#মেঘবদল
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১১
–স্যার!
সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ঝিমিয়ে এসেছিল নাহিদের। মাথা এলিয়ে দিয়েছিলো কিছুক্ষনের জন্য। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। এর মাঝেই মৃন্ময়ীর জ্ঞান ফিরে এসেছে। তাই নার্স ডাকতে এসেছে তাকে। কিন্তু গভীর ঘুমে থাকায় মৃদু কণ্ঠ কানে গেলো না তার। নার্স ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে আবারো ডেকে উঠলো। একটু জোরেই। হঠাৎ করে এমন ডাক কানে আসতেই হকচকিয়ে গেলো নাহিদ। মাথা কাজ করছে না তার। কিছু বুঝে উঠতেই পারছে না। তবে সামনে দাড়িয়ে থাকা সাদা পোশাক পরিহিত নার্সকে দেখে কয়েকবার পলক ফেলে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল সে। অগছালভাবে বলল
–কিছু হয়েছে কি?
নার্স মুচকি হেসে বলল
–আপনার পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।
মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো নাহিদের। ভারাক্রান্ত মনটা হালকা হয়ে গেলো। কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল
–উনি এখন কেমন আছেন?
নার্স ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল
–আপনার সাথে কথা বলতে চান। আসুন আমার সাথে।
নাহিদ ভেতরে ঢুকল। নার্স তাকে দেখিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাহিদ ধির পায়ে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসল। মৃন্ময়ীর চোখ বন্ধ। মাথার অর্ধেকটা জুড়ে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। উপরে লাল রক্তের দাগ ভেসে আছে। নাহিদের বুকের ভেতরে অজানা ব্যথা নাড়া দিলো। হতাশ শ্বাস ছেড়ে মৃদু সরে ডাকল
–মৃন্ময়ী?
মৃন্ময়ী নড়েচড়ে উঠলো। নিজের নামটা শুনে চোখ মেলে তাকাল। নাহিদকে দেখে অবাক হল বেশ। তার উপস্থিতি ভাবিয়ে তুলল তাকে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল। চোখে মুখে অবাকের রেশ টেনে মৃদু সরে বলল
–আপনি?
নাহিদ যেন সস্তি পেলো গলা শুনে। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–এখন কেমন লাগছে?
মৃন্ময়ী ক্লান্ত চোখ জোড়া পিটপিট করে বলল
–ভালো। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন?
নাহিদ মৃদু হাসল। বলল
–আমিই আপনাকে হাসপাতালে এনেছি। তখন আপনার কোন জ্ঞান ছিল না।
ঠোট জোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁকা করে বড় বড় চোখে তাকাল সে। অবাক কণ্ঠে বলল
–আপনি এনেছেন?
নাহিদ হাসল। বলল
–আচ্ছা একটা কথা বলেন তো বারবার এভাবে আপনার সাথে দেখা হওয়ার কারণটা কি হতে পারে? কোন ইঙ্গিত নয় তো?
মৃন্ময়ী নাহিদের কথা ধরতে পারল না। বোকা বোকা চোখে চেয়ে থাকলো। নাহিদ তার বোকা চাহুনি দেখে হেসে ফেললো। মৃন্ময়ী বার কয়েক পলক ফেললো। মৃদু সরে জিজ্ঞেস করলো
–আপনি কিভাবে জানলেন এক্সিডেন্টের কথা?
–জানি না তো। আমি সেদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। রাস্তার পাশে ভিড় দেখে কৌতূহল জাগল কি হয়েছে সেটা জানার। এর মাঝেই একজন বলল এক্সিডেন্ট হয়েছে। একজন মেয়ে রিক্সা থেকে পড়ে গেছে। মাথা ফেটে গেছে। ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখি আপনি।
কথাটা বলে থামল নাহিদ। মৃন্ময়ী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতক্ষন নাহিদ অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। মৃন্ময়ীর দিকে দৃষ্টি স্থির করতেই চোখে চোখ পড়ে। আচমকা এমন হওয়াতে মৃন্ময়ী লজ্জা পেয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। নাহিদ আবেগি কণ্ঠে বলে
–রক্তে ভিজে উঠেছিল রাস্তা। দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। কি করবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিলো আপনাকে বাঁচাতে হবেই। নাহলে বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে।
মৃন্ময়ীর হৃদ স্পন্দন বেড়ে গেলো। কথাগুলো কেমন যেন ঠেকল তার কাছে। নাহিদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–মৃন্ময়ী আপনার বাড়ির কাউকে জানানো উচিৎ। তারা চিন্তা করবে। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে।
মৃন্ময়ী শুকনো মুখে তাকাল। এতো কিছুর মাঝে সে এটা নিয়ে ভাবেনি। ক্যানুলা লাগানো হাতটা নাড়িয়ে বলল
–আপনি কাউকে জানান নি?
পর মুহূর্তেই ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলো সে। চোখ মুখ কুচকে নিলো। শক্ত হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকাল আবার। নাহিদ হালকা হাতে তার সেই ক্যানুলা লাগানো হাত ধরে ঠিক করে দিচ্ছে। হাতে হাত রেখেই নাহিদ বলল
–আপনার খালার নাম্বারে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ।
মৃন্ময়ী তার হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে। নাহিদ হাতটা আলতো করে রেখে বলল
–আপনার ফোনে পাসওয়ার্ড দেয়া আছে। তাই কারো নাম্বার পাওয়া সম্ভব হয়নি। আর কেউ ফোনও দেয়নি।
–ফোনটা দিন আমাকে।
মৃন্ময়ী অস্থির কণ্ঠে বলল। নাহিদ পকেট থেকে ফোনটা বের করে তার হাতে দিতেই সে এক হাতে পাসওয়ার্ড টাইপ করে নাম্বার বের করলো। খালার নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখল সত্যিই সেটা বন্ধ। তারপর তার ভাইয়ের নাম্বারে ফোন দিলো। কয়েকবার রিং হতেই ঘুম জড়ান কণ্ঠে হ্যালো বলল মামুন। মৃন্ময়ী ক্লান্ত সরে বলল
–ঘুমিয়ে পড়েছিস?
–রাত ২ টা বাজে এখন তো ঘুমানোর সময় আপু।
মামুনের কথা শুনে মৃন্ময়ী নাহিদের দিকে তাকাল। এতো রাত হয়ে গেছে সে ভাবেই নি। মামুন এতক্ষনে আবার জিজ্ঞেস করলো
–এতো রাতে তুমি ফোন দিয়েছ কেন? কি হয়েছে আপু?
মৃন্ময়ী কিভাবে বলবে সেটা ভাবতেই নাহিদ ফোনটা তার কাছ থেকে নিয়ে নিলো। গম্ভীর সরে বলল
–আমি নাহিদ বলছিলাম। চিনতে পেরেছ?
মামুন কথাটা ধরতে পারল না। মস্তিস্ক স্থির হতেই প্রথম তার মাথায় এলো এতো রাতে নাহিদ আর মৃন্ময়ী একসাথে কেন? কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–জি। চিনতে পেরেছি।
–আসলে তোমার আপু আজ সন্ধ্যায় এক্সিডেন্ট করেছে। আমিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। তেমন গুরুতর না। এখন ঠিক আছে। বাসায় জানানো সম্ভব হয়নি। তাই তোমাকে…।
নাহিদ নিজের কথা শেষ করতে পারল না। মামুন চিৎকার করে বলল
–আপু এক্সিডেন্ট করেছে? কোথায় আছে এখন? আমি আসছি।
নাহিদ হতবিহবল হয়ে গেলো। এতো রাতে কিভাবে আসবে ছেলেটা। আশস্তের কণ্ঠে বলল
–ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তোমার আপু এখন ঠিক আছে। আর আমি তো আছিই। চিন্তার কিছু নেই। তুমি নাহয় সকালে এসো।
মামুন অস্থির হয়ে উঠলো। নাহিদ ফোনটা মৃন্ময়ীকে দিলো। মৃন্ময়ীর সাথে কথা বললে হয়তো একটু সস্তি পাবে সে। মৃন্ময়ী শুরু থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা খুলে বলল তাকে। মামুন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিলো ফোনটা। নাহিদ উঠে দাঁড়াল। বলল
–আপনি এখন ঘুমান। আপনার রেস্ট দরকার।
মৃন্ময়ী মৃদু সরে বলল
–আর আপনি?
