#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৫
🍁
ছাদের রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে আছে রাইফ। অফিস থেকে বাসায় না গিয়ে সোজা ছাদে চলে এসেছে সে। টানা চার দিন অফিসের কাজে ব্যাস্ত ছিলো। ঘাড় ঘুরানোর সময় বা সুযোগ কিছুই হয় নি তার। আজ কাজ শেষ করে কিছুক্ষণ সময় অবসর পেলো। অফিসেই বেশিরভাগ সময় কাটানোর ফলে এই পাঁচ দিন দেখা হয়নি মীরার সাথে। যেতে আসতে ওই একটু বারান্দায় নজর বুলিয়ে গেছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
মাগরিবের আজান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ভ্যাপসা গরম। শার্টের হাতা কুনুই পর্যন্ত ভাঁজ করে রাখা রাইফের। শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খুলে রেখেছে। এলোমেলো চুল গুলোকে হাতের সাহায্যে গুছিয়ে নিলো। আকাশ পানে তাকিয়ে দেখলো চাঁদ নেই আকাশে। নক্ষত্র রা আজ পুরো আকাশ ছেঁয়ে আছে। আচ্ছা, রাইফ যদি তার পাখি টাকে নক্ষত্র করে বুকে রাখে তাহলে কি সে থাকবে। নাকচ করবে নাকি কোনো জবাব ই দিবে না। লজ্জাবতী পাতার মতো কুঁকড়ে যাবে নাকি লজ্জায় লাল হবে তার গাল! মাথা নিচু করে কি নিরব থাকবে! নাকি দৌড়ে পালাবে। মুচকি হাসলো আপনমনে। সেদিন পালাতে পারলেও আর দিবে না সে পালাতে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলালো। নিজের চিন্তা ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলল।
আপন মনে শুধালো,
“আমার মীরাবতী, আমার লাজুকলতা। একবার কাছে এসো, আমার করে রেখে দিবো মন পিঞ্জিরায়।”
_______________
মীরা কিচেনে বসে খাদিজা বেগমের সাথে টুকটাক কাজ করছে আর গল্প করছে। শওকত রহমান অফিসে গেছেন। ফিরতে বিকাল হবে। বাজারের ব্যাগ থেকে মরিচের প্যাকেট বের করে মরিচ থেকে বোটা আলাদা করছে মীরা। খাদিজা বেগম তেলে মাছ ছাড়লেন। তন্মধ্যে কলিং বেল বেজে উঠলো পর পর দুবার । খাদিজা বেগম পিছু ফিরে তাকালেন। মীরাকে বললেন,
-যা তো মা, দেখ কে এসেছে?
-এই সময় কে আসলো আবার?
-বসে না থেকে গিয়ে দেখ।
মীরা মাথায় ওড়না দিয়ে দরজায় গেলো। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলো বাহিরে সানজিদা বেগম আর উর্মি দাঁড়ানো। দ্রুত দরজার নব ঘুরিয়ে খুলে ফেলল,
ব্যাতিব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
-‘আস সালামু আলাইকুম ফুপুজান। মাফ করবেন, আপনাকে অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করালাম।’
কথাটা বলে মীরা সানজিদা বেগমকে জড়িয়ে ধরল। এর মধ্যেই উর্মি হনহন করে ড্রয়িং রুমে গিয়ে সোফায় বসে পরেছে। সানজিদা বেগম ভাতিজিকে আলিঙ্গন করে ছেড়ে দিলেন। থুতনিতে হাত রেখে বললেন,
-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম মীরা।বেশি অস্থির হওয়ার দরকার নায়। এক মিনিট ও দাঁড়িয়ে ছিলাম না। কেমন আছিস বল?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ফুপু। আসেন আসেন বসেন। ঘেমে গেছেন একেবারে।’
খাদিজা বেগম কিচেন থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেন তাদের। শাড়ির আঁচল কোমড় থেকে বের করে কাঁধে জড়িয়ে ডাইনিং এ আসলেন। সানজিদা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-‘আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো আপা?’
-‘না না, কোনো অসুবিধা হয় নি। কি করছো?’
-‘রান্না করছি আপা। ইলিশ মাছ ভাঁজছি।’
তৎক্ষনাৎ উর্মির চোখ চকচক করে উঠলো। তড়িঘড়ি করে বললো,
-‘আমার জন্য কিন্তু দুই পিস রাখবেন মামি। সাথে কাঁচা মরিচ ও ভাঁজবেন। অনেক মজা করে খাবো।’
-‘তোকে আস্ত মাছ ই ভেজে দিবো। তোরা খেলেই আমার শান্তি।’
-‘ঠিক আছে, তাহলে তাই করো।’
মীরা ট্রে হাতে ডাইনিং এ আসলো। ঠান্ডা শরবতের গ্লাস সানজিদা বেগমের দিকে এগিয়ে পাশে গিয়ে বসলো। ফুপুর কাঁধে মাথা রেখে আবদারের সুরে বলল,
-‘এবার কিন্তু অনেক দিন থাকতে হবে ফুপু। যাওয়ার নাম ও নিবেন না বলে দিলাম। তাহলে আমি অনেক কষ্ট পাবো।’
-‘থাকবো কিছুদিন।’
-‘অনেক অনেক ধন্যবাদ ফুপু।’
উর্মী তাকালো তাদের দিকে। রিমোট হাতে নিয়ে মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘গলা ধরাধরি শেষ হলে আমাকেও এক গ্লাস দে। আমিও এখানে আছি ভাই। গলাটা ফেটে যাচ্ছে।’
-‘এতো খারাপ অবস্থা তোর! তাহলে তো গ্লাসে হবে না। ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতে হবে। যা ফ্রিজে গিয়ে শুয়ে পর। একেবারে রাতে উঠিস।’
-‘মীরুর বাচ্চা…!!’
উর্মি কপট রাগ দেখালে হেসে দিলো সবাই।
____________
থোকা থোকা সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পরেছে। পৃথিবী কিছুটা শীতল এখন। হালকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। উর্মি ফ্রিজ থেকে আঁচারের বয়ম বের করে একটা বাটিতে আঁচার নিলো। রুমে এসে মীরাকে তড়িঘড়ি করে বলতে লাগল,
-‘নে নে, চল। সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তখন আর মামু বের হতে দিবে না।’
-‘কই যাবি?’
-‘তোর মাথায়। ছাদে যাবো চল।’
-‘ছাদে কেনো?’
-‘নাচতে।ঃ
-‘এখানেই নাচ। আমি দেখি।’
-‘তোকে দেখাবো কেনো। ছাদের গিয়ে পুরা এলাকাবাসী কে দেখাবো।’
-‘যেতে পারবো না।’
-‘যাবি না?’
-‘না’
-‘মীরু?’
-‘লাভ নায় রাগ দেখিয়ে। আমি উঠছি না এখান থেকে। হাতে কি? আঁচার? দেখি দে তো।’
-‘খাইতে হলে ছাদে চল।’
-‘খাবোনা।’
উর্মি মীরার হাত ধরে টেনে তুললো। হা হুতাশ করে বলতে লাগলো,
-‘এতো ওজন কেন তোর? পুরাই একটা হাতির বাচ্চা।’
উর্মির কথা শুনে মীরার মুখ হা হয়ে গেলো। বিস্মিত কন্ঠে জবাব দিলো,
-‘আমি হাতি হলে তুই কি! আমার থেকে তোর ওজন দুই কেজি বেশি।’
-‘আমি হাতি, আর তুই হাতির বাচ্চা। হয়েছে? এবার চল না বাপ। রুমে আর কতোক্ষণ থাকা যায় এভাবে।’
মীরা এই কয়দিন একেবারেই বের হয়নি বাসা থেকে। ওর ও দমবন্ধ লাগছে রুমে বসে। মন তো চাচ্ছে ছাদে যেতে কিন্তু আবার যদি লোকটির সাথে দেখা হয় তখন। সাত পাঁচ ভাবলো। নিজেকে বুঝালো হয়তো লোকটা অফিস থেকে ফিরেনি। দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুব ই কম। চেয়ার হতে কালো ওড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে ছাদের দিকে রৌওনা হলো তারা দুজন।
___________
মাথার উপর খোলা আকাশ। মীরা আর উর্মি নীচে পা ভাঁজ করে ছাদে বসেছে। দুজনের মাঝে বাটিতে টক ঝাল মিষ্টি আমের আঁচার রাখা। চামচে নিয়ে একটু একটু করে স্বাদ গ্রহন করছে দুজন। মীরা কিছুক্ষণ কিছু ভাবলো। বলবে না বলবে না করেও স্বাভাবিক কন্ঠে উর্মীকে ডাকলো,
-‘উর্মি?’
চামচে আঁচার নিয়ে মুখে পুরে জবাব দিলো,
-‘হ্যাঁ।’
-‘আমাদের বিল্ডিং এ কি নতুন কোনো ভাড়াটিয়া এসেছে?’
-‘নাহ তো।’
-‘মনে করে দেখ।’
-‘রাজিয়া আন্টিরা আসছে। ওই যে মোজাম্মেল আঙ্গেল রা ছিলো না পাঁচ তলায়। উনারা চলে গেছে।’
-‘ফ্লাট বিক্রি করছে?’
-‘নাহ রে। ফ্লাট তো আন্টিদের ই। মোজাম্মেল আঙ্গেল রা ফুল ফ্যামেলি আমেরিকা চলে গেছে। জোবাইদা আন্টির হাসবেন্ড আর মোজাম্মেল আঙ্গেল আপন ভাই। জাহাঙ্গীর আঙ্গেল আছে না, উনি জোবেদা আন্টির হাসবেন্ড।’
-‘কতো দিন হলো চলে গেছে?’
-‘এই তো সাত আট মাস।’
-‘আগে কখনো দেখিনি উনাদের।’
-‘দেখবি কি করে রে পটল। উনারা আগে ঢাকায় থাকতো। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতো। ময়মনসিংহ আসছে তিন বছর হবে প্রায়। তাও উনাদের অন্য বাসায় ছিলো। এখানে আসছে সাত আট মাস হবে।’
-‘এতো কিছু জানলি কি করে?’
-‘অল্প অল্প জানি। বেশি জানি না। শুধু দুই তিন দিন কথা হইছিলো রাজিয়া আন্টির সাথে। তখনি এসব শুনেছি। উনি আর উনার ছেলে থাকে।’
-‘আর কেউ নায়?’
-‘নাহ। আঙ্গেল নায়। মারা গেছে নাকি কয় বছর হলো।’
-‘ওহ। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুক।’
মীরা চুপ হলো। এতোক্ষণ উর্মী নিজ ধ্যানে খাচ্ছিলো বলে কোনো কিছুতে ধ্যান ছিলো না। যেমন যেমন প্রশ্ন করেছে তেমন ভাবেই সোজা সাপটা উত্তর দিয়েছে।টনক নড়লো উর্মীর, মীরা তো সহজে কারো কথা নিজ থেকে জিজ্ঞাসা করে না। তাহলে! ঘটনার পেছনের কাহিনী জানতে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করল,
-‘তুই এসব জিজ্ঞাসা করছিস কেনো?’
-‘অপরিচিত একজন কে দেখেছিলাম বিল্ডিং এ।’
-‘কাকে?’
-‘একটা ছেলে। রাইফ নাম মেবি।’
-‘ওহ রাইফ ভাইয়া। উনিই তো রাজিয়া আন্টির ছেলে। মাঝে মাঝেই দেখা হয়।’
-‘আচ্ছা?’
-‘হুম। ভালো আছে।’
এই মধ্যেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো মীরার। পাশ থেকে তুলে কানে গুজলো।
-‘আম্মা বলেন।’
-‘বাদাম আনছে তোর আব্বা। এসে নিয়ে যা।’
-‘ঠিক আছে, আসছি।’
ফোন কেটে কোলের উপর রাখলো। মীরা কিছু বলবে
তার আগেই উর্মি ভরভর করে বলল,
-‘আমি যেতে পারবো না। আজ অনেক উঠা নামা করছি। তুই গিয়ে আন।’
মীরা হতাশ হয়ে উর্মির দিকে তাকালো। উর্মি মুখ ভেংচি দিয়ে মাথা নেড়ে চূড়ান্ত ভাবে অসম্মতি জানালো। বাধ্য হয়ে মীরা উঠে দাঁড়ালো। খালি পায়েই ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেলো সিঁড়ির দরজার কাছে। সামনে পা ফেলবে তখনি কারো উপস্থিতি টের পেলো। পাশ কেটে চলে যাওয়ার জন্য ডান দিকে সরে আসতেই সামনের জন ও সেদিকেই এলো। আবার বা দিকে সরে গেলো। এবারও সামনের জন বা পাশে একি ভাবে সরে এলো। বিরক্ত হলো মীরা। মুখ দিয়ে চ কারান্ত শব্দ উচ্চারিত হলো। মনে মনে ভাবল ‘মহাবিপদ তো!’ পরক্ষণে মীরা নিজেই স্থির হলো। নিচ থেকে মাথা তুলে উপরে তাকালো। স্তব্ধ হলো তার মুখাবয়ব। বিস্ময়ে একটু ফাঁকা হলো গোলাপি দুই ঠোঁট। সামনের সুদর্শন পুরুষটি প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি। চোখের পলক পরছে না একটুও। মীরা নজর এদিক সেদিক ঘুরিয়ে পাশ কেটে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাইফ ডান হাত আর ডান পা বাড়িয়ে পথ আটকে দিলো। ধীরে সুস্থে মীরার সামনে বাম পা এনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। রাগ হলো মীরার। এ কেমন বেয়াদবি! কড়া কথা শুনাবে বলে মনস্থির করল। রাইফের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তখনি ভারী গলার গমগমে শীতল কন্ঠ ভেসে এলো,
“-তোমাকে দেখে আমার শান্তি না আসা পর্যন্ত ছাড়ছি না লাজুকলতা। খুব জ্বালিয়েছো এই কয় দিন। স্থির হয়ে দাঁড়াও”
চলবে…