মেঘবতী পর্ব-১২

0
1930

#গল্পঃমেঘবতী
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

প্রিসাঃমা কি হয়েছে?এত শোরগোল কেন?আর এতো প্রিপারেশন কিসের জন্য?

প্রিসার মাঃকারণ আজকে মেহমান আসবে।

প্রিসাঃকোথায়?আমাদের বাসাই?

প্রিসার মাঃনা মেহমান তো তোর চাচীর বাসায় আসবে।

প্রিসাঃতাহলে আমাদের বাসাই এতো শোরগোল কেন?আর কে আসবে?

প্রিসার মাঃআরে আজকে মিলাকে পাএপক্ষ দেখতে আসবে।তোর চাচী একা সবকিছু সামলাতে পারছে না তাই আমি কিছু সাহায্য করছি আর আমাদের এতো প্রিপারেশন নেওয়ার কারণ পাএপক্ষ যদি আমাদের বাসাই আসে,তাই আগে থেকেই সব প্রিপারেশন নিয়ে রাখছি।

প্রিসাঃআপুনি কে পাএপক্ষ দেখতে আসবে তাও আজ।মা তুমি আমার সাথে মজা করছো নাতো?

প্রিসার মাঃএই তোর কি আমাকে দেখে মনে হয় আমি মজা করছি?আর এমনভাব করছিস যেন তুই কিছু জানিস না।

প্রিসাঃআমি আবার কি জানবো?আচ্ছা এসব বাদ দাও এবার এটা বলো পাএপক্ষ আমাদের বাসাই আসবে এটার মানে কি?পাএপক্ষ আমাদের বাসায় কেন আসবে?

প্রিসার মাঃআরে আমরা মিলার চাচা-চাচী তো যদি পাএপক্ষ আমাদের সম্পর্কেও জানতে চাই তখন।তাই আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে রাখা ভালো।এবার তুই যাতো,এসেই একগাদা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিয়েছে।

বলে প্রিসার মা নিজের কাজে চলে গেলো কিন্তু প্রিসা এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

প্রিসাঃএটা কি হলো?আপুনিকে পাএপক্ষ দেখতে আসবে এটা সবাই জানে কিন্তু আমি জানিনা কেন?আপুনি কি জানে?হয়তো আপুনিও জানেনা,জানলে কি আর আমার থেকে লুকাতো।কিন্তু পাএপক্ষ আমাদের বাড়িতে আসতে চাইবে কেন?ধুর,কিছুই বুঝতে পারছি না।যাই একবার আপুনির সাথে দেখা করে আসি।

প্রিসা মিলাদের বাসায় যায় সেখানেও কাজ চলছে।প্রিসা সেদিকে এতো পাত্তা না দিয়ে মিলার রুমে যায়।সারারুমে খুঁজেও প্রিসা মিলাকে পাইনি,যখনি রুম থেকে চলে যাবে তখন কারো কথা বলার শব্দ সে পাই।বুঝতে পারে শব্দটা কোথা থেকে আসছে,প্রিসা নিঃশব্দে পা পেলে বারান্দায় যায়,দেখে মিলা কারো সাথে হেসে এসে কথা বলছে।

প্রিসাঃআপুনি।

মিলাঃকে?(ভীত গলায়)

প্রিসাঃআমি।

মিলাঃও পাখি তুই।ওই আসলে…. আচ্ছা তুই ভেতরে যা আমি আসছি।

প্রিসা ভেতরে চলে আসে কিছুক্ষণ পর মিলাও চলে আসে।মিলাকে দেখেই প্রিসা বলতে শুরু করে—

প্রিসাঃআপুনি তোমাকে বলে আজকে পাএপক্ষ দেখতে আসবে?

প্রিসা ভেবেছিলাম কথাটা শুনে মিলা অবাক হবে কিন্তু প্রিসার ভাবনা পুরোটাই ভুল প্রমানিত হলো।

মিলাঃহুম।(লজ্জা পেয়ে)

প্রিসাঃতুমি আগে থেকেই জানতে?

মিলাঃহুম।

প্রিসাঃতাহলে আমাকে আগে বলোনি কেন?

মিলাঃতুই জানতিস না?