নাহিদ ফিরে তাকাল। কোন কথা বলল না। মৃন্ময়ী আবারো বলল
–আপনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। শুধু শুধু রাতে থাকতে গেলেন। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে পারতেন।
কথাটা শুনে নাহিদের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। রাগি সরে বলল
–আপনাকে এই অবস্থায় রেখে আমি বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবো সেটা ভাবলেন কি করে মৃন্ময়ী? আর কিভাবে বা এমন কথা বলতে পারলেন? আপনার এসব না ভাবলেও চলবে। ঘুমান।
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। নাহিদের রাগের কারন মৃন্ময়ীর কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু অধিকার বোধটা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিলো। নাহিদ বেরিয়ে যেতেই মৃন্ময়ী মৃদু হাসল। মনটা উতফুল্য হয়ে উঠলো। মানুষটা এভাবে তার খেয়াল রাখছে সেটা ভেবেই মনটা আরও ভাল হয়ে গেলো। আসলেই মানুষটা অনেক ভালো। ভাবতে ভাবতেই ক্লান্ত চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এলো। ঘুমিয়ে পড়ল সে।
নাহিদ বাইরে এসে চেয়ারে বসে পড়ল। মৃন্ময়ীকে মোটামুটি সুস্থ দেখে তার এখন ভালো লাগছে। বেশ এলোমেলো লাগছিল। বুকের ভেতরটা কেমন ভার হয়েছিল। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে হালকা হয়েছে অনেকটা। চারিদিকে তাকিয়ে ভাবল এভাবে রাতটা তার হাসপাতালে কেটে যাবে সেটা ভাবেই নি। কিন্তু মৃন্ময়ীকে এই অবস্থায় রেখে যেতে মন কোনভাবেই সায় দেয়নি তার। মনে হয়েছিল চোখের সামনে থাকলে তবুও ভালো মন্দ সবটা জানতে পারবে। কিন্তু এখান থেকে চলে গেলে কিছুই জানতে পারবে না। চিন্তায় হয়তো রাতে ঘুমাতেও পারতো না। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিলো। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। কিন্তু এই পরিবেশে ঘুম হবে না। তারপরেও মনের কোথাও একটা শান্তি অনুভুত হচ্ছে। সস্তির শ্বাস নিতে পারছে সে। এখন শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা।
চলবে……
#মেঘবদল
লেখক – এ রহমান
পর্ব ১২
শেষ বিকেলের তেজহিন রোদটা পড়ছে ঠিক ফারিয়ার মুখে। ওড়নাটা বড়ো করে টেনে একটু আড়াল করে বসতেই ঈশা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলো। ফারিয়া মুচকি হেসে কাপটা হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সেটাতে চুমুক দিলো। শেষ বিকেলে এরকম ছাদে বসে চা খাওয়ার মজাটাই আলাদা। আর তার সাথে যদি মুড়ি মাখা আর আড্ডা দেয়ার মত কেউ থাকে তাহলে তো কথাই নাই। ঈশার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল
— তুমি চা টা কিন্তু খুব ভালো বানাও। খুব সুন্দর হয়েছে।
ঈশা হাসলো। বলল
— ততটাও না যতটা তুমি বলছো।
নিজের কাপে চুমুক দিয়ে ঈশা ফারিয়ার দিকে তাকাল। মুড়ির বাটিটা এগিয়ে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল
— আচ্ছা আপু তোমাদের কি লাভ ম্যারেজ না অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?
