মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩৪

0
490

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩৪

দিনের মধ্যভাগ। সূর্যরশ্মি লম্বালম্বি ভাবে প্রখর তাপ দিচ্ছে ধরণীতে। আজ একটু দেড়ি করেই ঘুম থেকে ওঠে শাশুড়ীর সাথে নাস্তা করে রাইফ অফিসে চলে যেতেই পুনরায় ঘুমিয়ে পরেছে মীরা। রাইফ যেনো আজ অফিস না যায় সে জন্য অনেক বার বারণ করেছিলো সে। কিন্তু জরুরি অফিসিয়াল কাজ থাকায় ছুটি নেওয়ার সুযোগ হয় নি রাইফের৷ রাতে পেইন কিলার খাওয়ার জন্য অবশ্য রাইফের মাথার পেছনে পাওয়া আঘাত অনেকটায় সেরে উঠেছে, ব্যাথাও কমে গেছে বেশ। জ্বরাক্রান্ত মীরার ও জ্বর কমে গেছে অনেকটা, কিন্তু শরীরে প্রফুল্লতা পাচ্ছে তেমন। ঝিমানো শরীরটা বার বার বিছানা টানছিলো শুধু। সেই যে সকালের নাস্তা শেষে বাবা মায়ের সাথে এক ফোঁকর দেখা করে এসেই ঘুমিয়েছিলো, সজাগ পেলো ভর দুপুরে বিছানার উপর অবহেলায় পরে থাকা মুঠোফোনের কর্কশ আওয়াজ এবং কম্পনে। ঘুমুঘুম চোখ জোড়া দুহাতের উল্টো পিঠের সাহায্যে ডলে ওঠে বসল। মুঠোফোনটা হাতে নিতেই দেখল ঝকঝকে স্কিনে জ্ব’লজ্ব’ল করে ভাসছে ‘Golar Mala’ লেখাটা। উর্মি কল করেছে। সকালেও দিয়েছিলো বেশ কয়েক বার। সে সময় কিছুটা ব্যাস্ত থাকার কারণে রেস্পন্স করা সম্ভব হয়নি মীরার। ফ্রি হয়ে যখন কল দিতে চেয়েছিলো তখন ই রাজ্যের ঘুম নেমেছিলো মীরার চোখে। কল ব্যাক করা সম্ভব হয় নি আর। মুখাবয়বের দুপাশ বেয়ে বুকের উপর ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে নিয়ে বৃদ্ধাংগুলির সাহায্যে মীরা কল রিসিভ করতে দেড়ি, অপর প্রান্ত হতে হুরমুর করে উর্মির ঝাঁঝালো কন্ঠ ভেসে আসতে দেড়ি হয় নি। ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলছে,

-‘দুই সপ্তাহ হয় নি বিয়ে হইছে তাতেই বড়লোক হয়ে গেছিস তাই না? এতো বার করে কল দেই, রিসিভ করিস না।’

-‘ব্যাস্ত ছিলাম রে। যখন ফ্রি হলাম তখন আবারও ঘুমাই গেছিলাম।’

মীরার কথার সূত্র ধরেই উর্মির প্রশ্ন,

-‘কেন? রাতে ঘুমাস নি? গরু চুরি করছিস নাকি জামাই আদর খাইছিস?’

উর্মির ঠেস দিয়ে বলা প্রশ্নতে মীরার শরীর শিরশির করে উঠলো। সয়ংক্রিয় ভাবে তার বাম হাত টা ঘাড়ে চলে গেলো। দু ঠোঁটের মাধ্যমে লোকটা যে গতরাতে বেশ জ্বালিয়েছিলো তাকে, আধিপত্য বিস্তার করেছিলো সমগ্র ঘাড় জুড়ে। রাইফের এমন কার্যকলাপ মনসপটে ভেসে উঠতেই মীরার ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ প্রসস্থ হলো, লজ্জা মিশ্রিত মুচকি হাসি ফুটে ওঠল ঘুম কাতুরে মায়াবী মুখশ্রী তে। আন্দাজে ঢিল মারা প্রশ্ন যে জায়গা মতো পরেছে সেটা উর্মি নিজে না জানলেও মীরা ঠিক ই জানে। বুদ্ধিদীপ্ত মীরা কিছুটা কৌশলের সহিত এমন ভাবে উত্তর দিলো ‘জামাই এর আদর।’ যে উর্মি সত্য কিনা মিথ্যা ধরতে পারল না। শুধু আফসোসের কন্ঠে বলল,

-‘তোর ই সময় মীরু, এসব আর বলিস না। না না, ভুলেও না। জামাই পাইছস, আদর ও পাইছস। আমার আর কে আছে বল?’

-‘ তোর জন্য দারোয়ান ব্যাটা আছে তো।’

চেতে গেলো উর্মি। যাকে সে যমের মতো ভয় পায় তার কথা বলেই খোঁচা দিচ্ছে। পাইছে টা কি মীরা? ঈষৎ রাগ প্রকাশ করে ধমকের স্বরে বলল উর্মি,

-‘ফালতু কথা বলবি না মীরু। রাইফ ভাই এর সাথে থাকতে থাকতে আজকাল তুই ও কেমন উল্টা পাল্টা বলিস। আমার জন মনে হয় সুইজারল্যান্ড আছে বুঝছিস। হেঁটে হেঁটে আসতেছে তাই সময় লাগছে।’

উর্মির অযৌক্তিক কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো মীরা। জামাই তার সুইজারল্যান্ড থাকে, কিন্তু আসছে হেঁটে হেঁটে! বাহ! কি মারাত্নক যুক্তি! না না, অসম্ভব। এটা যুক্তি হতেই পারে না। বলা যায় কি সুন্দর অযুক্তি।
তবে যুক্তিতর্ক আর করলো না মীরা, তাল মেলালো উর্মির কথায়। মিটিমিটি হাস্যজ্বল মুখে জিজ্ঞাসা করল,

-‘আকাশ দিয়ে হেঁটে আসছে নাকি পাতাল দিয়ে?’

-‘যেদিক দিয়েই আসুক, আসতেছে তো মেহেদী পায়ে দিয়ে কচ্ছপের গতীতে। আমার কি! আমার লাভ ও নাই, লস ও নাই। সে নিজেই এসে বউ টাকে বুড়ি অবস্থায় পাবে। ঠকবে তো ব্যাটা নিজেই।’

-‘হুম ভালোই হবে। এসেই লাঠিতে ভর দিয়ে চলা উর্মির গলার মালা হয়ে ঝুলে পরবে। তাই না গলা, উপস সরি, উর্মিমালা?

নাম নিয়ে মীরার সুক্ষ্ণ খোঁচা উর্মির বুঝতে সময় লাগলো না। এতো বছর এক সাথে ছোট থেকে বড় হয়েছে কিন্তু সুযোগ পেলেই মীরা গলার মালা ডাকতে ভুলে না তাকে। উর্মির সাথে না হয় মালা মিলিয়ে উর্মিমালা ডাকা যায়, কিন্তু গলার মালা না ছালা এসব আবার কি! যদিও সে জানে মীরা তাকে আদর করে সবসময় না ডাকলেও জমজমাট কথোপকথনে ‘গলার মালা’ বলে সম্বোধন করে তবুও মুখ কিছুটা গোমড়া করে থাকলো সে। কথায় বলবে না আজ। নিরবতা ভেঙ্গে ডেকে উঠলো মীরা,

-‘কিরে? রেগে গেলি?’

-‘হ্যাঁ।’

-‘আরেকটু রাগাই।’

-‘রাগা।’

-‘তোর বর খুঁজতে আজ আমিও সুইজারল্যান্ড এর উদ্দেশ্যে বের হবো বুঝছিস। কচ্ছপের গতীতে না রে, যাবো তো আমি খরগোশের গতিতে।’

কথা চলমান অবস্থাতেই বড় একটা হাই উঠলো মীরার। মুখের উপর বা হাতের উল্টো পিঠ রেখে হাই তোলা অবস্থাতেই বলল,

-‘মাঝ রস্তায় ঘুমিয়ে গেলে ডেকে তুলিস। ঠিক আছে?’

-‘না ঠিক নাই। ভাল্লাগে না। তুই এখনি ঘুমা।’

-‘আচ্ছা।’

নিরব হলো দুজন ই। কারো মুখ থেকেই কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। মূলত মীরার খোঁজ নিতেই কল করেছিলো উর্মি। কিন্তু এক কথা, দু কথা থেকে কতো কথা হয়ে গেলো, অথচ আসল কথা জিজ্ঞাসা করতেই ভুলে গিয়েছে সে। মোলায়েম কন্ঠে উর্মি শুধালো,

-‘এখন তোর শরীর কেমন মীরু? মামির কাছে শুনেছি রাতের ঘটনা। আল্লাহ, আমি শুনেই খুব ভয় পাইছি।’

-‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। আল্লাহ বাঁচাইছে রে। এমন ভাবে ট্রাকটা আমাদের দিকে আসতেছিলো, ত্রিশ সেকেন্ড দেড়ি হলেই আজ হয়তো আমাদের লা/শ পরে থাকতো। উনি যদি আমাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পরতো, এতোক্ষণে হয়তো.. ‘

কন্ঠ কেঁপে উঠলো, গলা ধরে গেলো মীরার। বাকি টুকু বলতে চেয়েও আর বলতে পারলো না। দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার মতো চিরন্তন সত্য আমরা জানলেও এই দুই দিনের দুনিয়ার মায়া কেউ ই কাটাতে পারি না সহজে। মীরাও তার ব্যাতিক্রম নয়। নিজের মৃত্যুর সাথে সঙ্গীর মৃ/ত্যুর ভয় সেই যে কোমল হৃদ যন্ত্রটাতে জেঁকে বসেছে, এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারে নি সে।

_________________

পড়ন্ত বিকেল। রাজিয়া বেগমের নরম বিছানায় বসে শুকনো কাপড় চোপড় সাবধানতা অবলম্বন করে ক্ষত হাতেই ধীরে ধীরে ভাঁজ করছে মীরা। পাশেই রাজিয়া বেগম খোশগল্প জুড়ে দিয়েছেন পুত্রবধূর সহিত। কতো রকমের গল্প যে উনি করছেন তার হদিস নেই। কখনও উনার বিয়ের গল্প তো কখনও ছেলের জন্মের গল্প। কখনও নিজের শৈশবের গল্প তো কখনও কৈশরের। এই তো কিছুক্ষণ আগেই নিজের সুন্দর সংসারের মিষ্টি মিষ্টি ঘটনা গুলো হাসি মুখে শুরু করলেও শেষ টা এখন বিষাদের দিকে গড়াচ্ছে। স্বামীর সুমধুর স্মৃতিচারণ যে ধীরে ধীরে স্বামীর শূন্যতা গ্রাস করবে উনাকে, বেদনাদায়ক করে তুলবে তার ভেতরটা বুঝতেই পারছেন না তিনি। মীরা আজ আর নিরব শ্রোতা নয়। সে নিজেও ভীষণ আগ্রহের সহিত নিজে থেকে দুই একটা প্রশ্ন করছে। জানার আগ্রহ বাড়ছে রাইফের শৈশব থেকে শুরু করে শশুড়ের অন্তিম বিদায়ের কাহিনীও।
সদর দরজায় পরপর দুবার টোকা পরতেই অগ্যাত মীরা পিছু ফিরল। কাপড় গুলো এক দিকে সরিয়ে রেখেই ছুটলো দোর খোলার উদ্দেশ্য। দ্রুতপদে ছুটে যাওয়া মীরার কপালে কিছুটা চিন্তার সুক্ষ্ণ ভাঁজ লক্ষনীয়। সবে তিনটা পঞ্চাশ বাজে, এতো দ্রুত তো উনার আসার কথা নয়। তবে? এ’কদিনের মাঝেই মীরা দরজার উপর টোকা দেওয়ার ধরণ শুনেই বুঝে যায় রাইফের আগমন। লোকটা সবসময় পরপর দুবার কিছুটা তাল মিলিয়ে টোকা দেয় যা সবার থেকে কিছুটা ইউনিক হয়, অন্যদের থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। চিহ্নিত করা যায় রাইফের আগমন।
নব ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো চৌকস চেহারার অধিকারী সেই পরিচিত মুখ। ক্লান্তিপূর্ণ মুখটাতে মীরাকে দেখা মাত্রই ফুটে তুলেছে মুচকি হাসি। রাইফের হাসিতে মীরা নিজেও ফেরত দিলো সুন্দর মিষ্টি হাসি। সামনে থেকে সরে গিয়ে স্বামীকে ভেতরে আসার জায়গা করে দিলো মীরা। রাইফ জুতা খুলে প্রবেশ করতে করতেই মীরার শরীর এবং মায়ের খোঁজটুকু জেনে নিলো। দরজা লাগিয়ে রাইফের পিছু পিছু হাঁটতে থাকা মীরার মনে খচখচ করা প্রশ্নটা করেই বসল সে। ধীর কন্ঠে শুধালো,

-‘আজ এতো দ্রুত আসলেন?’

চলমান রাইফ পিছু ফিরে এক পলক তাকালো মীরার দিকে। রুমে ঢুকে ফোন, ওয়ালেট এবং বাইকের চাবিটা ছোট টেবিলটাতে রেখেই বিছানায় বসল। গায়ে আঁটসাঁট ভাবে জড়িয়ে থাকা ধূসর রংয়ের শার্টটার উপরের দু বোতাম খুলে দিয়ে পরখ করল মীরাকে। আসল কথা বলতে গিয়েও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মীরার উৎসুক মুখটা দেখে আর সোজা-সাপটা কথাটা বলা হলো না রাইফের। দুষ্টুমি মাখা স্বরে বাঁকা কথাটা বলেই ফেললো,

-‘বউ ছাড়া মন টিকে না।’

আহাম্মক বনে গেলো মীরা। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো রাইফের উল্টো জবাব দেওয়ার অভ্যাসটা। তবে আজ আর তাল মিলালো না। উত্তরটা জানার উদ্দেশ্য শান্ত কন্ঠেই বলল,

-‘ঠাড্ডা করবেন না তো। এতো দ্রুত কেনো আসলেন সেটা বলেন?’

-‘বাসায় আসবো না?’

-‘আসবেন। কিন্তু,’

-‘কিন্তুটা তুমি মীরাবতী। বাড়িতে বউ রেখে অফিসে মন টেকানো মেরে লিয়ে না মুমকিন হ্যাঁ। সামঝি?’

বুঝেও মীরার অবুঝ উত্তর,

-‘নেহি, মুঝে সামাঝ নেহি আয়া।’

রাইফের মৃদ্যু হাসিটা মীরার উত্তর শুনে প্রসস্থ হলো বেশ এবং ধীরে ধীরে অট্টহাসিতে রূপ নিলো। নিজেই হিন্দিতে উত্তর দিয়ে আবার বলছে সামাঝ নেহি আয়া। স্মার্ট, ভেরি স্মার্ট।কোনো রকমে হাসি থামিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করতে বিপরীত পাশে চলে যাওয়া মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল রাইফ,

-‘বোঝো নি যখন তখন সামনে আসো, কাছে বসো। দুই একটা চুমুটুমু খাই। আঘাত পেয়ে হ্যাং হয়ে যাওয়া মাথাটা আমার ও খুলে যাক, তোমার ও ব্যাথা কমুক।’

রাইফের এমন খোলামেলা কথায় ফ্যানের সুইচ অন করতে থাকা মীরার হাত থেমে গেলো, কান গরম হলো অস্বাভাবিক ভাবে। এই লোক শোধরানোর না। এখন কথা বাড়ানো মানেই রাইফের ইঙ্গিত পূর্ণ কথাতে আরো লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পরা। দ্রুত সুইট টা অন করেই নিজেকে আড়াল করতে দ্রুতপদে ছুটলো রুম হতে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাইফ এবারও রেহাই দিলো না তার লাজুকলতাকে। কন্ঠটা কিঞ্চিৎ উঁচু করে গমগম আওয়াজ তুলে বলল,

-‘এভাবে লজ্জা পেয়ো না লাজুকলতা। মারাত্নক সুন্দর লাগে, ভীষণ মিষ্টি লাগে। আহ্ হা! মনটা শুধু বউ বউ করে। না জানি হুট করে কেউ ভরা মজলিসে বউ পা’গলা ডেকে বসে।’

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে