মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩০+৩১

0
560

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩০

🍁
জায়নামাজে বসে অঝরে অশ্রু বর্ষণ করছে মীরা। মিনিটের পর মিনিট অতিবাহিত হচ্ছে, এক ভাবেই বসে আছে সে। আজ তার কোমল হৃদয়টা বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেছে। বিষাদের আনাগোনা তার মনিকোঠায়। দেখতে দেখতে গত হলো চারটি বছর, মীরাকে একা করে নূর জাহান বেগমের গত হওয়ার চার চারটি বছর। নিঃসঙ্গ মীরার সঙ্গী হয়েছে এখন কিন্তু দুচোখ ভরে যার দেখার কথা ছিলো সেই নেই।
মীরার কান্নায় ফুলে ফেঁপে ওঠা র’ক্তিম লাল চোখ দুটো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে জায়নামাজের উপর। নিরবে অশ্রুপাত করার আকুল চেষ্টা করছে মীরা, কিন্তু বারবার ঝড়ের বেগে দলা পাকিয়ে চিৎকার করে বেরিয়ে আসছে কান্না গুলো। অবাধ্য কান্নাকে দমন করার ব্যার্থ প্রচেষ্টা রত মীরার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, গুঙিয়ে কেঁদে উঠছে মাঝে মাঝেই।
আজকের দিনে ভঙ্গুর হৃদয়ের মীরার খুব ইচ্ছে করছে দাদীজানের সান্দিধ্য পেতে। তাকে না ছুঁতে পেলো, তাকে জড়িয়ে রাখা সোদা মাটির ঘ্রাণ নিতে হৃদয়টা ভীষণ রকমের ব্যাকুল হয়ে আছে তার। চোখ মুছে পাশের টেবিল থেকে মুঠোফোন টা হাতে নিলো মীরা। কল লিস্টের দ্বিতীয় নাম্বার টাতে ডায়াল করলো সে। পরপর তিনবার রিং হতেই রিসিভ হলো। রাইফের কন্ঠস্বর শোনা গেলো কানে ধরে রাখা মুঠোফোন টায়। উৎকন্ঠিত কন্ঠে রাইফ বলছে,

-‘কি ব্যাপার আজ! আমার মহারানীর তলব পরেছে যে? কোনো সমস্যা মীরা?’

ছোট একটা ঢোক গিলে ভেজা গলায় বলল মীরা,

-‘না, সমস্যা না। আমি একটু বাহিরে যাবো। দাদীজানকে মনে পরছে খুব। যাই?’

-‘একা যাবা? আমি আসি?’

-‘না না। আপনার কষ্ট করে আসতে হবে না। উর্মিকে সাথে নিয়ে যাবো আমি।’

রাইফ হাত ঘড়িতে চোখ বুলাল। সময় দুইটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। সূর্য এখনও প্রখর তাপ দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল রাইফ,

-‘একটু পর বের হও মীরা। এখন বাহিরে অনেক রোদ। চারটা বা সাড়ে চারটা নাগাদ বের হবা কেমন? আর শোনো, আমি আসবো তোমাকে নিতে। ফোন কাছেই রেখো।’

-‘ঠিক আছে।’

মীরা ছোট্ট জবাবের পর ই নিরব হলো ফোনের দুই প্রান্তের মানুষ দুটো। কোনো সাড়াশব্দ নেই দুজনের মুখেই। রাইফ ইচ্ছা করেই কথা বলছে না এখন। সারাদিন তো নিজেই বকবক করে, এবার তার মহারানীর মুখ থেকে কিছু শুনতে ইচ্ছা করছে। মীরার ধারণা ছিলো রাইফ ই কিছু বলবে এখন। কিন্তু যখন তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, তখন নীরবতা ভাঙ্গলো সে নিজেই।

-‘শুনছেন?’

-‘বলেন, শোনার জন্যই বসে আছি।’

রাইফের গলায় ঠাড্ডার সুর। মীরা ছোট করে প্রশ্ন করল,

-‘খেয়েছেন?’