ফারিয়া থেমে গেলো। একটু সময় নিয়ে ঈশার প্রশ্নের উত্তর গোছাতে লাগলো। কিন্তু সঠিক কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। ঈশা ফারিয়ার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে। উত্তরের অপেক্ষায়। ফারিয়া হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
— ঠিক লাভ ম্যারেজ না। তবে আমরা আগে থেকেই একে অপরকে চিনতাম।
— তাই নাকি? কিভাবে চিনতে?
ঈশার কৌতূহল দেখে ফারিয়া হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল
— সেই কলেজ লাইফ থেকে আমরা একসাথে পড়তাম। বেশ ভালো বন্ধু ছিলাম।
ঈশার কৌতূহল আরো বেড়ে গেলো। নড়েচড়ে বসে বলল
— বেস্ট ফ্রেন্ড? বাহ! বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে বিয়ে। চমৎকার বিষয়। তাহলে তো তোমরা দুজন দুজনের সব কিছু ভালোভাবে জানো। তাহলে ভালোবাসাটাও নিশ্চয় অনেক গভীর।
ফারিয়া হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল। ভালোবাসা শব্দটা অদ্ভুত ঠেকলো তার কাছে। জারিফের সাথে বন্ধুত্বটা তার ভালই ছিলো। নিজেদের মনের কথা একে অপরের কাছে বলতো বিনাদ্বিধায়। কিন্তু ভালোবাসাটা কি আদৌ ছিলো? এই প্রশ্নের উত্তর ফারিয়ার কাছে নেই। কারণ সে নিজেই এসব নিয়ে কখনো ভাবেনি। জারিফ কি কখনো ভেবেছে?
— আচ্ছা পরিবারের সবাই মিলে তোমাদের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত কেনো নিলো? মানে তারা কি ভেবেছিলেন যে তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসো?
ঈশার প্রশ্নে ফারিয়া চমকে তাকাল। গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলো এতক্ষণ। মৃদু হেসে বলল
— বাবা আমার বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সবে পড়ালেখা শেষ করেছি। ভেবেছিলাম আরো বছর খানেক পর বিয়ে নিয়ে ভাববো। কিন্তু বাবা সেই সময়টা দিতে কোন ভাবেই রাজি নয়। অনেক যুদ্ধ করেও লাভ হয়নি। একদিন সকাল বেলা অপ্রত্যাশিত ভাবে জারিফের বাবা মা আমাদের বাসায় হাজির। ওনারা প্রায়ই আসতেন। কিন্তু সেদিন অতো সকালে ওনাদের দেখে আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম। বিশেষ কিছু কথা বার্তার এক পর্যায়ে জারিফের বাবা বিয়ের প্রস্তাব রাখেন আমার বাবার কাছে। আর বাবা আশ্চর্যজনক ভাবে কোন কথা না বলেই রাজি হয়ে যান। আমাদের দুজনের অবশ্য বিয়েতে মত ছিলো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েই গেলো।
ফারিয়া থেমে যেতেই ঈশা হাসি দিয়ে বলল
— যাক ভালই হয়েছে। বন্ধুর সাথে বিয়ে ব্যাপারটা আসলেই অনেক সুন্দর। কত ভালো সম্পর্ক তোমাদের। ভাইয়া নিশ্চয় তোমাকে খুব ভালোবাসে।
ফারিয়া পূর্ণদৃষ্টি মেলে ঈশার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু সরে বলল
— জানি না।
ঈশা বেশ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল
— না জানার তো কিছু নেই। ভাইয়া তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। দেখলেই বোঝা যায়।
ঈশার কথা ফারিয়ার মাথায় বেশ ভালোভাবেই ঢুকলো। অগোছালো মস্তিষ্ক কাঙ্ক্ষিত উত্তর হাতড়াতে লাগলো। কিন্তু কোন শব্দ খুঁজে পেলো না। ঈশা এক আজলা মুড়ি মুখে দিয়েই নিচে তাকাল। ইভান রাস্তার এক পাশে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। ঈশা সেদিকে তাকিয়ে হতাশ শ্বাস ছাড়তেই ফারিয়া গভীর দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিচে ইভানের দিকে তাকাল। ঈশার এমন হতাশ হওয়ার কারণ বুঝতে পারলো সে। চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— খুব ভালোবাসো ইভান ভাইয়াকে?