প্রিসাঃনা আমি তো আজকেই জানতে পারলাম।

মিলাঃও আচ্ছা আমি তো ভেবেছিলাম তুই জানতিস তাই আর বলিনি।

প্রিসাঃআচ্ছা আমি আসছি।

প্রিসা চলে যেতে নিলেও আবার ফিরে আসে।

প্রিসাঃআপুনি।

মিলাঃকি কিছু বলবি?

প্রিসাঃআপু কালকে রাতে আমি এসেছিলাম তোমার কাছে কিন্তু তোমাকে দেখিনি।কোথায় ছিলে তুমি?

মিলাঃওই ছাদে ছিলাম।

প্রিসাঃও আচ্ছা।কালকে আমি যখন এসেছিলাম তখন কেউ তোমাকে ফোন করেছিল,’অয়ু’ নামে।কে এই ‘অয়ু’ আপুনি?(না জানার ভান করে)

মিলাঃ ওই ‘অয়ু’ আমার একটা ফ্রেন্ড।পুরো নাম অায়ুশী আমি ওকে অয়ু বলে ডাকি।

প্রিসাঃ(আপুনি তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বললে।কিন্তু কেন?— মনে মনে)ও আচ্ছা।

মিলাঃতুই কি ফোনটা রিসিভ করেছিস?(কিছুটা ভীত গলায়)

প্রিসাঃনা,রিসিভ করার আগেই কেটে গিয়েছে।কেন তুমি দেখোনি?

মিলাঃনা আসলে আমি খেয়াল করিনি।

প্রিসাঃ(দেখবে কেমন করে আমি তো নম্বর ডায়াল লিস্ট থেকে ডিলিট করে দিয়েছিলাম।—- মনে মনে)ও আচ্ছা।আমি আসছি,পরে আবার আসবো।

প্রিসা নিজের রুমে চলে আসে।বিছানায় বসে ভাবতে থাকে কেন মিলা থাকে মিথ্যা কথা বলেছে।প্রিসা সাইড থেকে ফোনটা নিয়ে অয়নকে ফোন দেয় কিন্তু ফোন বিজি,তারপর কি মনে করে যেন মিলাকে ফোন দেয়।হ্যাঁ সে যেটা ভেবেছিল সেটাই মিলার ফোনও বিজি।এতোসবের চিন্তায় প্রিসা মাথাব্যথা করছে,মনে হচ্ছে কেউ যে মাথার উপর ভারী কিছু রেখে দিয়েছে।না খেয়ে আবার শুয়ে পরে প্রিসা,কিছুক্ষণ পর আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় প্রিসা।

বিকেলে,

মিলা আর প্রিসা দুজনের বাড়িতে তোরজোর চলছে।প্রিসা বুঝতে পারছে না তার মা কেন শুধু শুধু তাদের বাড়িতে এতো কিছু করছে।প্রিসা এখন মিলার সাথে তার রুমে বসে আসে।মিলা কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পরেছে সেই সাথে হালকা মেকাপ আর চুলগুলো খোঁপা করা।প্রিসাকেও জোর করেছিল শাড়ি পড়ার জন্য কিন্তু প্রিসা সাফসাফ মানা করে দিয়েছে।তার একটাই প্রশ্ন কেন সে শাড়ি পড়বে?তাকে তো আর দেখতে আসছে না।

প্রিসাঃআপুনি আমার এবার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে।

মিলাঃকিসের…সন্দেহ?(সামান্য ভীত গলায়)

প্রিসাঃআমার কেন যে মনে হচ্ছে তোমার সাথে ওরা আমাকেও পাএপক্ষের সামনে বসাবে।দেখো পাএপক্ষ দেখতে আসবে তোমাকে আর তারা তোমাদের বাসাই আসবে তাহলে আমাদের বাসায় কেন এতো তোড়জোড় আর তোমার সাথে সাথে আমাকেও কেন শাড়ি পড়তে জোর করেছিল?

মিলাঃআরে মেরি বেহেনা,এরকম কিছু না তুই শুধু শুধু শুধু চিন্তা করছিস,রিলেক্স।

প্রিসাঃহুম।

প্রিসা মুখ হুম বললেও কেন যেন তার ভয় ভয় লাগছে,প্রিসা জানে তার বাবা-মা তাকে না জানিয়ে এরকম কাজ করবে না কিন্তু তাও কেন যেন তার ভয় ভয় লাগছে।

কিছুক্ষণ পর পাএপক্ষ এলো।প্রিসার মা আর চাচী মিলাকে নিয়ে গেলো,প্রিসাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু প্রিসা পরে আসবে বলে যায়নি।মিলা যাওয়ার কিছু সময় পর প্রিসাও বাইরে আসে কিন্তু যাদের দেখে তাতে তো প্রিসা অবাক না অনেকটাই অবাক।প্রিসার চোখ একজনের দিকে আটকে যায়,হ্যাঁ সেই ব্যক্তিটি হচ্ছে অয়ন।প্রিসা একদৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকিয়ে আছে।কতদিন পর সে অয়নকে এতোটা কাছ থেকে দেখছে কিন্তু অয়ন তার দিকে একবারের জন্যও তাকাইনি,যেটা দেখে প্রিসার অনেক খারাপ লাগে।অয়নের থেকে চোখ সরিয়ে প্রিসা দেখে এখানে তার মামা-মামী এবং সায়ন-অয়ন ছাড়াও তিনজন ব্যক্তি উপস্থিত আছে।একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা,একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ আর একটা ছেলে,যার বয়স মোটামুটি অয়ন বা সায়নের সমান হবে কিন্তু এদের কাউকে প্রিসা চিনেনা।তাদের কথায় প্রিসা বুঝতে পারলো ছেলেটা নাকি অয়নের বন্ধ সেই সাথে মধ্যবয়স্ক লোকটা নাকি তার মামার বন্ধু।এছাড়াও আরো একটা কথা প্রিসা জানতে পেরেছে মিলাকে যার জন্য দেখতে এসেছে সে আর কেউ না বরং অয়ন,তার থেকেও যে কথাটায় প্রিসা বেশি কষ্ট পেয়েছে সেটা হচ্ছে অয়ন আর মিলা নাকি একে অপরকে আগে থেকেই পছন্দ করতো।এটা কথাটা শুনে প্রিসার চোখ জলে ভিজে যায়।প্রিসা একবার অয়নের দিকে তাকাই কিন্তু অয়ন একেবারে জন্যও প্রিসার দিকে তাকাইনি,এমন ব্যবহার করছে যেন প্রিসা ওখানে নেই।প্রিসার এখন কান্না করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু পারছে না,কোনভাবে সে তার চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করছে।এই বিষয়টা অন্যকেও খেয়াল করুন আর না করুক সায়ন ঠিকই খেয়াল করেছে কারণ প্রিসার নাকটা আস্তে আস্তে লাল হয়ে যাচ্ছে আর সায়ন এটা জানে যে কান্না করলে প্রিসার নাকটা লাল হয়ে যায়।এদিকে,সবার কথাবার্তা শেষ হলে অয়ন আর মিলাকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় কিন্তু সায়ন তার মাঝে বলে উঠে সে নাকি অয়নের সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই,সবাই অবাক হলেও তাদের আলাদা করে কথা বলতে দেয়।

ছাদে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে অয়ন আর সায়ন।

অয়নঃকি হয়েছে?আলাদা করে কথা বলতে চাইলি।যা বলার বাড়ি গিয়েও তো বলতে পারতিস।

সায়নঃনা পারতাম না।আচ্ছা তুই কেন এরকম করছিস?

অয়নঃকি কি রকম করছি?

সায়নঃএইযে একজনে ভালোবাসি বলে অন্যজন কে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিস।

অয়নঃকিসব বলছিস তুই?

সায়নঃআমি যা বলছি ঠিক বলছি।তুই না কিছুদিন আগে তোর মেঘবতীকে ভালোবাসি বলেছিস তাহলে আজকে এসব কি?

অয়নঃতুই কিভাবে জানলি?

সায়নঃওইদিন যখন তুই ওকে ভালোবাসি বলেছিস আমি তখন দরজার বাইরেই ছিলাম।কেন তুই তোর মেঘবতীকে কষ্ট দিচ্ছিস?জানিস মেয়েটা তোর সাথে মিলার বিয়ের কথা শুনে কতটা কষ্ট পেয়েছে।

অয়নঃও আচ্ছা এবার বুঝতে পেরেছি।শুন ব্রো আমি প্রিসাকে কখনোই ভালোবাসিনি ওটা জাস্ট কিছুদিনের মোহ ছিল,আমি তো মিলাকে ভালোবাসি।

সায়নঃকিসব বলছিস তুই এগুলো?মেঘবতী তোর মোহ ছিল?(অবাক হয়ে)

অয়নঃহ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি প্রিসা আমার কিছুদিনের মোহ ছিল আর মিলার আমার সত্যি কারের ভালোবাসা।আর তাছাড়া প্রিসার থেকে মিলা অনেক ভালো।দেখতে শুনতে প্রিসার থেকে মিলা অনেক ভালো আর প্রিসার এখনো ইমমেচিউর কিন্তু আমার মেচিউর কাউকে চাই।

সায়নঃঅয়ন কি বলছিস তুই এসব?তুই মেঘবতীকে এরকম বলতে পারলি।

অয়ন বুঝতে পেরেছে সায়ন রেগে গিয়েছে কারণ তারা রেগে গেলেই একজন অপরজনের নাম ধরে ডাকে।

অয়নঃআমি যা বলছি একদম ঠিক বলছি।

সায়নঃঅয়ন?(কিছুক্ষণ চুপ থেকে)তুই কি খেয়াল করেছিস আমি তোর মেঘবতীকে মেঘবতী বলে ডেকেছি কয়েকবার।তাও তুই কিছু বললি না যে?

অয়নঃএতে বলার কি আছে?তোর যদি নামটা পছন্দ হয় তাহলে তুই প্রিসাকে মেঘবতী বলে ডাক আর ইচ্ছে হলে তুই ওকে বিয়েও করতে পারিস,আমার কোন সমস্যা নেই।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে,

সায়নঃঠিক আছে আমি প্রিসাকে বিয়ে করবো আর আজ থেকে তুই ওকে আর মেঘবতী বলে সম্বোধন করবিনা।

এদিকে সিঁড়ি কাছে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ,সে আর কেউ না প্রিসা।এতক্ষণ সে অয়ন আর সায়নের সব কথা শুনেছে।প্রিসার এটা জেনে কষ্ট হচ্ছে যে সে অয়নের মোহ ছিল,সেই সাথে তাকে মেঘবতী বলে সম্বোধন করার অধিকার সে অন্যকাউকে দিয়ে দিয়েছে।প্রিসা ওখানে থেকে নেমে আসতে থাকে।

সায়নঃঅয়ন তুই এমন কেন করছিস?প্লিজ এসব বন্ধ কর,নয়তো খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।

এরপর আর কোন কথা প্রিসা শুনতে পাইনি।প্রিসা দৌড়ে এসে নিজের রুমে চলে যায়।দরজা বন্ধ করে নিচে বসে পড়ে আর হাঁটুতে মুখ গুজে কান্না করতে থাকে।

প্রিসাঃকেন আমার সাথে এমনটা হলো,কেন?আমি তো ওনার কাছে ভালোবাসার প্রস্তাব নিয়ে যাইনি,উনিই তো এসেছিলেন আর এখন যখন আমি ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছি তখনই উনি বলেন আমি ওনার মোহ ছিলাম।

আরো কিছুক্ষণ কান্না প্রিসা ওয়াশরুমে চলে যায়।মুখ ধুয়ে এসে কিছুক্ষণ বসে তারপর দরজা খুলে মিলাদের বাসাই যায়।প্রিসার মোটেও সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই কিন্তু যেতে তো হবেই না হলে সবাই সন্দেহ করবে।ওখানে গেলে প্রিসাকে তার বাবা-মা বলে সায়ন নাকি তাকে বিয়ে করবে,যেটা শুনে সে মোটেও অবাক হয়নি কারণ সে এটা আগে থেকেই জানতো।প্রিসাও সায়নকে বিয়ে করার জন্য হ্যাঁ বলে দেয় আর অয়নের কথাও কাউকে বলেনি।কারণ বলে কি লাভ ভালোবাসাটাতো এখন একতরফা আর একতরফা ভালোবাসা কখনো পূর্ণতা পাইনা।তার থেকে বরং চুপ থাকাটাই বেটার,এতেই সবার ভালো হবে।

চলবে………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে