে হাসলো। বলল
— কে বলল তোমাকে?
নাহিদ বেশ অবাক হলো। উত্তর না দিয়ে এভাবে হাসার কি আছে। ভ্রু কুঁচকে বলল
— সবাই তো বলছিলো। এখন এটাই আলোচনার এক মাত্র টপিক। যেখানেই যাচ্ছি কেউ দুঃখ বিলাশ করে বলছে। আবার কেউ খুশি হয়ে বলছে।
ইভান আবারও হাসলো। বলল
— কে দুঃখ বিলাশ করছে?
নাহিদ সরু চোখে তাকাল। বলল
— এমন ভাব যেনো তুই কিছুই বুঝিস না। মোটামুটি সবাই এখন দুঃখ করেই আলোচনা করছে। কিন্তু একজন আছে যে একটু বেশিই দুঃখ বিলাশ করে বেড়াচ্ছে।
ইভান হাসলো। বলল
— ওই দুঃখ বিলাসীর জন্যই তো এতো কিছু। একটু বোঝা উচিৎ যে তার ইচ্ছা মতো সব কিছু হয় না। সব সময় তাকে উল্টা বুঝতেই হয়। এবার আর উল্টা বুঝবে না। যা বুঝবে একদম ঠিক।
নাহিদ বিরক্ত হয়ে বলল
— তুই অযথা নিরীহ মেয়েটাকে মানসিক ভাবে টর্চার করিস। এরকম না করলেও পারিস।
ইভান মৃদু হেসে বলল
— নিরীহ মেয়েটা কি আমাকে কম টর্চার করেছে। এখনো করছে। একটু তো ভোগ করতেই হবে। ইভান এতো সস্তা না। সে কাউকে ছেড়ে দেয় না। সব সুদে আসলে উসুল করে নেয়।
— তোরা দুজনই এক। তোদের বাকি জীবনটা যে কিভাবে কাটবে সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
দুজনেই হেসে ফেললো। নাহিদের ফোন বাজলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে কপালে ভাঁজ পড়লো তার। ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠে বলল
— নাহিদ সাহেব বলছেন?
— জি বলছিলাম।
— আমি মৃন্ময়ী। আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।
নাহিদ একটু ঘাবড়ে গেলো। চুপ হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মাথায় সবটা ঢুকতেই বলল
— আপনি? আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?
— অনেক কষ্ট করে খুজে বের করেছি। আপনার সাথে জরুরি কথা ছিলো।
— জি বলুন।
— কাল একবার দেখা করতে পারবেন? কোন সম্পর্কে জড়ানোর আগে আপনাকে কিছু কথা জানানোর আছে। সেগুলা আপনার জানা দরকার।
চলবে……
#মেঘবদল
লেখক – এ রহমান
পর্ব ১৬
সাদা মাটা কচু পাতা রঙের একটা সুতি শাড়ি পরেছে মৃন্ময়ী। রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে বসে আছে মাথা নীচু করে। সামনের চেয়ারে বসা নাহিদ তার দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে। মেয়েটাকে আজ বেশ লাগছে শাড়ীতে। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তাকিয়ে থাকলে মেয়েটার অসস্তি হবে। অন্য কিছুও ভেবে বসতে পারে। তাই সে সাহস টা করে উঠলো না। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরেই দুজন চুপচাপ বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। মৃন্ময়ী তাকে কেনো ডেকেছে সেটা এখনো বলেনি। আর কি এমন কথা যে বলতে এতো সময় নিচ্ছে। মৃন্ময়ীর অস্থির দৃষ্টি সর্বত্র বিচরণ করছে এলোমেলোভাবে। কিছু একটা বলতে যেয়েও আটকে যাচ্ছে কথা। নাহিদ ব্যাপারটা খেয়াল করলো। তাই কথা শুরু করতেই বলল
— কিছু বলছেন না যে?
মৃন্ময়ী চমকে তাকাল। অস্থির ভাবে নিশ্বাস নিলো। নাহিদ অবাক হলো। এই কথাটা চমকানোর মত ছিলো না। মৃন্ময়ীর অস্বাভাবিক আচরণ এবার তার দৃষ্টিতে ঠেকলো। ভেতরে অজানা ভয় গ্রাস করলো। সে আগ্রহ নিয়ে তাকাল। গম্ভীর সরে বলল
— দেখুন আপনার যদি বিয়ে করতে কোন সমস্যা থাকে আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন। আমি সামলে নিবো সবটা।
মৃন্ময়ী গোল গোল চোখে তাকাল। দুই ঠোঁট গোল করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
— না না। সেরকম কিছু না। বিয়েতে আমার কোন সমস্যা নেই। আসলে..।
আবারো চোখ নামিয়ে নিলো মৃন্ময়ী। এক হাত আরেক হাতের উপরে রেখে নাড়াচাড়া করছে অস্থির ভাবে। নাহিদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল
— বিয়েতে আপনার সমস্যা নেই জেনে ভালো লাগলো। কিন্তু যদি থাকতো তাহলে এর থেকে ভয়ংকর কথা আর হতে পারে না। যা বলতে চান বিনাদ্বিধায় বলতে পারেন।
— এর থেকেও ভয়ংকর ঘটনা থাকতে পারে নাহিদ সাহেব। বাস্তবতা যে অনেক কঠিন।
কেপে উঠলো মৃন্ময়ীর কণ্ঠ। নাহিদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। কি এমন বাস্তবতার কথা বলতে চায় সে। নাহিদ নরম কণ্ঠে বলল
— ঘাবড়াবেন না মৃন্ময়ী। কি বলতে চান বলুন।
মৃন্ময়ী একটু সাহস পেলো যেনো। পানির গ্লাসটা তুলে একটু চুমুক দিয়ে আবার রেখে দিলো। নিচের দিকে তাকিয়েই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল
— আমি গ্রামের মেয়ে। আমার পড়ালেখার শুরু গ্রামেই। অল্প কিছু জমি আর বাবার একটা ছোট দোকান দিয়েই সংসার চলতো। বাবাই ছিলো সংসারের এক মাত্র কর্মক্ষম ব্যাক্তি। আমার এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার আগে আগে বাবা একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। জানতে পারলাম স্ট্রোক করেছে। প্যারালাইজড হয়ে গেছে। মাথায় আকাশ ভেংগে পড়লো। বাড়ির বড়ো মেয়ে হিসেবে আমার দায়িত্বটা একটু বেশী। তাই আর অপেক্ষা না করে কাধে দায়িত্বের ভার নিয়ে শহরে চলে এলাম। খালার বাসায় উঠলাম। তারা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমার তো তাদের সাহায্য দিয়ে শুধু চলবে না। তাই নিজের জন্য চাকরি খুঁজতে বের হলাম। খুঁজেও পেলাম। একজন সেলস গার্ল হিসেবে। চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে গেলাম। ভালই কাটছিল দিনগুলো।
বলেই থামলো মৃন্ময়ী। তার চোখে পানি। মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল নাহিদ। মৃন্ময়ী থেমে যাওয়ায় বিরক্ত হলো। কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো আপনা আপনি। গম্ভীর সরে বলল
— তারপর?
মৃন্ময়ী শুকনো ঢোক গিলে নাক টেনে বলল
— একদিন মালিক দোকান থেকে জরুরী কাগজ নিয়ে বাসায় যেতে বললেন। সবাই ব্যস্ত থাকায় আমাকে যেতে হলো। আমি কোনো কিছু না ভেবেই চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে দেখি একজন কাজের মহিলা আর স্যারের ছেলে আছেন। মহিলাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো স্যার কোন জরুরী কাজে একটু সময়ের জন্য বাইরে গেছেন। তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আমাকে অপেক্ষা করতে বলল। আমি ভিতরে গিয়ে বসলাম সোফায়। কিছুক্ষণ পরে তার ছেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। এসে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন আমি কে। আমি নিজের পরিচয় দিয়ে আবারো বসে পড়লাম সোফায়। তিনিও আমার সামনে সোফায় বসে পড়লেন। আমার সাথে টুকটাক কথা বলতে শুরু করলেন। ভদ্রতার খাতিরে মালিকের ছেলে হিসেবে আমি তাকে কোন অবস্থাতে ইগনোর করতে পারছিলাম না। কিন্তু একজন মেয়ে হিসেবে তার দৃষ্টি ঠিক কতটা জঘন্য ছিল সেটাকে ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছিলাম। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোন লাভ হলো না। আমি পরে আসবো বলে বের হতে নিলেই সে আমাকে…।
চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল মৃন্ময়ীর। নাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চোখ বন্ধ করে ফেললো। মৃন্ময়ী কাতর নয়নে তাকাল। নাহিদের চোখ বন্ধ দেখে তার চোখের পানির বেগ বেড়ে গেলো। এলোমেলো হয়ে গেলো সব কিছু। নাহিদ চোখ খুলে মৃদু সরে বলল
— বলতে থাকুন মৃন্ময়ী।
মৃন্ময়ীর ভেতরের আর্তনাদ বাইরেও প্রকাশ পেলো। চোখের পানি বেড়ে গেলো। কেপে কেপে উঠছে সে। আঁচলে মুখ চেপে ধরলো। নাহিদ বিরক্তকর স্বরে বলল
— কাঁদবেন না মৃন্ময়ী।
নাহিদের কণ্ঠস্বর শুনে মৃন্ময়ী আরো ভেঙে পড়ল। টেবিলে দুই হাত রেখে তার মাঝে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণ কাদার পরে মাথায় কারো আলতো স্পর্শ পেয়ে স্থির হয়ে গেল মৃন্ময়ী। কিছু বোঝার আগেই কানে এল ভীষন অদূরে কণ্ঠস্বর।
— শান্ত হোন। এতো ভেংগে পড়লে চলবে না।
মৃন্ময়ী মাথা তুলে তাকাল। চোখের পানি মুছে ফেললো। নাহিদ ভ্রু কুচকে বলল
— আপনি কি কোন স্টেপ নিয়েছিলেন নাকি চুপ করে সহ্য করে গিয়েছিলেন।
মৃন্ময়ী নিজেকে সাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল
— আমি স্যারকে সবটা জানাই। সব শুনে উনি আমাকে টাকা দিয়ে বিষয়টা সামলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি তাতে রাজি হই নি। পরে আমার মাকে সব জানালে তিনি লোকলজ্জার ভয়ে চেপে যেতে বলেন। তাই আর…।
— ডিসগাস্টিং!
মৃন্ময়ীর কথা শেষ হওয়ার আগেই নাহিদ চাপা স্বরে বলে। মৃন্ময়ী নিচের দিকে তাকিয়ে বলে
— আপনার আগেও আমার কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। পছন্দও করেছে অনেকে। কিন্তু কোন সম্পর্কে জড়ানোর আগে আমি আমার জীবনের এই জঘন্য সত্যি টা জানালে সবাই পিছপা হয়ে যায়। শান্তনা দেয়ার মতো অনেকেই আছে। কিন্তু সীকৃতি দেয়ার মত কেউ নেই।
মৃন্ময়ী শেষের কথাটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে। নাহিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে
— আর যদি কেউ বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়?
মৃন্ময়ী সিক্ত চোখে তাকাল। নাহিদ শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী চোখের পাতা পিটপিট করে আবার নিচের দিকে তাকাল। নাহিদ গম্ভীর সরে বলল
— দেখুন মৃন্ময়ী। আমার মা আপনাকে পছন্দ করেছে। তার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাই। মা হয়তোবা আপনাদের বাসায় ফোন করে বলেছেন। আমি জানি না আপনার বিয়েতে মত আছে কিনা। নাকি আপনি পরিবারের কথা ভেবেই হ্যা বলেছেন। সে যাই হোক। সম্পর্কে যেহেতু আমরা জড়িয়েই যাচ্ছি তাই আমার মনে হয় আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব হওয়াটা খুব দরকার। কারণ সব সম্পর্কের শুরু বন্ধুত্ব থেকেই হয়।
মৃন্ময়ী তাকাল অবুঝের মতো। নাহিদের কথাটা কান ভেদ করে গেলেও মস্তিষ্ক ভেদ করতে পারলো না। তাই মৃদু সরে বলল
— জি?
নাহিদ হাসলো। তার হাসির অর্থ মৃন্ময়ীর মস্তিষ্ক ধরতে পারলো না।
—————–
ফারিয়া টিভির সামনে বসে চিপস খাচ্ছে। জারিফ পাশেই বসে কাজ করছে ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে। ফারিয়ার ফোন কেপে উঠতেই তার কাজে ব্যাঘাত ঘটলো। ভ্রু কুঁচকে তাকাল ফারিয়ার দিকে। কিন্তু ফারিয়া এতো বেশি মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে যে ফোনের কাপুনি অনুভব করার মতো অবস্থায় সে নেই। জারিফ বেশ বিরক্ত হলো। ফারিয়াকে ডাকতে চেয়েও ডাকলো না। নিজেই ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে ফারিয়ার কাছ থেকে রিমোট নিয়ে টিভির সাউন্ড কমিয়ে দিলো। ফারিয়া বিরক্ত হয়ে তাকাল জারিফের দিকে। ঝাঁঝালো গলায় বলল
— কি হলো?
জারিফ দাত কেলিয়ে বলল
— তোমাকে একটা ভালো খবর দেয়ার ছিলো। তাই টিভির সাউন্ড টা কমিয়ে দিলাম।
ফারিয়া শান্ত হয়ে বসলো। বেশ শান্ত সরে বলল
— কি খবর?
জারিফ আবারও দাত বের করে হেসে বলল
— তোমার মা আর আমার মা আসছে কাল।
ফারিয়া মুখ গোল করে হা করে তাকাল। বলল
— কোথায় আসছে?
— আমাদের বাসায় আসছে। তোমার আর আমার সংসার জীবন দেখতে।
জারিফ উঠে দাঁড়ালো। ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ফারিয়া অবাক হয়ে বলল
— এখন কি হবে?
জারিফ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল
— কি আর হবে। এতদিন আলাদা ঘরে থাকতাম এখন এক ঘরে থেকে হানিমুন করতে হবে।
জারিফের কথা শুনে ফারিয়া বিরক্ত হলো। বলল
— কিসব উলটা পাল্টা কথা বলছো?
জারিফ ঘুরে তাকাল। শান্ত সরে বলল
— তাছাড়া আর কি করবে? আমার মা আসলেই তোমাকে বাচ্চার কথা বলবে। তখন কি উত্তর দিবে সেটা এখন থেকেই ভেবে রাখো।
ফারিয়া উঠে দাড়ালো বলল
— এরকম কথা আবার বলে নাকি?
জারিফ সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বলল
— কেনো তুমি কি এখনো অবিবাহিত মেয়ে যে তোমার কাছে বাচ্চার কথা বলা পাপ হয়ে যাবে।
বলেই ঘরের দিকে চলে গেলো। ফারিয়া ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। জারিফের কথাটাই সে ভাবছে। জারিফের মা যদি সত্যি সত্যি এমন কথা বলে তাহলে তার উত্তর কি দেবে।
————–
ছাদ থেকে শুকনো কাপড় নিয়ে নামছিল ঈশা। ছাদের দরজা বন্ধ করে পিছনে ঘুরে সিড়িতে পা দিতেই পা পিছলে গেল। ধরেই নিলো সে সিড়ি বেয়ে গড়িয়ে একদম নিচে পড়ে যাবে। চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলতেই মনে হলো দুটো হাত খুব যত্ন করে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ঢিপ ঢিপ আওয়াজটা স্পষ্ট কানে আসছে। বেশ মাদকতা তৈরি করেছে এই আওয়াজটা। ঈশা চোখ খুলে ফেললো। তার বুঝতে কষ্ট হলো না কেউ তাকে নিজের বুকে আগলে রেখেছে খুব যত্নে। তৎক্ষণাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ালো। ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঈশা ইভান কে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে মনে মনে বেশ খুশি হলো। ইভান ধমক দিয়ে বলল
— এখান থেকে পড়ে গেলে কি হবে সেটার ধারণা আছে? চোখ কোথায় রেখে এসেছিস?
ঈশা মিষ্টি হাসলো। ইভান বেশ অবাক হলো। কিন্তু তার রাগটা নিমেষেই চলে গেলো। গভীর ভাবে তাকাল সে। ঈশা হাসি মুখেই বলল
— ধারণা নেই জন্যই তো পড়ে যাচ্ছিলাম।
ইভান চোখ বন্ধ করে ফেললো। সে ঈশার এমন উত্তরে বেশ বিরক্ত। আর বুঝতেও পারছে ঈশা তাকে বিরক্ত করতেই এখন প্রস্তুত। তাই ঈশার হাত ধরে বলল
— ধারণা টা তাহলে নেয়া উচিৎ তাই না?
ঈশা শান্ত কণ্ঠে বলল
— কিভাবে ধারণা নিবো?
— এখান থেকে তোকে ফেলে দেবো। তাহলেই খুব ভালো ধারণা পাবি।
ঈশা মৃদু হেসে ঠোঁট কামড়ে বলল
— তাহলে আগেই ছেড়ে দিতে। ওভাবে জড়িয়ে ধরার কোন দরকার ছিল না।
ইভান এর মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল। ঈশার কথার ধরন একদম অন্য রকম। ইভান এর উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না। তাই ঈশা কে একটু রাগ দেখিয়ে বলল
— বিরক্তিকর। সব সময় উল্টা পাল্টা চিন্তা মাথায়।
বলেই নিচে চলে গেলো দ্রুত। ঈশা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।
চলবে……