-‘হুম।’

মীরার কিঞ্চিৎ রাগ হলো রাইফের জবাবে। সবসময় তো কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসে থাকে, আর আজ হু হা বলে কে’টে পরছে। কথায় বলছে না। এমনি তেই মীরার মন খারাপ, তার উপর হু হা। ভালো লাগে না, এভাবে কি এক তরফা কথা বলা যায় নাকি? ধৈর্য হারা হয়ে মীরা নিজেই শুধালো,

-‘আপনি কি ব্যাস্ত?’

পিঠ টান টান করে বসে একটানা কাজ করা রাইফ আরাম করে হেলান দিলো চেয়ারে। লম্বা একটা হাই তুলে বলল,

-‘ব্যাস্ত হতে চাচ্ছিলাম। আমার মহারানীর কথা শুনে ব্যাস্ত হওয়ার শখ জেগেছিল খুব কিন্তু সে আর হলো না। আম্মা কি করে?

-‘ঘুমাচ্ছে।’

-‘তুমিও বিশ্রাম নাও একটু। সাবধানে এসো।’

-‘ঠিক আছে। রাখি?’

-‘রাখো।’

_____________

পড়ন্ত বিকেলে আসরের সালাত আদায় করেই বেড়িয়ে পরেছে মীরা এবং উর্মি। রিক্সা দিয়ে এসে মূল গন্তব্যের একটু আগেই নেমে পরেছে দুজন। ব্যাস্ততম শহরে দুজন পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে চায় কিছুক্ষণ। পাঁচমিনিটের পথ অতিক্রম করে কবর স্থানের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করল দুজন। দুরন্ত স্বভাবের উর্মিও আজ ঝিমিয়ে গেছে, মীরার মতো নেতিয়ে পরেছে মন। মীরার হাত টা ধরে ইট বাঁধা সরু পথটা দিয়ে সামনে এগিয়ে ডান দিকে বাঁধায় করা তিনটা কবরের পরের কবরেই এসে পা থামলো দুজনের। দাদীজানের মাথার কাছেই চুপটি করে দাঁড়ালো মীরা। কোনো রা নেই দুজনের মুখে। নিরবে টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বর্ষণ করছে মীরা, থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠলো উর্মি। কি নিদারুণ যন্ত্রণা, কি নিষ্ঠুর বেদনাদায়ক অনুভূতি!
পাতলা ঠোঁট নাড়িয়ে বিরবির করে সূরা তেলওয়াত করছে মীরা। ভেজা নয়নে সময় অতিবাহিত হলো অনেক ক্ষণ। সবুজ ঘাসে বসে আছে উর্মি কিন্তু মীরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে।

পেছন থেকে রাইফের আওয়াজ শোনা মাত্র চমকিত হলো মীরা। চকিত দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালো তৎক্ষনাৎ। সাদা ফরমাল শার্ট, কালো প্যান্ট এর পরিপাটি বেশভূষা রাইফের যে কারো নজর কাড়তে সক্ষম।
স্বামীর পানে ভেজা নয়নে এক পলক তাকিয়ে মুখটা আড়াল করে নিলো মীরা। চুপিসারে চোখের জল মুছে ফেলল, দু ঠোঁট হালকা গোলাকৃতি করে ছেড়ে দিলো ভেতরে জমে থাকা হাহাকার ভর্তি চাপা দীর্ঘশ্বাস।
উর্মি উঠে দাঁড়ালো রাইফ কে দেখে। রাইফের চোখে চোখ পরতেই বেদনা ভরা মুখটাতে ফুটিয়ে তুলল কিঞ্চিৎ হাসি। চোখে চোখে কথা হলো উর্মি এবং রাইফের। উর্মির কাছ থেকে রাইফ যা জানতে পারলো তার সারমর্ম ‘মীরার অবস্থা ভালো না। সরানো যাচ্ছে না এখান থেকে। কেঁদে কুঁদে একাকার অবস্থা। এবার আপনি সামলান।’
রাইফ মীরাকে ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে। চোখের কোল বেয়ে পরা অশ্রুটুকু স্বান্তনা দেওয়া হাতের অভাবে শুকিয়ে গেছে, দাগ হয়ে আছে ফর্সা গালে। মীরার লালচে হয়ে আসা গাল দুটোই হাত রাখল রাইফ। শুকনো দাগ টাতেই বৃদ্ধাংগুল ছোঁয়ালো, আলতো করে মুছে দিলো অশ্রুপাতের শেষ চিহ্ন টুকু।
রাইফের ভরসার হাত টা মীরার হাত টেনে নিলো নিজের দিকে। সামনে পা আগাতে আগাতে মীরাকে ইশারা করলো তার সাথে পা মেলানোর। বোনের ভরসার হাতটা টেনে নিলো উর্মিকে। তিন জোড়া পা চলল একই পদক্রমে। দুজনের মনে নানী এবং দাদীজানকে হারানোর শোক তো অপর জনের মনে শুকরিয়া। মীরাকে নিজের করে পাওয়ার শুকরিয়া। এক সাথে চলা তিন জোড়া পায়ের এক জোড়া পা হঠাৎ কিছুটা ধীর হলো। এপর্যায়ে এসে বাম দিকের কোণায় সাদা রঙের কবরটাতে নজর রাখল রাইফ। পিতার শূন্যতা অনুভব হলো, চাপা কষ্টে র/ক্তক্ষ/রণ হলো শক্তপোক্ত বুকের বা পাশটাতে।

____________

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে মীরা, উর্মি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না পায়ের ব্যাথায়। হেলান দিয়েছে স্ট্যান্ড করে রাখা রাইফের বাইকে।
সামনের দোকান থেকে ফার্স্টফুড পার্সেল করা প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে মীরাদের কাছে এসে দাঁড়ালো রাইফ। পার্সেল টা উর্মির হাতে দিয়েই হাঁক ছাড়ল রিক্সার জন্য। হাত উঁচিয়ে ডাকলো একজন অর্ধবয়স্ক ব্যাক্তিকে যিনি পরিবারের মুখে হাসি ফোঁটাতে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিক্সার প্যাডেল ঘোরান জীবীকার তাগিদে৷
অর্ধবয়স্ক লোকটি কাছে আসলে বাসার এড্রেস বলল রাইফ। রিক্সাওয়ালা ব্যাক্তিটি এক গাল হেসে দিলেন, বললেন সেদিকে যেতে ইচ্ছুক তিনি।
ধৈর্য হারা উর্মি পায়ের ব্যাথায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তড়িঘড়ি করে এক প্রকার লাফ দিয়েই রিক্সায় উঠে গেলো, বসে পরলো এক পাশে মীরার জন্য জায়গা রেখে। রাইফের পাশেই এক হাত পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মীরা স্বভাব বশত মাথায় পেঁচানো ওড়নাটা শুধু শুধু টানলো একটু। রিক্সায় ওঠার জন্য দু কদম এগিয়ে গিয়ে রাইফ কে অতিক্রম করবে এমন সময় মীরার হাত রাইফের হাতে ব’ন্দী হলো, টান পরলো কোমল হাতে। প্রশ্নত্নাক দৃষ্টিতে পিছু ফিরল মীরা। রাইফ মীরাকে এক পলক দেখে সামনে চোখ রাখল। উর্মিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘আমাদের ফিরতে দেড়ি হবে শালিকা। তোমার বোনটাকে নিয়ে একটু ঘুরবো। তুমি পৌঁছে একট কল দিবা ঠিক আছে? যাও।’

পা ব্যাথায় জর্জরিত উর্মির মুখে ফুটল দুষ্ট হাসি। রাইফ আজ উর্মিকে শালিকা সম্বোধন করছে। যেখানে ছেলে মেয়ে সমান অধিকার, সেখানে উর্মি কেনো পিছিয়ে থাকবে! ঠোঁট চেপে মুচকি হেসে বলল উর্মি,

-‘আপনাদের ই সময় দুলাভাই। কাবাবের হাড্ডি হাড্ডি ফিল নিতে চাচ্ছি না আজ। দোয়া করিস মীরু, বাসায় পৌঁছানোর আগেই যেনো একটা আশিক মিলে যায়, দেওয়ানা হয়ে যায় আমার প্রেমে।’

🔳

গোধূলি লগ্ন। পশ্চিমাকাশে ঢলে পরা গোলাকার র’ক্তি’ম সূর্য টার তেজ এখন নেই বললেই চলে। শহর কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হতে শুরু করেছে।
মীরার ধরে রাখা হাত টা টেনে বাইকের সামনে এনে দাঁড় করালো রাইফ। এতো ক্ষণ মনের মাঝে চেপে রাখা প্রশ্নটা করেই ফেলল মীরা,

-‘কোথাও যাবেন?’

-‘হুম, ঘুরে আসি চলো। ভালো লাগবে তোমার। আচ্ছা প্রিয় কোনো জায়গা আছে তোমার? কোথায় যেতে চাও বলো?’

পর পর প্রশ্ন করা রাইফের প্রস্তাব মীরার ভালো লাগলো। বিষন্ন মনটা যদি একটু ভালো হয় এই সুযোগে। এই শহরের কোলাহল থেকে দূর থেকে দূরান্তর যেতে চায় মীরা। ধীর কন্ঠে স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিলো সে,

-‘যে দিকে চোখ যায়।’

রাইফ এর স্বাভাবিক চেহারায় ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। ব্যাস্ত নগরীর ব্যাস্ত সব কিছু। কেও ই দেখার জন্য কিংবা তাদের আলাপচারিতা শোনার জন্য থেমে নেই। তারপরেও পুরুষালী কন্ঠটা যতো টুকু সম্ভব খাঁদে নামালো রাইফ। ভরাট কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল,

-‘আমার মন তো শুধু তোমাকেই চায়। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়াতে চায়, দু চোখ ভরে দেখতে চায়।’

চলবে…

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩১

উর্মি বাসায় পৌঁছেছে মিনিট পাঁচেক আগে। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়েই রাইফের দেওয়া খাবারের পার্সেল নিয়ে বসেছে বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর। এক হাতে তার বার্গার তো অন্য হাতে পিজ্জার টুকরো। দুটোতেই সমান তালে কামড় বসিয়ে দন্তপাটি তে পিষ্ট করে গলাধঃকরণ করছে সে, মাঝে মাঝেই অমৃত স্বাদ নিচ্ছে চোখ বন্ধ করে। খাবারের স্বাদ কে আরো দ্বিগুণ করে তুলতে দু হাতের কব্জির সাহায্যে কোল্ড ড্রিংকস এর ক্যান তুলে চুমুক দিচ্ছে থেমে থেমে।
বার্গারে মাত্র বড়সড় আরেকটা কামড় বসানোর জন্য মুখ হা করতেই মায়ের উচ্চ আওয়াজের ডাক কানে আসলো উর্মির, বিরক্তির ভাঁজ ফুটে ওঠলো কপালে। এমনিতেই তার মন মেজাজ খারাপ, তার উপর মায়ের ডাকা ডাকি। শান্তি নেই একটুও।
অবশ্য মেজাজ খারাপের ও যথেষ্ট কারণ আছে তার কাছে। বাসায় ফেরার সময় উর্মি আজ আশেপাশে নজর রেখেই আসতেছিলো এই ভেবে যে, যদি কেউ তার দিকে প্রেমের ইশারা টিশারা দেয়। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি দিয়ে কোথায় থেকে যেনো হুট করে আগমন হলো তার শ্রদ্ধেয় পিতার। রিক্সা থামিয়ে দুই দুইটা বাজারের ব্যাগ রিক্সায় দিয়ে বলেছিলো বাসায় নিয়ে যেতে, তার দেড়ি হবে ফিরতে। দুঃখে, কষ্টে মাঝ রাস্তায় অল্পের জন্য কেঁদে দেয় নি উর্মি। থুতনির নিচে আঁটকে রাখা মাক্সটা দিয়ে দ্রুত মুখ ঢেকেছিলো সে লোকলজ্জায় ভয়ে। এভাবে পরিচিত কেউ দেখলে নিশ্চিত ঠাড্ডা করতে ভুলবে না। এমনিতেই শখের পুরুষের দেখা পাচ্ছে না সে, তার উপর বাজারের ব্যাগ! এই বুঝি মান ইজ্জত ধূলিসাৎ হয়ে গেলো তার। তাকাবে না, কেউ তাকাবে না আজ তার দিকে। প্রশ্নই উঠে না তাকানোর? ড্যাশিং, হ্যান্ডসাম, সুদর্শন যুবক যখন দেখবে দুই দুইটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে সে, কেউ কি ফিরে তাকাবে? হতাশ মনে বিড়বিড় করে তখন বলেছিলো উর্মি, ‘আমার ভবিষ্যতের জান, প্রাণ, আত্না। আমি বুড়ি হলে দেখা দিয়েন বুঝছেন। নাকি মায়ের কোল থেকে হাঁটাই শুরু করেনি কে জানে! ভাল্লাগে না। দ্রুত আসতে কি হয় অসভ্য লোকটার।’

___________________________

পশ্চিমাকাশে ঢলে পরা অস্তমিত প্রায় সূর্যটা টুকটুকে লাল রং ধারণ করেছে নীল আকাশের বুকে, যে কোনো সময় হারিয়ে যাবে দূর ওই আকাশ হতে।
পিচ ঢালা সরু রাস্তায় পশ্চিম দিকে ছুটে চলছে বাইক।
বিশাল আকাশে ধূসর রংয়ের তুলোর মতো থোকায় থোকায় ভেসে থাকা মেঘ গুলোর মাঝে তেজহীন রক্তিম সূর্যটা দেখতে অপরুপ লাগছে মীরার। এরিমধ্যে শহরের কোলাহল থেকে দুজন চলে এসেছে গ্রামের দিকে। পিচ ঢালা রাস্তার দুপাশে যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ করে বিরাণ ভূমি। অনেক ক্ষণ পর পর দুই একটা বাড়ির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। লোকালয় থেকে লোকালয় ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বাইকের উপর বসে থাকা দুজন। শিরশিরে হাওয়া ছুঁইয়ে দিচ্ছে রাইফ-মীরাকে।
মীরার নরম কোমল হাতটা রাইফের কাঁধে। এই হাতটা যখন রাইফের শক্ত পোক্ত কাঁধ ছুঁয়েছিলো, কোমল হাতের মেয়েটার কেঁপে উঠেছিলো তনুমন। কাঁধে ছোঁয়া পাওয়া পুরুষটার মন হয়ে উঠেছিলো উৎফুল্ল।

বাবার কাছ থেকে কিনে নেওয়া শখের ‘ইয়ামাহা আর ওয়ান ফাইভ’ এ চার বছর ধরে রাইড করেছে রাইফ। কিন্তু আজকের মতো অনুভূতি তার হয় নি কখনও। শখের নারীর পরশে কালো রংয়ের শখের বাইক টাকে রকেটের ন্যায় ছুটাতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু পেছনে বসা রমনী টা যে তার খুবই নাজুক, সাথে ভীষণ আদুরেও বটে। এইতো মিনিট বিশেক আগের কথা, যাত্রা শুরুর পূর্বে যখন হ্যালমেট টা মীরাকে নিজ হাতে পরিয়ে দিচ্ছিলো রাইফ, লজ্জাবতী পাতার ন্যায় নুইয়ে পরেছিলো মীরার ঘন আঁখি পল্লব। রাইফের তখন খুব করে ইচ্ছে করছিলো মীরার নুইয়ে পরা আঁখি পল্লবের উপর আধর ছোঁয়াতে, রক্তিম লাল সূর্যের ন্যায় ছোট ছোট চুম্বন এঁকে সৌন্দর্য বর্ধন করতে মীরার লাজুক মুখশ্রীতে।

🔸
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছে, চোখে মুখে সেই মুগ্ধতা স্পষ্ট দৃশ্যমাণ মীরার। দু চোখ ভরে অবলোকন করছে দু পাশের গ্রাম্য দৃশ্য, বিশুদ্ধ শ্বাস নিচ্ছে বুক ভরে। বাইক চালিয়ে মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করতে থাকা রাইফকে মৃদ্যু আওয়াজে ‘শোনেন’ বলে ডেকে উঠলো মীরা। শো শো বাতাসের শব্দ আর হ্যালমেট পরা থাকায় শুনতে পেলো না রাইফ। রাইফের কাঁধে রাখা হাত টা হালকা চাপ দিয়ে গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করে চেঁচিয়ে ডাকলো মীরা,

-‘শুনুন?’

কান খাঁড়া করলো রাইফ। তৎক্ষনাৎ অর্ধাঙ্গিনীর ডাকে সাড়া দিলো তার কন্ঠ অনুকরণ করেই,

-‘হ্যাঁ বলুন।’

-‘হ্যালমেট টা খুলি?’

-‘অসুবিধা হচ্ছে?’

-‘না। বাতাস টা পুরোপুরি নিতে ইচ্ছা করছে।’

-‘দাঁড়াবো?’

-‘না। আমি পারবো।’

মীরা পারবে বলার পরেও রাইফ বাইক থামালো। মীরার কার্য সম্পন্ন হলে যাত্রা শুরু হলো আবারও। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাইফ নিজেই ডেকে উঠলো মীরাকে,

-‘মীরা?’

-‘জ্বী।’

-‘একটা কথা।’

রাইফের সাথে থাকতে থাকতে স্বামীর বিদ্যা এ কদিনের বেশ আয়ত্ত করেছে ফেলেছে মীরা। রাইফের বিদ্যা কাজে লাগিয়ে ত্যাড়া ভাবে বলল সে,

-‘একটা কেনো? দুইটা বলুন।’

মীরার জবাবে ঠোঁট বিস্তৃত করে প্রসস্থ হাসি ফুটল রাইফের। স্ত্রী তার বেশ ভালো দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছে দেখা যাচ্ছে। ঘাড় ঘুড়িয়ে একটু দেখার চেষ্টা করল মীরাকে। শুধালো,

-‘তুমি বিয়েতে কেনো রাজি হইছিলা মীরা? এতো পাষাণ তুমি! আমার কথা একটুও ভাবলা না?’

কি ওলট পালট কথা বলছে লোকটা! নিজেই বিয়ের সমন্ধ পাঠিয়ে, বিয়ের জন্য উতলা হয়ে এখন নিজেই বলছে তার কথা নাকি ভাবে নি। মাথায় আজ উনার অবরোধ চলছে নাকি? কেমন গন্ডগোল মার্কা কথা বার্তা! হালকা চেঁচিয়ে জবাব দিলো মীরা,

-‘আপনার কথা ভেবেছি বলেই তো রাজি হয়েছি।’

-‘আরেহ বোকা মেয়ে! তোমার দাদীজান, আমার নুরজাহান ডার্লিং বেঁচে থাকা অবস্থায় যে বিয়েটা ঠিক হয়েছিলো, সেটাতে কেনো মত দিছিলা?’

মীরার বোধগম্য হলো এবার। দাদীর কথা মনে পড়ার সাথে সাথে ক্ষানিক মন খারাপও হলো। চুপ করে রইলো সে। রাইফ চেঁচিয়ে আবারও ডাকলো মীরাকে। মীরা ছোট আওয়াজে সাড়া দিতেই শুধালো রাইফ,

-‘মন খারাপ হলো বিয়ে ভেঙ্গেছিলো বলে?’

-‘না। দাদীজানের পছন্দ ছিলো তাই রাজী হয়েছিলাম।’

-‘ভাগ্যিস বিয়েটা ক্যান্সেল হইছে। তোমার যদি বিয়েটা হয়েই যেতো?’

মীরা মন ম/রা বিবশ কন্ঠে জবাব দিলো,

-‘হতো না বিয়েটা। ক্যান্সেল হতো যেভাবেই হোক। আপনার সাথেই যে আমার রিজিক জুড়ে আছে। শুধু বিয়ে ভাঙ্গার অছিলাটা দাদীজান না হলেও পারতো। আগে হোক বা পরে, আমি তো আপনার ই হতাম।’

-‘পুরোপুরি হতে আর কতো দিন লাগবে মীরা। দেড়ি তো সহে না, মনে তো মানে না।’

মীরা বললো কি আর রাইফের জবাব কি? এই লোকটার সাথে মীরা আর পারছে না। সব সময় ইনিয়ে বিনিয়ে ইঙ্গিত পূর্ণ কথা বলবেই বলবে। রাইফের কথা শুনে কান গরম হয়ে মাথা শূন্য লাগছে মীরার। কোনো রকমে একটা প্রবাদ ছুড়ে দিলো রাইফের উদ্দেশ্যে,

-‘সবুরে মেওয়া ফলে। অপেক্ষা করেন।’

-‘মেওয়ার মিঠে স্বাদ নিতে মরিয়া হয়ে আছি। আমার আশার ষোলকলার পূর্ণতা কিন্তু চাই ই চাই।’

রাইফের আবারও ইঙ্গিত দেওয়া অর্থপূর্ণ কথাতে কিছুটা লজ্জা পাওয়া মীরা কপট রাগ দেখালো। রাইফকে চুপ থাকতে বলে শাসালো ক্ষানিক।
মীরার শাসন গায়ে লাগলো না রাইফের, উল্টো হো হো করে হেসে দিলো। হাসির চোটে শরীর মৃদু দুলছে তার। মীরা রাগান্বিত স্বরে মৃদ্যু আওয়াজে ধমকে উঠলো আবারও। রাইফ লুকিং গ্লাসে তাকালো, মীরার নজরে নজর আবদ্ধ হতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মীরা। আকাশী রংয়ের মাক্সে ঢাকা মুখাবয়বে মীরার ছোট ছোট দৃশ্যমান চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে হাসছে সে। রাইফ জোর গলায় বলে উঠল,

-‘তোমার কন্ঠে আদুরে ধমক টা এতো মিষ্টি, না জানি ভালোবাসার কথায় কতো নতুন অনুভূতির সৃষ্টি। শোনো আমার লজ্জাবতী, তোমার কড়া ধমকের আড়ালে চোখে ফুটে ওঠা গোপন হাসি এই হৃদয় ছেদন করল, এই রাইফ আজ ম/রতে ম/রতেও অমর হলো।’

______________

বুড়িগঙ্গা নদের উপর সুবিশাল ব্রিজের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। আজ ভরা পূর্নিমা। সম্মুখে সুদূরে অবস্থিত পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের দা/নবীয় পাহাড়টার কোল বেয়ে আসা নদীর টলমল জল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। জোনাকিপোকা জ্ব/লছে ঝোপে ঝাড়ে, ঝি ঝি পোকার ডাকও শোনা যাচ্ছে আশে পাশে। গ্রাম্য এলাকা বলে খুব একটা আনাগোনা নেই মানুষজনের। দুই একটা গাড়ির যাতায়াত দেখা যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। ব্রিজের মাঝ বরাবর এক পাশে দাঁড়িয়ে এক জোড়া কপোত-কপোতী। সুউচ্চ ব্রিজে শীতল বাতাস মন প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে দুজন এর।
ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মীরার হালকা গা ঘেষে পেছন দিকে পাশে এসে দাঁড়ালো রাইফ। ডান বাহু দিয়ে মীরার ডান পাশের রেলিং টা ধরে ফেলল। এক দিকে রাইফের সুঠাম দেহ, অন্যদিকে বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে ঘিরে বুকের খুব নিকটে আবদ্ধ করেছে মীরাকে। এমন ভাবে আবদ্ধ করেছে যে শরীরের সাথে শরীর স্পর্শ হবে হবে ভাব আবার হচ্ছেও না। রাইফ কাছাকাছি আসতে রেলিং থেকে হাত নামালো, আড়ষ্ট থেকে আরো আড়ষ্টতর হলো মীরা। ছটফট করে উঠলো তার বক্ষ পিঞ্জর। রাইফের মুখের কাছে ওড়না দিয়ে আচ্ছাদিত মীরার মাথাটায় চুমুর পরশ এঁকে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলো না। মীরার অজান্তেই অধর ছোঁয়ালো ছোট্ট করে। দিন শেষে এতো টুকুতেই ভীষণ রকমের শান্তি অনুভব করলো সে। আরেকটু শান্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠলো পুরুষালী হৃদয়। রেলিং থেকে হাত সরিয়ে মীরার হাতের উপর হাত রাখলো, মীরার ছোট্ট দেহটাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। পুরো শরীর জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে যাওয়া মীরার বক্ষ পিঞ্জর এর অবস্থা এখন টালমাটাল। শিরা-উপশিরায় শিহরণ বয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। নিজেকে এরকম পরিস্থিতিতে সামলাবে এমন সময় দশ সেকেন্ড এর ব্যাবধানে বেপরোয়া ভাবে ক্ষিপ্র গতীতে ছুটে আসা মালবাহী ট্রাক দিক ভুল করল, উচ্চ আওয়াজে হর্ণ বাজিয়ে ধেয়ে আসলো তাদের দিকে। রাইফের দিকে সেকেন্ডের ব্যাবধানে ঘুরে দাঁড়ালো মীরা, ভয়ে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল রাইফের কোমড়। মূহুর্তেই গগণ বিদারী চিৎকার এ ভরে উঠলো রাতের আকাশ।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে