মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০৩

0
606

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩

🍁
সকাল আট টা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট, বিছানায় উপুড় হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রাইফ। মুখের একপাশ দৃশ্যমান। গতরাতে অনেক রাত করে ছাদ থেকে এসেছিলো সে। রাজিয়া বেগম ঘরে আসলেন। মেরুন রঙের পর্দা টেনে সরিয়ে দিলেন। জানালা খুলে ফেলার সাথে সাথেই রুম আলোকিত হয়ে উঠলো। বারান্দার দরজা খুলে দিয়ে তিনি বিছানার কাছে এলেন। রাইফ এর শিয়রে বসে ছেলের মাথায় আঙুল বুলিয়ে মমতা ভরা কন্ঠে ডাকলেন,

-‘রাইফ, আব্বা উঠ। অফিস যেতে হবে না? নয়টা বেজে গেলো তো।’

রাইফ কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠলো। মায়ের দিকে পাশ ফিরে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,

-‘আর পাঁচটা মিনিট ঘুমাই আম্মা। রাতে ঘুম হয় নাই। তুমি একটু মাথাটা বুলিয়ে দাও।’

-‘তোর কি শরীর খারাপ বাজান? ঘুম হয় নি কেনো রাতে?’

-‘তেমন কিছু না আম্মা। রাতে একটা লতাপাতার সাথে ধাক্কা লাগছিল। তার পর থেকেই কেমন আতলাম মা’তলাম ফিল হচ্ছে। খুব কষ্টে চোখে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমাইছি।’

-‘কি বলিস বাবা! কিসের লতাপাতা ছিলো? অনেক পাতায় কিন্তু ভাইরাস থাকে। অসুখ বিসুখ হয় নি তো আবার?’

‘হয়েই গেছে অলরেডি আম্মা। আমিতো নেশা করিনা। তাহলে এমন মা/তাল মা/তাল লেগে কেনো!’
মনের কথা মনে রেখেই রাইফ তার গালে হালকা দাড়িতে হাত বুলাল। রাজিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,

-‘নাম জানি না আম্মা, তবে দেখতে মনোমুগ্ধকর। টোকা দিলেই চুপসে যায় এমন। নাম জানলে তোমাকে জানাবো।’

-‘লজ্জাবতী গাছের কথা বলছিস নাকি?’

-‘লজ্জাবতী!!’

রাইফ এবার চোখ খুললো। মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আবারও চোখ বুজে বালিশে মুখ গুজলো। মায়ের উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বলল,

-‘লজ্জাবতী চুপসে গেলেও এতো সুন্দর কেনো আম্মা, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে!’

-‘হ্যাঁ? কি বললি আব্বা?’

-‘কিছু না আম্মা, তুমি যাও। আমি আসছি।’

___________________

মীরা বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টি তার খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে নীলাভ আকাশে।সিঁড়িতে পরে যাওয়ার ফলে কোমড়ে অতি তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করছে ভোর থেকে। ফজরের আজান শুনে সালাত আদায়ের জন্য যখন উঠবে তখনি কোমড়ের আচমকা ব্যাথার বিষিয়ে গিয়েছিলো মীরার মুখ। রাতে বুঝতে পারেনি এতোটা ব্যাথা সে পেয়েছে৷ বুঝতে পারলে সাথে সাথেই পেইন কিলার খেয়ে নিতো। কাল রাতের ঘটনার পর মনটাকে কিছুতেই স্থির করতে পারছে না। নিজের আহম্মকিতে মিনিটে মিনিটে নিজেই নিজেকে বকা দিচ্ছে। কিভাবে পারলো সে একজন অপরিচিত ব্যাক্তির টি-শার্ট ছিড়ে ফেলতে। কি লজ্জাজনক ব্যাপার স্যাপার। ভাবলো, আর দেখা না হোক অপরিচিত ব্যাক্তিটির সাথে। আর না কোনো কথা হোক।

ডাইনিং এ বসে সকালের নাস্তা করছেন শওকত রহমান। খাদিজা বেগম ডিম পোচ করে টেবিলে রাখলেন। শওকত রহমান মীরার উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লেন,

-‘আম্মাজান, আসেন। খাওয়া শুরু করে দিয়েছি।’

রুমের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,

-‘আসছি আব্বাজান। আপনি বিসমিল্লাহ করেন।’

মীরা খাবার রুমে এলো। কুশলাদি বিনিময় করে শওকত রহমানের পাশের চেয়ারে বসলো। দুটো পাতলা রুটি, সবজি আর ডিম পোচ নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে। ছোট ছোট রুটির টুকরো মুখে পুরে ধীরে ধীরে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে টুকটাক কথা হচ্ছে বাবা-মার সাথে। আবার নিরবতায় ছেঁয়ে যাচ্ছে। খাদিজা বেগম নিরবতা ভাঙ্গলেন। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-‘তোর ফুপু ফোন দিছিলো, তোকে যেতে বলেছে। তোর পছন্দের ঝাল পিঠা বানাইছে নাকি।’

-‘না গেলে হয় না আম্মাজান? ফুপুদের বাসায় অনেক মানুষ। উর্মির চাচা-চাচী’ ফুপুরা সবাই থাকে। আমার সংকোচ লাগে অনেক।’

খাদিজা বেগম স্বামীর পানে তাকালেন। শওকত রহমান তার বেগম কে শান্ত থাকার ইশারা করলেন।
মীরার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম সুরে বললেন,

-‘মানুষদের সাথে মিশিতে হবে তো আম্মাজান। তারা আপনার আপনজন। আপনার ফুপু আপনাকে কতো ভালোবাসে তা কি আপনি জানেন না। আপনি গেলে সানজিদা আনেক খুশি হবে।’

-‘জানি তো। মিশতে চেষ্টা তো করছি আব্বজান। কিন্তু সবাই যেমন খোলামেলা ভাবে মিশে, আমি যে তা পারি না।’

-‘পারবেন ইনশাআল্লাহ। না গেলে আমার ছোট বোন টার মন খারাপ হবে অনেক। খাওয়া টুকু শেষ করেন। আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিসে যাবো।’

-‘ঠিক আছে’
বলে খাওয়াই মনোযোগ দিলো মীরা।

_________________

গুটিগুটি পায়ে পাশের ভবনে ফুপু সানজিদা বেগমের বাসার উদ্দেশ্যে শওকত রহমানের পেছন পেছন হাঁটছে মীরা। পরনে তার শালীন বেশভূষা। মাথায় বরাবরের মতো হালকা গোলাপি রংয়ের ওড়না পেঁচানো। মুখে নীল রংয়ের সার্জিক্যাল মাক্স। ছোট ছোট পা ফেলে এগুচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে সামনের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই নজরে এলো গত রাতের সেই পুরুষটির৷ বাইকে বসে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই। ফুল হাতা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতা তে ফরমাল লুক এ একেবারে পরিপাটি লাগছে। হাতে কালো রংয়ের ঘড়ি জ্বল জ্বল করছে। মীরা শওকত রহমানের পেছনে নিজেকে আড়াল করলো । রাইফ নেমে এগিয়ে এলো। পেছনের মেয়েটিকে চিনতে তার অসুবিধা হলো না একটুও।মুচকি হেসে শওকত রহমান কে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘আস সালামু আলাইকুম চাচা। কেমন আছেন? শরীর ভালো তো?’

-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি রাইফ বাবা। তোমার কি অবস্থা বলো?’

-‘আল্লাহর রহমতে ভালো আছি চাচা। আপনি নাকি সিঁড়ি থেকে পরে গেছিলেন? কোমড় ঠিক আছে তো আপনার?’

কথা টা বলেই রাইফ চোরা চোখে শওকত রহমানের পেছনে লুকানো মীরার দিকে তাকালো। মীরা রাইফের কথা শুনে থ মেরে গেলো৷ সুক্ষ্ণ খোঁচাটা বুঝতে মীরার এক মিনিট ও লাগলো না। লোকটাকে সে যেমন ভেবেছিলো, এখন ঠিক তার উল্টো স্বভাবের বলে মনে হচ্ছে। শওকত রহমান শুধালেন,

-‘না না বাবা। আমার তো কিছু হয় নি। ঠিক আছি আমি।’

-‘ওহ, দাড়োয়ান ব্যাটা কি উল্টা পাল্টা নিউজ দিলো বলেন তো দেখি। তাহলে বোধহয় আশেপাশের কেউ পরেছে। খাওয়া দাওয়া করে না মনে হয় ঠিক মতো বুঝলেন চাচা। নিজের কোমড় ভাঙ্গবে সাথে আশেপাশের মানুষ কেউ চিন্তায় রাখবে।’

রাইফ এর কথা শুনে মীরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো নিচের দিকে। একের পর এক এই লোকটা কে নিয়ে ধারণা পাল্টে যাচ্ছে মূহুর্তেই। শওকত রহমান মাথা নেড়ে বললেন,

-‘হবে হয়তো। অফিস যাচ্ছো?’

-‘জ্বী। চলেন একসাথে যাই। আপনার অফিসের সামনে দিয়েই যাবো।’

-‘না না বাবা, আজ না। মীরা আম্মাজান কে ওর ফুপুর বাসায় রেখে তারপর যাবো।’

রাইফ আরেকবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মীরার দিকে।
চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে মনে মনে আওড়ালো
‘মীরা! লজ্জাবতী মীরা’

মীরা শওকত রহমানের কাছে ঘেষলো। খুবই ধীর কন্ঠে বাবাকে বলল,

-‘আব্বাজান চলেন, দেড়ি হচ্ছে।’

-‘হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি। ভালো থেকো রাইফ। বাসায় এসো।’

-‘ঠিক আছে চাচা। আস সালামু আলাইকুম।’

সালাম ফিরিয়ে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হলেন শওকত রহমান। মীরা এগোবে তখনি রাইফ একটু কাছে এলো তার। মীরা থমকে গেলো। শক্ত পোক্ত দেহের দীর্ঘাকৃতির লোকটি সরাসরি মীরার চোখে তাকিয়ে নে/শাময় ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

-‘কোমড় ভাঙ্গলো একজনের, পেইন হচ্ছে আমার। ঠিক বুকের বা পাশে।

বলেই শো করে অপর দিকে চলে গেলো রাইফ।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে