#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৮
🍁
নতুন জামাতার আগমনের খবর শুনেই ভাইয়ের বাসায় ছুটে এসেছেন সানজিদা বেগম। একমাত্র ভাতিজিকেও দেখতে তার মন আকুপাকু করছিলো সকাল থেকেই। এসেই খাদিজা বেগমের সাথে লেগে পরেছেন রান্না বান্নায়। শওকত রহমান বাজার করে এনেছেন ব্যাগ ভরে। আপাতত গরুর গোস্ত আর কাবাবের লোভনীয় সুস্বাদু ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে পুরো বাসায়।
নিজ রুমে বসে থাকা শওকত রহমান হাঁক ছুটালেন উচ্চ আওয়াজে, ডেকে উঠলেন প্রিয় সহধর্মিণীকে। খাদিজা বেগম আসলেন, ঘর্মাক্ত মুখ শাড়ির আঁচলে মুছে তাগদা দিলেন কি জন্য ডেকেছে সেটা বলতে।
শওকত রহমান পাশে বসালেন, ফোনটা হাতে নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,
-‘রাইফের আম্মাকে ফোন দিয়ে আসতে বলো। সবাই আছে, উনিও আসুক। একা একা কি করবে বাসায়।’
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ। দেন, তাড়াতাড়ি কল দেন। কথা বলছি।’
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই কল রিসিভ হলো। রাজিয়া বেগমের সহিত খাদিজা বেগম কুশলাদি বিনিময় করলেন খোশ মেজাজে। অনুরোধের সুরে বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানালেন, কিন্তু রাজিয়া বেগমের ইচ্ছা থাকা স্বতেও আসতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। হাঁটুর ব্যাথা চরম আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে তার৷ রেস্ট করছেন শুয়ে শুয়ে। না আসতে পারার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিলেন বিনীতস্বরে।
🔹
মীরার হাতের চা খাওয়ার সৌভাগ্য আর হয় নি রাইফের। হবে কি করে? নববধূ মীরাকে যে ভাবে কথার জালে জব্দ করে যাচ্ছে একের পর এক, সামনে মুখ দেখানোর মতো আর সাহস পায় নি মীরা। প্রখর জ্ঞানসম্পন্ন রাইফও জানে মীরা আর আসবে না। লজ্জাবতী লাতার ন্যায় চুপসে যাওয়া মীরার ছোট্ট কোমল হৃদয়ে যে এখন তুখোড় গতিতে ডামাডোল বাজছে তা সে খুব ভালো করেই জানে। রাইফ ফ্রেশ হয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। তার ক্লান্ত দেহ মীরার নরম বিছানা পেয়ে প্রশান্তিতে চোখ বুজে নিলো। খুব বেশি সময় লাগলো না, মূহুর্তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো রাইফ।
একটু আগে রাইফের কথার বাণে বি’দ্ধ হওয়া মীরা ঘুরঘুর করছে কিচেনে, খাদিজা বেগমের আশেপাশে। কাজ না থাকা স্বতেও একবার এটা ধরছে তো আরেকবার ওটা। ব্যাস্ত হাতে কাজ করা খাদিজা বেগমের চার পাশে ঘুরঘুর করাতে তার মাথা ঘুরছে। বিরক্তি ভরা চোখে তাকালেন তিনি, মীরাকে ধমকে উঠলেন কিঞ্চিৎ। মেয়েকে স্থির থাকতে বলে রুমে গিয়ে রাইফের কি লাগে দেখতে বললেন। মীরা তো যাবে না কিছুতেই, এমন পরিস্থিতির পর কিভাবে যাবে মীরা রাইফের সামনে? রাইফের কাছ থেকে গা ঢাকা দিতেই তো এখানে ঘুরঘুর করছে আর উনি কিনা বলে রাইফের কাছে যেতে। অসম্ভব, এখন যাওয়া মানেই আরেক বার উনার বেফাঁস কথায় কান গরম হওয়া। মীরা আমতা আমতা করল, মিনমিন করে বলল,
-‘উনার মনে হয় কিছু লাগবে না আম্মা।’
-‘লাগবে না মানে কি? চা নিয়ে যা।’
মীরা মাথা চুলকালো। ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
-‘চা খাবে না।’
-‘কি খাবে?’
-‘কিছুই খাবে না।’
-‘এসব কি ধরণের কথা বার্তা মীরা। নতুন জামাই, না দিলে খাবে কি করে। এই নে ট্রে, যা নিয়ে যা।’
মীরা যে আজ কঠিন বি’পদে পরেছে তা একদম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। রাইফ এর বলা একেকটা কথা যে তার ভেতর কম্পন সৃষ্টি করে তা তো আর কেউ জানে না। মীরার মনে হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে সে আর বেশি দিন বাঁচবে না। এমন দুরুদুরু বুকে ভয়ে ভয়ে আর কতো দিন ই বা থাকা যায় দুনিয়ায়। রাইফের হুট হাট কাজে মীরার হৃদ স্পন্দন থেমে যায় তো কখনও বেগতিক ভাবে চলে। কথাতেই এমন, কাজে কর্মে না জানি কেমন হবে এটা ভেবেই দিশেহারা সে। কঠিন শঙ্কায় মীরা, কবে জানি হার্ট এট্যাক করে বসে রাইফের এমন আচরণে। এলোমেলো চিন্তা মনের মাঝেই চাপা দিয়ে দুরুদুরু বুকে নিজ রুমে উঁকি দিলো মীরা। ওই তো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রাইফ। মীরার কপালে খানিক চিন্তার ভাঁজ পরল। এই কয় দিনে রাইফকে সন্ধ্যার পর কখনও ঘুমাতে দেখেনি সে। শরীর খারাপ করে নি তো? ট্রে টা টি টেবিলের উপর শব্দহীন ভাবে রেখেই মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠলো মীরা,
-‘শুনছেন?’
মীরার মিহি ডাকে ঘুমন্ত রাইফের ঘুম পাতলা হলো, কিন্তু জবাব দিলো না। ওভাবেই পরে রইলো বিছানায়। জড়তার সাথে কথা বলা মীরা আরেকটু এগিয়ে এলো। কন্ঠে উৎকন্ঠা মিশিয়ে ডেকে উঠল পুনরায়,
-‘এই যে শুনছেন? আপনার কি শরীর খারাপ?’
রাইফ যেনো এটার ই অপেক্ষায় ছিলো। ঘুম ভে/ঙ্গে গেলো পুরোপুরি, বালিশে গুঁজে দেওয়া মুখটায় ফুটে ওঠলো দুষ্ট বাঁকা হাসি। নড়াচড়া না করে ওভাবেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে জবাব দিলো রাইফ,
-‘হুম। ব্যাথা, বুকের বা পাশে ব্যাথা, তোমায় কাছে না পাওয়ার প্রচন্ড ব্যাথা।’
রাইফের নিচু স্বরে বলা কথার শেষ অংশ টুকু শুনতে পেলো না মীরা। যতোটুকু শুনল তাতে ব্যাথা শব্দটা শুনে ধরে নিলো রাইফের সত্যি সত্যি শরীর খারাপ। মীরা উৎকন্ঠিত হলো, ব্যাতিব্যাস্ত কন্ঠে শুধালো,
-‘কোথায় ব্যাথা? মেডিসিন দিবো? দেই একটা?’
তড়িৎগতিতে মাথা উঁচু করে তাকাল রাইফ। মুখে তার বিস্তর হাসি। কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুল গুলো এক হাতের সাহায্যে গুছিয়ে নিয়ে উঠে বসল ধীরে সুস্থে। মীরার মুখ বরাবর মুখ এনে চাপা আওয়াজে বলল,
-‘মেডিসিন লাগবে না মীরা। বুকে আসো, বিশ্বাস করো কোনো ব্যাথা থাকবে না। একটুও না। এন্টিবায়োটিক তুমি, ভিটামিন, ব্যাথানাশক সব তুমি।’
মীরার তনুমনে শিহরণ বয়ে গেলো। শীতল স্রোত বয়ে গেলো শিড়দাড়া দিয়ে। শেষের কথাতে মীরার অবশ্য হাসিও পেলো বেশ। এই লোক সভ্য হবে না কখনও। সিরিয়াস সময়েও কেমন অসিরিয়াস কথাবার্তা! হাতাশার শ্বাস ফেলে রাইফের সামনে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
-‘আপনার সাথে কথা বলাই বৃথা। সব সময় কথা উল্টান। সোজা কথা কবে বলবেন?’
রাইফের এবার পুরো মুখ জুড়ে হাসি ফুটালো। আরাম করে বসে মীরার গোলগাল মুখটায় নজর বুলিয়ে ভ্রু জোড়া কিছুটা উপরে তুলে বলল,
-‘সোজাসাপটা কথা হজম করতে পারবা তো মীরা? তাহলে বলি শোনো, তোমার ওই গোলাপি ঠোঁট টার জন্যও….
মীরা বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে, চোখ কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার জোগার। কি বলছে এসব? সর্বনাশ! পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে উপস্থিত বুদ্ধি মাথায় যা আসলো তাই করলো। হাতে থাকা চায়ের গরম কাপ টা রাইফের বকবক করে বলতে থাকা ঠোঁটে ছোঁয়ালো। রাখঢাক না রেখে বেঁফাস কথা বলা রাইফের জবান বন্ধ হলো চায়ের কাপের গরম ছ্যাঁ/কে। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল রাইফ, ঠোঁটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-‘কাপ না ছুঁইয়ে তোমার গোলাপি ঠোঁট দুটোই ছুঁইয়ে দিতা। তিল তিল করে না পু’ড়ে একেবারেই না হয় পু’ড়ে যেতাম। বুকের ব্যাথা তো কমে যেতো।’
🔹
ভাতিজি জামাই এর সাথে গল্প জুড়েছেন সানজিদা বেগম। আলাপ আলোচনায় বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন তিনি। রাইফ ও সুন্দর ভাবে একেকটার জবাব দিয়েই যাচ্ছে। উর্মি হুটহাট আসে, আবার হুটহাট চলে যায়। এই তো একটু আগে এসে যখন রাইফ আর সানজিদা বেগমের আলাপচারিতায় বাগরা দিয়ে তার বিয়ের কথা বলে আফসোস করতে থাকল, সানজিদা বেগম নিজের জেগে ওটা রাগ কোনো রকমে চেপে গেছেন সামনে বসে থাকা রাইফের জন্য। রাইফ না থাকলে এই মেয়েকে আজ উনি কিছু একটা করতেন ই করতেন। এতো ধিঙ্গিপণা মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব বিপাকে পরেন আজকাল। এবার মনে হচ্ছে নিজের মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে হবে অচিরেই। তবু যদি একটু শুধরানো যায়।
_____________
সবাই নৈশভোজ সেরেছে কিছুক্ষণ হলো। রাইফ তখনি জানিয়ে দিয়েছে সে আজ থাকতে পারবে না। শওকত রহমান এবং খাদিজা বেগম অনেক জোরাজুরি করেছেন, কিন্তু রাইফ অনুরোধ করেছে না থাকার জন্য। অন্য দিন অবশ্যই থাকবে। মীরার মনটা পরিবার কে পেয়ে প্রফুল্ল হয়েছে। রাইফ থাকলে মেয়েটার একটু হলেও অস্বস্তি হবে। থাকুক সে, পরিবারের সাথে একান্ত সময় কাটাক। তার উপর মায়ের অসুস্থতার কারণেও বাসায় যেতে ইচ্ছুক সে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাইফ, চলে যাবে এখনি। উর্মিকে দিয়ে মীরাকে ডেকে পাঠিয়েছে কয়েক বার। আহম্মকি কাজ করায় মীরার খুব সংকোচ হচ্ছে রাইফের সামনে আসতে। কেনো যে তখন কাপ টা রাইফের ঠোঁটে লাগালো। ছিহ্, নিজের উপর ই তার বিরক্ত লাগছে তখন থেকে। ছোট ছোট কদমে জড়সড় হয়ে রাইফের সামনে এসে দাঁড়ালো মীরা। এই লোকটার সামনে আসতে তার অন্তর কাঁপে, ভীত নড়বড়ে হয়। আলোছায়ায় ঘেরা বারান্দায় রাইফ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে দেখছে মীরাকে। মীরা পিটাপিট করে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক। ঘন পাপড়ির ওঠানামা রাইফের হৃদয়ে ব্যাকুলতা সৃষ্টি করছে। ডাগর ডাগর চাওনি দেওয়া চোখটাতে আলতো করে অধর ছোঁয়ার তীব্র বাসনা চেপে বসেছে মনের মধ্যিখানে। মীরার একটা হাত টা টেনে নিলো রাইফ, দুহাতের মুঠোয় চেপে গাঢ় স্বরে বলল,
-‘ধীরে ধীরে সংকোচ দূর করো মীরা। তোমাকে মা ডাক শোনানোর তীব্র বাসনা জেগেছে আমার মনে।
ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তোমার এই ছোট্ট দেহ টাকে বুকে আগলে নিতে দিনকে দিন সত্যি বেহায়া হচ্ছে আমার মন।’
চলবে………
#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৯
🍁
রাতের আঁধার দূরীভূত করে ধরণীর বুকে সবেমাত্র সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পরতে শুরু করেছে। এতো সকালেই রাজিয়া বেগমের পুরো কিচেন খাবারের ঝাঁঝালো ঘ্রাণে ভরে গেছে। দুই চুলায় ঝমঝম আওয়াজ তুলে পুরোদস্তুর রান্না করছে মীরা। পাশেই উঁচু মোড়ায় বসে আছেন রাজিয়া বেগম।
ফজরের সালাত আদায় করেই মীরা চলে এসেছিলো পাঁচ তলায়। শাশুড়ীর অসুস্থতার খবর শুনে গতরাতেই একবার দেখতে আসতে চেয়েছিলো মীরা, কিন্তু রাইফের বারণে আসতে পারেনি। ভোরেই ঘুম থেকে উঠে ফজরের সালাত আদায় করেই সোজা উপরে চলে এসেছে সে।
মীরার কঠোর বারণ রাজিয়া বেগমের প্রতি। কোনো ভাবেই যেনো উনি রান্না-বান্নার কাজে হাত না লাগায়। রাজিয়া বেগম বেশ কয়েক বার বাঁধা দিয়েছেন মীরা যেনো রান্না না করে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। গতরাতে রাইফ চলে আসার সময় রাজিয়া বেগমের জন্য খাবার প্যাক করে পাঠিয়েছিলেন মীরার মা। সেই খাবার থেকে অল্প একটু খেয়েছেন তিনি৷ সেটা দিয়েই চালাতে চেয়েছিলেন আজকের সকালের খাওয়া-দাওয়া পর্ব। সেই সকাল থেকে বলেই যাচ্ছে মীরা যেনো খাবার রান্না না করে, কিন্তু মীরা মানতে নারাজ। শাশুড়ীর কি খেতে ইচ্ছা করছে তা পেট থেকে বের করেই ছেড়েছে। বিয়ের দিন থেকে গোস্ত, পোলাও, কোরমা খেতে খেতে মুখের রুচি কমে গেছে রাজিয়া বেগমের। তাই মীরাকে বলেছে অল্প কিছু ভর্তা করার জন্য।
মীরা আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা, তিল ভর্তা শেষে এখন ইলিশ মাছ ভাজছে আর অন্য চুলায় ওদের বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার টুকু গরম করছে। মীরা ফল কে/টে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে শাশুড়ী আম্মাকে এবং একটু পর পর ই তাগদা দিচ্ছে খাওয়ার জন্য। রাজিয়া বেগম এক টুকরো খাচ্ছেন তো দুই টুকরো মীরার মুখেই তুলে দিচ্ছেন। মীরা না করলেও শুনছেন না তিনি। শাশুড়ী-পুত্রবধু যেনো একে অপরকে খাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে আজ সাত-সকালে।
______________
মীরা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। বদ্ধ রুমের দরজা খানিক খুলে উঁকি দিলো রুমে। রাইফ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শব্দ বিহীন পায়ে রুমে প্রবেশ করল সে। ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাইফের পাশেই বসে আধোশোয়া হয়ে হেলান দিলো বিছানায়। মোবাইলে চোখ বুলাল, সময় সাতটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ডেকে তোলা প্রয়োজন রাইফকে। অফিসের সময় হয়ে এলো, কিন্তু মীরার ডাকতে ইচ্ছা করছে না একটুও। কি সুন্দর ভাবে ঘুমাচ্ছে রাইফ, শ্যমবর্ণের মুখটায় মায়া ছড়িয়ে পরেছে সর্বত্র। লাজুক মীরার খুব করে ইচ্ছা করছে রাইফের এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে, আংগুলের সাহায্যে অগোছালো চুল গুলোকে আরেকটু এলোমেলো করতে।
গত তিনদিনেই মীরার অভ্যাস টাও কেমন পালটে গেছে হুট করে। রাইফের আংগুলে আংগুল রেখে রাত্রিযাপন করা মীরার গতরাতের ঘুমে বার বার খুঁজছিলো রাইফের শক্তপোক্ত হাতটা। লোকটা ভালো, ভীষণ রকমের ভালো। কিন্তু মীরার অস্বস্তি ওই এক যায়গাতেই। হুটহাট কথা বলে লজ্জায় ফেলে দেয় সুযোগ পেলেই।
সময় পেরোলো মিনিট দশেক। মীরার মনে রাইফকে ঘিরে হাজারও ভাবনা প্রজাপতির ন্যায় ডানা ঝাপ্টাচ্ছে এমন সময় পাশে রাখা মুঠোফোনটায় কর্কশভাবে বেজে উঠলো এলার্ম ধ্বনি। মীরা বতিব্যাস্ত হলো এলার্ম অফ করার জন্য। বালিশের পাশে পরে থাকা মুঠোফোনটায় হাত দিতেই রাইফের হাতটাও মীরার হাতের উপর স্পর্শ করল। আচানাক কারো হাতের সংস্পর্শে রাইফ ভ্রু কুঁচকালো এবং সেকেন্ড পাঁচেক পার হতেই কুঁচকানো ভ্রু সোজা হলো। বদ্ধ চোখের মুখটাতে ফুটে উঠল মুচকি হাসি। শক্ত করে আবদ্ধ করে নিলো মীরার হাত। উপুর হয়ে শুয়ে থাকা রাইফ পাশ ফিরলো মীরার দিকে। চোখ খুলল, সকাল বেলায় অপ্রত্যাশিত ভাবে কাঙ্ক্ষিত নারীর মুখটা দেখে প্রশান্তি ছেয়ে গেলো তার হৃদয় জুড়ে। মীরা রাইফের চাওনিতে ফেরত দিলো মুচকি হাসি। টিকটিক করে বেজে যাওয়া এলার্ম টা অফ করার জন্য হাত ছেড়ে নিতে চাইল মীরা। রাইফ বাঁধা দিলো,হাত ছাড়ল না। উপায়ন্তর না পেয়ে মীরা বা হাতের সাহায্যে এলার্ম অফ করে চাইল রাইফের পানে। সাধারণত স্বাভাবিক সময়ে মীরা নিঃসংকোচে তাকায় রাইফের পানে, চোখে চোখ রেখে কথা বলে কোনো অস্বস্তি বিহীন। কিন্তু রাইফের কিছু দৃষ্টি আছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, গভীর থেকে গভীরতর দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে শুধুই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। সেই গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতেই মীরা নজর রাখতে পারে না। দৃষ্টি রাখবে কি করে? রাইফের এই দৃষ্টিতে যে এক আকাশ সম প্রেম স্পষ্ট দেখতে পায় মীরা, অনুভব করে শিরা উপশিরায়।
রাইফ ইশারা দিলো মীরাকে পাশে পুরোপুরি ভাবে শোয়ার জন্য। কিন্তু মীরা ইশারার সঙ্গ দিলো না। বুঝেও না বোঝার ভান ধরল তৎক্ষনাৎ। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নাত্মক ইশারায় জিজ্ঞাসা করল “কি?”
রাইফ আবারও ইশারায় বলল শুয়ে পরার জন্য। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হলো না তার। মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যাওয়া মীরা আবারও না বোঝার ভান ধরল, আবারও ইশারায় বোঝালো রাইফের ইশারা বোঝেনি সে। প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন রাইফ ধরে ফেলল মীরার চালাকি। রাইফ পুনরায় ইশারা দিলো মীরাকে যার অর্থ “আমার ইশারা কি বোঝো নি?”
মীরা ইশারাতেই বলল বোঝে নি সে। রাইফ বিস্তৃত হাসল। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসছে মীরাও। লাজুকলতার মিঠে মুচকি হাসি রাইফের মন শীতল করে তুলল। এই মেয়েটা জানেই না হাসলে কতো সুন্দর লাগে তাকে। রাইফের সঙ্গ পেয়ে মীরাও যে দুষ্টুমি আয়ত্ত করে ফেলছে সেটাও ধরে ফেলল সে।
এ পর্যায়ে এসে শেষ টোপ টা ফেলতে চায় রাইফ। ওস্তাদের সাথে পাঙ্গা নিয়েছে, খেল তো জমাতেই হবে। কেননা না, লাটাই তো তার ই হাতে। আংগুলে আংগুল রাখা মীরার হাতটা আরো শক্ত করে ধরল। ধারালো চোখে তীক্ষ্ণ এক ইশারা দিলো যার অর্থ এবার পাল্টে গেছে। এবার আর পাশে শুতে বলে নি রাইফ, এবার সোজা তার বুকে মাথা রাখতে বলেছে মীরাকে। এবং পরক্ষণেই এটাও ইশারা করেছে, এর ব্যত্যয় ঘটলে তার মুঠোয় আবদ্ধ হওয়া হাতটা টেনে কাছে টানবে মীরাকে।
রাইফের শেষ ইশারায় মীরার হাসিহাসি মুখটা থেকে ফুরুৎ করে উড়ে গেলো মুচকি হাসিটুকু। কিছুটা লজ্জায় গোমড়া হলো চেহারা। রাইফের বুকে যাওয়ার ভয়ে ফটাফট আগের ইশারা মতো শুয়ে পরল দ্রুত। এই লোকের এক বিন্দুও গ্যারান্টি নায়। কখন যে হেঁচকা টানে কাছে নিবে বলা যায় না। মীরার এমন আচরণে রাইফের পেট ফেটে হাসি পেলো, এতোক্ষণের চেপে চেপে মুচকি হাসি শব্দ হয়ে বেরিয়ে এলো। রাইফের খলখল হাসির শব্দে ভরে গেলো পুরো রুম। মীরার কিঞ্চিৎ রাগ হলো। এভাবে হাসার কি আছে? আজ তাকে আলাভোলা পেয়ে এভাবে হাসছে তো, সেও একদিন দেখে নিবে। হুহ!
বদ্ধ রুমে রাইফের হাসি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। মীরা ধ্যান দিলো রাইফের হাস্যজ্বল মুখাবয়বে। শ্যাম সুন্দর পুরুষটার এমন হাসি দেখেনি সে আগে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সঙ্গ দিলো রাইফের, শেষ পর্যন্ত হেসে উঠল মীরা নিজেও।
রাইফের হাসি থামল, এগিয়ে এলো মীরার দিকে। চিত হয়ে শুয়ে থাকা মীরার মুখ থেকে হাসি উবে গেলো রাইফের হঠাৎ কাছে আসাতে। পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের সোনালী ঝলমলে রোদ্দুর্র মীরার মুখে পরেছে তীর্যক ভাবে। মীরার ফর্সা মুখে লেপ্টে যাওয়া সোনালী আভা এ মূহুর্তে যে কারো বক্ষ পিঞ্জরে মুগ্ধতা ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট। রাইফের হাসি হাসি মুখটা ধীরে ধীরে গম্ভীর হলো। হালকা করে মাথায় পেঁচানো ওড়না টার ফাঁক দিয়ে কিছু চুল পরে আছে মীরার গোলাপী আভা যুক্ত গালে। শান্ত স্থির মুখাবয়বে রাইফ মীরার মুখে সম্পুর্ন দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাকিয়ে আছে উপুড় হয়ে বুকে ভর দিয়ে। মীরার একটা হাত এখনও মুঠোয় তার। অন্য হাতে গালে পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিলো আলতো করে। নরম গালে রাইফের হাতের স্পর্শ পেয়ে মীরা হৃদয় থমকে গেলো, চোখ বুঝে গেলো সয়ংক্রিয় ভাবে। মীরা অশান্ত মন বলছে রাইফ আজ কিছু করবেই করবে। আচ্ছা এতো যে ধ্যান মে/রে তাকিয়ে আছে তার মুখে, সেই মুখটাতেই অধিকার ফলাবে না তো! অধিকার ফলালে ফলাবে, এতে মীরার আপত্তি নেয় একটুও। রাইফ তার স্বামী, সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে মীরার প্রতি। রাইফকে বাঁধা দেওয়া অনুচিত তবুও নতুন জন্ম নেওয়া গোলমালে অনুভূতি গুলোই বার বার মীরাকে আরষ্ঠ করে তুলছে। রাইফ মীরার ছোট গোলগাল মুখটায় হাত রাখল। নরম গাল টা ঘষে দিলো আলতো করে। মীরার নিশ্বাস ক্রমশ ভারী হতে থাকলো রাইফের স্পর্শে, চোখ বুজেই বিছানায় পরে রইলো শক্ত হয়ে। বালিশের উপর মীরার মুঠোবন্দী হাতটা টেনে তুলল রাইফ। মেহেদীর রঙ এখনও শোভা পাচ্ছে মীরার হাতে। মেহেদীর গাঁঢ় খয়েরী রংটা একদিনে এখন হালকা লালে পরিণত হয়েছে। মীরার হাতের উল্টো পাশটায় রাইফ খুব যত্ন করে বৃদ্ধাংগুল ঘষলো বার কয়েক। মীরার বদ্ধ চোখে আরেকবার নজর বুলাল। ছোট একটা ঢোক গিলে মুঠোয় রাখা মীরার হাতের উলটো পাশে অধর ছোঁয়ালো ছোট্ট করে। মীরার অন্তরাত্মা ধরাম করে উঠল, বদ্ধ নয়ন কুঁচকে আরো ভেতরে গেলো। হৃদ স্পন্দন এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গিয়ে বেগতিক হাড়ে ছুটতে শুরু করলো। রাইফের অধরের ছোঁয়ায় মুঠোয় পরে থাকা হাতটা দিয়ে রাইফের হাত শক্ত করে চেপে ধরল মীরা। রাইফের মন অশান্ত হলো। এতো ছোট চুম্বনে মনটা কিছুতেই শান্ত করা সম্ভব না, কিছুতেই না। বুকের ভেতর যে ঝড় উঠেছে সেটা থামানো প্রয়োজন, খুবই প্রয়োজন। বেশি সময় নিলো না, সাত-পাঁচ ভাবার সময় নেই তার এখন। সম্মুখে ধরে রাখা হাত টাতে পুনরায় অধর ছোঁয়ালো। এক বার, দু বার, তিন বার এবং পর পর অনেক বার৷ অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তুলল মীরার মেহেদী রাঙা হাত। কখন বা স্বশব্দে কখনও বা শব্দ বিহীন।
চলবে……..