#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৬
রাইফের আকস্মিক এমন উদ্ভট কথা শুনে মীরার কান তব্দা খেলো। কস্মিনকালেও ভাবে নি এমন কথা শুনতে হবে তার। ভালো ভেবেছিলো সে কিন্তু লোকটার মাথায় যে সমস্যা আছে আজ পুরোপুরি নিশ্চিত। মনে মনে ভাবলো,’মহাবিপদ তো! এ কার পাল্লায় পরলাম আমি। এমন ভাবে বলছে যেনো মামার বাড়ির আবদার। দেখতে চাইলেই দেখতে দিবে।’ তড়িৎগতিতে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। শুধু কাজল কালো আঁখিদ্বয় দৃশ্যমান। রাগে গজগজ করছে মীরার মাথা। রাইফের স্থির শীতল চাহনি দেখে মেজাজ আরো বিগড়ে গেল।
কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
-‘অসভ্য লোক। সরেন সামনে থেকে।’
রাইফ ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে ধীরে ধীরে মৃদু হাসি স্থান করে নিচ্ছে। বাঁকা কন্ঠে বলল,
-‘ছুঁয়ে দিয়ে টি-শার্ট ছিড়ে দিলে অসভ্যতামী হয় না, আমি একটু দেখতে চাইলেই দোষ!’
-‘অবশ্যই দোষ এবং গুনাহও বটে’।
রাইফ এবার নিবিড় ভাবে দৃষ্টিপাত করল। চাপা কন্ঠে ভরাট গলায় ফিসফিস আওয়াজে বলল,
-‘আমার করে নিয়ে দেখলেও কি গুনাহ হবে?’
মীরা কেঁপে উঠলো। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
-‘মা-মানে!’
-‘মানে অনেক কিছু। শান্তি প্রয়োজন আমার। সাথে তোমার ও শান্তির ঠিকানা হতে চাই।’
মীরার মাথা শূন্য শূন্য লাগছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। নিজেই গমগম করে পাশ কেটে চলে যাবে তখনি রাইফ দ্রুততার সহিত বলল,
-‘বারান্দায় আসো না কেনো মেয়ে, সমস্যা কি? কেউ অপেক্ষা করে তোমার জন্য।’
মীরার পা থেমে গেলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছু ফিরলো। কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-‘আমার মহাভারত অশুদ্ধ হয় বারান্দায় গেলে।’
কথাটা বলেই হনহন করে নিচে চলে গেলো। রাইফ কিছুক্ষণ থ মেরে থাকলো। মিনিট সময় পেরুতেই অট্টহাসি তে ফেটে পরলো সে। যেমন ভেবেছিলো তেমন টাও না। তেজ আছে দেখা যায়। এই তেজটা যেনো বহুগুণ সুন্দর করে তুললো মীরার ব্যাক্তিত্ব।
মীরা দৌড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকেছে। ঘেমে উঠেছে শরীর। খাদিজা বেগম ডাকছে ড্রয়িং রুম থেকে। মীরা আয়নায় তাকালো। ধুকপুক করছে তার হৃদয়। কি বলল লোকটা! আঁখিদ্বয় বন্ধ করে মনে করলো সেই উক্তিটি “আমার করে নিয়ে দেখলেও কি গুনাহ হবে”
বিড়বিড় করে কয়েকবার আওড়ালো সেই কথা। তড়িৎগতিতে চোখ খুলে দুহাত ভরা জল মুখে ঝাপ্টা দিলো। পর পর কয়েকবার। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বাহিরে বেরিয়ে এলো। খাদিজা বেগম এগিয়ে এলেন। বাদামের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-‘নে।’
-‘রাখো।’
-‘যাবি না?’
-‘না। ‘
-‘কেনো?’
-‘ইচ্ছে করছে না।’
-‘কি হলো আবার?’
-ঃমন খারাপ। একটু একা থাকি প্লিজ।’
-‘মন ভালো হলে রুমে আসিস। শুনবো তোর মন খারাপের গল্প।’
-‘ঠিক আছে। ‘
মায়ের মমতা মাখা হাত ছুয়ে দিলো মীরার মাথা। চোখ বন্ধ করে শান্তি টুকু কুড়িয়ে নিলো। পাশ থেকে কাঁথা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে শুয়ে পরলো। যখনি মীরাকে দুঃশ্চিন্তা ঘিরে ধরে তখনি সে চুপ করে শুয়ে পরে।
_______________
রাইফ ছাদে ঢুকতেই বা দিকে উর্মিকে নজরে এলো। কাছাকাছি এসে বলল,
-‘আরেহ উর্মি যে…’
-‘জ্বী ভাইয়া। কেমন আছেন?’
-‘ভালো। এখন একটু বেশি ভালো আলহামদুলিল্লাহ।
তোমার কি খবর? কি করছো?’
-‘আঁচার খাচ্ছি। খাবেন?’
-‘নাহ। তুমি খাও।’
-‘বাদাম আনতেছে মীরা। বাদাম খাইয়েন।’
-‘আর আসবে না।’
-‘কী?’
-‘বাদাম। যাও নীচে যাও।’
-‘কেনো আসবে না?’
-‘মন বলছে।’
সন্দেহর নজরে তাকালো উর্মি। উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
-‘আপনার মন কেনো বলছে আসবে না? আপনার মন সব জানে?’
-‘নাহ, তবে বাদাম আসবে না এটা জানে। বাদামের দেখা আমি আরো ১ সপ্তাহ পাবো না সেটাও জানে। হায় কপাল আমার।’
আফসোস ঠিকরে পরছে রাইফের কন্ঠে। তারপরেও তার মনটা ফুরফুরে লাগছে। অফিসের ব্যাস্ততা শেষে আজ রাইফ বাসাতেই ছিলো। ঘুমিয়েই কাটিয়েছে দিন। বিকেলে বাহিরে একটু ঘুরে আসবে বলে বের হয়ে কি মনে করে নীচে না গিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো। এভাবে যে প্রেয়সীর সাক্ষাৎ লাভ করবে সে এক বিন্দুও আন্দাজ করতে পারে নি।
______________
নৈশভোজ করতে ডাইনিং এ বসেছে সবাই। খাদিজা বেগম কয়েকবার ডেকে এসেছে মেয়েকে। কিন্তু এখনও উঠার নাম নিচ্ছে না মেয়েটা। হঠাৎ কি হলো ভেবে চিন্তার ভাঁজ পরলো কপালে। শওকত রহমান তাকালেন খাদিজা বেগমের পানে। সহধর্মিণীর মলিন মুখ দেখে কিছু ঠাহর করতে পারলেন বোধহয়। ধীরে সুস্থে উঠে মীরার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। টোকা দিয়ে ডাকলেন,
-‘আমার আম্মাজান, ভেতরে আসি?’
মীরা প্রাণপ্রিয় আব্বাজানের ডাক শুনে ধরফর করে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসলো। বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে মাথায় জড়ালো। কন্ঠস্বর উঁচু করে জবাব দিলো,
-‘অবশ্যই আব্বাজান। আসুন আসুন। বাহিরে দাঁড়িয়ে কেনো?’
শওকত রহমান দরজা খুলে ধীর পায়ে মেয়ের কাছাকাছি এলেন। পাশাপাশি বসে মীরার পানে দৃষ্টিআরোপ করলেন। মোলায়েম স্বরে বললেন,
-‘শরীর খারাপ নাকি মন?’
-‘মন।’
মীরার সহজ স্বীকারোক্তি। শওকত রহমান আরেকটু কাছ ঘেষে বসলেন। বললেন,
-‘কি করতে পারি আপনার আম্মাজানের জন্য?’
-‘কিছু করতে হবে না আব্বাজান। এখন ঠিক আছি আমি।’
-‘আলহামদুলিল্লাহ। রাতের খাবার টুকু খাবেন আমার সাথে?’
-‘ফ্রেশ হয়ে আসি?’
-‘অবশ্যই।’
-‘আপনি শুরু করেন। আমি আসছি।’
_________________
সানজিদা বেগম বসে আছেন শওকত রহমানের কক্ষে। খোশমেজাজে গল্প করছে ভাই বোন। উর্মি মামার রুমের বারান্দার গাছগুলো থেকে আগাছা পরিষ্কার করছে। খাদিজা বেগম চা নিয়ে আসলেন। পাশে বসে তিনিও বিভিন্ন বিষয়ের আলাপচারিতায় যুক্ত হলেন। এক পর্যায়ে সানজিদা বেগম বললেন,
-‘মীরার ব্যাপারে এখন কিন্তু চিন্তা করা দরকার ভাইজান।’
কথাটা শুনে খাদিজা বেগম তাকালেন স্বামীর পানে। এই বিষয়টি যে তাকেও অনেক ভাবায়। কম তো চেষ্টা করছে না। কিন্তু কোনো ভাবেই রাজী করানো যাচ্ছে না মেয়েকে। শওকত রহমান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন। অসহায় কন্ঠে বললেন,
-‘কম তো চেষ্টা করলাম না। আমার মেয়েটা যে একেবারেই নাজুক। ‘
-‘এভাবেও তো চলবে না ভাইজান। মেয়ে মানুষ, এক দিন না একদিন পরের ঘরে যেতেই হবে।’
-‘তা তো অবশ্যই। আমার নিজের ও তো কম চিন্তা হয় না। স্বস্তি পাই না আমি।’
-‘যেভাবেই হোক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এবার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। ওর অবস্থা দেখছেন আপনি? সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে।’
চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শওকত রহমান। তিনি খুব ভালো করেই জানেন মীরা ভালো নেই। ওর হৃদয় টা যে খণ্ড-বিখণ্ড। এই খণ্ড বিখণ্ড মেয়েটাকে একটু চাপ দিলেই একেবারে ভেঙ্গে পরবে। বাবা হয়ে এমন টা কিছুতে দেখতে পারবেন না তিনি।
মীরা দ্রুত মুখ চেপে ধরলো। কিছুক্ষণ আগে এসেছিলো সবার সাথে গল্প করতে। দরজায় টোকা দিবে সে মূহুর্তেই কানে আসে ফুপুর বলা কথাটুকু। তখনি থেমে যায় হাত। লুকিয়ে কারো কথা শোনার অভ্যাস নেই কিন্তু কোনো ভাবেই যেনো বাবার উত্তরটা না শুনে ফেরত আসতে পারছিলো না। মীরা চোখ বুজলো। নোনাজল গুলোকে বেরিয়ে না আসার আকুল আবেদন তার চোখে মুখে। হুরমুর করে কান্নারা গলায় হামলে পরেছে। যে কোনো সময় চিৎকার এর সহিত বেড়িয়ে আসবে। ধপা-ধপ আওয়াজ তুলে দৌড়ে গেলো নিজের কক্ষে। দরজা বন্ধ করে বসে পরলো ফ্লোরে। চিৎকার করে ভেতরের আর্তনাদ গুলো বের করে দিতে ইচ্ছা করছে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিজেকে খোলস থেকে বেড়িয়ে আনলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে মানসপটে ভেসে উঠলো বছর তিনেক আগের কথা।
চলবে…..