ঈশা অসহায়ের মত তাকাল। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল
— কতো ভালোবাসি জানি না। কিন্তু এই মানুষটাকেই আমার চাই। কবে যে বুঝবে সে।
ফারিয়া প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল। তার মাথায় বেশ কিছু প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে বেশ অসস্তি হচ্ছে। তারপরেও নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলল
— আমার কেনো জানি মনে হয় তোমাদের দুজনের উপরেই দুজনের অসীম অভিমান জমে আছে। তোমরা দুজনেই কোন কারণে কষ্ট পাচ্ছো। দুজন দুজনকে ভালোবেসেও প্রকাশ করতে পারছ না।
ঈশা মৃদু হাসলো। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে বলল
— আমার কোন অভিমান নেই কিন্তু ভুলটা একটু বেশিই ছিলো। তাই তার অভিমানটা তীব্র। ভুল বুঝে বিশ্বাস না করে অনেক কষ্ট দিয়েছি।
ফারিয়া উদাসীন কণ্ঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল
— যেখানে গভীর ভালোবাসা আছে সেখানে অভিমান অভিযোগ এসব থাকবেই। ভালোবাসা দিয়েই সেসব জয় করে নিতে হয়।
— মানুষটা খুব অভিমানী। এতো সহজে অভিমান কমবে বলে মনে হয়না।
ঈশার হতাশ কণ্ঠ শুনে ফারিয়া ঘুরে তাকাল তার দিকে। মুচকি হেসে বলল
— ভালোবাসার মানুষের কাছে রাগ জেদ কোন কিছুই বেশিক্ষণ টিকে না। কতোদিন আর তোমার উপরে অভিমান করে থাকবে। নিজের মনের কথা তোমার সামনে প্রকাশ করতেই হবে।
ফারিয়ার কথা শুনে ঈশা হেসে উঠলো। বলল
— তুমি ঠিক বলেছো আপু।
—————–
সমস্ত খাবার টেবিলে সাজিয়ে রেখে ফারিয়া ঘরের দিকে তাকাল। জারিফ বেশ জোড়ে সাউন্ড দিয়ে টিভিতে কিছু একটা দেখছে। এখান থেকে ডাকলে শুনতে পাবে না সেটা ভেবেই ঘরের দিকে গেলো। দরজায় দাড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলো। জারিফ গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। ফারিয়া মৃদু স্বরে দুইবার ডাকলো।
— জারিফ। জারিফ।
জারিফ শুনতে পেলো না। তাই ফারিয়া তার কাছে গেলো। ঘাড়ে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল
— শুনছো?
জারিফ শুনতে পেলেও বিশ্বাস করতে পারলো না। ফারিয়ার এমন নরম কণ্ঠ খুব কম সময়েই শুনেছে সে। আর বিয়ের পর শুনেছে কিনা সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। তাই তো বিশ্বাস করতে তার এতো কষ্ট। টিভি বন্ধ করে দিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল
— তুমি কি আমাকে ডাকছিলে?
ফারিয়া বোকার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে অত্যন্ত নরম সরে বলল
— খেতে ডাকছিলাম। খাবে না?
জারিফ ‘ হুম’ বলে ফারিয়ার সাথে চলে গেলো। টেবিলে বসে দুজন খাবার খাচ্ছে নিশ্চুপ হয়ে। কেউ কোন কথা বলছে না। ফারিয়ার মাথায় ঈশার কথাটা ঘোরাফেরা করছে। খাওয়া থামিয়ে দিয়ে জারিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। গম্ভীর সরে বলল
— তুমি কি আমাকে ভালোবাসো জারিফ?
মুখে মাত্র খাবার তুলেছে। ফারিয়ার কথা শুনে গলায় আটকে গেলো। ফারিয়া পানি এগিয়ে দিলো। জারিফ একটু খেয়ে অবাক কণ্ঠে বলল
— কি বললে তুমি?
ফারিয়া স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর সরে বলল
— ভালোবাসো কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম।
— হোয়াট?
জারিফ ভ্রু কুচকে চেচিয়ে উঠলো। ফারিয়া এবার একটু লজ্জা পেলো। না বুঝেই এমন একটা প্রশ্ন করে বসেছে। জারিফ কি ভাবছে কে জানে। চোখের পাতা পিটপিট করে নিজের অসস্তি লুকাবার চেষ্টা করলো। জারিফ এখনো তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। ফারিয়ার মুখে এমন কথা শুনে তার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। অসস্তিকর একটা পরিস্থিতি। দুইজনের কেউই বুঝতে পারছে না কি কথা বলবে। তাই চুপচাপ খাবার শেষ করে যে যার মত ঘরে চলে গেলো। জারিফের মাথায় এখনো ঢুকছে না ফারিয়ার এমন প্রশ্ন করার পিছনে ঠিক কি কারণ থাকতে পারে। মস্তিষ্কে এক গাদা অগোছালো চিন্তা ভাবনা নিয়েই শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করেই ভাবতে লাগলো।
এইদিকে ফারিয়া তার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন কাজ করে রাতে টায়ার্ড হয়ে যায়। সে এতো বেশি কাজ আগে কখনো করেনি। তাই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝরাতে খুটখাট শব্দ পেয়ে ফরিয়ার ঘুম ভেংগে যায়। হুট করে গভীর ঘুম ভেংগে যাওয়ায় প্রচন্ড ভয় পায় সে। পুনরায় কাথা মাথায় পর্যন্ত ঢেকে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু খানিকবাদে আবার ওরকম শব্দে ঘুম ভেংগে যায়। উঠে বসে পড়ে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসে। একা একা আর থাকতে পারেনা ঘরে তাই এক দৌড় দিয়ে জারিফের ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। জারিফ তখন ঘুমে বুদ। ফারিয়া জারিফ কে কয়েকবার ডাকে। কিন্তু কোন সাড়া পায় না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কিন্তু কোনভাবেই ঘরে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারেনা। তাই তার এক পাশেই শুয়ে পড়ে।
সকালে জারিফের ঘুম হালকা হতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল সে। তাকাতেই ফারিয়াকে এভাবে আস্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরে থাকতে দেখে চমকে গেলো। সকাল সকাল এমন একটা পরিস্থিতি দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। আর ফারিয়া তো তার ঘরেই ঘুমাচ্ছিল। এখানে কিভাবে আসলো সেটাই মাথায় ঢুকছে না। জারিফ একটু নড়তেই ফারিয়া নড়েচড়ে আবার ঘুরে ঘুমিয়ে গেলো। জারিফ উঠে বসে ভাবতে লাগলো। কিন্তু মনে হলো এভাবে ভাবতে বসলে তার অফিসে দেরি হয়ে যাবে। তাই পরে ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করবে সে কিভাবে আসলো এখানে। উঠে ওয়াশরুমে গেলো জারিফ। ফ্রেশ হয়ে এসে রেডি হওয়ার প্রস্তুতি নিতেই খেয়াল করলো ফারিয়া বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। পাশে বসে শোনার চেষ্টা করলো। কানে এলো চাপা আর্তনাদ। ফারিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
— ফারিয়া কি হয়েছে?
ফারিয়া জোর করে চোখ মেলে তাকাল। ঘোলাটে দেখতে পাচ্ছে সে। অস্পষ্ট স্বরে বলল
— কষ্ট হচ্ছে। ভীষন কষ্ট।
বলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। জারিফ অস্থির হয়ে পড়লো। হঠাৎ করে কি হলো মেয়েটার। কি করবে বুঝতে পারছে না।
চলবে….